শ্যামপুর গ্রামে সেদিন নন্দোৎসব।
শ্যামপুরের পাশের গ্রামে আমার মাতুলালয়। চৌধুরী-বাড়ির উৎসবে আমার মামার বাড়ির সকলের সঙ্গে আমারও নিমন্ত্রণ ছিল—সুতরাং সেখানে গেলাম।
গ্রামের ভদ্রলোকেরা একটা শতরঞ্জি পেতে বৈঠকখানায় বসে আসর জমিয়েচেন। আমার বড় মামা বিদেশে থাকেন, সম্প্রতি ছুটি নিয়ে দেশে এসেচেন—সবাই মিলে তাঁকে অভ্যর্থনা করলে।
—এই যে আশুবাবু, সব ভালো তো? নমস্কার!
—নমস্কার। একরকম চলে যাচ্ছে—আপনাদের সব ভালো?
—ভালো আর কই? জ্বরজাড়ি সব। ম্যালেরিয়ার সময় এখন, বুঝতেই পারচেন।
—আপনার সঙ্গে এটি কে?
—আমার ভাগ্নে, সুশীল। আজই এসেচে—নিয়ে এলাম তাই।
—বেশ করেচেন, বেশ করেচেন, আনবেনই তো। কি করেন বাবাজি?
এখানে আমি মামাকে চোখ টিপবার সুবিধে না পেয়ে তাঁর কনিষ্ঠাঙ্গুলি টিপে দিলাম।
মামা বললেন—আপিসে চাকরি করে—কলকাতায়।
—বেশ, বেশ। এসো বাবাজি, বসো এসে এদিকে।
মামার আঙুল টিপবার কারণটা বলি। আমি কলকাতার বিখ্যাত প্রাইভেট-ডিটেকটিভ নিবারণ সোমের অধীনে শিক্ষানবিশি করি। কথাটা প্রকাশ করবার ইচ্ছা ছিল না আমার।
নন্দোৎসব এবং আনুষঙ্গিক ভোজনপর্ব শেষ হলো। আমরা বিদায় নেবার যোগাড় করচি, এমন সময় গ্রামের জনৈক প্রৌঢ় ভদ্রলোক আমার মামাকে ডেকে বললেন—কাল আপনাদের পুকুরে মাছ ধরতে যাবার ইচ্ছে আছে। সুবিধে হবে কি?
—বিলক্ষণ! খুব সুবিধে হবে! আসুন না গাঙ্গুলিমশায়, আমার ওখানেই তাহলে দুপুরে আহারাদি করবেন কিন্তু।
—না না, তা আবার কেন? আপনার পুকুরে মাছ ধরতে দিচ্চেন এই কত, আবার খেয়ে বিব্রত করতে যাবো কেন?
—তাহলে মাছ ধরাও হবে না বলে দিচ্চি। মাছ ধরতে যাবেন কেবল ওই এক শর্তে।
গাঙ্গুলিমশায় হেসে রাজী হয়ে গেলেন।
পরদিন সকালের দিকে হরিশ গাঙ্গুলিমশায় মামার বাড়িতে এলেন। পল্লীগ্রামের পাকা ঘুঘু মাছ-ধরায়, সঙ্গে ছ’গাছা ছোট-বড় ছিপ, দু’খানা হুইল লাগানো—বাকি সব বিনা হুইলের, টিনে ময়দার চার, কেঁচো, পিঁপড়ের ডিম, তামাক খাওয়ার সরঞ্জাম, আরও কত কি।
মামাকে হেসে বললেন—এলাম বড়বাবু, আপনাকে বিরক্ত করতে। একটা লোক দিয়ে গোটাকতক কঞ্চি কাটিয়ে যদি দেন—কেঁচোর চার লাগাতে হবে।
মামা জিজ্ঞেস করলেন—এখন বসবেন, না, ওবেলা?
—না, এবেলা বসা হবে না। মাছ চারে লাগতে দু’ঘন্টা দেরি হবে। ততক্ষণ খাওয়া দাওয়া সেরে নেওয়া যায়। একটু সকাল-সকাল যদি আহারের ব্যবস্থা . . .
