সকালবেলায় শীত-শীত ছিল । দুপুরবেলায় বাতাসটি অল্প একটু তাতিয়া উঠিয়া দক্ষিণ দিক হইতে বহিতে আরম্ভ করিয়াছে ।
যতীন যে বারান্দায় বসিয়া ছিল, সেখান হইতে বাগানের এক কোণে এক দিকে একটি কাঁঠাল ও আর-একদিকে একটি শিরীষগাছের মাঝখানের ফাঁক দিয়া বাহিরের মাঠ চোখে পড়ে । সেই শূন্য মাঠ ফাল্গুনের রৌদ্রে ধূধূ করিতেছিল । তাহারই এক প্রান্ত দিয়া কাঁচা পথ চলিয়া গেছে — সেই পথ বাহিয়া বোঝাই-খালাস গোরুর গাড়ি মন্দগমনে গ্রামের দিকে ফিরিয়া চলিয়াছে , গাড়োয়ান মাথায় গামছা ফেলিয়া অত্যন্ত বেকারভাবে গান গহিতেছে ।
এমন সময় পশ্চাতে একটি সহাস্য নারীকণ্ঠ বলিয়া উঠিল , “ কী যতীন , পূর্বজন্মের কারও কথা ভাবিতেছ বুঝি? ”
যতীন কহিল , “কেন পটল, আমি এমনিই কি হতভাগা যে , ভাবিতে হইলেই পূর্বজন্ম লইয়া টান পাড়িতে হয় । ”
আত্মীয়সমাজে ‘পটল ‘ নামে খ্যাত এই মেয়েটি বলিয়া উঠিল , “ আর মিথ্যা বড়াই করিতে হইবে না । তোমার ইহজন্মের সব খবরই তো রাখি , মশায় । ছি ছি , এত বয়স হইল তবু একটা সামান্য বউও ঘরে আনিতে পারিলে না। আমাদের ঐ-যে ধনা মালীটা , ওরও একটা বউ আছে — তার সঙ্গে দুইবেলা ঝগড়া করিয়া সে পাড়াসুদ্ধ লোককে জানাইয়া দেয় যে , বউ আছে বটে। আর তুমি যে মাঠের দিকে তাকাইয়া ভান করিতেছ , যেন কার চাঁদমুখ ধ্যান করিতে বসিয়াছ , এ-সমস্ত চালাকি আমি কি বুঝি না — ও কেবল লোক দেখাইবার ভড়ং মাত্র। দেখো যতীন , চেনা বামুনের পৈতের দরকার হয় না- আমাদের ঐ ধনাটা তো কোনোদিন বিরহের ছুতা করিয়া মাঠের দিকে অমন তাকাইয়া থাকে না; অতিবড়ো বিচ্ছেদের দিনেও গাছের তলায় নিড়ানি হাতে উহাকে দিন কাটাইতে দেখিয়াছি, কিন্তু উহার চোখে তো অমন ঘোর-ঘোর ভাব দেখি নাই। আর তুমি, মশায়, সাতজন্ম বউয়ের মুখ দেখিলে না — কেবল হাসপাতালে মড়া কাটিয়া ও পড়া মুখস্থ করিয়া বয়স পার করিয়া দিলে , তুমি অমনতরো দুপুরবেলা আকাশের দিকে গদ্গদ হইয়া তাকাইয়া থাক কেন। না, এ-সমস্ত বাজে চালাকি আমার ভালো লাগে না । আমার গা জ্বালা করে। ”
যতীন হাতজোড় করিয়া কহিল, “থাক্, থাক্ , আর নয়। আমাকে আর লজ্জা দিয়ো না । তোমাদের ধনাই ধন্য । উহারই আদর্শে আমি চলিতে চেষ্টা করিব। আর কথা নয়, কাল সকালে উঠিয়াই যে কাঠকুড়ানি মেয়ের মুখ দেখিব, তাহারই গলায় মালা দিব — ধিক্কার আমার আর সহ্য হইতেছে না। ”
পটল । তবে এই কথা রইল ?
