মাতা পিতা সন্তানের জান্নাতের পথ

সন্তানের কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় নেয়ামত হল মা বাবা। আর মা বাবার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় নিয়ামত হলো সন্তান। মাকে সন্তুষ্ট করতে হবে, তাহলে দুনিয়া-আখেরাতের কোথাও আটকাবে না। মা ছাড়া সন্তানের কোনো গতি নেই। মা যেমনই হোক, মায়ের দোআ যারা পাবে জীবনে তাদের কোনো ভয় নেই। মানুষ তো মূল্যবান সম্পদ অনেক পয়সা খরচ করে অর্জন করে। আমরা সবাই যেন মায়ের সন্তুষ্টিকে মূল্যবান সম্পদ মনে করি এবং যেকোনো মূল্যে তা অর্জন করার চেষ্টা করি। কারণ আল্লাহ তা’আলা তওহীদের পর পিতা-মাতার অধিকারকে প্রাধান্য দিয়েছেন। আমার আল্লাহ নিজেই মায়ের কথা বলেছেন’ তিনি পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন, ‘মা-বাবার প্রতি সদাচরণ কর, কারণ মা কষ্ট করে তোমাকে গর্ভে ধারণ করেছেন। ’ [সূরা আহকাফ : ১৫]
দেখুন, মা-বাবা দু’জনের সাথেই সদাচরণের আদেশ করেছেন। আপনারা যদি বাবা মায়ের মর্যাদা বুঝতে পারেন তাহলে আমি আল্লাহর রহমতের উপর ভরসা করে নিশ্চয়তার সাথে বলতে পারি যে, দুনিয়াতে এবং আখেরাতে কোনোখানে আপনারা আটকাবেন না ইনশাআল্লাহ। পবিত্র কুরআনের অন্যত্র বলা হয়েছে, ‘আর তোমরা আল্লাহর ইবাদত করবে ও কোন কিছুকে তাঁর শরীক করবে না; এবং পিতা মাতা, আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম, অভাবগ্রস্ত, নিকট প্রতিবেশী, দূরপ্রতিবেশী, সংগী-সাথী, পথচারী এবং তোমাদের অধিকারভূক্ত দাস দাসীদের প্রতি সদ্ব্যবহার করবে। যে দাম্ভিক ও আত্মগর্বী, নিশ্চয় আল্লাহ তাকে ভালবাসেন না।’ [সুরা নিসার : ৩৬]
উক্ত আয়াতে আল্লাহ তাআলা মানুষকে তাঁর ইবাদত করা এবং তাঁর সাথে কোন কিছু শরীক করা থেকে নিষেধ করার পর আয়াতের ‘”ওয়াবিল ওয়ালিদাইনি ইহ্সানা’ অংশে মাতা-পিতার প্রতি সদাচার ও সদ্ব্যবহার করতে নির্দেশ দিয়েছেন। এ আয়াতে তাওহীদের পর সমস্ত আত্মীয়-স্বজন ও সম্পর্কযুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে সর্বাগ্রে মাতা-পিতার হক সম্পর্কিত আলোচনা করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা স্বীয় এবাদত-বন্দেগি ও হকসমূহের পরপরই মাতা-পিতার হক সম্পর্কিত বিবরণ দানের মাধ্যমে ইঙ্গিত করেছেন যে, প্রকৃতপক্ষে সমস্ত নেয়ামত ও অনুগ্রহ একান্তই আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে। কিন্তু বাহ্য উপকরণের দিক দিয়ে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, আল্লাহর পরে মানুষের প্রতি সর্বাধিক  এহসান বা অনুগ্রহ থাকে মাতা-পিতার। সাধারণ উপকরণসমূহের  মাঝে মানুষের অস্তিত্বের পিছনে মাতা-পিতাই বাহ্য কারণ। তাছাড়া জন্ম থেকে যৌবন প্রাপ্তি পর্যন্ত যে সমস্ত কঠিন পথ ও স্তর রয়েছে তাতে বাহ্যতঃ মাতা-পিতাই তার অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখেন, তার প্রতিপালন ও পরিবর্ধনের জামানতদার হয়ে থাকেন। সেজন্যই কুরআন-করীমের অন্যান্য জায়গায়ও মাতা-পিতার হক সমূহকে আল্লাহ তাআলার এবাদত ও আনুগত্যের সাথে যুক্ত করে বর্ণনা করা হয়েছে।
যেরুপ সূরা লোকমানের ১৪ নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘‘আমার প্রতি এবং স্বীয় মাতা-পিতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও’।
হযরত মা’আয ইবনে জাবাল রা. বলেন, ‘রাসূলে কারীম সা. দশটি অসিয়ত করেছিলেন। তন্মধ্যে একটি হচ্ছে আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করবে না, যদিও তোমাদেরকে সেজন্য হত্যা কিংবা অগ্নিদগ্ধ করা হয় আর একটি হচ্ছে নিজের মাতা-পিতার নাফরমানী কিংবা তাদের মনে কষ্ট দিবে না, যদিও তারা এমন নির্দেশ দিয়ে দেন যে, তোমরা তোমাদের পরিবার পরিজন ও ধন সস্পদ ত্যাগ কর। ”[মুসনাদে আহমদ]
