নিত্য ‘না না’ করতে করতেই মাধব হারুর পিঠের ওপর দুম করে কিল বসিয়ে দিল। ওদিকে হারুও হেরে যাওয়ার পাত্র নয়। সে দাঁত খিঁচিয়ে, মুঠ পাকিয়ে ‘তবে রে’ বলে চেঁচিয়ে উঠে মাধবকে ধরে জুডোর প্যাঁচ কষতেই নিত্য মাঝখানে এসে দাঁড়াল।
‘এই থাম্, হচ্ছেটা কী অ্যা?’
কিন্তু থামতে বললেই থামছে কে? মাধবের মাথা গরম। আগে-পিছে ভেবে কাজ করার ছেলে সে নয়। নইলে এই পূজার সময় কেউ গায়ে হাত তোলে? ওদিকে হারুও হেরে যাওয়ার পাত্র নয়; পারলে সে পূজার নারুর মতো মাধবকে চিবিয়ে খেয়ে ফেলত কিন্তু নিত্যর জন্য সেটা হলো না। ফলে নিত্যর কাছেই সে অভিযোগটা দেয়, ‘দেখ না, বলছে আমাদের প্রতিমা নাকি ভালো হয়নি!’
নিত্যর পেছন থেকে মাথাটা বের করে মাধব বলে ওঠে, ‘খারাপ হলেও ভালো বলতে হবে নাকি?’
‘তোদেরটা বুঝি খুব ভালো হয়েছে, না?’ হারু পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে চন্দপাড়ার প্রতিমাটা দেখিয়ে বলে, ‘এই দেখ, তোদের সিংহটাকে তো বিড়ালের মতো মনে হচ্ছে। অসুরকে দেখে কোথায় হুংকার দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে তা নয়, দুই পায়ের মধ্যে লেজ সেধিয়ে বসে আছে।’
এতক্ষণে দুজনের ঝগড়ার কারণটা ধরতে পারে নিত্য। সে কিছু বলার আগেই মাধব চেঁচিয়ে ওঠে, ‘উ, আর তোদের অসুরটা যে জয়নাল মালির মতো পটকা দেখাচ্ছে তার কী হবে? আমাদের অসুরের এইট প্যাক বুঝলি! ও রকম বডি দেখেছিস কখনো?’
‘বডি না ছাই। ঢুসা। ঢুসা।’
দেলুয়া গ্রাম একেবারে ছোট নয়। গ্রামে চারটি পূজা হয়। সবাই বলছে এবার কর্মকার পাড়ার প্রতিমা সুন্দর হয়েছে। কিন্তু চন্দপাড়ার লোকেরা সে কথা মানতে নারাজ। তারা এবার যশোর থেকে পাল এনে প্রতিমা গড়েছে। শহর থেকে ভাড়া করে নিয়ে আসা হয়েছে ডেকোরেশনের সবকিছু। লাইটটাও মন্দ হয়নি, বাদ্যবাজনারও কমতি নেই, তাহলে তাদেরটা সুন্দর হবে না কেন?
নিত্য এ কথার সঠিক জবাব দিতে পারে না। তবে এটা ঠিক, কর্মকার পাড়ার ওরা পূজা করছে বছর তিনেক হলো, সেদিক দিয়ে চন্দপাড়ার কাছে তারা শিশু। তাই বলে তাদেরও জাঁকজমকের কমতি নেই। এই যেমন এবার ওরা প্রতিমা বসিয়েছে রথের ওপর। দেলুয়ায় এর আগে এমনটা কখনো হয়নি।
‘যাই বলিস, কর্মকারপাড়ার মণ্ডপের ডিজাইনটা কিন্তু সুন্দর হয়েছে!’ নিত্য এ কথা বলতেই মাধবের উত্সাহ দ্বিগুণ বেড়ে যায়। সে দুই আঙুলে টাস টাস চুটকি বাজিয়ে বলে, ‘আরে, আমি তো সে কথাই বলছি। কিন্তু ও মানছেই না।’
‘কার ঘাড়ে কয়টা মাথা যে মাধবের কথা অমান্য করে’, নিবারণ দাদু এগিয়ে এসে বলেন, ‘এই তোরা সবাই যে কাল পূজো দেখলি এই বুড়ো দাদুকে তো সঙ্গে নিলি না। আজ আমাকে একটু চন্দপাড়ার মণ্ডপে নিয়ে চল, মাকে প্রণাম করে আসি।’
‘ওখানে গিয়ে কী দেখবে?’ মাধব দাদুকে উল্টো প্রস্তাব দেয়, ‘চলো দাদু, কর্মকার পাড়ার প্রতিমাটা তোমায় দেখিয়ে আনি। ওদের প্রতিমাটা হ্যাব্বি হয়েছে!’
মাধাইয়ের কথায় দাদু চমকে ওঠে ‘সে কী রে! মায়ের আবার সুন্দর-অসুন্দর আছে নাকি?’
‘আছেই তো’, মাধব বলে, ‘নইলে সবাই বলছে কেন, এবার কর্মকার পাড়ার প্রতিমা ভালো হয়েছে।’ হারু দুই হাতের বুড়ো আঙুল নাকের সামনে তুলে ধরে বলে, ‘কচু ভালো হয়েছে! দাদু তুমি গিয়ে দেখে এসো ওদের কার্তিকের গোঁফের কী ছিরি! আর সরস্বতীর ওটা হাঁস না রাজহাঁস, সেটা যদি বুঝতে পারো তবে আমার নাম পাল্টে রেখো।’
‘যা, তোর নাম আমি এখনই পাল্টে দিলাম। হারুর বদলে নারু, হারু নারু, হারু নারু।’ মাধব সুর করে ছড়া কাটতেই দাদু হো হো করে হেসে ওঠেন। সেই হাসিতে নিত্যও যোগ দেয়। কিন্তু এরপর দাদু যে কথাটি বলেন তাতে সকলের হাসি থেমে যায়।
‘আচ্ছা, তোরা বুঝি তোদের মা কে সুন্দর, কে সুন্দর নয়—এ নিয়ে তর্ক করিস?’
‘কখ্খনো না।’ মাধব বলে।
‘উহু, নেভার।’ হারুও তাতে সায় দেয়।
‘তবে এই মাকে নিয়ে অহেতুক তর্ক কেন?’ দাদু বলেন, ‘শোন, মা তো মা-ই। পৃথিবীর কোনো মায়ের মুখ অসুন্দর হয় না। কার্তিকের গোঁফটা হয়তো পালমশায় ভালো আঁকতে পারেননি, কিন্তু ময়ূরটা নিশ্চয়ই সুন্দর হয়েছে, চল দেখে আসি।’
দাদুর কথায় ওদের ভুল ভাঙে। হারু ‘সরি’ বলে দাদুর সঙ্গে পা বাড়ায়। মাধবও হাঁটতে শুরু করে। আজকে ওরা দাদুকে নিয়ে চারটি প্রতিমাই দেখবে।
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।