মালিকেরা—- দীপু মাহমুদ

এগারো দিন হলো সালমা প্রায় কিছুই মুখে দেয়নি। বেতন ভাতার দাবিতে অনশন শুরু করেছে। অথচ মাস তিনেক আগে ডাক্তার তাকে সুসংবাদ দিয়েছে- মা হবে সে।
খবর শুনে ইয়াকুবের আনন্দ ধরে না! ইয়াকুব সালমার স্বামী। রিকশা চালায়। সালমা কাজ করে গার্মেন্টসে। ইয়াকুব মোবাইলে ফোন করে ছোট বোনকে। বোনটা মায়ের সঙ্গে থাকে। ওদের বাড়ি ফরিদপুরের সালথায়। ফোন পেয়ে ছোট বোন মুন্নি চিৎকার করে ওঠে- মা, ও মা শোনো। তুমি দাদি হবা! তারপরই মুন্নি জানতে চায় ওদের বাড়ি যাওয়ার কথা।
ইয়াকুব বলে, এখন বাড়ি যাওয়া হবে না। ঈদে তোর ভাবিকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি যাব। মিষ্টি নিয়ে যাব।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর সালমাকে নিয়ে ঈদে বাড়ি যাওয়া হয় না ইয়াকুবের। তিন মাস সালমাদের গার্মেন্টসে বেতন দিচ্ছে না। কাজে যোগ দেওয়ার সময় বলেছিল, বেতনের সাথে ঈদের বোনাস পাওয়া যাবে। ওভারটাইম কাজের মজুরি পাওয়া যাবে। সামনে ঈদ। এখন কিছু দিচ্ছে না।
ইয়াকুব বলল, ঈদে বাড়ি গেলে অনেক খরচ। বাড়িতে এবার না যাই।
সালমা বাধা দিয়ে বলল, না যাও। মা কত আশা করে আছে। মুন্নি আছে।
ইয়াকুব জিজ্ঞেস করল, তুমি কী করবা?
সালমা বলল, আমি থাকি। আজ-কাইলের ভিতর বেতন দিতে পারে। পরশু ঈদ।
এরপর আর কথা আগায় না। ইয়াকুব রিকশার গ্যারেজে চলে যায়। রহমতউল্লাহকে সেখানেই পায় সে। রহমতউল্লাহ গ্যারেজের মহাজন। ইয়াকুব তার কাছে টাকা জমা রাখে। সেই টাকাগুলো সে ফেরত চেয়ে নেয়। তারপর দ্বিধা নিয়ে বলে, মহাজন, পাঁচশ টাকা হাওলাত দেন। বাড়ি যাব। বউয়ের বেতন হয় নাই। ঈদের সময়।
মহাজন একশ টাকার তিনটা নোট এগিয়ে দেয় ইয়াকুবের দিকে। টাকা নিয়ে সস্তায় মা আর মুন্নির জন্যে কিছু জিনিস কেনে ইয়াকুব।
ঈদের আগের দিন সকালে বাড়িতে রওনা হলো ইয়াকুব। স্বামীকে রওনা করিয়ে দিয়ে সালমা গেল বাড্ডার হোসেন মার্কেটে। সেখানেই ওদের গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি। বেতন ভাতার দাবিতে আজও অনশন শুরু করবে ওরা। ইয়াকুব থাকলে তাকে অনশন করতে দিত না। বলত, এই শরীরে না খেয়ে থাকবা!
