মুমিতের বয়স তিন পেরিয়েছে। তিন বয়স অতিক্রম করবার পরে ওর নতুন উপসর্গ দেখা দিয়েছে। প্রতিরাতে ওকে গল্প শোনাতে হয়। গল্প না শুনলে ওর ঘুম আসেনা। যদি ঘুমিয়েও পড়ে তবে মাঝরাতে ঠিক জেগে উঠবে। তারপর গল্প শুনবে। গল্প শুনতে শুনতে ঘুমাবে। আর এই গল্প শোনাতে হবে আমাকে। অন্য কেউ গল্প শোনালে হবেনা। প্রতিরাতে আর কত নতুন নতুন গল্প বলা যায়!! তাই এক গল্পের মাথা আর অন্য গল্পের লেজ একসাথে মিক্সিং করে গল্প বানাতে হয়। বানানো গল্প বলতে হয়। মাঝে মাঝে ওর মত করে গল্পের পথ চলতে হয়।
গতকাল ঘরে ফিরেছি দেরী করে। ফিরে দেখি মুমিত ঘুমিয়ে গিয়েছে। কিন্তু ঠিক রাত ২:৩০ টায় জেগে উঠেছে। তারপর বাপ আর বেটার কথোপকথন:
মুমিত: বাবা…এ্যাই বাবা…বাবাই..
বাবা: কি হয়েছে বাবাই!
মুমিত: অন্ধকার আমি ভয় পাই। আলো জ্বালাও।
বাবা: ঠিক আছে বাবা। আলো জ্বালিয়ে দিচ্ছি। (আমি আলো জ্বালিয়ে দেখলাম মুমিতের মুখে ঘুম ভাঙা হাসি। দেব শিশুর হাসি কি এর চেয়ে সুন্দর হয়!! আমার জানা নেই।)
মুমিত: তুমি কখন এসেছো! আমি আজ গল্প শুনি নাই।
বাবা: আমি যখন এসেছি তখন তুমি ঘুমিয়ে ছিলে বাবাই। কেন গল্প শুনো নাই!
মুমিত: তুমি আসো নাই। তুমি গল্প বল নাই। এখন বল।
বাবা: এক ছিল একটা জঙ্গল। বড় জঙ্গল।
মুমিত: বড় বড় গাছ। অন্ধকার অন্ধকার?
বাবা: হুম। সেই জঙ্গলের দুই পাশে ছিল দুইটা নদী।
মুমিত: দুইটা না বাবা। একটা নদী।
বাবা: কিন্তু বাবাই, গল্পের জন্য যে দুইটা নদী দরকার!
মুমিত: তবে একটা সমুদ্দ। কক্সবাজার।
বাবা: ঠিক আছে। একটা সমুদ্র। জঙ্গলের একপাশে একটা নদী আর অন্য পাশে একটা সমুদ্র। সেই জঙ্গলে থাক’তো একটা ইয়া ব্বড়..
মুমিত: হাতি।
বাবা: সেই হাতিটার ছিল দুটো চকচকে সাদা সাদা..
মুমিত: দাঁত।
বাবা: চারটা মোটা মোটা কান।
মুমিত: পা। আর একটা লম্বা শূড়।
বাবা: বড় দুটো কান আর ছোট্ট …
মুমিত: একটা লেজ আর ছোট ছোট দুটো চোখ।
বাবা: সেই হাতিটা নদীতে হাপুস করত। নদীর পাশেই থাকত। একা একা ঘুরে বেড়াত।
মুমিত: ও।
বাবা: সেই জঙ্গলের অন্যপাশে ছিলো একটা নদী।
মুমিত: না..না.. নদী না’তো। সমুদ্দ। বড় বড় ঢেউ। সাদা সাদা ঢেউ। কক্সবাজার।
বাবা: আচ্ছা অন্যপাশে সমুদ্র। সেখানে থাকতো একটা জলহস্তী।
মুমিত: জলহস্তী থাকতো না। গন্ডার থাকতো। মোটা মোটা পাঁ। নাকের উপর একটা শিং। লম্বা শিং। ঐ যে আমার বইতে দেখেছোনা। ঐ রকম একটা গন্ডার।
বাবা: আচ্ছা একটা গন্ডার থাকতো। সেই জঙ্গলের মাঝে থাকতো একটা খরগোশ।
মুমিত: আমি জানি খরগোশকে ইংরেজীতে রেবিট বলে। খরগোশের অনেক বুদ্ধি। বাঁধাকপি আর মটরশুটি খায়।
বাবা: হ্যাঁ। কিন্তু খরগোশটা ছোট বলে হাতি আর গন্ডার ওকে খুব বকতো। কাজ করতে বলতো।
মুমিত: কি কাজ করতে বলতো?
