মাল্যদান–তৃতীয় অংশ- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

আনিয়াছে ।

যতীন তাহাকে দেখিতে গেল। মেয়েটির মুখের অধিকাংশ চাদরে ঢাকা ছিল। যতীন প্রথমেই তাহার হাত তুলিয়া লইয়া নাড়ী দেখিল। নাড়ীতে জ্বর অধিক নাই, কিন্তু দুর্বলতা অত্যন্ত। তখন পরীক্ষার জন্য মুখের চাদর সরাইয়া দেখিল, সেই কুড়ানি ।

ইতিমধ্যে পটলের কাছ হইতে যতীন কুড়ানির সমস্ত বিবরণ জানিয়াছিল । অব্যক্ত হৃদয়ভাবের দ্বারা ছায়াচ্ছন্ন তাহার সেই হরিণচক্ষুদুটি কাজের অবকাশে যতীনের ধ্যানদৃষ্টির উপরে কেবলই অশ্রুহীন কাতরতা বিকীর্ণ করিয়াছে । আজ সেই রোগনিমীলিত চক্ষুর সুদীর্ঘ পল্লব কুড়ানির শীর্ণ কপোলের উপরে কালিমার রেখা টানিয়াছে ; দেখিবামাত্র যতীনের বুকের ভিতরটা হঠাৎ কে যেন চাপিয়া ধরিল । এই একটি মেয়েকে বিধাতা এত যত্নে ফুলের মতো সুকুমার করিয়া গড়িয়া দুর্ভিক্ষ হইতে মারীর মধ্যে ভাসাইয়া দিলেন কেন । আজ এই-যে পেলব প্রাণটি ক্লিষ্ট হইয়া বিছানার উপরে পড়িয়া আছে , ইহার এই অল্প কয়দিনের আয়ুর মধ্যে এত বিপদের আঘাত , এত বেদনার ভার সহিল কী করিয়া , ধরিল কোথায় । যতীনই-বা ইহার জীবনের মাঝখানে তৃতীয় আর-একটি সংকটের মতো কোথা হইতে আসিয়া জড়াইয়া পড়িল । রুদ্ধ দীর্ঘনিশ্বাস যতীনের বক্ষোদ্বারে আঘাত করিতে লাগিল — কিন্তু সেই আঘাতের তাড়নায় তাহার হৃদয়ের তারে একটা সুখের মীড়ও বাজিয়া উঠিল । যে ভালোবাসো জগতে দুর্লভ , যতীন তাহা না চাহিতেই , ফাল্গুনের একটি মধ্যাহ্নে একটি পূর্ণবিকশিত মাধবীমঞ্জরির মতো অকস্মাৎ তার পায়ের কাছে আপনি আসিয়া খসিয়া পড়িয়াছে । যে ভালোবাসা এমন করিয়া মৃত্যুর দ্বার পর্যন্ত আসিয়া মূর্ছিত হইয়া পড়ে , পৃথিবীতে কোন্‌ লোক সেই দেবভোগ্য নৈবেদ্যলাভের অধিকারী ।

যতীন কুড়ানির পাশে বসিয়া তাহাকে অল্প অল্প গরম দুধ খাওয়াইয়া দিতে লাগিল । খাইতে খাইতে অনেকক্ষণ পরে সে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া চোখ মেলিল । যতীনের মুখের দিকে চাহিয়া তাহাকে সুদূর স্বপ্নের মতো যেন মনে করিয়া লইতে চেষ্টা করিল । যতীন যখন তাহার কপালে হাত রাখিয়া একটুখানি নাড়া দিয়া কহিল “ কুড়ানি ” তখন তাহার অজ্ঞানের শেষ ঘোরটুকু হঠাৎ ভাঙিয়া গেল — যতীনকে সে চিনিল এবং তখনই তাহার চোখের উপরে বাষ্পকোমল আর-একটি মোহের আবরণ পড়িল । প্রথম-মেঘ সমাগমে সুগম্ভীর আষাঢ়ের আকাশের মতো কুড়ানির কালো চোখদুটির উপর একটি যেন সুদূরব্যাপী সজলস্নিগ্ধতা ঘনাইয়া আসিল ।

যতীন সকরুণ যত্নের সহিত কহিল , “ কুড়ানি , এই দুধটুকু শেষ করিয়া ফেলো । ”

কুড়ানি একটু উঠিয়া বসিয়া পেয়ালার উপর হইতে যতীনের মুখে স্থিরদৃষ্টিতে চাহিয়া সেই দুধটুকু ধীরে ধীরে খাইয়া ফেলিল ।

