মিতব্যয়

বর্তমানে প্রায় সারাবিশ্বেই অর্থনৈতিক মন্দা বিরাজ করছে। আর মন্দার হাত থেকে পৃথিবীকে বাঁচাতে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা বিপুল পরিমাণ আর্থিক সাহায্যের ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু তারপরও মন্দা যেন কাটছে না। মূলত অপব্যয়, অপচয় ও বিলাসিতার কারণেই বিশ্ব এখন আর্থিক সংকটের মুখোমুখি। এ কারণেই ইসলাম ধর্মে অপচয় ও বিলাসিতাকে নিষিদ্ধ করে মিতব্যয়ী হবার জন্য তাগিদ দেয়া হয়েছে। ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতু্ল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী ইসলামের এই নির্দেশনার আলোকে চলতি ফার্সী বছরকে ব্যয় সংকোচন বা পরিমিত ব্যয়ের বছর হিসেবে ঘোষণা করেছেন। তিনি ব্যয় সংকোচনের মাধ্যমে দেশের জনগণকে সর্বোত্তম জীবন যাপনের আহবান জানান। ফার্সী নববর্ষ ১৩৮৮ উপলক্ষে দেয়া এক ভাষণে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা বলেছেন, দেশের সম্পদ ব্যয়ের বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ এবং এর অপচয় রোধ করতে হবে। সবার আগে সরকারকে এ বিষয়ে মনোযোগী হতে হবে। এরপর বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এবং ধনী গরিব নির্বিশেষে সবাইকে অপচয় বন্ধ করে পরিমিত ব্যয়ে অভ্যস্ত হতে হবে। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা তার ভাষণে মিতব্যায়ের সঠিক সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন, “মিতব্যয়ের অর্থ কম খরচ করা নয়। মিতব্যায় অর্থ সঠিকভাবে টাকাপয়সা ব্যয় করা। যেখানে যতটুকু প্রয়োজন, ততটুকু ব্যয় করা এবং সম্পদের অপচয় না করা। অর্থ এমনভাবে ব্যয় করতে হবে যে, তা যেন কাজে আসে। বিশ্বের বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলায় অপচয় রোধ অর্থাৎ মিতব্যয়ের কোন বিকল্প নেই। বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিধায় আমরা মিতব্যয় সম্পর্কে একটি বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করেছি ।

ইসলাম একটি ভারসাম্যপূর্ণ এবং কল্যাণকামী ধর্ম। তাই ইসলামে অপচয় ও অপব্যয় উভয়ই নিষিদ্ধ। ইসলামের দৃষ্টিতে অপচয় ও অপব্যয় না করে তা মানব কল্যাণে ব্যয় করাই হচ্ছে প্রকৃত মুমিনের কাজ। কুরআন মজীদে আল্লাহ্‌ তা’আলা এ সম্পর্কে বলেছেন, “যখন তারা ব্যয় করে তখন তারা অপচয় করে না, কার্পণ্যও করে না, বরং তারা মধ্যম পন্থা অবলম্বন করে।” (২৫ : ৬৭ )। অন্যদিকে সূরা আরাফের ৩১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, “তোমরা খাও এবং পান করো, কিন্তু অপচয় করো না, কারণ আল্লাহ অপচয়কারীকে পছন্দ করেন না।” অপচয়ের মতো অপব্যয়কে নিষিদ্ধ করে কুরআন মজীদে বলা হয়েছে-“আর কিছুতেই অপব্যয় করবে না। যারা অপব্যয় করে তারা শয়তানের ভাই এবং শয়তান তার প্রতিপালকের প্রতি অতিশয় অকৃতজ্ঞ”। (১৭ : ২৬-২৭) মূলত এসব কারণেই মহানবী (সাঃ) অপচয় করতে নিষেধ করেছেন। অপচয়ের ব্যাপারে তিনি কত কঠোর ছিলেন এ সম্পর্কে একটি হাদিস শোনা যাক। একদিন নবী করীম (সাঃ), হযরত সা’দ (রাঃ)- এর পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। সা’দ তখন ওযু করছিলেন। নবী করীম (সাঃ) বললেন, ‘হে সা’দ অপচয় করছো কেন ! সা’দ বললেন, ওযুতে কি অপচয় হয় ? নবী করীম (সাঃ) বললেন, হ্যাঁ, প্রবাহমান নদীতে বসেও যদি তুমি অতিরিক্ত পানি ব্যবহার করো- তবে তাও অপচয়।” কেবল ওযুর ক্ষেত্রেই নয়, গোসলের ক্ষেত্রেও অতিরিক্ত পানি ব্যবহার করতে তিনি নিষেধ করেছেন।

