সেও এক কৃষ্ণপক্ষের গভীর অন্ধকার রাত্রি। মাঝে-মাঝে বৃষ্টি পড়চে আবার থেমে যাচ্চে, অথচ গুমট কাটেনি। আমার ঘরটার উত্তরদিকে একটা মাত্র কাঠের গরাদে দেওয়া জানলা, জানলার সামনাসামনি দরজা। পশ্চিমদিকের দেওয়ালে জানলা নেই—একটা ঘুলঘুলি আছে মাত্র।
রাত প্রায় একটা কি তার বেশি। আমার ঘুম আসে নি, তবে সামান্য একটু তন্দ্রার ভাব এসেচে।
হঠাৎ বাইরে ঘুলঘুলির ঠিক নিচেই যেন কার পায়ের শব্দ শোনা গেল! গরু কি ছাগলের পায়ের শব্দ হওয়া বিচিত্র নয়—বিশেষ গ্রাহ্য করলাম না।
তারপর শব্দটা সেদিক থেকে আমার শিয়রের জানলার কাছে এসে থামলো। তখনও আমি ভাবচি, ওটা গরুর পায়ের শব্দ। এমন সময় আমার বিস্মিত-দৃষ্টির সামনে দিয়ে অস্পষ্ট অন্ধকারের মধ্যে কার একটা সুদীর্ঘ হাত একেবারে আমার বুকের কাছে—ঠিক বুকের ওপর এসে পৌঁছলো—হাতে ধারালো একখানা সোজা-ছোরা, অন্ধকারেও যেন ঝকঝক করচে!
ততক্ষণে আমার বিস্ময়ের প্রথম মুহূর্ত কেটে গিয়েচে।
আমি তাড়াতাড়ি পাশমোড়া দিয়ে ছোরা-সমেত হাতখানা ধরতে গিয়ে মুহূর্তের জন্য একটা বাঁশের লাঠিকে চেপে ধরলাম।
পরক্ষণেই কে এক জোর ঝটকায় লাঠিখানা আমার হাত থেকে ছিনিয়ে নিলে। সঙ্গেসঙ্গে ছোরার তীক্ষ্ণ অগ্রভাগের আঘাতে আমার হাতের কব্জি ও বুকের খানিকটা চিরে রক্তারক্তি হয়ে গেল।
তাড়াতাড়ি উঠে টর্চ জ্বেলে দেখি, বিছানা রক্তে মাখামাখি হয়ে গিয়েচে। তখুনি নেকড়া ছিঁড়ে হাতে জলপটি বেঁধে লণ্ঠন জ্বাললাম।
লাঠির অগ্রভাগে তীক্ষ্ণাস্ত্র ছোরা বাঁধা ছিল—আমার বুক লক্ষ্য করে ঠিক কুড়ুলের কাপের ধরনে লাঠি উচিয়ে কোপ মারলেই ছোরা পিঠের ওদিক দিকে ফুঁড়ে বেরুতো। তারপর বাঁধন আল্গা করে ছোরাখানা আমার বিছানার পাশে কিংবা আমার ওপর ফেলে রাখলেই আমি যে আত্মহত্যা করেচি, এ-কথা বিশেষজ্ঞ ভিন্ন অন্য লোককে ভুল করে বোঝানো চলতো।
আমি নিরস্ত্র ছিলাম না—মিঃ সোমের ছাত্র আমি। আমার বালিশের তলায় ছ’নলা অটোমেটিক ওয়েবলি লুকোনো। সেটা হাতে করে তখুনি বাইরে এসে টর্চ ধরে ঘরের সর্বত্র খুঁজলাম—জানালার কাছে জুতো-সুদ্ধ টাটকা পায়ের দাগ!
ভালো করে টর্চ ফেলে দেখলাম।
কি জুতো?…রবার-সোল, না, চামড়া?…অন্ধকারে ভালো বোঝা গেল না।
এখুনি এই জুতোর সোলের একটা ছাঁচ নেওয়া দরকার। কিন্তু তার কোনো উপকরণ দুর্ভাগ্যের বিষয় আজ আমার কাছে নেই।
আমার মনে কেমন ভয় করতে লাগলো, আকাশের দিকে চাইলাম। কৃষ্ণপক্ষের ঘোর মেঘান্ধকার রজনী।
এমনি রাত্রে ঠিক গত কৃষ্ণপক্ষেই গাঙ্গুলিমশায় খুন হয়েছিলেন।
আমি শ্ৰীগোপালের বাড়ি গিয়ে ডাকলাম—শ্ৰীগোপাল, শ্রীগোপাল, ওঠো—ওঠো!