মাতা-পিতার অবাধ্য হওয়ার সর্বনিম্ন পর্যায় হলো যে, কোন অপছন্দনীয় কথার পর আফসোস করতে গিয়ে ‘উফ” শব্দ বলা। কুরআনুল করীমে এ ধরনের আচরণ থেকেও নিষেধ করা হয়েছে। সুরা বনী ইসরাইলের ২৩ নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘মাতা-পিতার (কথার) উপর ‘উফ” শব্দও বলবে না এবং তাদেরকে ধমক দিবে না।’
আল্লাহ ব্যতীত মাতা-পিতা এবং মাতা-পিতা ব্যতীত আল্লাহর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন কবুলের যোগ্য নয়। তিরমিযী শরীফের এক রেওয়াতে বর্ণিত রয়েছে ‘যে ব্যক্তি স্বীয় মাতা-পিতাকে সন্তুষ্ট করল সে যেন আল্লাহকে সন্তুষ্ট করল। আর যে ব্যক্তি স্বীয় মাতা-পিতাকে অসন্তুষ্ট করল সে যেন আল্লাহ তাআলাকে অসন্তুষ্ট করল।’ রাসূলে কারীম সা.এর বাণী সমূহে যেমন মাতা-পিতার আনুগত্য ও তাদের সাথে সদ্ব্যবহারের তাকীদ রয়েছে, তেমনিভাবে তার সীমাহীন ফযীলত, মর্তবা ও সওয়াবের কথাও উল্লেখ রয়েছে। হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, রাসূল সা. কে প্রশ্ন করা হলো,  আমার উত্তম ব্যবহার পাওয়ার সবচেয়ে উপযুক্ত ব্যক্তি কে? তিনি বললেন, তোমার মা। তারপর কে? তিনি বললেন তোমার মা। তারপর কে? তিনি বললেন, তোমার মা। তিনি আবার জিজ্ঞাস করলেন, তারপর কে? রাসূল সা. বললেন, তোমার পিতা। [বুখারী] উল্লেখিত হাদীস দ্বারা বুঝা যায়, মা’র হক বাবার তুলনায় তিনগুণ বেশি। এর কারণ হলো, একজন মা সন্তানের জন্য তিনবার ভীষণ কষ্ট সহ্য করেন। প্রথমত মা একটি সন্তান দশ মাস দশ দিন গর্ভধারণ করার কষ্ট সহ্য করেন। দ্বিতীয়ত প্রসব বেদনার অসহ্য কষ্ট নিরবে সহ্য করেন। তারপর নবজাতককে ভুমিষ্ট করেন। তৃতীয়ত দুই বছর কত কষ্ট পরিশ্রম করে দুধ পান করান। তারপর তাকে লালন পালন করা, লেখা পড়া করানো, তাকে আদর যতœ করে বড় করে তুলতে যে কত কষ্ট সহ্য করেন তা তো বলে শেষ করা যাবেনা। চতুর্থবারে বাবার হকের কথা বলা হয়েছে। যেহেতু বাবা সন্তানের ভরণ-পোষণ ইত্যাদীর কষ্ট করে থাকেন। সন্তানকে খাওয়ানো পড়ানো, চিকিৎসা, ভরণ-পোষণ, তাদের সেবায় পরিশ্রম করা, কোলে কাঁেধ করে মানুষ বানানো, তার পিছনে টাকা পয়সা খরচ করা হতে শুরু করে এমন কী কাজ আছে, যা সন্তানের জন্য একজন মা বাবা করেন না? আর এসব কিছুই করে থাকেন একজন মা বাবা বিনিময় ছাড়া।
কিছু মা বাবা আছে যারা সন্তান জন্ম দিয়ে তাদেরকে আদর্শ শিক্ষা না দেওয়ার কারনে ঐ সন্তান চুরি করা থেকে শুরু করে লুটতরাজ, সন্ত্রাস চাঁদাবাজি, মানুষকে কষ্ট দেওয়া, মানুষ খুন করা, মানুষের ইজ্জত নিয়ে টানা টানি করে থাকে। ঐ ধরনের সন্তান পরিশেষে মা বাবার জন্যই বুমেরাং হয়। ঐ ধরনের সন্তান ঘরে বাহিরে বিপর্যয় সৃষ্টি করে। ঐসব সন্তানেরা যে ঘরে যাবে সে ঘর তুষের আগুনে সারখার করে মানুষের সুখের ঘরে আগুন লাগিয়ে পুড়ে তছনছ করে দেয়। ওদের মা বাবা থাকার চেয়ে না থাকাই ভাল ছিল। ওরা কোন একটি ইয়াতিম খানায় লালন পালন হতো সেই ভাল ছিল। ঐ সব সন্তান যদি কোন ভাল ঘরের বউ অথবা জামাই হয়ে যেতে পারে তাহলে ঐ ঘর জ্বলে পুরে সারখার হয়ে যাবে ও যাচ্ছে। কারণ তেতুল গাছের বিচি লাগালে তেতুল গাছই হবে আঙ্গুর গাছ লাগালে আঙ্গুর ফলই হবে। ফুকাহায়ে কেরামের কাছে বিয়ে শাদীর ক্ষেত্রে কুফু একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কম- বেশি ছয়টি বিষয়ে ছেলে মেয়ের সাথে মিল থাকা চাই। না হয় সেই দাম্পত্য সংসারে সুখ আসবে না। কুফুর বিষয়ে বিভিন্ন হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূল সা. কুফুর দিকে খুব খেয়াল রাখতেন। পবিত্র কুরআনেও ঘোষণা হয়েছে- ব্যভিচারী পুরুষ কেবল ব্যভিচারিণী নারী অথবা মুশরিকা নারীকেই বিয়ে করে এবং ব্যভিচারিণীকে কেবল ব্যভিচারী অথবা মুশরিক পুরুষই বিয়ে করে এবং এদেরকে মুমিনদের জন্যে হারাম করা হয়েছে। [সূরা নূর : ৩]
