‘হি হি হি.. .. ! কী যে বলো না! তুমি অনেক দুষ্টু!’
সোমার মুখে দুধসর হাসি। হাসির এ নামকরণ বাবার করা। এ হাসিতে হো হো করে শব্দ হয় না। মুখের ঝাঁপ খুলে বত্রিশ দাঁতের দোকান খুলে দেওয়া হয় না। ঘন জ্বাল দেওয়া দুধ খেলে সরের প্রলেপ ঠোঁটের ওপর যেমন থাকে, তেমনি লেগে থাকে এ হাসি। তাই দুধসর হাসি নাম।
মা সামনে দাঁড়ানো। অংকের টিচারের মতো। বেতটা হাতে নেইÑ শুধু এটুকু পাথর্ক্য। চোখ মটকে মা বলেন, ‘কে? কে রে? কে ফোন করেছে?’
‘আর বলো না, রাস্তার পিচ ঢালার পর ইয়া মোটকা একটা রোলার দিয়ে গড় গড় গড় করে রাস্তা পালিশ করা হয় না! সেটা চলছে এখন। সেই জন্য ডিস্টার্ব হচ্ছে। শব্দ শুনতে পাচ্ছ না?’
‘কী? কাকে তুই রোলার বললি? কাকে মোটকা বললি? দাঁড়া দেখাচ্ছি!’
মায়ের কোমরে দু’হাত। চারপাশে চোখ বোলান। কী যেন খোঁজেন। বেত নাকি ব্যাটÑ বোঝা যায় না।
‘কী যে বলো না মা! তুমি কি মোটা? নাকি রোলার? বড় জোর বোলার হতে পারো। বোলার মানে যে বলে আর কী! সারাক্ষণ বলে। মানে বকবকম বকবকম..। আরে, তুমি মোটা হলে স্লিম কে? ছিঃ মা, নিজের সম্বন্ধে তোমার এত গ্রাউন্ড কনসেপ্ট?’
‘কী, কী বলিল তুই আবার? গ্রাউন্ডের সেপ্টিক ট্যাংক কাকে বললি?’
‘সেপ্টিক ট্যাংক কেন বলব? ছিঃ মা, এত ছোট মন তোমার! আমি বলেছি গ্রাউন্ড কনসেপ্ট। গ্রাউন্ড হল নিচ আর কনসেপ্ট হল ধারণা। তোমার নিজের সম্বন্ধে নিচু ধারণা!’
‘ফোন কে করেছে, তাই বল?’ মা কিছুটা ঠাণ্ডা হন।
‘তোমার চারকোণা।’
‘চারকোণা মানে? আমি কি চারকোণা? তার মানে মোটা?’ মায়ের চোখ ছলছল।
‘ছিঃ মা! এই সহজ জোকটাও তুমি বোঝো না? তুমি একটা স্ট্রেট লাইন। থাক বাপু স্ট্রেট লাইন না, তুমি আবার কী বুঝতে কি বোঝো! তুমি আমার সোজা সরল মা। শোন, চারকোণা মানে হল স্কোয়ার। আর তুমি, মানে মা স্কোয়ার মানে মামা। বুঝলে এতক্ষণে?’
শুনে মায়ের মুখে হাসি ফোটে। বলেন, ‘তোর এত বাঁদরামি কবে বন্ধ হবে? সোজাসাপ্টা বলতে পারিস না? কে ফোন করেছিল, মন্টু না তুই?’
‘মামা ফোন করেছিল। মামা আসছে। সামনের সোমবার।’
শুনে মায়ের মুখের হাসি বিস্তৃত হয়। সোমা বলে, ‘এই তো দেখি, টুথপেস্ট হাসি। ভাইয়ের কথা শুনে দিল ঠাণ্ডা। মিঠাই মাণ্ডা।’
২
রান্নাঘরের পাশে একটা ছোট রুম আছে। তাতে রাজ্যের বাতিল জিনিসপাতি ঢাঁই করে রাখা। মা বলেন স্টোর রুম। সোমা আর তার ছোট বোন নুহার কাছে এটা গোয়েন্দা ঘর। ওরা ওদের পড়া প্রিয় গোয়েন্দা সিরিজে দেখেছে, গোয়েন্দাদের আলাদা একটা রুম থাকে। তারা দুজনেই নিজেকে গোয়েন্দা ভাবে। কোনও কিছু চিন্তা করার প্রয়োজন হলে এ রুমে এসে দু’হাঁটুতে মাথা গুঁজে ভাবে। আব্বু তাই এ রুমের নাম দিয়েছেন ভাবনা ঘর।
এখন অবশ্য দু’বোন একসাথে ভাবনা ঘরে আশ্রয় নিয়েছে। মামা আসছে। ফোনে জানতে চেয়েছে, কী আনবে। তাদের কী চাই, জানাতে। সোমা অবশ্য বলে দিয়েছে, তাদের কিছু লাগবে না। তারপরও। মামা মুরব্বি মানুষ। একটা কথা বলেছে, সেটা অগ্রাহ্য করে কী করে?
সোমা আর নুহা মাথায় মাথা ঠেকিয়ে বসে বসে ভাবছে। আর ভাবছে।
৩
‘শামসুর রহমান সাহেব, আপনার একটা চিঠি।’
শামসুর রহমান সাহেব অবাক হন। কে চিঠি লিখবে তাকে? আজকাল কেউ চিঠি লেখে নাকি?
তার তাড়া খুব। আজ রাতের ট্রেনে ঢাকা যাবেন। অফিসের কাজ গোছানো হয়নি এখনও। তারপর কিছু অ্যাডভান্স নিতে হবে। সপ্তাহ খানেকের জন্য যাচ্ছেন ঢাকা। সেখানে বোন, দুলাভাই আর দুই ভাগ্নি আছে।ওদের জন্য কিছু কেনা হয়নি এখনও। কী কেনা যায়? ভাগ্নিকে জিগ্যেস করেছিল, কী লাগবে ওদের। কিছুই বলেনি। মেয়েটা এত দুষ্টু! আর মিষ্টিও। ঢাকা গেলে ওকে ছেড়ে আসতে ইচ্ছে করে না। ভাবতে ভাবতে খাম খোলেন। দেখেন, আঁকাবাঁকা হাতের লেখা।
‘মামা,
তুমি কেমন আছো?
তোমাকে অনেকদিন দেখি না। তুমি আমাদের বাসায় আসবে শুনে আমি আর নুহা খুব খুশি। শোনো, আমাদের জন্য কিছু আনতে হবে না। তুমি আমাদের বাসায় এলেই আমরা খুশি। আমাদের পাশের বাসার মিমি আছে না! ওর চাচ্চু ওর জন্য বারবি ডল এনেছে। ও চেয়েছে, তাই এনেছে। আমরা কিন্তু ওর মতো ছোঁচা না। তোমার কাছে বারবি ডল চাইছি না।
জানো, পুতুলটা না শোয়ালে ঘুমিয়ে পড়ে। আবার দাঁড় করালে হাসে। তুমি কবে আসবে? বেশি রাত করবে না কিন্তু। জানো, বাইরে চোর ডাকাত আছে!
ইতি।
তোমার প্রিয় সোমা ও নুহা
চিঠিটা ভাঁজ করতে করতে মৃদু হাসি ফোটে শামসুর রহমানের ঠোঁটে। ভাবেন, যাক একটা ভাবনা দূর হল।
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।