শিবু বিস্ময়ে হতবুদ্ধি হইয়া শুধু কহিল, তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?
সেদিন সন্ধ্যার পর পাঁচু সদর হইতে ফিরিয়া আসিয়া শ্রান্তভাবে ধপ করিয়া বসিয়া পড়িল। শিবু গরুর জন্য খড় কুচাইতেছিল, অন্ধকারে তাহার মুখের চোখের চাপা হাসি লক্ষ্য করিল না—সভয়ে জিজ্ঞাসা করিল, কি হ’লো ?
পাঁচু গাম্ভীর্যের সহিত একটু হাস্য করিয়া কহিল, পাঁচু থাকলে যা হয় তাই! ওয়ারিন্ বের করে তবে আসচি। এখন কোথায় আছে জানতে পারলেই হয়।
শিবুর কি-একপ্রকার ভয়ানক জিদ চড়িয়া গিয়াছিল। সে কহিল, যত খরচ হোক, ছোঁড়াকে ধরাই চাই। তাকে জেলে পুরে তবে আমার অন্য কাজ। তার পরে উভয়ের নানা পরামর্শ চলিতে লাগিল। কিন্তু রাত্রি এগারোটা বাজিয়া গেল, ভিতর হইতে আহারের আহ্বান আসে না দেখিয়া, শিবু আশ্চর্য হইয়া রান্নাঘরে গিয়া দেখিল ঘর অন্ধকার।
শোবার ঘরে ঢুকিয়া দেখিল, স্ত্রী মেজের উপর মাদুর পাতিয়া শুইয়া আছে। ক্রুদ্ধ এবং আশ্চর্য হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, খাবার হয়ে গেছে ত আমাদের ডাকিস নি কেন?
গঙ্গামণি ধীরে সুস্থে পাশ ফিরিয়া বলিল, কে রাঁধলে যে খাবার হয়ে গেছে?
শিবু তর্জন করিয়া প্রশ্ন করিল, রাঁধিস নি এখনো?
গঙ্গামণি কহিল, না। আমার শরীর ভাল নেই, আজ আমি পারব না।
নিদারুণ ক্ষুধায় শিবুর নাড়ী জ্বলিতেছিল, সে আর সহিতে পারিল না। শায়িত স্ত্রীর পিঠের উপর একটা লাথি মারিয়া বলিল, আজকাল রোজ অসুখ, রোজ পারব না! পারবি নে ত বেরো আমার বাড়ি থেকে।
গঙ্গামণি কথাও কহিল না, উঠিয়াও বসিল না। যেমন শুইয়াছিল, তেমনি পড়িয়া রহিল। সে রাত্রে শালা-ভগিনীপতি কাহারও খাওয়া হইল না।
সকালবেলা দেখা গেল, গঙ্গামণি বাটীতে নাই। এদিকে ওদিকে কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর পাঁচু কহিল, দিদি নিশ্চয়ই আমাদের বাড়ি চলে গেছে।
স্ত্রীর এইপ্রকার আকস্মিক পরিবর্তনের হেতু শিবু মনে মনে বুঝিয়াছিল বলিয়া তাহার বিরক্তিও যেমন উত্তরোত্তর বাড়িতেছিল, নালিশ মকদ্দমার প্রতি ঝোঁকও তেমনি খাটো হইয়া আসিতেছিল। সে শুধু বলিল, চুলোয় যাক, আমার খোঁজবার দরকার নেই।
বিকালবেলা খবর পাওয়া গেল, গঙ্গামণি বাপের বাড়ি যায় নাই। পাঁচু ভরসা দিয়া কহিল, তা হলে নিশ্চয় পিসীমার বাড়ি চলে গেছেন।
তাহাদের এক বড়লোক পিসী ক্রোশ পাঁচ-ছয় দূরে একটা গ্রামে বাস করিতেন। পূজা-পর্ব উপলক্ষে তিনি মাঝে মাঝে গঙ্গামণিকে লইয়া যাইতেন। শিবু স্ত্রীকে অত্যন্ত ভালবাসিত। সে মুখে বলিল বটে, যেখানে খুশি যাক গে! মরুক গে! কিন্তু ভিতরে ভিতরে অনুতপ্ত এবং উৎকণ্ঠিত হইয়া উঠিল। তবুও রাগের উপর দিন পাঁচ-ছয় কাটিয়া গেল। এদিকে কাজকর্ম লইয়া, গরু-বাছুর লইয়া সংসার তাহার একপ্রকার অচল হইয়া উঠিল। একটা দিনও আর কাটে না এমনি হইল।