হাসপাতালের ডাক্তার একটিমাত্র রোগীর পাশে সমস্তক্ষণ বসিয়া থাকিলে কাজও চলে না , দেখিতেও ভালো হয় না । অন্যত্র কতর্ব্য সারিবার জন্য যতীন যখন উঠিল তখন ভয়ে ও নৈরাশ্যে কুড়ানির চোখদুটি ব্যাকুল হইয়া পড়িল । যতীন তাহার হাত ধরিয়া তাহাকে আশ্বাস দিয়া কহিল , “ আমি আবার এখনই আসিব, কুড়ানি , তোমার কোনো ভয় নাই । ”

যতীন কর্তৃপক্ষদিগকে জানাইল যে , এই নূতন-আনীত রোগিনীর প্লেগ হয় নাই , সে না খাইয়া দুর্বল হইয়া পড়িয়াছে । এখানে অন্য প্লেগরোগীর সঙ্গে থাকিলে তাহার পক্ষে বিপদ ঘটিতে পারে ।

বিশেষ চেষ্টা করিয়া যতীন কুড়ানিকে অন্যত্র লইয়া যাইবার অনুমতি লাভ করিল এবং নিজের বাসায় লইয়া গেল । পটলকে সমস্ত খবর দিয়া একখানি চিঠিও লিখিয়া দিল ।

সেইদিন সন্ধ্যার সময় রোগী এবং চিকিৎক ছাড়া ঘরে আর কেহ ছিল না । শিয়রের কাছে রঙিন কাগজের আবরণে ঘেরা একটি কেরোসিন ল্যাম্প্‌ ছায়াচ্ছন্ন মৃদু আলোক বিকীর্ণ করিতেছিল ব্র্যাকেটের উপরে একটা ঘড়ি নিস্তব্ধ ঘরে টিক্‌টিক্‌ শব্দে দোলক দোলাইতেছিল ।

যতীন কুড়ানির কপালে হাত দিয়া কহিল , “ তুমি কেমন বোধ করিতেছ , কুড়ানি । ”

কুড়ানি তাহার কোনো উত্তর না করিয়া যতীনের হাতটি আপনার কপালেই চাপিয়া রাখিয়া দিল ।

যতীন আবার জিজ্ঞাসা করিল, “ ভালো বোধ হইতেছে ? ”

কুড়ানি একটুখানি চোখ বুজিয়া কহিল, “ হাঁ। ”

যতীন আবার জিজ্ঞাসা করিল , “ তোমার গলায় এটা কী কুড়ানি । ”

কুড়ানি তাড়াতাড়ি কাপড়টা টানিয়া তাহা ঢাকিবার চেষ্টা করিল । যতীন দেখিল সে একগাছি শুকনো বকুলের মালা । তখন তাহার মনে পড়িল , সে মালাটা কী । ঘড়ির টিক্‌টিক্‌ শব্দের মধ্যে যতীন চুপ করিয়া বসিয়া ভাবিতে লাগিল । কুড়ানির এই প্রথম লুকাইবার চেষ্টা- নিজের হৃদয়ের ভাব গোপন করিবার এই তাহার প্রথম প্রয়াস । কুড়ানি মৃগশিশু ছিল , সে কখন হৃদয়ভারাতুর যুবতী নারী হইয়া উঠিল । কোন্‌ রৌদ্রের আলোকে , কোন্‌ রৌদ্রের উত্তাপে তাহার বুদ্ধির উপরকার সমস্ত কুয়াশা কাটিয়া গিয়া তাহার লজ্জা , তাহার শঙ্কা , তাহার বেদনা এমন হঠাৎ প্রকাশিত হইয়া পড়িল ।

রাত্রি দুটা-আড়াইটার সময় যতীন চৌকিতে বসিয়াই ঘুমাইয়া পড়িয়াছে । হঠাৎ দ্বার খোলার শব্দে চমকিয়া উঠিয়া দেখিল , পটল এবং হরকুমারবাবু এক বড়ো ব্যাগ হাতে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিলেন ।

হরকুমার কহিলেন , “ তোমার চিঠি পাইয়া কাল সকালে আসিব বলিয়া বিছানায় শুইলাম । অর্ধেক রাত্রে পটল কহিল , ‘ ওগো , কাল সকালে গেলে কুড়ানিকে দেখিতে পাইব না — আমাকে এখনই যাইতে হইবে । ‘ পটলকে কিছুতেই বুঝাইয়া রাখা গেল না, তখনই একটা গাড়ি করিয়া বাহির হইয়া পড়িয়াছি । ”

পটল হরকুমারকে কহিল , “ চলো , তুমি যতীনের বিছানায় শোবে চলো । ”

হরকুমার ঈষৎ আপত্তির আড়ম্বর করিয়া যতীনের ঘরে গিয়া শুইয়া পড়িলেন , তাঁহার নিদ্রা যাইতেও দেরি হইল না ।

পটল ফিরিয়া আসিয়া যতীনকে ঘরের এক কোণে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিল , “ আশা আছে ? ”

