এ ক লোক একবার ভীষণ বিপদে পড়েছিল। কোনো কিছুতেই উদ্ধারের সম্ভাবনা দেখা গেল না। কেউ কেউ তাকে পরামর্শ দেয়, সত্যপীরের দরগায় গিয়ে মানত করো। তোমার বিপদ কেটে যাবে।
তাদের বুদ্ধিটা তার মনে ধরে। সে সত্যপীরের দরগায় গিয়ে হাত তুলে মানত করে, যদি তার বিপদ কেটে যায় সে তার আথালের একটি বলদ সত্যপীরের নামে ছেড়ে দেবে।
অল্পদিনের মধ্যেই লোকটি বিপদ থেকে মুক্ত হয়। সে সুখ-শান্তিতে সংসার করতে থাকে।
বেশ কিছুকাল কেটে যায়। লোকটি তার বলদ সত্যপীরের নামে আর ছেড়ে দেয় না। একসময় সে তার প্রতিজ্ঞার কথা বেমালুম ভুলে যায়।
একদিন সে মাঠে কাজ করছিল। আশপাশে কোথাও কেউ ছিল না। সে একা। কে যেন পেছন থেকে তার কানের কাছে বলল, তুমি যে আমাকে একটি গরু দিতে চেয়েছিলে তা তো এখনও দিলে না।
লোকটি পেছনে ও ডানে বাঁয়ে তাকিয়ে দ্যাখে কোথাও কেউ নেই।
সে ভাবল, সত্যপীরের আত্মাই হয়তো তার কানের কাছে এসে তাকে এ কথা বলেছে।
লোকটি তখন মনে মনে অদৃশ্য সত্যপীরের উদ্দেশে বলল- আমার মাত্র এক জোড়া বলদই আছে। তার একটি আপনাকে দিলে আমার চাষাবাদের কাজে অসুবিধা হবে। আমার কয়েকটি ছাগল আছে। তার একটি আমি আপনার নামে ছেড়ে দেব।
আবার অনেকদিন কেটে যায়। ছাগল দেয়ার কথাও ভুলে যায় লোকটি। বাজারে ছাগল-খাসির দামও খুব চড়া।
একদিন দুপুরে সে ঘুমাচ্ছিল। তার বউঝি কেউই বাড়িতে ছিল না। ঘুমের ঘোরে সে শুনতে পেল, কে যেন তাকে বলে গেল, তোমার বকরিটাও তো আমাকে দিলে না। এত দেরি কেন?
চোখ খুলে লোকটি দ্যাখে ঘর খালি। বাড়িতে কেউই নেই। সে বুঝল সত্যপীরই তাকে তার প্রতিশ্রুতির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।
এবার লোকটি সত্যপীরের উদ্দেশে বলল, আগামী মাসে আমার মেয়ের বিয়ে। অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলে। অনেক খরচাপাতি করে বিয়ে দিতে হবে। আমার হাত টানাটানি। কয়েকটি ছাগলের খাসি বিক্রি করতে হবে। আর কয়েকটি মেহমানদের আপ্যায়ন করতে জবাই করতে হবে। আমার খোপে বেশকিছু মোরগ-মুরগি আছে। তার একটি মোরগ আপনার নামে ছেড়ে দেব কালই।
লোকটির মেয়ের বিবাহ ভালো মতো হয়ে গেল।
একদিন সন্ধ্যার কিছু পর গ্রামের হাট থেকে সে একা বাড়ি ফিরছিল। ছোট একটি ফসলের মাঠ পার হতে হয়। ক্ষেতের সরু আলপথ দিয়ে সে যাচ্ছে। এক হাতে হাট থেকে কেনা কিছু জিনিসপত্র, আরেক হাতে স্ত্রীর জন্য কেনা একটি শাড়ি। হঠাৎ মনে হল, কে যেন তাকে বলল, কই মোরগটাও তো আজও দিলে না।
মেয়ে বিয়ে দেয়ার পর জামাইবাড়ি থেকে ঘন ঘন মেহমান আসে। নতুন আত্মীয়। কুটুম্বদের খাতির-যত্ন করতে মোরগ-মুরগি জবাই করতে হয়। লোকটি ধান-পাটের মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে কী ভাবল। ক্ষেতের মধ্যে উড়াউড়ি করছিল বড় বড় ফড়িং। সে মনে মনে সত্যপীরের উদ্দেশে বলল, আপনার নিজের জন্য তো কিছুই দরকার নেই। আবার চাইলে আপনি সবই পেতে পারেন। আপনি শুধু আমার ইমান পরীক্ষা করছেন। আমি সব বুঝি। দিতে যখনই চেয়েছি তখন আমার ওয়াদা আমি রক্ষা করব। মুরগি না দেই। কিছু একটা দেবই।