ভাল আর মন্দ এক সাথে থাকতে পারে না। তখন ঐ ঘরের সন্তানেরা আরো মহা বিপদে পরে যায়। না পারে তারা ভালো করতে, আর না পারে খারাপ করতে। কারণ হয়তোবা তাদের মা ভাল ছিল অথবা বাবা ভাল ছিল। ফলে তারা না ভাল কিছু করতে পারে, না খারাপ করতে পারে, মিশ্রিত হয়ে বিপদে পড়ে যায়। কখনো দেখা যায় কিছু সন্তান মায়ের মত ভাল হয়েছে, আবার কখনো দেখা যায় বাবার মত ভাল হয়েছে। তাই আমার অনুরুধ সন্তানের মা বাবার কাছে, আপনার সন্তান যেমন চরিত্র সেই রকম চরিত্র ব্যক্তির কাছেই বিবাহ দিবেন, কালো-সুন্দর সেখানে বিবেচ্য বিষয় না। কারণ প্রবাদ আছে জাতের মেয়ে কালও ভাল নদীর পানি ঘোলাও ভাল। তাহলে কুফু কুফু মিলে যাবে। তখন আপনাদের আর অসম্মানিত হতে হবে না। বিয়াইর বাড়ি ইজ্জত পাবেন। কেননা ওখানে অন্তরে অন্তর মিলে যাবে ফলে আপনি সম্মান পাবেন। এটাকে বলে যেমনের তেমন। মা বাবা আদর্শ নীতিবান ও সম্মানিত হলে তার পরবর্তী বংশের লোকেরা ঐ সম্মান পেতে থাকবে। যেমন তার ছেলে মেয়ে নাতিন পুতি ইত্যাদি। আর যদি কেহ কোন সন্তান জন্ম দিয়ে গেল কিন্তু আদর্শ, সুশিক্ষা দিলনা তাহলে ঐ সন্তানের মা বাবা অভিশাপ ও গালাগাল পেতে থাকে। তাহলে বুঝা গেল সন্তানের জন্য মা বাবা সম্মানিত হয় আর মা বাবার জন্য সন্তান সম্মানিত হয়। অপর পক্ষে মা বাবার জন্য সন্তান অসম্মানিত হয় আবার খারাপ সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য মা বাবাও অসম্মানিত হয়।
কিছু অনাদর্শ ও নীতিহীন মা বাবা কন্যা সন্তান জন্ম দিয়ে তাদেরকে আদর্শ শিক্ষা না দিয়ে আদব কায়দা   না শিক্ষা দিয়ে বড় লোকের ও শিক্ষিত ছেলেদের পেছনে লেলিয়ে দেয়। ফলে তারা প্রেম ও ভালবাসার অভিনয় করে বড় লোকের ও শিক্ষিত ছেলেদের মাথা খারাপ করে তাদের মা বাবাকে বাধ্য করে, তাকে বউ হিসেবে ঘরে তুলতে। তবে কিছু দিন যেতে না যেতেই ঐ ছেলে মা বাবা কে বাদ দিয়ে শাশুড়ি ও বউয়ের পুঁজা করা শুরু করে দেয়। ঐ ছেলে বউ ও শাশুড়ির মোহে পড়ে গর্ভ ধারিনী মা বাবা কে ভুলে যায়। ঐ ছেলে বউয়ের মুখে মায়ের নামে মিথ্যা ও বদনামের কথা শুনতে খুবই মজা পায়। মা যদি শাসন করতে দুই একটি কথা বলে তা সহ্য হয় না। আর বউ এবং শাশুড়ির মিথ্যা বানোয়াট কথা শুনতে মধুরমত লাগে। অনেকে দুষ্ট বউয়ের কথায় সুখের সংসারে আগুন লাগিলে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে জান মাল ইজ্জত নিয়ে ছিনি মিনি খেলে সংসারটাকে জাহান্নামে পরিণত করে। কুরআন ও হাদীসের কোথায় আছে মা বাবাকে বাদ দিয়ে শ্বশুড় বাড়ির লোকের কথা মত চলতে? আর সেই দুষ্ট মহিলা বউ হিসেবে শ্বশুড় বাড়ি যেতে না যেতেই আমার স্বামী, আমার টাকা, আমার সব করে ছেলেকে তার মা বাবা, ভাই বোন থেকে আলাদা করে ফেলে। অথচ আমার স্বামী কোথা থেকে আসল, আর তার টাকাই বা কোথা থেকে আসল বা কে তার স্বামীকে জন্ম দিল, লালন পালন করল এবং লেখা পড়া করিয়ে আদর্শবান, শিক্ষিত যুবক হিসেবে গড়ে তুলল সেসব চিন্তা কখনো করে না। হয়তো বা ঐ কন্যার মা বাবা তার বাবা মার সাথে সেইরকমই করেছিল যা আজ তাদের সন্তানও ওদের থেকে শিক্ষা পেয়েছে। আমার কিছুই বুঝে আসে না গর্ভধারিনী মাকে ভুলে গিয়ে একজন সন্তান কেমন করে থাকতে পারে যে মা ১০ মাস ১০ দিন পেটে ধারণ করে লালন পালন করেছেন, লেখা পড়া শিখিয়েছেন, সে মাকে কিভাবে কষ্ট দিতে পারে? মা না খেয়ে ছেলেকে খাইয়েছে, স্বামীর অত্যাচার সহ্য করেছে, দিন রাত ঘুমায়নি! তবুও সন্তানকে ছেড়ে চলে যাননি। এই সব ক্ষেত্রে স্বামী তার স্ত্রীকে বুঝানো উচিত। আর যদি না বুঝে তাহলে আমি মনে করি জাহান্নামের শাস্তি থেকে নিজে বাঁচার জন্য এবং নিজের পরিবারকেও শাস্তি থেকে বাঁচানোর জন্য ঐ স্ত্রীকে কঠিন থেকে কঠিন শাস্তি দেওয়া উচিত।