বাবা: হাতিটা বলতো এ্যাই খরগোশ আমি হাপুস করেছি আমার শরীরটা মুছিয়ে দাও। এ্যাই খরগোশ খেলা রেখে আমার পা’ চারটা পরিষ্কার করে দাও। এ্যাই খরগোশ পড়া বাদ দিয়ে আমার কানটা একটু চুলকে দাও। খরগোশ ছোট। তাই হাতির কথা তাকে শুনতে হয়। কিন্তু খরগোশের মন খুব খারাপ থাকে।
মুমিত: খরগোশটার খুব কষ্ট হয়!! আর গন্ডারটা কি বলে বাবাই?
বাবা: গন্ডারটাও খরগোশকে শুধু কাজ করতে বলে। বলে আমার মোটা চামড়াটা একটু চুলকে দাও। আমার শিংটাতে একটু তেল মালিশ করে দাও। আমাকে একটু বাতাস কর।
মুমিত: খরগোশটা কিছু বলে না কেন বাবাই? খরগোশটা রেগে যায় না!!
বাবা: খরগোশটা রেগে যায়। কিন্তু মনে মনে। কারন হাতিটাও বড়। আর গন্ডারটাও বড়। খরগোশ তাই মনে মনে ভাবে কি করা যায়!! একটা বুদ্ধি খুঁজছে। হাতি আর গন্ডারকে কিভাবে শাস্তি দেয়া যায় শুধু এটাই ভাবছে।
মুমিত: তারপর কি করলো!
বাবা: ভাবতে ভাবতে একটা উপায় বের করলো। তারপর খরগোশ গাছের লতা দিয়ে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে একটা লম্বা দড়ি বানালো। দড়িটা বানিয়ে সে গেল হাতির কাছে। হাতিকে বললো “বস্! যদি বেয়াদবি না নেন তবে একটা কথা বলি!” হাতি বললো “বলো, পিচ্চি খরগোশ।” খরগোশ বললো, “বস্, আপনি কি আমার সাথে দড়ি টানাটানি খেলায় পারবেন?”
মুমিত: হাতি কি বললো বাবাই?
বাবা: হাতি হাসতে হাসতে বললো “এসো খেলেই দেখি। এমন একটা টান দিবো যে তুমি পুরো টুকরোই হয়ে যাবে। হা: হা: হা:” তখন খরগোশ দড়িটার একটা মাথা হাতির পায়ে বেঁধে দিল। তারপর বললো “বস্ ! আমি যখন তিনবার দড়িতে টান দিবো তখন আপনি বুঝবেন দড়ি টানাটানি খেলার সময় হয়েছে।” বলেই খরগোশ দিলো দৌড়।
মুমিত: খোরগোশ দৌড়ে কোথায় গেল?