মনে মনে বলে কয়েক কদম এগিয়ে যেতেই আবার কাউকে পিঠের কাছে কথা বলতে শোনা গেল : আর কিছু না দাও ক্ষেতের ভেতর থেকে ধরে একটি ফড়িং তো দিতে পার।
ফড়িং দেয়া আর কষ্ট কী? একদিন ক্ষেতের মধ্যে থেকে ধরে সত্যপীরের নামে ছেড়ে দেব। লোকটি ভাবে।
কিন্তু নানা ঝামেলায় লোকটি ফড়িং ধরে সত্যপীরের নামে ছেড়ে দেয়ার কথাও ভুলে গেল।
বেশ সুখেই কাটে তার দিন। একদিন গরুগুলোকে নিয়ে লোকটি নদীর পাড়ে যাচ্ছে, তার স্ত্রী ছুটে এলো তার দিকে। তার চোখে মুখে জ্বলজ্বল করছে খুশি। বলল, শুনেছ তোমার নাতি হবে। মেয়ে তোমার পোয়াতি।
নাতি হওয়ার কথা শুনে খুশিতে লোকটি একটি খাসি জবাই দিয়ে আত্মীয়স্বজনকে মেজমানি দেয়।
একদিন সন্ধ্যার আগে লোকটি তার বাঁধাকপির ক্ষেতে পানি দিচ্ছে, ঘাড়ের কাছে মনে হল কেউ দাঁড়িয়ে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখার আগেই কানে এলো তার কথা- ফড়িংটাও দিলে না?
এবার লোকটির রাগ হল। বিরক্তির সঙ্গে মনে মনে বলল, সারা দুনিয়ায় কত ফড়িং। ফড়িংটাও কি আমাকেই ধরে দিতে হবে। নানা ঝামেলায় বাঁচি না।
সত্যপীর এবার বিরক্ত ও নাখোশ হলেন। লোকটিকে আর কিছু না বলে নিজে নিজেই বললেন, যাও তোমাকে আর কিছুই দিতে হবে না।
লোকটির সুখ-শান্তিতে দিন কাটছিল। হঠাৎ কী এক মামলার নোটিশ আসে সদর থেকে। সেই নোটিশ নিয়ে পান চিবোতে চিবোতে উকিলের বাড়ি যাচ্ছিল। বগলে ছাতা। অন্যদিক থেকে একজন লোক দৌড়ে এলো তার কাছে। সে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই ওই লোকটি জানালো, সকাল থেকে তার মেয়ের প্রসব ব্যথা উঠেছে। খুব রক্তস্রাব হবে। বাঁচে কিনা সন্দেহ।
লোকটি হন্হন্ করে চলে যাচ্ছিল। ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, খবরটা আপনের বেয়াই আপনাকে জানাইতে কইছে। আমি মোবারক ডাক্তারকে খবর দিতে যাইতেছি।
পথের মধ্যে থমকে দাঁড়ায় লোকটি। উকিলের বাড়ি যাবে না মেয়ের শ্বশুরবাড়ি যাবে সে সিদ্ধান্ত নেয়ার মতো সময় তার নেই। তার প্রথম মনে পড়ল তার বলদ দুটোর কথা। সঙ্গে সঙ্গেই নিজের মেয়ের কথা নয় তার মনে পড়ল গ্রামের হাজী সাহেবের মেয়ের কথা, সে মেয়েটি তিন বছর আগে সন্তান প্রসবকালে মারা গেছে। কয়েক মিনিট কী ভাবল লোকটি। এবার মনে মনে নয়, রাস্তায় দাঁড়িয়ে জোরে জোরেই সত্যপীরের উদ্দেশে বলল, আমার গোয়ালে যে এক জোড়া বলদ আছে ওই দুইটাই আমি আজ বিকালেই আপনার নামে ছেড়ে দেব। আমার মেয়ের জীবন রক্ষা করুন।
সত্যপীর এবার তার কথায় কোনো সাড়া দিলেন কিনা তা সে জানতে পারল না।
লেখক : গবেষক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।