সন্তানের উপর মা বাবার কিরুপ অধিকার রয়েছে এ সম্পর্কে সন্তানকে উদ্দেশ্য করে হাদীসে বলা হয়েছে- ‘ তুমি এবং তোমার মাল তোমার (মা) বাবার জন্য। হযরত ইবরাহীম আ. এর ঘটনা আমরা সবাই জানি যে, তিনি তার পুত্র ইসমাইল আ. কে বলেছিলেন তোমার চৌকাঠ বদলাও। সাথে সাথে পিতার আদেশ পালনার্থে তিনি নিজ স্ত্রীকে তালাক দিয়ে দিলেন। কারণ ইসমাঈলের বংশে আমাদের শ্রেষ্ঠ নবীর জন্ম হবে। তাই ইবরাহীম আ. ছেলে ইসমাঈলকে নিজ স্ত্রী তালাক দেওয়ার আদেশ করেছেন। যেহেতু সে ছিল অকৃজ্ঞ নারী।  আমাদের শ্রেষ্ঠ নবী বলেছেন মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত। এগুলো হলো একজন সন্তান তার পিতা মাতার কাছে আনুগত্য প্রকাশের বহিঃপ্রকাশ।
ছেলের বউ হিসেবে যখন অন্য সংসারের কোন মেয়ে নব বধুর রূপ নিয়ে স্বামীর সংসারে আসে তখন একটি সংসার আনন্দময়, সুখময় ও ফলপ্রসূ হওয়ার জন্য বউ শাশুড়ির মিল- মোহাব্বত অত্যন্ত জরুরি। বউ শাশুড়ির মাঝে যদি মিল-মোহাব্বত থাকে তাহলে সংসারে সুখ-সমৃদ্ধির জোয়ার আসে। সংসার হয়ে ওঠে জান্নাতের টুকরা। আর যদি সংসারের এই দুটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভের মাঝে বিরূপ সম্পর্ক থাকে তাহলে সংসারের শান্তি হয়ে যায় সোনার হরিণ। জীবন তখন হয়ে ওঠে দুর্বিসহ। সংসারটা হয়ে যায় জাহান্নামের টুকরা। একটি সংসারকে সুখ-সমৃদ্ধ ও প্রাণবন্ত করার জন্য যেমনি প্রয়োজন শাশুড়ির সুনিপুন পরিচালনা, তেমনি প্রয়োজন বউয়ের আন্তরিকতা ও সদিচ্ছা। এক্ষেত্রে বউ তার শাশুড়িকে শ্রদ্ধা করবে। মনে করবে তার শাশুড়ি তার জন্য জননীতুল্য শ্রদ্ধার পাত্র। শ্বশুরকে মনে করবে পিতাতুল্য। পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে তার আচরণ হবে হৃদ্যতাপূর্ণ। বউয়ের দায়িত্ব হলো শাশুড়িকে সম্মান করা। যৌথ পরিবার হলে তার নির্দেশমতো সংসার চালানো। শাশুড়িকে নিজের প্রতিপক্ষ বা শত্রু না ভাবা। বউয়ের চিন্তা করা উচিত যে, শাশুড়ি যদি তার প্রতিপক্ষ বা শত্রু হত তাহলে তাকে ছেলের বউ করে ঘরে তুলত না। অনেক বউ আছেন, শাশুড়ি বা ননদের কথা তিলকে তাল বানিয়ে স্বামীর কাছে মায়া কান্না করে স্বামী ও তার মা বোনদের মধ্যে বিবাদ সৃষ্টি করে দেয়। স্বামী বেচারাও ধূর্ত স্ত্রীর প্রতারণায় পড়ে মা বোনদের বিরুদ্ধে উত্তেজিত হয়ে ওঠেন। এতে মা-ছেলের মায়া জড়ানো সম্পর্ক বিনষ্ট হয়ে যায় এবং মা বেচারী খুবই অপমানবোধ করেন। বউয়ের মনে রাখা উচিত যে, যে স্বামীর খেদমত করা মহান আল্লাহ তাআলা তার ওপর ফরজ করে দিয়েছেন, তার জন্মদাতা মাকে খুশি করলে সে নিশ্চয় খুশি হবে। এতে তার স্বামীর জান্নাতের রাস্তাও যেমন সুগম হবে তেমনি তারও দুনিয়া আখেরাত কল্যাণকর হবে।
হাদীসে আছে, বিখ্যাত সাহাবী হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, হযরত রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ওই ব্যক্তি নিকৃষ্ট, অপমানিত, পর্যুদস্ত ও ধ্বংসপ্রাপ্ত; যার পিতা-মাতাকে বা যে কোনো একজনকে বার্ধক্যকালে পেয়েছে, কিন্তু সে (তাদের খেদমত করে) জান্নাতে প্রবেশ করতে পারেনি’। [মুসলিম শরিফ]
এই পবিত্র হাদীস থেকে প্রতীয়মান হলো যে, মা-বাবার খেদমত করা কতই বরকতময় আমল। যে কাজের বিনিময়ে জান্নাত নিশ্চিত হতে পারে, তার চেয়ে বড় আমল আর কী-ই বা হতে পারে? অথচ আমরা আমাদের চারদিকে আজ কী দেখছি? সন্তান কর্তৃক মা-বাবাকে নির্যাতন, বয়সের ভারে ন্যূজ মা-বাবাকে অবহেলা করা, মা-বাবাকে ঘর থেকে বের করে দেওয়া, মা-বাবার ভরণ-পোষণ না করা এসব অমানবিক কাজগুলো আমাদের দেশে অহরহ হতে দেখা যায়। এমনকি প্রাণপ্রিয় সন্তান কর্তৃক পিতা-মাতাকে হত্যার মতো জঘন্য অপরাধ সংঘটিত হতেও দেখা যায়, যা কল্পনা করাও জঘন্য গুনাহ। অথচ রাব্বুল আলামীন মহান আল্লাহ তাআলা নিজের ইবাদতের সঙ্গে মা-বাবার খেদমতকেও সমান গুরুত্ব দিয়ে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেন, তোমার পালনকর্তা আদেশ করেছেন যে, তাকে ছাড়া অন্য কারও ইবাদত করো না এবং পিতা মাতার সাথে সদ্ব্যবহার কর। তাদের একজন বা উভয়কে যদি তোমার জীবদ্দশায় বয়োবৃদ্ধ অবস্থায় পাও, তবে তাদের ‘উফ’ শব্দটিও বলো না, আর তাদের ধমক দিওনা বা কটু কথা বলো না; বরং তাদের সঙ্গে সুন্দর ও নরম ভাষায় কথা বলো। তোমার দুই বাহু তাদের পদতলে বিছিয়ে দাও, (তাদের খেদমতে সর্বাত্মক নিজেকে নিয়োজিত রাখো। ) আরো বলোÑ হে আমাদের প্রতিপালক! তাদের ওপর রহম করো যেভাবে তারা আমাকে শৈশবকালে লালন-পালন করেছেন’। [সূরা আল ইসরা : ২৩-২৪]