আগেই বলেছি যে, ইসলাম ব্যয়ের ক্ষেত্রে মধ্যম পন্থাকে গ্রহণ করেছে। এ সম্পর্কে মহানবী (সাঃ) বলেছেন, “ব্যয় করার ক্ষেত্রে মধ্যমন্থা অবলম্বন করা বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক।” তিনি আরও বলেছেন,”যে ব্যক্তি ব্যয় করার ক্ষেত্রে মধ্যম পন্থা অবলম্বন করে সে কখনো দরিদ্র ও অভাবগ্রস্ত হয় না।” তাই বলে এটা মনে করার কোন কারণ নেই যে, ইসলাম মানুষকে কৃপণ হতে বলেছে। সত্যি বলতে কী, ইসলামের দৃষ্টিতে অপচয় কিংবা অপব্যয় যেমন দূষণীয়, তেমনি ব্যয়ের ক্ষেত্রে কৃপণতাও দোষনীয়। ধন-সম্পদ কমে যাবে এ কারণে নিঃস্ব ও অভাবী মানুষকে সহায়তা না করা ইসলামের দৃষ্টিতে অবশ্যই দোষনীয়। কুরআন ও হাদীসে ক্ষুধার্তকে খাদ্যদান, বস্ত্রহীনকে বস্ত্রদান, অভাবগ্রস্তকে সাহায্য দান, অনাথ-ইয়াতীমদেরকে লালন-পালন, নিঃস্ব ব্যক্তির উপার্জনের ব্যবস্থা করা, বিপদগ্রস্ত মানুষকে সহায়তা করা মুসলিমদের কর্তব্য বলে ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু কৃপণরা তা করে না। ফলে কৃপণতা মানুষকে আল্লাহ্‌তা’আলা তথা জান্নাত থেকে দূরে সরিয়ে শয়তান তথা জাহান্নাম পর্যন্ত পৌঁছে দেয়। রাসূলেখোদা বলেছেন-“তোমরা কৃপণতা থেকে বেঁচে থাকবে। কেননা এ কৃপণতা তোমাদের পূর্ববর্তীদেরকে ধ্বংস করে দিয়েছে। ” তিনি আরও বলেছেন-“কৃপণ ব্যক্তি আল্লাহ্‌ থেকে দূরে, জান্নাত থেকে দূরে এবং মানুষের থেকে দূরে থাকে। কিন্তু জাহান্নামের নিকটবর্তী থাকবে।”

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) হযরত খাদিজা (সাঃ আঃ)কে বিয়ে করার পর আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধনী হিসেবে পরিচিত হন। কিন্তু সেই ধন-সম্পদ তিনি বিলাসিতার কাজে ব্যবহার করেননি কিংবা অপচয় করেননি। বরং তিনি তা গরীব-দুঃখীদের দুঃখ-দুর্দশা ও অভাব-অনটন দূর করার কাজে ব্যয় করেছেন। নবীজীর বিশিষ্ট সাহাবী ও আহলে বাইতের মহান ইমামগণও সবসময় বিলাসিতাকে এড়িয়ে চলতেন। শুধু তাই নয়, নবীজীর আদর্শের অনুসারী মরহুম ইমাম খোমেনী (রহঃ)ও অত্যন্ত সাদাসিধে জীবন যাপন করেছেন। বিষ্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, তিনি তেহরানে দুকক্ষ বিশিষ্ট একটি একতলা বাড়ীতে বসবাস করতেন। বাড়ীর বড় রুমটির মাঝখানে পর্দা দিয়ে একপাশে ইমাম ও তাঁর স্ত্রী ঘুমাতেন। আর অপর পাশে কয়েকটি সাদা কভারের সোফা, কোরআন হাদিস রাখার কিছু তাক, একটি আয়না, একটি টেলিভিশন ও একটি রেডিও রাখা হতো। বাসার ছোট রুমটিতে তিনি মেহমানদের সাথে কথা বলতেন। একটি দেশের সর্বোচ্চ নেতা হয়েও ইমাম খোমেনীর সাধারণ জীবনযাপন ইসলামের প্রাথমিক যুগের মুসলমানদের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়।