বাবা: খরগোশ গেল গন্ডারের কাছে। গিয়ে বললো, “ওস্তাদজি, আপনি কি আমার সাথে দড়ি খেলায় পাড়বেন?” গন্ডার বললো, “পুঁচকে খরগোশ!! আমার সাথে দড়ি খেলার শখ!! এমন মজা দেখাবো যে বুঝবে টানাটানি কাকে বলে। “খরগোশ বললো, “হুজুর মাফ করবেন। একবার খেলেই দেখি।” তারপর খরগোশ দড়িটার একটা মাথা গন্ডারের পায়ে বেঁধে দিল। তারপর বললো “হুজুর, আমি যখন তিনবার দড়িতে টান দিবো তখন আপনি বুঝবেন যে দড়ি টানাটানি খেলার সময় হয়েছে।”
মুমিত: খরগোশ কি করলো বাবাই! দড়ি খেলতে গেলে তো খরগোশ কষ্ট পাবে।
বাবা: খরগোশ’তো দড়ি নিজের পায়ে বাঁধেই নাই। একটা মাথা বেঁধেছে হাতির পায়ে। আর একটা মাথা বেঁধেছে গন্ডারের পায়ে।
মুমিত: হি:…. হি:….. হি:…..হি:…
বাবা: চালাক খরগোশ জঙ্গলের মাঝে বসে দড়িতে দিল তিন টান। ব্যাস হাতি দড়ি টানছে। ভাবছে খরগোশকে একটানে পায়ের কাছে এনে ফেলবে। কিন্তু খরগোশকে টেনে আনতেই পারছেনা। হাতি ভাবছে খরগোশ এত ভারী হল কেমন করে।
মুমিত: আর গন্ডার কি করছে?
বাবা: গন্ডারও দড়ি টানছে। আর ভাবছে এত্তটুকুন খরগোশ এত্ত ভারী হল কেমন করে!! আসলে’তো একদিক থেকে টানছে হাতি। হাতি গন্ডারকে দেখতে পাচ্ছেনা। আবার অন্যদিন থেকে টানছে গন্ডার। গন্ডারটা হাতিকে দেখতে পাচ্ছেনা। শুধু জঙ্গলের মাঝখানে বসে খরগোশ মজা করে দু’জনের দড়ি টানাটানি দেখছে। আর হাসছে। হাসছে আর দেখছে। হাতি টানতে টানতে গন্ডারকে একটু টেনে আনে। গন্ডারও আবার হাতিকে টানতে টানতে অন্যদিকে এনে ফেলে।
মুমিত: আর চালাক খরগোশ কি করে?
বাবা: খরগোশ তখন হাসতে হাসতে মাঝখান থেকে দড়িটাকে দিল ক্যাঁচ করে কেটে। দড়ি কাটার সাথে সাথে হাতিটা ধপাস করে নদীতে উল্টে পরল আর গন্ডার পরল সমুদ্রে। হাতি আর গন্ডারের পা দড়ি টানাটানি করতে করতে কেটে গিয়েছিল। পানিতে ওদের পা জ্বলতে শুরু করল।
খরগোশ হাসতে হাসতে হাতির কাছে গেল। হাতি বললো, “লিটিল বস্, সরি। আমার ভুল হয়ে গেছে। তোমাকে আর আমার কোন কাজ করতে হবেনা।” তখন খরগোশ দৌড়ে গেল গন্ডারের কাছে। গন্ডার খরগোশকে দেখতে পেয়েই বললো,” ছোট হুজুর আপনার গায়ে দেখি হাতির মত জোড়। এত শক্তি আপনার ছোট শরীরে। এতদিন যা করেছি তার জন্য মাফ করে দিন। আপনাকে আর আমার কোন কাজ করতে হবেনা।”
মুমিত: তারপর ছোট্ট খরগোশ কি করলো?
বাবা: ছোট্ট খরগোশ তারপর মন ভরে খেললো। পড়তে বসলো। আর মনে মনে বললো বুদ্ধির জোড় সবচাইতে বড় জোড়।
মুমিত: দেখো আমার বুদ্ধি হয়েছে। (বলেই সে হাতের দুটো আঙ্গুল ফুটালো)। আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দাও।
আমি ওর পিঠে হাত বুলাতে শুরু করলাম। কারন ও আমার বুকে উপর হয়ে শুয়ে আছে। এই উপুর হয়ে শোয়াকে ও বলে ” আমি আল্লাদ (আহলাদ) করে ঘুমাবো।”