প্রিয় পাঠক! আল্লাহ তাআলার কালামের প্রতি লক্ষ্য করুন। মা-বাবার প্রতি কীভাবে আচরণ করতে হবে তা কত সুন্দর সাবলিল ভাষায় আমাদের বলেছেন। বুকে হাত দিয়ে কী আমরা বলতে পারি আমরা মা-বাবার প্রতি সে রকম আচরণ করছি? অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন, আর আমি মানুষকে তার পিতা মাতার সাথে সদ্ব্যবহারের জোর নির্দেশ দিয়েছি। তার মাতা তাকে কষ্টের পর কষ্ট করে গর্ভে ধারণ করেছে। তার দুধ ছাড়ানো দু বছরে হয়। নির্দেশ দিয়েছি যে, আমার প্রতি ও তোমার পিতা মাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। অবশেষে আমার নিকট ফিরে আসতে হবে। [সূরা লুকমান : ১৪]
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসীরকারগণ বলেন, পিতা-মাতার কৃতজ্ঞতা ব্যতীত আল্লাহর কৃতজ্ঞতা আদায় হয় না।
আল্লাহ তাআলা ও প্রিয়নবী হযরত রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পর আসমানের নিচে আর যমীনের ওপর মা-বাবার চেয়ে অধিক সম্মানের যোগ্য, অধিক সদাচারণের উপযোগী, অধিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশের মাধ্যম পৃথিবী আর কেউ নেই। আল্লাহ তাআলার ইবাদতের পর মা-বাবার খেদমত করা মানব সন্তানের ওপর ফরজ। মা-বাবা বিধর্মী হলেও তাদের প্রতি কোনো অবস্থাতেই অশ্রদ্ধাপূর্ণ ব্যবহার করা যাবে না।
হযরত ইবনে আব্বাস রা.বর্ণনা করেন, নবী করীম সা. বলেন, ‘যে সৎচরিত্রবান সন্তান মাতা-পিতার প্রতি একবার ভালবাসাপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায়, আল্লাহ তাআলা তার প্রতিদান স্বরুপ একটি মকবুল হজ্জের সওয়াব দান করেন। উপস্থিত লোকসকল জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ সা. যদি কেউ এমনিভাবে একদিনে একশতবার মহব্বত ও দয়ার সাথে তাকায়? হুজুর সা. বললেন, হ্যাঁ একশতবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেও একশত কবুল হজ্জের সওয়াব পাবে। ”[মুসলিম, মাআরিফুল হাদীস]
সন্তানের ওপর পিতা-মাতার কতগুলো হক বা অধিকার
সন্তানের ওপর পিতা-মাতার কতগুলো হক বা অধিকার রয়েছে। যথাÑ ১. খাবার না থাকলে খাবারের ব্যবস্থা করা ২. কাপড় না থাকলে কাপড়ের ব্যবস্থা করা ৩. বসবাসের মতো ঘর না থাকলে ঘরের ব্যবস্থা করা ৪. অসুস্থ হলে চিকিৎসা করানো ৫. মা-বাবার খেদমত করা ৬. ডাকার সঙ্গে সঙ্গে জবাব দেওয়া ও হাজির হওয়া ৭. বিনয়, ভদ্রতা ও নম্রতার সঙ্গে কথা বলা ৮. তাদের নাম ধরে না ডাকা। এটা চূড়ান্ত বেয়াদবি ৯. তাদের পিছনে চলা, সামনে বা ডানে বামে হাঁটা অনুচিত ১০. যা নিজের জন্য পছন্দ করবে, তা মা-বাবার জন্যও পছন্দ করা। পক্ষান্তরে যা নিজের জন্য অপছন্দ করবে, তা তাদের জন্যও অপছন্দ করা ১১. সর্বাবস্থায় তাদের জন্য দোআ করা। মা-বাবার জন্য দোআ না করলে জিন্দেগী সংকীর্ণ হয়ে যায়। ১২. যদি তারা কোনো হুকুম দেয়, সঙ্গে সঙ্গে তা তামিল করা। তবে কুরআন সুন্নাহ বিরোধী হলে তা আমল করা যাবে না। ১৩. সর্বাবস্থায় নিজের এবং স্ত্রী ও সন্তানের ওপর মা-বাবাকে অগ্রাধিকার দেওয়া। ১৪. মৃত্যুর পর মা-বাবার বন্ধু-বান্ধবীদের সঙ্গে সদাচরণ করা। ১৫. মৃত্যুর পর মা-বাবার কবর জিয়ারত করা ১৬. মৃত্যুর পর মা-বাবার জন্য ঈসালে সাওয়াব করা। কুরআন তেলাওয়াত, দরূদ শরীফ, দোআ-দরূদ, নফল নামায, জিয়াফত ও দান-সাদকাহ করে ঈসালে সাওয়াব করা যায়।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছেলেকে বাঁচানোর জন্য মায়ের মমতাকে জাগিয়ে দিয়েছিলেন