কিছুদিন আগে সারা বিশ্বের মিডিয়াতে একটি আলোড়ন সৃষ্টিকারী প্রতিবেদন ছাপা হয় ইরানের প্রেসিডেন্ট ড. মাহমুদ আহমাদিনেজাদকে নিয়ে। ঐ প্রতিবেদনে ইরানের প্রেসিডেন্টের সাদাসিধে জীবন যাপনের অকল্পনীয় কিছু কাহিনী তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, ইরানের প্রেসিডেন্ট জীবন যাপনের ক্ষেত্রে খলিফাদের অনুসরণ করেন। সাধারণ কর্মচারীদের মতো তিনি প্রতিদিন একটি ব্যাগে করে অফিসে নিয়ে আসেন সকালের নাশতা। তাতে থাকে কিছু স্যান্ডউইচ বা রুটি, জলপাই তেল আর পনির। প্রেসিডেন্ট পত্নী নিজ হাতে প্রস্তুত করে দেন এ খাবার। প্রেসিডেন্ট আহমাদিনেজাদ সরলতায় আরও নজির স্থাপন করেছেন। তার জন্য বরাদ্দ ‘দ্য প্রেসিডেন্টস এয়ারক্রাফট’ এর বদলে ব্যবহার করেন একটি মালবাহী বিমান। যাতে কোনো বিশেষ ব্যবস্থা নেই। তিনি প্রেসিডেন্টের ম্যানেজার বা সহকারীর অফিস বাতিল করেছেন। ফলে যেকোনো মন্ত্রী পূর্বানুমতি ছাড়াই তার অফিসে ঢুকে পড়তে পারেন।

খরচ বাঁচানোর জন্য তিনি লাল গালিচা সংবর্ধনা, ফটোসেশন, ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপন অথবা দেশের কোনো স্থান পরিদর্শনকালে বিশেষ কোনো সম্মান দেয়ার রীতি বন্ধ করেছেন। সরলতার আরও উদাহরণ রেখেছেন তিনি। তিনি বিছানার পরিবর্তে মেঝেতেই মাদুরের ওপর চাদর বা কম্বল বিছিয়ে ঘুমাতে পছন্দ করেন। বাড়িতেও তিনি মাঝে মাঝেই গেস্টরুমে মাদুর বিছিয়ে ঘুমান। নামাজ আদায় করতে যেখানে জায়গা পান সেখানে দাঁড়িয়েই নামাজ আদায় করেন। সামনের সারিতে দাঁড়াতেই হবে এমন কোনো তাগিদ তার নেই। আর খাবার খেতে দেখা যায় সবার সঙ্গে ডাইনিং রুমের মেঝেতে বসে।

আহমাদিনেজাদের মন্ত্রী পরিষদে নিযুক্ত মন্ত্রীদের একটি বিশেষ শর্তাবলীর দলিলে স্বাক্ষর করতে হয়। তাহলো তার মন্ত্রী পরিষদে যিনি মন্ত্রী হবেন তাকে সাধারণ মানুষের মত জীবনযাপন করতে হবে। ঐ মন্ত্রীর ব্যক্তিগত ও আত্মীয়-স্বজনদের হিসাবেরও নজরদারি করা হবে। ঐ মন্ত্রী ও তার আত্মীয়-স্বজনরা মন্ত্রণালয় থেকে কোন সুযোগ সুবিধা নিতে পারবে না। ইরানী প্রেসিডেন্ট আহমাদিনেজাদ বর্তমান বিশ্বের প্রেসিডেন্টদের মধ্যে একমাত্র ব্যক্তি যিনি অতি সাধারণ জীবনযাপন করেন। তার এ সাধারণ জীবন যাপন ইসলামের ইতিহাসের প্রথম যুগের খলিফা ও সাহাবীদের কথাই স্মরণ করে দেয় যে, মুসলমান নেতা ও রাষ্ট্রনায়করা হবেন জ্ঞান বিজ্ঞানে উচ্চ শিক্ষিত আর ভোগ বিলাসে হবেন অতি সাধারণ। ইরানের ৬ষ্ঠতম প্রেসিডেন্ট আহমাদিনেজাদ লেখাপড়ায় ডক্টরেট ডিগ্রিধারী হলেও জীবন যাপনে সাধারণ, যা বিশ্বের মানুষের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস।

বিলাসিতা ও অপচয় পরিহার করেও যে সম্মানের সাথে জীবনযাপন করা যায় তা ইরানের প্রেসিডেন্টের তা দেখিয়ে দিয়েছেন। আমাদের সবার উচিত অপচয় ও অপব্যয় পরিহার করে সাধারণ জীবনযাপনের চেষ্টা করা। তাহলে আল্লাহতায়ালা আমাদের উত্তম প্রতিদান দেবেন।

অন্যায় বিচারের পরিণতি

অসৎ সঙ্গ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *