মামুন সাহেবের মুরগি কেনা

রেজা সাহেব নিজ হাতে বাজার করতে পছন্দ করেন। তাইতো প্রতিদিন সকালে হাঁটতে হাঁটতে কাঁচা বাজারে চলে আসেন। বয়স তার সত্তর ছুঁই ছুঁই কিন্তু তাকে দেখে তার সঠিক বয়স আন্দাজ করার সাধ্যি কারো নেই। এখনো বেশ শক্ত-সমর্থ। বাজার শেষে দুহাতে বাজারের থলে নিয়ে আধ মাইল হেটে বাসায় যান। রোজকার মতো শাকসবজি কেনার পর আমিষ জাতীয় কিছু কেনার জন্য দেশী মুরগির দোকানে দাঁড়িয়ে মুরগি বাছাই করছিলেন তিনি।
‘মিডিয়াম সাইজের প্রায় দেড় কেজি হবে এমন দেখে ৪ টা মুরগি দাও’। পরিচিত কন্ঠের কথা শুনে রেজা সাহেব ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকালেন। দেখলেন তার প্রতিবেশী মামুন সাহেব ফার্মের মুরগির দোকানের চ্যাংড়া ছেলেটাকে মুরগির অর্ডার দিচ্ছেন।
‘এই যে মামুন সাহেব, কেমন আছেন? এই সাত সকালে বাজারে? আমার তো জানা ছিলো আপনি শুধু শুক্রবারে পুরো সপ্তাহের বাজার করেন’। স্মিত হেসে রেজা সাহেব বলে উঠলেন মামুন সাহেবের দিকে এগিয়ে গিয়ে।
‘আরে রেজা ভাই যে, এই তো আছি কোনোরকম। আপনার কি অবস্থা? বেশ কিছুদিন ধরে তো আপনাকে দেখাই যায় না’। বলে হাত বাড়িয়ে রেজা সাহেবের সাথে করমর্দন করলেন মামুন সাহেব।
‘জমির কাজের ব্যাপারে ৩-৪ দিনের জন্য গ্রামের বাড়ি গিয়েছিলাম। কাল সন্ধ্যায় বাসায় ফিরেছি তো তাই দেখা সাক্ষাত হয়নি’।
‘তাই তো বলি, রেজা সাহেবের দেখা নেই কেনো? বয়স তো আর কম হলো না। দিনকাল খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। অসুখ বিসুখ লেগেই আছে। ডাক্তার বললেন সকালে হাঁটাহাঁটি করার জন্য। তাই হাঁটাহাঁটির পাশাপাশি বাজারটাও সেরে ফেলতে আসলাম আরকি। কয়দিনই বা বাঁচবো, ভালোমন্দ যা খাওয়া যায় খেয়ে নেই’।
‘তাই বলে কি মন্দ খাবেন নাকি? খাবেন যখন ভালোটাই খাবেন’।
‘কি যে বলেন ভাই, মন্দ খাবো কেনো? ওটা তো কথার কথা। মন্দ কি আর কেও ইচ্ছা করে খায় নাকি?’
‘তাহলে এটা কি করছিলেন?’ আঙুল তুলে ফার্মের মুরগির দিকে ইশারা করলেন রেজা সাহেব।
‘কেন ফার্মের মুরগিতে কি সমস্যা? ফার্মের মুরগিতে তো বেশি পুষ্টি। ওরা তো মুরগিকে ভালো ভালো খাবার দেয়, ভিটামিন দেয়, যত্ন করে’।
ফার্মের মুরগি সম্পর্কে মামুন সাহেবের ধারণা দেখে রেজা সাহেবের হাসি পেয়ে গেল। বেশ কষ্টে হাসি সংবরণ করে তিনি বললেন, ‘ফার্মের মুরগিকে যে খাবার দেয়া হয় তার সাথে মেশানো হয় ট্যানারির চামড়ার উচ্ছিষ্ট। এগুলো মুরগির দ্রুত মোটাতাজা করার জন্য বেশ কার্যকর প্রোটিন’।
‘তাহলে তো এগুলোর মাংস খেলে আমাদের ভালোই হবে। বাচ্চাকাচ্চারা আরো ভালোভাবে বেড়ে উঠবে’। খুশি খুশি গলায় বলে উঠলেন মামুন সাহেব।