তাম্বিহুল গাফেলীনের ৭৩ নং পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে, আনাস ইবনে মালেক রা. বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সা. এর যুগে আলকামাহ্ নামে এক যুবক ছিল। সে বিভিন্ন দিক দিয়ে দ্বীনের সাহায্য করার চেষ্টা করত। সে খুব বেশী বেশী দান করত। অকস্মাত সে এক কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ল। তার স্ত্রী কোন এক লোকের মারফত রাসূলুল্লাহ সা. এর নিকট এই সংবাদ প্রেরণ করল। খবর শুনে রাসূলুল্লাহ সা. হযরত আলি, হযরত বেলাল, হযরত সালমান ফারসী ও হযরত আম্মার রা. কে তার অবস্থা দেখার জন্য পাঠালেন। যখন তারা পৌঁছলেন তখন আলকামাহ এর প্রাণ প্রায় ওষ্ঠাগত। তাঁরা আলকামাহ কে কালেমায়ে তাওহীদের তালকীন দিলেন। কিন্তু শত চেষ্টা সত্বেও তার মুখে কালেমা উচ্চারিত হয় না। এই শোচনীয় অবস্থার সংবাদ তারা হযরত বেলাল রা. এর মাধ্যমে নবী সা. এর নিকট পাঠালেন। রাসূলুল্লাহ সা. জিজ্ঞেস করলেন তার মাতা পিতা জীবিত আছে কি? হযরত বেলাল রা. উত্তর দিলেন তার বৃদ্ধ মাতা জীবিত আছেন। নবীজী সা. হযরত বেলাল রা. এর মারফত ঐ বৃদ্ধার নিকট সংবাদ প্রেরণ করলেন যে, সম্ভব হলে তিনি যেন নবীজী সা. এর সাথে সাক্ষাত করেন। অপারগ হলে রাসূলুল্লাহ সা. স্বয়ং তার নিকট যাবেন। আলকামাহ এর মাতা বললেন, আমার জীবন রাসূল সা. এর জন্য কোরবান হোক। আমি নিজেই রাসূলুল্লাহর সা. এর দরবারে উপস্থিত হব। অতঃপর লাঠিতে ভর করে নবীজী সা. এর দরবারে উপস্থিত হয়ে সালাম করতঃ বসে পরলেন। সালামের জবাব দিয়ে নবীজী সা. বললেন, যা জিজ্ঞেস করব ঠিক ঠিক উত্তর দিবে। আলকামাহর জীবনকাল কেমন ছিল? তার মা বলল, সে বেশী বেশী নামায পড়ত ও রোযা রাখত। আর দান সদকা করার তো কোন সীমা ছিল না। রাসূলুল্লাহ সা. পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, তোমার এবং তার মধ্যকার সম্পর্ক কেমন ছিল? বৃদ্ধা উত্তর দিল, আমি তার প্রতি অসন্তুষ্ট।’ সে আমার উপর স্ত্রীকে প্রাধান্য দিত এবং স্ত্রীর কথামত চলত। নবীজী সা. বললেন, মাতার অসন্তুষ্টিই তাকে কালেমা পড়া থেকে বিরত রেখেছে। রাসূলুল্লাহ সা. হযরত বেলাল রা.কে বললেন, কিছু শুকনা কাঠ সংগ্রহ কর আমি আলকামাহকে আগুনে পুড়িয়ে ফেলবো। এই কথা শুনে তার বৃদ্ধা মা অস্থির হয়ে নবীজী সা. কে বলতে লাগলেন আমার সামনে আমার কলিজার টুকরাকে আগুনে পোড়াবেন না; আমি সহ্য করতে পরব না। রাসূলুল্লাহ সা. বললেন, আল্লাহর আযাব ইহা অপেক্ষা অনেক শক্ত ও দীর্ঘস্থায়ী। তুমি যদি চাও আল্লাহপাক তোমার ছেলেকে ক্ষমা করুক, তবে তার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে যাও। আল্লাহর শপথ করে বলছি, তোমার সন্তুষ্টি ব্যতীত তার নামায, রোযা এবং অন্যান্য ইবাদত বিন্দুমাত্র কাজে আসবে না। এই কথা শোনামাত্র বৃদ্ধা বলতে লাগল, ইয়া রাসূলাল্লাহ সা., আমি আল্লাহকে, আপনাকে এবং উপস্থিত সকলকে সাক্ষী রেখে বলছি, আমি আলকামাহর প্রতি সন্তুষ্ট।’ নবীজী সা. বেলাল রা. কে বললেন, গিয়ে দেখ আলকামাহ কালেমা পড়তে পারছে কিনা। বেলাল রা. দরজায় পৌঁছে শুনতে পেলেন আলকামাহর স্বর ভেসে আসছে। সে পাঠ করছে, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ। হযরত বেলাল ভিতরে প্রবেশ করে সবাইকে বললেন, তার মাতার অসন্তুষ্টিই তাকে বাকরুদ্ধ করে রেখেছিল।’
কাজেই, সন্তান হিসেবে আমাদের প্রত্যেকের উচিত নিজ নিজ পিতা মাতা বেঁচে থাকতে তাঁদের যথাসাধ্য খেদমতের মাধ্যমে আল্লাহপাকের সন্তুষ্টি লাভের চেষ্টা করা অথবা মৃত বাবা মা’র জন্য সবসময় দোআ করা, যেন আল্লাহপাক তাঁদের জান্নাতে প্রবেশ করানোর মাধ্যমে সন্তান হিসেবে আমাদের প্রত্যেকের পিতা মাতার প্রতি যথাযথ কর্তব্য পালনের সুযোগটুকু দান করেন। মায়ের দিকে মুহাব্বতের নযরে তাকালে মাকবুল হজ্জের সওয়াব পাওয়া যায়। কিন্তু মানুষের তো ঐ হজ্জের দরকার নেই, তাদের শুধু দরকার দুই লাখ তিন লাখ টাকা খরচ করে এই হজ্জ করা!