শ্রীগোপাল জড়িত-কণ্ঠে উত্তর দিলে—কে?
—বাইরে এসো—আলো নিয়ে এসো—সব বলচি।
শ্ৰীগোপাল একটা কেরোসিনের টেমি জ্বালিয়ে চোখ মুছতে-মুছতে বিস্মিতমুখে বার হয়ে এসে বললে—কে? ও, আপনি? এত রাত্রে কি মনে করে?
—চলো বসি—সব বলচি। এক গ্লাস জল খাওয়াও তো দেখি!
—চা খাবেন? স্টোভ আছে। চা-খোর আমি, সব মজুত রাখি—করে দিই।
চা খেয়ে আমি আর বসতে পারচি না। ঘুমে যেন চোখ ঢুলে আসচে! শ্ৰীগোপাল বললে—বাকি রাতটুকু আমার এখানেই শুয়ে কাটিয়ে দেবেন-এখন।
ব্যাপার সব শুনে শ্রীগোপাল বললে—এর মধ্যে ননী আচে বলে মনে হয়। এ তারই কাজ।
—না।
—না? বলেন কি?
—না, এ ননীর কাজ নয়।
—কি করে জানলেন?
—এখানকার লোক ছোরার ব্যবহার জানে না—বাংলাদেশের পাড়াগাঁয়ে ছোরার ব্যবহার নেই।
—তবে?
—এ-কাজ যে করেচে সে বাংলার বাইরে থাকে। তুমি কাউকে রাতের কথা বোলো না কিন্তু!
—আপনাকে খুন করতে আসার উদ্দেশ্য?
—আমি দোষী খুঁজে বার করবার কাজে পুলিসকে সাহায্য করচি—এছাড়া আর অন্য কি উদ্দেশ্য থাকতে পারে?
ভোর হলো। আমি উঠে আমার ঘরে চলে গেলাম।
জানলার বাইরে সেই পায়ের দাগ তেমনি রয়েচে। রবার-সোলের জুতো বেশ স্পষ্ট বোঝা যাচ্চে। ক’নম্বরের জুতো তাও জানা গেল।
বিকেলে আমি ভাবলাম, একবার মামার বাড়ি যাবো। এ-গ্রামে ডাক্তার নেই ভালো—মামার বাড়ি গিয়ে আমার ক্ষতস্থানটা দেখিয়ে ওষুধ দিয়ে নিয়ে আসবো। ঘরের মধ্যে জামা গায়ে দিতে গিয়ে মনে হলো—আমার ঘরের মধ্যে কে যেন ঢুকেছিল।
কিছুই থাকে না ঘরে। একটা ছোট চামড়ার সুটকেস—তাতে খানকতক কাপড়-জামা। কে ঘরের মধ্যে ঢুকে সুটকেসটা মেজেতে ফেলে তার মধ্যে হাতড়ে কি খুঁজেচে—কাপড়জামা, বা, একটা মনিব্যাগে গোটা-দুই টাকা ছিল যেগুলো ছোঁয়নি। বালিশের তলা—এমন কি, তোশকটার তলা পর্যন্ত খুঁজেচে।
আমি প্রথমটা ভাবলাম, এ কোনো ছিঁচকে-চোরের কাজ। কিন্তু চোর টাকা নেয় নি—তবে কি, রিভলভারটা চুরি করতে এসেছিল? সেটা আমার পকেটেই আছে অবিশ্যি—সে উদ্দেশ্য থাকা বিচিত্র নয়।
জানকীবাবুকে ডেকে সব কথা বললাম। জানকীবাবু শুনে বললেন—চলুন, জায়গাটা একবার দেখে আসি।
ঘরে ঢুকে আমরা সব দিক ভালো করে খুঁজে দেখলাম। সব ঠিক আছে। জানকীবাবু আমার চেয়েও ভালো করে খুঁজলেন, তিনিও কিছু বুঝতে পেরেচেন বলে মনে হলো না।
বললাম—দেখলেন তো?
—টাকাকাড়ি কিছু যায় নি?
—কিছু না।
—আর কোনো জিনিস আপনার ঘরে ছিল?
—কি জিনিস?
—অন্য কোনো দরকারি—ইয়ে—মানে—মূল্যবান?
—এখানে মূল্যবান জিনিস কি থাকবে?
—তাই তো!
সমাপ্ত