‘উঁহু, অনেক ক্ষতি হবে’। মাথা নাড়লেন রেজা সাহেব। মামুন সাহেবের জিজ্ঞাসু দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে একটু চুপ থেকে বলে উঠলেন, ‘ট্যানারির চামড়াতে ক্রোমিয়াম ব্যবহার করা হয় যা মানব দেহের জন্য খুব ক্ষতিকর। মানুষের দেহে ক্রোমিয়ামের সহনীয় মাত্রা হচ্ছে দিনে মাত্র ৩৫ মাইক্রোগ্রাম। বাচ্চাদের জন্য এর সহনীয় মাত্রা তো আরো অনেক কম। কিন্তু তা এই মুরগিতে রয়েছে অনেকগুণ বেশী পরিমাণে’।
‘মাংস রান্না করলে কি আর ওইসব ক্রোমিয়াম থাকে নাকি?’ রেজা সাহেবের কথা শেষ করার আগেই মাঝখান থেকে হঠাৎ করে বাচ্চাদের মতো প্রশ্ন করে বসলেন মামুন সাহেব।
‘ক্রোমিয়ামের বয়েলিং পয়েন্ট হচ্ছে ২৬৭১ ডিগ্রী সেন্ট্রিগেড। তাই রান্না করার সময় ১০০ ডিগ্রীতে তা নষ্ট হবার প্রশ্নই আসে না। এই ক্রোমিয়াম শরীরের ওপরে তার বিষের প্রভাব ফেলে ধীর গতিতে। এক নাগাড়ে এত ক্রোমিয়াম দেহে যেতে থাকলে কিডনী ও লিভারের নানারকম রোগ দেখা দেবে’।
‘বলেন কি? এতো ভীষণ ব্যাপার’। অজানা এসব তথ্য শুনে মামুন সাহেবের চোখ কপালে উঠার দশা।
‘শুধু মুরগির খাবারে নয়, মাছের খাবারেও থাকে প্রচুর পরিমাণে ক্রোমিয়াম। ফার্মের মুরগির রোগবালাই দূর করার জন্য ব্যবহার করা হয় উচ্চ মাত্রার অ্যান্টিবায়োটিক। মুরগি ও ফার্মের মুরগির ডিমে এই সিপ্রোফ্লক্সাসিন জাতের অ্যান্টিবায়োটিকের পরিমাণ আমাদের দেহের সহনীয় মাত্রার চেয়েও প্রায় ৫ গুণ বেশী’।
‘হায় হায়, না জেনে শুনে কি যে খাচ্ছি?’
রেজা সাহেব খেয়াল করলেন আশে পাশে আরো যে কয়েকজন দাঁড়িয়ে আছে তারাও তার কথা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছে। মামুন সাহেবের অর্ডার করা মিডিয়াম সাইজের ফার্মের মুরগির পা ধরে শুন্যে ঝুলিয়ে দোকানের ছেলেটাও হাঁ করে রেজা সাহেবের কথা গিলছে। রেজা সাহেব তার দিকে তাকাতেই সে অবাক চোখে একবার মুরগি দেখে আরেকবার রেজা সাহেবকে দেখে।
বোকা বোকা দৃষ্টি নিয়ে ছেলেটা বলে উঠলো, ‘স্যার, খাওনে যদি বিষ থাকে তয় মুরগি মরে না কেন?’
রেজা সাহেব একটু রঙ্গ করেই বললেন, ‘তোমরা মুরগিকে মরার টাইম দেও নাকি? মুরগিতো আগেই খালাস করে দাও। আগেই তো বললাম এ বিষ কাজ করে ধীর গতিতে। ফার্মের মুরগিতো বেশী বেশী খাওয়া পেয়ে বড় হয়ে যায় ১-২ মাসেই’।
ছেলেটা কিছু না বলে শুধু মাথা নাড়ে, তার প্রশ্নের উত্তর সে পেয়ে গেছে।
মামুন সাহেব তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, ‘রেখে দাও মুরগি। আমি আর খাচ্ছি না ফার্মের মুরগি। আজ থেকে শুধুই দেশী মুরগি কিনবো’।
ফার্মের মুরগি কেনার জন্য আরো কয়েকজন যারা দোকানের সামনে ভিড় করেছিলেন তারাও সরে এসে দাঁড়ালেন দেশী মুরগির দোকানীর মুরগির ঝাঁকার কাছে। সাত সকালে একসাথে এতগুলো কাস্টমার দেখে দেশী মুরগি বিক্রেতার দাঁত বত্রিশটা বের হয়ে গেল।

দুঃখিত!