মানুষরূপী কাকের গল্প

ফরিদ আলীর টিনের চালে ১০-১২টা কাক সমস্বরে ডাকছে। দুপুরবেলার কাঁচা ঘুম ভেঙে যাওয়ায় মহা বিরক্ত হল ফরিদ আলী।
হুই-স-স-স-স-স করে মুখ দিয়েই জোরে শব্দ করার চেষ্টা করল সে—শব্দ শুনে কাকগুলো যদি পালায়।
ফরিদ আলীর শব্দ শুনে কাকগুলো মনে হয় উৎসাহ পেল। কা কা শব্দে ঘরে টেকাই দায় হয়ে পড়ল।

প্রচণ্ড অনিচ্ছা নিয়ে বিছানা থেকে নামল ফরিদ আলী। কেন জানি সে কাক সহ্য করতে পারে না। অথচ রাজ্যের সব কাকের বাসা তার বড় আমগাছটাতে। এত কাকের সাথে বাস করতে করতে সখ্যতা গড়ে ওঠাই স্বাভাবিক ছিল, কিন্তু কাক ফরিদ আলীর দুই চোখের বিষ।

লোকে কাককে ঝাড়ুদার পাখি বলে—এই তার কারণ। ফরিদ আলীর সাত পুরুষের কেউ ঝাড়ুদারের কাজ করে নি। তবু লোকে তাকে ঝাড়ুদার ডাকে।

বিয়ে করেনি ফরিদ আলী। ছোট ভিটায় দুই চালা টিনের ঘর। ঘরের সামনে আমগাছের নিচে অনেক দিনের পুরনো একটা বাঁশের মাচা—দেখলেই মনে হয় ভেঙে পড়বে। ফরিদ আলীর সারা দিন কাটে সেই মাচায় বসে।

গ্রামবাসীর কাছে মাচাটা ভেঙে না পড়ার মতোই রহস্যময় তার আয়ের উৎস। দু-একজন মানুষ অবশ্য তার আয়ের উৎস জানে। তারাই তাকে ঝাড়ুদার বলে ডাকে।

মাটির হাঁড়ি থেকে পানি ঢালল ফরিদ আলী। প্রচণ্ড পিপাসা অনুভূত হচ্ছে। এক চুমুক দিতেই থু থু করে ফেলে দিল—পানি তো নয় যেন লবণ-গোলা জল। অথচ ঘুমাবার আগেও এই পানি খেয়েছে সে।

শূন্য গ্লাসের দিকে বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। শূন্য গ্লাস থেকে সে চোখ ফেরাতে পারছে না। অদ্ভুত এক শূন্যতা পেয়ে বসেছে তাকে। কা কা শব্দে বাস্তবে ফিরে এল সে। গ্লাসটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে বাইরে এল।

বাইরে এসেই মন খারাপ হয়ে গেল তার। ঘরের চালে একটা কাক মরে পড়ে আছে। অন্য কাকগুলো মরা কাকটাকে ঘিরে চেঁচাচ্ছে। জীবনে প্রথম একটা মরা কাকের জন্য মায়া হল তার।

মায়া নামক শব্দটা ফরিদ আলীর জীবনের অভিধানে নেই। একটা মরা কাকের জন্য তার চোখে পানি আসবে, সে কোনোদিন ভাবতে পারেনি। লুঙ্গির কোণা দিয়ে চোখ মুছে মাচায় গিয়ে বসল ফরিদ আলী।

একটা মরা কাকের জন্য অন্য কাকগুলোর কত মায়া! তার জন্য কি কারো মায়া আছে? বিষণ্ণ মনে কাকগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল সে। টেরও পেল না আবার কখন ঘুমিয়ে পড়েছে।

ফরিদ আলীর ঘুম ভাঙল সন্ধ্যারও পরে। তার সাগরেদ আক্কাস মিয়া তাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলল। চেয়ারম্যান সাহেব দেখা করতে বলছে—বিশেষ দরকার।

কোন বিশেষ দরকারে তার ডাক পড়ে, ভাল করেই জানে ফরিদ আলী। সে চেয়ারম্যানের ঝাড়ুদার। চেয়ারম্যানের পথের কাঁটা ঝাড়ু দেয় সে। তার মনে মায়া থাকলে চলে?

আজ আমাবস্যার রাত। চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। ঘরে ঢুকে পাঁচ ব্যাটারির টর্চলাইট নিয়ে প্রস্তুত হয়ে বের হল সে। লাইটটা চেয়ারম্যান সাব কিনে দিয়েছে—বলেছে উপহার।

এটাই ফরিদ আলীর সবচেয়ে বড় অস্ত্র। আমাবস্যার রাতে আড়াল থেকে সরাসরি শিকারের চোখে আলো ফেলে—এতে প্রায় অন্ধ হয়ে যায় শিকার। তখন দক্ষ হাতে গামছার ফাঁস লাগাতে কোনো কষ্টই হয় না।