সাতদিনের দিন সে আপনি গেল না বটে, কিন্তু নিজের পৌরুষ বিসর্জন দিয়া পিসীর বাড়িতে গরুর গাড়ি পাঠাইয়া দিল।
পরদিন শূন্য গাড়ি ফিরিয়া আসিয়া সংবাদ দিল সেখানে কেহ নাই। শিবু মাথায় হাত দিয়া বসিয়া পড়িল।
সারাদিন স্নানাহার নাই, মড়ার মত একটা তক্তপোশের উপর পড়িয়াছিল, পাঁচু অত্যন্ত উত্তেজিতভাবে ঘরে ঢুকিয়া কহিল, সামন্তমশাই, সন্ধান পাওয়া গেছে।
শিবু ধড়মড় করিয়া উঠিয়া বসিয়া কহিল, কোথায়? কে খবর দিলে? অসুখ-বিসুখ কিছু হয়নি ত? গাড়ি নিয়ে চল্ না এখুনি দু’জনে যাই।
পাঁচু বলিল, দিদির কথা নয়—গয়ার সন্ধান পাওয়া গেছে।
শিবু আবার শুইয়া পড়িল, কোন কথা কহিল না।
তখন পাঁচু বহুপ্রকারে বুঝাইতে লাগিল যে, এ সুযোগ কোনও মতে হাতছাড়া করা উচিত নয়। দিদি ত একদিন আসবেই, কিন্তু তখন আর এ-ব্যাটাকে বাগে পাওয়া যাবে না।
শিবু উদাসকণ্ঠে বলিল, এখন থাক গে পাঁচু! আগে সে ফিরে আসুক—তার পরে—
পাঁচু বাধা দিয়া কহিল, তার পরে কি আর হবে সামন্তমশাই? বরঞ্চ দিদি ফিরে আসতে না আসতে কাজটা শেষ করা চাই। সে এসে পড়লে হয়ত আর হবেই না।
শিবু রাজী হইল। কিন্তু আপনার খালি ঘরের দিকে চাহিয়া পরের উপর প্রতিশোধ লইবার জোর আর সে কোনমতেই নিজের মধ্যে খুঁজিয়া পাইতেছিল না। এখন পাঁচুর জোর ধার করিয়াই তাহার কাজ চলিতেছিল।
পরদিন রাত্রি থাকিতেই তাহারা আদালতের পেয়াদা প্রভৃতি লইয়া বাহির হইয়া পড়িল। পথে পাঁচু জানাইল, বহু দুঃখে খবর পাওয়া গেছে, শম্ভু তাহাকে পাঁচলার সরকারী পুলের কাজে নাম ভাঁড়াইয়া ভর্তি করিয়া দিয়াছে—সেইখানেই তাহাকে গ্রেপ্তার করিতে হইবে।
শিবু বরাবর চুপ করিয়াই ছিল, তখনও চুপ করিয়া রহিল।
তাহারা গ্রামে যখন প্রবেশ করিল, তখন বেলা দ্বিপ্রহর। গ্রামের একপ্রান্তে প্রকাণ্ড মাঠ, লোকজন, লোহা-লক্কড়, কল-কারখানায় পরিপূর্ণ—সর্বত্রই ছোট ছোট ঘর বাঁধিয়া জনমজুরেরা বাস করিতেছে—অনেক জিজ্ঞাসাবাদের পর একজন কহিল, যে ছেলেটি সাহেবের বাংলা লেখাপড়ার কাজ করচে, সে ত? তার ঘর ঐ যে—বলিয়া একখানা ক্ষুদ্র কুটীর দেখাইয়া দিলে, তাহারা গুঁড়ি মারিয়া পা টিপিয়া অনেক কষ্টে তাহার পাশে আসিয়া দাঁড়াইল। ভিতরে গয়ারামের গলা শুনিতে পাওয়া গেল। পাঁচু পুলকে উচ্ছ্বসিত হইয়া পেয়াদা এবং শিবুকে লইয়া বীরদর্পে অকস্মাৎ কুটীরের উন্মুক্ত দ্বার রোধ করিয়া দাঁড়াইবামাত্রই তাহার সমস্ত মুখ বিস্ময়ে, ক্ষোভে, নিরাশায় কালো হইয়া গেল। তাহার দিদি ভাত বাড়িয়া দিয়া একটা হাতপাখা লইয়া বাতাস করিতেছে এবং গয়ারাম ভোজনে বসিয়াছে।
শিবুকে দেখিতে পাইয়া গঙ্গামণি মাথায় আঁচলটা তুলিয়া দিয়া শুধু কহিল, তোমরা একটু জিরিয়ে নিয়ে নদী থেকে নেয়ে এসো গে, আমি ততক্ষণ আর এক হাঁড়ি ভাত চড়িয়ে দিই।
গল্পের প্রথম অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।