যতীন । হাঁ , রহিল ।
পটল । তবে এসো ।
যতীন । কোথায় যাইব ।
পটল । এসোই-না ।
যতীন । না, না , একটা-কী দুষ্টুমি তোমার মাথায় আসিয়াছে । আমি এখন নড়িতেছি না ।
পটল । আচ্ছা , তবে এইখানেই বোসো । – বলিয়া সে দ্রুতপদে প্রস্থান করিল ।
পরিচয় দেওয়া যাক । যতীন এবং পটলের বয়সের একদিন মাত্র তারতম্য । পটল যতীনের চেয়ে একদিনের বড়ো বলিয়া যতীন তাহার প্রতি কোনোপ্রকার সামাজিক সম্মান দেখাইতে নারাজ । উভয়ে খুড়তুতো-জাঠতুতো ভাইবোন । বরাবর একত্রে খেলা করিয়া আসিয়াছে । ‘ দিদি ‘ বলে না বলিয়া পটল যতীনের নামে বাল্যকালে বাপ-খুড়ার কাছে অনেক নালিশ করিয়াছে , কোনো শাসনবিধির দ্বারা কোনো ফল পায় নাই — একটিমাত্র ছোটো ভাইয়ের কাছেও তাহার পটল-নাম ঘুচিল না ।
পটল দিব্য মোটাসোটা গোলগাল , প্রফুল্লতার রসে পরিপূর্ণ । তাহার কৌতুকহাস্য দমন করিয়া রাখে , সমাজে এমন কোনো শক্তি ছিল না । শাশুড়ির কাছেও সে কোনোদিন গাম্ভীর্য অবলম্বন করিতে পারে নাই। প্রথম প্রথম তা লইয়া অনেক কথা উঠিয়াছিল। কিন্তু , শেষকালে সকলকেই হার মানিয়া বলিতে হইল — ওর ঐ রকম। তার পরে এমন যে , পটলের দুর্নিবার প্রফুল্লতার আঘাতে গুরুজনদের গাম্ভীর্য ধূলিসাৎ হইয়া গেল। পটল তাহার আশেপাশে কোনোখানে মন-ভার মুখ-ভার দুশ্চিন্তা সহিতে পারিত না — অজস্র গল্প-হাসি-ঠাট্টায় তাহার চারি দিকের হাওয়া যেন বিদ্যুৎশক্তিতে বোঝাই হইয়া থাকিত।
পটলের স্বামী হরকুমারবাবু ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট — বেহার-অঞ্চল হইতে বদলি হইয়া কলিকাতায় আবগারি-বিভাগে স্থান পাইয়াছেন। প্লেগের ভয়ে বালিতে একটি বাগানবাড়ি ভাড়া লইয়া থাকেন, সেখান হইতে কলিকাতায় যাতায়াত করেন । আবগারি-পরিদর্শনে প্রায়ই তাঁহাকে মফস্বলে ফিরিতে হইবে বলিয়া দেশ হইতে মা এবং অন্য দুই-একজন আত্মীয়কে আনিবার উপক্রম করিতেছেন , এমন সময় ডাক্তারিতে নূতন-উত্তীর্ণ পসারপ্রতিপত্তিহীন যতীন বোনের নিমন্ত্রণে হপ্তাখানেকের জন্য এখানে আসিয়াছে।
কলিকাতার গলি হইতে প্রথম দিন গাছপালার মধ্যে আসিয়া যতীন ছায়াময় নির্জন বারান্দায় ফাল্গুন মধ্যাহ্নের রসালস্যে আবিষ্ট হইয়া বসিয়া ছিল , এমন সময়ে পূর্বকথিত সেই উপদ্রব আরম্ভ হইল। পটল চলিয়া গেলে আবার খানিকক্ষণের জন্য সে নিশ্চিন্ত হইয়া একটুখানি নড়িয়া-চড়িয়া বেশ আরাম করিয়া বসিল — কাঠকুড়ানি মেয়ের প্রসঙ্গে ছেলেবেলাকার রূপকথার অলিগলির মধ্যে তাহার মন ঘুরিয়ে বেড়াইতে লাগিল।
এমন সময় আবার পটলের হাসিমাখা কণ্ঠের কাকলিতে সে চমকিয়া উঠিল ।
পটল আর-একটি মেয়ের হাত ধরিয়া সবেগে টানিয়া আনিয়া যতীনের সম্মুখে স্থাপন করিল ; কহিল, “ ও কুড়ানি । ”
মেয়েটি কহিল, “ কী , দিদি । ”
পটল । আমার এই ভাইটি কেমন দেখ্ দেখি ।
মেয়েটি অসংকোচে যতীনকে দেখিতে লাগিল । পটল কহিল , “ কেমন , ভালো দেখিতে না ? ”
মেয়েটি গম্ভীরভাবে বিচার করিয়া ঘাড় নাড়িয়া কহিল , “ হাঁ, ভালো । ”
যতীন লাল হইয়া চৌকি ছাড়িয়া উঠিয়া কহিল , “ আঃ পটল , কী ছেলেমানুষি করিতেছ । ”
পটল। আমি ছেলেমানুষি করি , না তুমি বুড়োমানুষি কর! তোমার বুঝি বয়সের গাছপাথর নাই!