চেয়ারম্যান সাবও কাজের লোক—আগেই এমন ব্যবস্থা করে রাখে যে, প্রতি বারই সে শিকারকে একলা পায়। ফলে সাক্ষীর কোনো ঝামেলাই থাকে না।

চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়ির দিকে রওনা হল ফরিদ আলী। টর্চলাইটটা চেক করার জন্য নিজের অজান্তেই ঘরের চালে ফোকাস মারল সে। মরা কাকটা নেই। কাকটার জন্য এখন আর তার দুঃখ বোধ হচ্ছে না—জেগে উঠেছে তার ঝাড়ুদার স্বত্তা।

চেয়ারম্যান মজিদ ভুইয়ার শোবার ঘরে কারো ঢোকার অনুমতি নেই। মজিদ ভুইয়া আরামকেদারায় চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। তার খাস চাকর কুদ্দুস এসে খবর দিল—ফরিদ এসেছে।
— “ভিতরে পাঠাইয়া দিয়ে দরজা বন্ধ করে দে”—গম্ভীর গলায় বলল মজিদ ভুইয়া।

মজিদ ভুইয়ার এই গলারে ভয় পায় কুদ্দুস। কথামত কাজ করে কেটে পড়ল সে। ফরিদ আলী মজিদ ভুইয়ার সামনের পাকা করা মেঝেতে বসল। চোখ বন্ধ করেই মজিদ ভুইয়া বলল—
— “শরীরটা ভালো, ফরিদ আলী?”
— “জ্বী হুজুর”—অল্প কথায় উত্তর দিল ফরিদ আলী।
— “শুনলাম শরীর খারাপ—ভরা সন্ধ্যায় শুইয়া আছ।”
— “অহন ঠিক আছি।”
— “ভাল হইলেই ভাল”—বলে টেবিলের উপর একটা প্যাকেট দেখিয়ে দিল মজিদ ভুইয়া। প্যাকেটের মধ্যে টাকা আছে, জানে ফরিদ আলী।

— “মানুষটা কে?”—নিচু স্বরে জানতে চাইল ফরিদ আলী।
— “মানুষ না, মানুষ না—কুত্তার বাচ্চা! কাদির মাস্টার—আমার বিরুদ্ধে ইলেকশন করব!”—হিংস্র হয়ে উঠল মজিদ ভুইয়া। “দারোগার সাথে কথা হইছে—কোন সমস্যা নেই। এখন যা।”

মজিদ ভুইয়ার আদেশ শুনেও চুপচাপ বসে রইল ফরিদ আলী।
— “কি, কিছু বলবি?”—জিজ্ঞেস করল মজিদ ভুইয়া।
— “নাহ্”—বলে দরজার দিকে রওনা হল ফরিদ আলী।
— “আরে, টাকা না নিয়েই যাচ্ছিস—টাকা নিবি না?”—বিরক্ত হয়ে বলল মজিদ ভুইয়া।
— “নাহ্”—আবারও ছোট শব্দে উত্তর দিল ফরিদ আলী।
— “কেন?!?”—অবাক হল মজিদ ভুইয়া।
— “ঝাড়ু দেওনের কাম ছাইড়া দিছি”—প্রায় ফিসফিস করে বলল ফরিদ আলী।
— “ভাত ছিটালে কাকের অভাব হয় না”—হালকা হাসির রেখা দেখা দিল মজিদ ভুইয়ার ঠোঁটে।
— “আমি কাক না। কাক আবর্জনা ঝাড়ু দেয়, আর আমি আবর্জনা বাড়াই। আমি কাকেরও অধম”—বলে দ্রুত পায়ে বের হয়ে এল ফরিদ আলী।

আক্কাস মিয়া আর কুদ্দুস গল্প করছিল।
— “চল আক্কাস, বাড়ি যাই”—বলে বাড়ির পথে রওনা হল ফরিদ আলী।
মাথা নিচু করে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকল আক্কাস মিয়া।

ঘুটঘুটে অন্ধকারে পথ চলতে গাছের শিকড়ে হোঁচট খেল ফরিদ আলী। টর্চলাইটটা সে মজিদ ভুইয়ার শোবার ঘরে রেখে এসেছে। নোংরা লোকটার উপহার সে রাখবে কেন?

হঠাৎ পাঁচ ব্যাটারির টর্চের তীব্র আলো এসে প্রায় অন্ধ করে দিল তাকে। গলায় ফাঁস অনুভব করল সে। মনে পড়ে গেল মজিদ ভুইয়ার শেষ কথা—
“ভাত ছিটালে কাকের অভাব হয় না।”

শেষকথা:
ওস্তাদের লাশের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আক্কাস মিয়া। ঝাড়ুদার হিসেবে প্রথম কাজটা বেশ সফলতার সাথেই শেষ করেছে। দ্রুত প্রমাণ নষ্ট করে চেয়ারম্যানের বাড়ির দিকে রওনা হল সে।

গাছের ডালে বসে থাকা কাকগুলো নেমে এসে ফরিদ আলীকে ঘিরে কা কা করে ডাকতে শুরু করল।

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!