ঈদের পর ইয়াকুবের ফিরে আসার কথা। সালমার মন খারাপটা এক সময় দুশ্চিন্তায় পরিণত হয়। বাড়ি যাওয়ার পর ইয়াকুব তার খোঁজ নেয়নি। কিন্তু এমন তো হওয়ার কথা না। মোবাইলটা কি হারিয়ে গেল? চার্জ নাই? মোবাইল বন্ধ।
নিজের পেটে আস্তে আস্তে হাত বুলাতে থাকে সালমা। ক্লান্ত লাগছে। খানিকটা অস্থিরতাও পেয়ে বসেছে তাকে। দিন চারেক হলো তার এই অস্থিরতা শুরু হয়েছে। কেন অস্থির লাগছে বুঝতে পারছে না। বুকের ভেতর ধকধক করছে। রাস্তার ওপর গতকালও পুলিশের সাথে গার্মেন্টস শ্রমিকদের মারামারি হয়েছে। পুলিশ কয়েকজন শ্রমিককে পিটিয়েছে।
শান্তভাবে নিজের পেটে হাত বুলাতে বুলাতে বিড়বিড় করে ওঠে সালমা, ভালো থাকিস মা। একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে।
সিঁড়িতে দুড়দাড় শব্দ হচ্ছে। বুটের শব্দ। হেলমেট মাথায়, লাঠি হাতে পুলিশ উঠে আসছে কারখানার দোতলায়। এক সময় ওদের ওপর চড়াও হলো পুলিশ। বেধড়ক লাঠিপেটা করে কারখানা থেকে বের করে দিতে চাইছে আন্দোলনরত শ্রমিকদের। সালমা তাড়াতাড়ি বড় একটা মেশিনের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল। পুলিশ যদি ধাক্কা দিয়ে তাকে ফেলে দেয়। যদি আচমকা পেটে লাথি মেরে বসে। সব পারে পুলিশ।
লাঠির বাড়িতে অনেক শ্রমিক ফ্লোরের ওপরই শুয়ে পড়েছে। বেতন না নিয়ে তারা কারখানা ছাড়বে না। পুলিশ পিপার স্প্রে করছে। নাকে-মুখে মরিচের মতো ঝাঁঝালো কিছু ঢুকে যাচ্ছে। সালমার চোখ জ্বলতে শুরু করে দিল। চোখ মুছতে মুছতে ছুটে কারখানা থেকে বের হয়ে এলো সে।
সালমার শরীর দুলছে। নেতিয়ে পড়েছে সে। হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে। চোখে পানির ঝাপটা দিয়েও ঝাঁঝ কাটেনি। বাসা কাছেই। তবু এখন মনে হচ্ছে অনেক দূর।
কোনমতে বাসার কাছে আসতেই পুনরায় ইয়াকুবের মুখটা মনে পড়ল তার। হঠাৎ করেই অভিমান হলো সালমার। বাড়ি গিয়ে মা বোনকে পেয়ে এভাবে ভুলে গেল তাকে! হঠাৎ পাশের ঘর থেকে সাথির মা বেরিয়ে এসে সালমার মুখোমুখি দাঁড়ায়। খবরটা সেই দেয়, মাওয়া ঘাটে লঞ্চ ডুবেছে। লঞ্চে মানুষ ছিল অনেক। সেই লঞ্চেই ইয়াকুব বাড়ি যাচ্ছিল।
এটুকু শুনেই সালমার বুক ফেটে কান্না আসে। সে চিৎকার করে ওঠে, না, ইয়াকুব বেঁচে আছে।
সালমা রওনা হয়েছে মাদারীপুর। সেখানে শিবচরের পাঁচ্চর ইশকুল মাঠে লঞ্চডুবিতে নিহতদের লাশ এনে রাখা হচ্ছে। ভীষণ দুর্বল লাগছে শরীর। আনমনে নিজের পেটে হাত বুলায় সালমা। ইয়াকুবের অস্তিত্ব তার শরীরের ভেতর। সালমা বুঝে গেছে সব মালিক এক। গার্মেন্টস কারখানার মালিক, লঞ্চের মালিক সবাই এক। এরা টাকা বোঝে, মানুষ বোঝে না। মানুষের জীবনের কোনো মূল্য নেই এদের কাছে।
সালমা পেটে হাত বুলাতে বুলাতে নিজের মনেই বলে ওঠে, মাগো, আমাদের ওরা মেরে ফেলল। তোরা বেঁচে থাকিস।
সালমা কাঁদছে। তার গাল বেয়ে টপ টপ করে পানি পড়ছে।

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!