—হ্যাঁ হ্যাঁ, সব হয়ে গেছে। আমিও জানি, আপনি এসেই খেতে বসবার জন্যে তাগাদা দেবেন। মাছ যারা ধরে, তাদের কাছে খাওয়া-টাওয়া কিছুই নয় খুব জানি। আর ঘন্টা খানেক পরেই জায়গা করে দেবো খাওয়ার।
যথাসময়ে হরিশ গাঙ্গুলি খেতে বসলেন এবং একা প্রায় তিনজনের উপযুক্ত খাদ্য উদরসাৎ করলেন।
আমি কলকাতার ছেলে, দেখে তো অবাক!
আমার মামা জিজ্ঞেস করলেন—গাঙ্গুলিমশায়, আর একটু পায়েস?
—তা একটুখানি না হয় . . . ওসব তো খেতে পাইনে! একা হাত পুড়িয়ে রেঁধে খাই। বাড়িতে মেয়েমানুষ নেই, বৌমারা থাকেন বিদেশে আমার ছেলের কাছে। কে ওসব করে দেবে?
—গাঙ্গুলিমশায় কি একাই থাকেন?
—একাই থাকি বইকি। ছেলেরা কলকাতায় চাকরি করে, আমার শহরে থাকা পোষায় না। তাছাড়া কিছু নগদী লেন-দেনের কারবারও করি, প্রায় তিন হাজার টাকার ওপর। টাকায় দু’আনা মাসে সুদ। আপনার কাছে আর লুকিয়ে কি করবো? কাজেই বাড়ি না থাকলে চলে কই? লোকে প্রায়ই আসচে টাকা দিতে-নিতে।
গাঙ্গুলিমশায় এই কথাগুলো যেন বেশ একটু গর্বের সঙ্গে বললেন।
আমি পল্লীগ্রাম সম্বন্ধে তত অভিজ্ঞ না হলেও আমার মনে কেমন একটা অস্বস্তির ভাব দেখা দিলে। টাকা-কড়ির কথা এ-ভাবে লোকজনের কাছে বলে লাভ কি! বলা নিরাপদও নয়—শোভনতা ও রুচির কথা যদি বাদই দিই।
গাঙ্গুলিমশায়কে আমার বেশ লাগলো।
মাছ ধরতে-ধরতে আমার সঙ্গে তিনি অনেক গল্প করলেন।
. . . থাকেন তিনি খুব সামান্য ভাবে—কোনো আড়ম্বর নেই—খাওয়া-দাওয়া বিষয়েই কোনো ঝঞ্ঝাট নেই তাঁর। . . . এই ধরনের অনেক কথাই হলো।
মাছ তিনি ধরলেন বড়-বড় দুটো। ছোট গোটা-চার-পাঁচ। আমার মামাকে অর্ধেকগুলি দিতে চাইলেন, মামা নিতে চাইলেন না। বললেন—কেন গাঙ্গুলিমশায়? পুকুরে মাছ ধরতে এসেছেন, তার খাজনা নাকি?
গাঙ্গুলিমশায় জিব কেটে বললেন—আরে রামো! তাই বলে কি বলচি? রাখুন অন্তত গোটা-দুই!
—না গাঙ্গুলিমশায়, মাপ করবেন, তা নিতে পারবো না। ও নেওয়ার নিয়ম নেই আমাদের।
অগত্যা গাঙ্গুলিমশায় চলে গেলেন। আমায় বলে গেলেন—তুমি বাবাজী একদিন আমার ওখানে যেও একটা ছুটিতে। তোমার সঙ্গে আলাপ করে বড় আনন্দ হলো আজ।
কে জানতো যে তাঁর বাড়িতে আমাকে অল্পদিনের মধ্যেই যেতে হবে; তবে সম্পূর্ণ অন্য কারণে—অন্য উদ্দেশ্যে।
গাঙ্গুলিমশায়ের সঙ্গে খোশগল্প করার জন্যে নয়!
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।