মিতুলের সেই ছোট্টবেলা থেকে খুব কিউরিওসিটি । সব কিছু জানবার এক অদম্য ইচ্ছে । এখন তার বয়স মাত্র নয় । তার মধ্যে তাদের পুরোণো বাড়ির নাড়ী-নক্ষত্র ঐটুকুনি ছেলের একেবারে নখদর্পণে । চিলেকোঠার মাচা থেকে শুরু করে নীচের গ্যারেজ ঘরের আলো-আঁধারি , সিঁড়ির তলা থেকে ঠাকুরঘরের বাসনকোসন রাখার জায়গা সর্বত্র তার অবাধ বিচরণ । বাড়ির পুরোণো কাজের লোক হারুর সাথে সব জায়গা ঘুরে ঘুরে কত কি খেলার রসদ পায় সে! মাঝেমাঝেই মা-ঠাকুমার কাছে এই জন্য বকুনি খায় ।
নোংরা সব জিনিসপত্র ঘেঁটে এনে তাকে ধুয়ে মুছে খেলনার বাস্কেটে রেখে দেয় মিতুল । বাড়ির লোকে বাতিল করেছে তো কি ! মিতুলের কাছে সেগুলো দুষ্প্রাপ্য । মিতুলের ঠাকুর্দার একটা হিন্দুস্তান ফর্টিন গাড়ি ছিল । সেই গাড়ির বাতিল সব পার্টস জোগাড় করেছে সে । পড়ার টেবিলের পাশে কয়েক মাইক্রো একর জায়গা নিয়ে গাড়ির কারখানা হবে অদূর ভবিষ্যতে…এই তার প্ল্যান । এইভাবে চলতে থাকে মিতুলের ফ্যান্টাসির সাথে হৈ হৈ করে স্বপ্ন ডাউনলোডিং আর রোজনামচার ওঠাবসা তো আছেই ।ড্রইংক্লাসের হোমওয়ার্ক, স্কুলের পড়া, কিবোর্ডের লেসেন রপ্ত করা ।
ঐটুকু দুধের কচির কত্ত কাজ! ঐ পুঁচকে মাথার মধ্যে কত্ত চিন্তা সারাক্ষণ কিলবিল করছে । তারপর সবশেষে রাতের বেলায় ঠাম্মার কাছে ঠাকুর্দার গাড়ির গল্প, নীল জাহাজ-লাল জাহাজের গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়া । সেই ছোট্টবেলা থেকে শুনে আসছে ঠাকুর্দার কথা । ছবিতে দেখেছে মিতুল কিন্তু চোখে তো আর দেখা হল না তার । এই নিয়ে মনে খুব দুঃখ পায় ।
ঠাকুর্দা খুব সুন্দর কবিতা লিখতেন ইত্যাদি ইত্যাদি । ঠাকুর্দার গাড়ির শখ ছিল । যতদিন ঠাকুর্দা বেঁচে ছিলেন ততদিন ওনার পুরোণো গাড়িটা ভিন্টেজ কার শোতে যেত প্রতিবছর । ঠাকুর্দা মারা যাবার পর বাবা যে কেন বিক্রি করে দিল গাড়িটা! মিতুলের খুব রাগ হয় মনে মনে । সে গাড়িটার ছবি দেখেছে । তার চড়া হয়নি । হিন্দুস্থান ফর্টিনের আগে ঠাকুর্দার আরেকটা ষ্টুডিবেকার গাড়ি ছিল । মিতুলের গাড়ির সব নাম ঠোঁটস্থ । পুরোণো গাড়িকে রাখা মানে হাতী পোষা । তার পেছনে অনেক খরচা খরচা করতে হয় তাই বাবা সব একে একে বিক্রি করে দিয়েছে । ঠাকুমার সাথে বিয়ে হবার পর এই বাড়ি থেকেই না কি ঠাকুর্দার একখানা কবিতার খাতা কর্পূরের মত উধাও হয়ে গিয়েছিল । সেই নিয়ে উনি খুব মনোকষ্টে থাকতেন । আর বিশাল পুরোণো বাড়ির আনাচকানাচ, গলিঘুঁজি, দালান হাতড়ে ঐটুকুনি খাতা খোঁজার ধৈর্য্য কার আছে ? মিতুল জানে ব্যাপারটা ।
নিজের সৃষ্টি হারিয়ে যাবার দুঃখ কত যে করুণ তা সে বোঝে । এই তো গতবছর দীঘার সমুদ্রতটে বেড়াতে গিয়ে মিতুল কি দারুণ একটা সমুদ্রের ছবি এঁকেছিল । অমন ছবি আঁকার স্যার দেখলে নির্ঘাত অবাক হতেন । কিন্তু মা ভুল করে হোটেলের ঘরেই ছবিখানা ফেলে এসেছিল । সেই নিয়ে মায়ের সাথে এক সপ্তাহ কথা বন্ধ ছিল মিতুলের । তারপর থেকে শত চেষ্টা করেও সুন্দর একটা সমুদ্রের ল্যান্ডস্কেপ আঁকতে পারেনি মিতুল । সেবার মুসৌরী বেড়াতে গিয়ে মিতুলের বাবা একটা কাগজের প্লেন বানিয়ে দিয়েছিলেন ।
পাহাড়ের কোলে হোটেলের ঘরের লাগোয়া বারান্দা থেকে ঘন সবুজ পাইন বনে সেই প্লেন বাবা উড়িয়ে দিয়েছিলেন । মিতুল দেখেছিল সেই প্লেন কেমন করে উড়তে উড়তে, ভাসতে ভাসতে ঘন সবুজ বনের মধ্যে দিয়ে কোথায় যেন হারিয়ে গেছিল । জিনিস হারিয়ে গেলে মিতুলের ভারি কষ্ট হয় । বাবা কত সুন্দর প্লেন বানালো আর সেটা কি না কোন গাছের ফাঁকে হয়ত আটকে আছে এখনো, বৃষ্টিতে ভিজে প্লেনটার আর কোনো অস্তিত্বই নেই । বৃষ্টির দিনে রাস্তায় জল জমে গেলে কাগজের নৌকো বানিয়ে দিত মা । কিন্তু সেটাকে জলে ভাসাতে মিতুলের খুব আপত্তি । জলে ভিজে গেলে নৌকোটা তো নষ্ট হয়ে যাবে ।