যতীন পলায়ন করিল । পটল তাহার পিছনে পিছনে ছুটিতে ছুটিতে কহিল , “ ও যতীন , তোমার ভয় নাই , তোমার ভয় নাই । এখনই তোমার মালা দিতে হইবে না — ফাল্গুন-চৈত্রে লগ্ন নাই — এখনো হাতে সময় আছে । ”
পটল যাহাকে কুড়ানি বলিয়া ডাকে , সেই মেয়েটি অবাক হইয়া রহিল । তাহার বয়স ষোলো হইবে , শরীর ছিপ্ছিপে — মুখশ্রী সম্বন্ধে অধিক কিছু বলিবার নাই , কেবল মুখে এই একটি অসামান্যতা আছে যে দেখিলে যেন বনের হরিণের ভাব মনে আসে । কঠিন ভাষায় তাহাকে নির্বুদ্ধি বলা যাইতেও পারে- কিন্তু তাহা বোকামি নহে, তাহা বুদ্ধিবৃত্তির অপরিস্ফুরণমাত্র , তাহাতে কুড়ানির মুখের সৌন্দর্য নষ্ট না করিয়া বরঞ্চ একটি বিশিষ্টতা দিয়াছে ।
সন্ধ্যাবেলায় হরকুমারবাবু কলিকাতা হইতে ফিরিয়া আসিয়া যতীনকে দেখিয়া কহিলেন , “ এই-যে , যতীন আসিয়াছ , ভালোই হইয়াছে । তোমাকে একটু ডাক্তারি করিতে হইবে । পশ্চিমে থাকিতে দুর্ভিক্ষের সময় আমরা একটি মেয়েকে লইয়া মানুষ করিতেছি — পটল তাহাকে কুড়ানি বলিয়া ডাকে । উহার বাপ-মা এবং ঐ মেয়েটি আমাদের বাংলার কাছে একটি গাছতলায় পড়িয়া ছিল । যখন খবর পাইয়া গেলাম গিয়া দেখি , উহার বাপ-মা মরিয়াছে , মেয়েটির প্রাণটুকু আছে মাত্র । পটল তাহাকে অনেক যত্নে বাঁচাইয়াছে । উহার জাতের কথা কেহ জানে না — তাহা লইয়া কেহ আপত্তি করিলেই পটল বলে , ‘ ও তো দ্বিজ ; একবার মরিয়া এবার আমাদের ঘরে জন্মিয়াছে , উহার সাবেক জাত কোথায় ঘুচিয়া গেছে । ‘ প্রথমে মেয়েটি পটলকে মা বলিয়া ডাকিতে শুরু করিয়াছিল ; পটল ধমক দিয়া বলিল , ‘ খবরদার, আমাকে মা বলিস নে — আমাকে দিদি বলিস । ‘ পটল বলে , ‘ অতবড়ো মেয়ে মা বলিলে নিজেকে বুড়ি বলিয়া মনে হইবে যে । ‘ বোধ করি সেই দুর্ভিক্ষের উপবাসে বা আর-কোনো কারণে উহার থাকিয়া থাকিয়া শূলবেদনার মতো হয় । ব্যাপারখানা কী, তোমাকে ভালো করিয়া পরীক্ষা করিয়া দেখিতে হইবে । ওরে তুল্ সি , কুড়ানিকে ডাকিয়া আন্ তো । ”
কুড়ানি চুল বাঁধিতে বাঁধিতে অসম্পূর্ণ বেণী পিঠের উপরে দুলাইয়া হরকুমারবাবুর ঘরে আসিয়া উপস্থিত হইল । তাহার হরিণের মতো চোখদুটি দুজনের উপর রাখিয়া সে চাহিয়া রহিল ।