প্রিয় পাঠক। আপনি আপনার মায়ের হয়ে যান। মায়ের হয়ে গেলে আল্লাহর হয়ে যাবেন। আর আল্লাহর হয়ে গেলে আল্লাহও আপনাদের হয়ে যাবেন। মাকে কখনো কষ্ট দিবেন না। যে মায়ের অবস্থা এমন যে, সন্তান অসুস্থ হলে তাঁর আর কোনো অসুস্থতা থাকে না, নিজের সকল অসুস্থতার কথা ভুলে যান সন্তানের চিন্তায়-সেই মাকে মানুষ কীভাবে কষ্ট দেয়!
আপনারা যদি বাঁচতে চান তাহলে মায়ের বিষয়টা খেয়াল রাখার চেষ্টা করেন। এটা আমাদের জন্য একটা বিরাট রাস্তা। এই রাস্তায় আমাদের বড় বড় সৌভাগ্য আসতে পারে। আবার এটা আমাদের বরবাদিরও কারণ হতে পারে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- মা-বাবা হল তোমার জান্নাত কিংবা জাহান্নাম। অর্থাৎ মা-বাবার মর্যাদা রক্ষা করে কেউ জান্নাতে যাবে আবার মা-বাবার অমর্যাদা করে কেউ জাহান্নামে যাবে। আর আল্লাহ তাআলা তো মুশরিক মা-বাবার সঙ্গেও সদাচরণ করার আদেশ দিয়েছেন।
এই পৃথিবীতে আপনাকে নিয়ে ভাববার কেউ নেই। এমনকি বাবাও আপনাকে নিয়ে তেমন ভাবেন না যেমন ভাবেন আপনার মা। ঘরে ভালো কিছু রান্না হলে আপনি নেই তাই নিজেও খেতে পারেন না। এমন মাকে ভালবাসবে না, সম্মান করবে না তো কাকে করবেন? মাকে ভালবাসলে, মাকে সম্মান করলে নিজেই লাভবান হবে। লেখাপড়া শিখতে মেধা লাগে, শ্রম লাগে, অনেক কিছু লাগে, কিন্তু মাকে ভালবাসতে, মাকে সম্মান করতে, মাকে খুশি করতে কিছুই লাগে না। তো প্রিয় পাঠক/পাঠিকা! মাকে ভালবাসুন, মাকে সম্মান করুন, মাকে সন্তুষ্ট করুন এবং মায়ের দোআ হাসিল করুন। তাহলে দেখবেন দুনিয়া ও আখেরাতের কোথাও আপনি আটকাবেন না। আপনার সন্তান হবে মর্যাদার শীর্ষে। যত দিন ছেলের মা বাবা জীবিত থাকবেন ততদিন ছেলের বউ তাদের খেদমত ও আনুগত্যকে নৈতিক দায়িত্ব হিসেবে জানবে এবং সে মতে তাদের খেদমত ও আনুগত্য করবে। তাদের সাথে কথা-বার্তা ও উঠা-বসায় আদব-সম্মানের প্রতি খুব লক্ষ্য রাখবে। শ্বশুর-শাশুড়ির খেদমত করা আইনতঃ ফরয না হলেও নৈতিক ফরয। পাঠক চলুন একটি বাস্তব ঘটনার মাধ্যমে আমরা তা বুঝার চেষ্টা করি।
শরিফের আম্মা আজ দুবছর ধরে অসুস্থ। কোন কিছু মনে রাখতে পারে না। কারো সাথে বেশী কথাও বলে না। কখনো জানালার পাশে দাঁড়িয়ে নীরবে কাঁদে। অনেক ডাক্তার দেখিয়েও ওনাকে ভাল করা যাচ্ছে না। তাই শরিফের আম্মাকে নিয়ে বাসার সবাই চিন্তিত। শরিফের বউ, ছোট বোন, ভাবী ও ছোট ভাইয়ের বউ সারাক্ষণ মা-শাশুড়ির সেবায় ব্যস্ত। সবাই সেবা-যতœ করে চলেছে। তাদের এই সেবা যতেœ শরিফের বাবা ও তাদের আত্মীয়-স্বজনরা সন্তুষ্ট।’
শরিফরা কিভাবে বড় হয়েছে তাদের আম্মা যে কত পরিশ্রম করে তাদেরকে, লেখা পড়া শিখিয়ে, আদব কায়দা শিক্ষা দিয়ে মানুষ করেছে, সেই বিষয়ে স্ত্রীকে বিয়ের পরেই জানিয়েছিল। শরিফ বাসর রাতে স্ত্রী ইয়াছমিনকে কয়েকটি কথা বলেছিল, ‘আম্মা একটু রাগী। আম্মার কোন ব্যবহারে মন খারাপ করো না। কোনো কারণে বাসার বাইরে গেলে আম্মাকে বলে যাবে। সাধ্যমত আম্মার সেবা করবে। কোন সমস্যা হলে আমাকে শেয়ার করবে। ”