যতীন কুড়ানির কাছে আসিয়া তাহার নাড়ি দেখিয়া মাথা নাড়িয়া ইঙ্গিতে জানাইল যে , আশা নাই ।

পটল কুড়ানির কাছে আপনাকে প্রকাশ না করিয়া যতীনকে আড়ালে লইয়া কহিল , “ যতীন , সত্য বলো , তুমি কি কুড়ানিকে ভালোবাস না । ”

যতীন পটলকে কোনো উত্তর না দিয়া কুড়ানির বিছানার পাশে আসিয়া বসিল । তাহার হাত চাপিয়া ধরিয়া নাড়া দিয়া কহিল , “ কুড়ানি , কুড়ানি । ”

কুড়ানি চোখ মেলিয়া মুখে একটি শান্ত মধুর হাসির আভাসমাত্র আনিয়া কহিল , “ কী , দাদাবাবু । ”

যতীন কহিল , “ কুড়ানি, তোমার এই মালাটি আমার গলায় পরাইয়া দাও । ”

কুড়ানি অনিমেষ অবুঝ চোখে যতীনের মুখের দিকে তাকাইয়া রহিল ।

যতীন কহিল , “ তোমার মালা আমাকে দিবে না ? ”

যতীনের এই আদরের প্রশ্নটুকু পাইয়া কুড়ানির মনে পূর্বকৃত অনাদরের একটুখানি অভিমান জাগিয়া উঠিল । সে কহিল , “ কী হবে , দাদাবাবু । ”

যতীন দুই হাতে তাহার হাত লইয়া কহিল , “ আমি তোমাকে ভালোবাসি , কুড়ানি । ”

শুনিয়া ক্ষণকালের জন্য কুড়ানি স্তব্ধ রহিল ; তাহার পরে তাহার দুই চক্ষু দিয়া অজস্র জল পড়িতে লাগিল । যতীন বিছানার পাশে নামিয়া হাঁটু গাড়িয়া বসিল , কুড়ানির হাতের কাছে মাথা নত করিয়া রাখিল । কুড়ানি গলা হইতে মালা খুলিয়া যতীনের গলায় পরাইয়া দিল ।

তখন পটল তাহার কাছে আসিয়া ডাকিল , “ কুড়ানি । ”

কুড়ানি তাহার শীর্ণ মুখ উজ্জ্বল করিয়া কহিল , “ কী, দিদি । ”

পটল তাহার কাছে আসিয়া তাহার হাত ধরিয়া কহিল , “ আমার উপর তোর কোন রাগ নাই , বোন ? ”

কুড়ানি স্নিগ্ধ কোমলদৃষ্টিতে কহিল , “ না , দিদি । ”

পটল কহিল , “ যতীন , একবার তুমি ও ঘরে যাও । ”

যতীন পাশের ঘরে গেলে পটল ব্যাগ খুলিয়া কুড়ানির সমস্ত কাপড়-গহনা তাহার মধ্য হইতে বাহির করিল । রোগিণীকে অধিক নাড়াচাড়া না করিয়া একখানি লাল বেনারসি শাড়ি সন্তর্পণে তাহার মলিন বস্ত্রের উপর জড়াইয়া দিল । পরে একে একে এক-একগাছি চুড়ি তাহার হাতে দিয়া দুই হাতে দুই বালা পরাইয়া দিল । তার পরে ডাকিল , “ যতীন । ”

যতীন আসিতেই তাহাকে বিছানায় বসাইয়া পটল তাহার হাতে কুড়ানির একছড়া সোনার হার দিল । যতীন সেই হারছড়াটি লইয়া আস্তে আস্তে কুড়ানির মাথা তুলিয়া ধরিয়া তাহাকে পরাইয়া দিল ।

ভোরের আলো যখন কুড়ানির মুখের উপরে আসিয়া পড়িল তখন সে আলো সে আর দেখিল না । তাহার অম্লান মুখকান্তি দেখিয়া মনে হইল , সে মরে নাই — কিন্তু সে যেন একটি অতলস্পর্শ সুখস্বপ্নের মধ্যে নিমগ্ন হইয়া গেছে ।

যখন মৃতদেহ লইয়া যাইবার সময় হইল তখন পটল কুড়ানির বুকের উপর পড়িয়া কাঁদিতে কাঁদিতে কহিল , “ বোন , তোর ভাগ্য ভালো । জীবনের চেয়ে তোর মরণ সুখের । ”

যতীন কুড়ানির সেই শান্তস্নিগ্ধ মৃত্যুচ্ছবির দিকে চাহিয়া ভাবিতে লাগিল , ‘ যাঁহার ধন তিনিই নিলেন , আমাকেও বঞ্চিত করিলেন না । ‘

গল্পের প্রথম অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!