যতীন ইতস্তত করিতেছে দেখিয়া হরকুমার তাহাকে কহিলেন, “ বৃথা সংকোচ করিতেছ , যতীন । উহাকে দেখিতে মস্ত ডাগর , কিন্তু কচি ডাবের মতো উহার ভিতরে কেবল জল ছল্ছল্ করিতেছে — এখনো শাঁসের রেখা মাত্র দেখা দেয় নাই। ও কিছুই বোঝে না — উহাকে তুমি নারী বলিয়া ভ্রম করিয়ো না , ও বনের হরিণী । ”
যতীন তাহার ডাক্তারী কর্তব্য সাধন করিতে লাগিল — কুড়ানি কিছুমাত্র কুণ্ঠা প্রকাশ করিল না। যতীন কহিল, “শরীরযন্ত্রের কোনো বিকার তো বোঝা গেল না। ”
পটল ফস্ করিয়া ঘরে ঢুকিয়া বলিল , “ হৃদয়যন্ত্রেরও কোনো বিকার ঘটে নাই । তার পরীক্ষা দেখিতে চাও ? ”
বলিয়া কুড়ানির কাছে গিয়া তাহার চিবুক স্পর্শ করিয়া কহিল, “ও কুড়ানি, আমার এই ভাইটিকে তোর পছন্দ হইয়াছে?”
কুড়ানি মাথা হেলাইয়া কহিল, “ হাঁ । ”
পটল কহিল , “ আমার ভাইকে তুই বিয়ে করিবি ? ”
সে আবার মাথা হেলাইয়া কহিল , “ হাঁ । ”
পটল এবং হরকুমারবাবু হাসিয়া উঠিলেন । কুড়ানি কৌতুকের মর্ম না বুঝিয়া তাঁহাদের অনুকরণে মুখখানি হাসিতে ভরিয়া চাহিয়া রহিল ।
যতীন লাল হইয়া উঠিয়া ব্যস্ত হইয়া কহিল , “ আঃ, পটল , তুমি বাড়াবাড়ি করিতেছ — ভারি অন্যায় । হরকুমারবাবু , আপনি পটলকে বড়ো বেশি প্রশ্রয় দিয়া থাকেন । ”
হরকুমার কহিলেন , “ নহিলে আমিও যে উঁহার কাছে প্রশ্রয় প্রত্যাশা করিতে পারি না । কিন্তু যতীন , কুড়ানিকে তুমি জান না বলিয়াই অত ব্যস্ত হইতেছ । তুমি লজ্জা করিয়া কুড়ানিকে সুদ্ধ লজ্জা করিতে শিখাইবে দেখিতেছি । উহাকে জ্ঞানবৃক্ষের ফল তুমি খাওয়াইয়ো না । সকলে উহাকে লইয়া কৌতুক করিয়াছে — তুমি যদি মাঝের থেকে গাম্ভীর্য দেখাও তবে সেটা উহার পক্ষে একটা অসংগত ব্যাপার হইবে । ”
পটল । ঐজন্যই তো যতীনের সঙ্গে আমার কোনোকালেই বনিল না , ছেলেবেলা থেকে কেবলই ঝগড়া চলিতেছে — ও বড়ো গম্ভীর ।
হরকুমার । ঝগড়া করাটা বুঝি এমনি করিয়া একেবারে অভ্যাস হইয়া গেছে — ভাই সরিয়া পড়িয়াছেন , এখন —
পটল । ফের মিথ্যা কথা। তোমার সঙ্গে ঝগড়া করিয়া সুখ নাই — আমি চেষ্টাও করি না ।
হরকুমার । আমি গোড়াতেই হার মানিয়া যাই ।
পটল । বড়ো কর্মই করো । গোড়ায় হার না মানিয়া শেষে হার মানিলে কত খুশি হইতাম ।
গল্পের দ্বিতীয় অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।