শরিফের গুণবতী স্ত্রী এই কথাগুলো আজও অক্ষরে অক্ষরে পালন করে চলেছে। আনন্দচিত্তে শাশুড়ির সেবা করেই যাচ্ছে। শ্বশুরবাড়িতে কাজের মধ্যে ডুবে থাকতে থাকতে মাঝে মধ্যে মন খারাপ হলেও কাউকে বুঝতে দেয় না। সবকিছু হাসি-মুখে মেনে নেয়।
শরিফ তার মায়ের সেবা-যতেœ অক্লান্ত পরিশ্রমের কথা স্বরণ করে স্ত্রীকে সব সময় বলে, ‘ইয়াছমিন, এই সেবার প্রতিদান তুমি দুনিয়া ও আখিরাতে পাবে। এর বিনিময়ে বৃদ্ধ বয়সে তোমার সন্তান ও পুত্রবধু তোমার সেবা করবে। আমরা যদি বাবা-মাদের কষ্ট দিই, তাদেরকে অবহেলা করি, তাদেরকে একা রেখে অন্যত্র বসবাস করি তাহলে আমাদের সন্তানেরাও একদিন আমাদের সাথে এমন আচরণ করবে। তাই কখনো বাবা-মায়ের মনে কষ্ট দেয়া যাবে না। আরেকটা কথা, বৃদ্ধ বয়সে সকলের বাবা-মা তো শিশুর মতই আচরণ করে। শিশুকালে আমরা যেমন বাবা-মার সেবা পেয়ে বড় হয়েছিলাম। আজ তারাও আমাদের সেবা-যতেœ বাকী জীবনটা কাটিয়ে দিবে। ”
প্রিয় পাঠক! একটি কথা মনে রাখতে হবে যে, আমরা মা-বাবার সঙ্গে যেরূপ আচরণ করবো, ঠিক একই আচরণ আমরা আমাদের সন্তানদের কাছ থেকে পাবো। তাই মা-বাবার সঙ্গে খারাপ আচরণ করলে মনে রাখতে হবে যে, আমাদের জন্যও ঠিক অনুরূপ বা তারচেয়েও নিকৃষ্ট আচরণ অপেক্ষা করছে। প্রবাদ আছে, ‘কামা তুদীনু তুদান’ অর্থাৎ ‘যেমন করবে, তেমন ভোগবে’। আল্লাহ না করুন! যদি কোনো কারণে মা-বাবার প্রতি অসদ্ব্যবহার করে থাকেন, তবে কালবিলম্ব না করে তাদের কাছে ক্ষমা চান। তাদের প্রতি কোনোরূপ অবহেলা বা অসদাচরণ করার পূবের্, গর্ভকালীন ১০ মাস ১০ দিন মায়ের পেটে আপনার অবস্থানের কথা চিন্তা করুন। ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর মা-বাবা কত কষ্ট করে কত ভালবাসায় আমাকে আপনাকে কোলে তোলে বুকে আগলে রেখে লালন-পালন করেছেন, সে চিন্তা করুন। আমাদের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার জোগান দিতে মা-বাবা কত গলদঘর্ম হয়েছেন, কত মেহনত করেছেন, কত কষ্টের পাহাড় হাসিমুখে ডিঙিয়েছেন, সেই মা বাবার বৃদ্ধবয়সে বৃদ্ধাশ্রমে কেন তাদের ঠিকানা হবে? আমার অনুরোধ থাকবে আজই মা বাবার কাছে ক্ষমা চেয়ে তাদের বৃদ্ধাশ্রম থেকে ফিরিয়ে আনবে এবং বাকী জীবন তাদেরকে মাথার তাজ বানিয়ে রাখবে। তাহলে দুনিয়া ও আখেরাতে সফলকাম হবে। যেই মা বাবা শিশুকালে ঠিকমত না খাওয়াতে পেরে, অসুখ হলে অর্থের অভাবে চিকিৎসা করতে না পেরে ডুকরে কাঁদছেন এবং লালন পালন করতে গিয়ে বিভিন্ন সময় কষ্টে কাঁদছেন, আজ কেন সেই মা বাবার জন্য একটু কষ্ট সইতে পারব না?  হায় আল্লাহ! এমন মাতা পিতার প্রতিদান আমরা কীভাবে দেবো? একটি কথা মনে রাখবেন, আপনাকে যদি আপনার মা বাবা ছোটকালে ভিক্ষা করে, ইটখলায় ইট ভেঙ্গে, লেবারী করে অথবা বাসায় বাসায় কাজ করে কতইনা নির্যাতন সহ্য করে লালন-পালন করতে পারেন, তাহলে আপনি কেন মা বাবাকে কাজ করে খাওয়াতে পারবেন না? মহান আল্লাহ আমাদেরকে মা বাবার জন্য দোআ শিখিয়েছেন যেন মাতা পিতার জন্য দোআ করি ‘রাব্বির হাম্ হুমা কামা রাব্বাইয়ানী ছাগীরা’ (প্রভু হে! আমার মা-বাবার প্রতি রহম করো, যেভাবে তারা শৈশবে আমাকে প্রতিপালন করেছেন) আল্লাহ আমাদের বুঝার তাওফিক দিন। আমিন!

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!