আল্লাহ পাক পবিত্র কুরআন মাজিদে ইরশাদ করেনঃ
অর্থ: “অতঃপর একটি মাছ তাঁকে গিলে ফেলে, আর তিনি নিজেকে ভৎসনা করছিলেন।”
(সূরা আস-সাফফাত, আয়াত ১৪২)
মাছ হযরত ইউনুস (আঃ)-কে গিলে ফেলার পর বলল,
“হে আল্লাহর নবী! আপনাকে ভালোভাবে রাখার জন্য আমাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যেন আপনার কোনো কষ্ট না হয়। আমার পেট এখন আপনার কারাগারস্বরূপ। যখন আল্লাহ ইচ্ছা করবেন, তখন আপনাকে মুক্তি দেবেন। আমার পেট সমস্ত প্রকার অপবিত্রতা থেকে মুক্ত। আপনি সম্পূর্ণ পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন স্থানে অবস্থান করছেন। আমি সর্বদা আল্লাহ তাআলার যিকির ও তাসবিহ পাঠে নিমগ্ন থাকি। এখন আমার পেটই আপনার কারাগার।”
হযরত ইউনুস (আঃ) চল্লিশ দিন মাছের পেটে অবস্থান করেছিলেন। ঐ সময় মাছটি নিজের মুখ খোলা রেখেছিল, যাতে তাঁর কোনো প্রকার কষ্ট না হয়। অবশেষে চল্লিশ দিন পর আল্লাহর নির্দেশে মাছটি হযরত ইউনুস (আঃ)-কে নদীর তীরে উগরে দেয়।
মাছের পেটে অবস্থানকালীন সময় তিনি নিরন্তর আল্লাহর যিকিরে মশগুল ছিলেন। ফলে শরীর অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়ে। যেহেতু তিনি মাছের পেটেও আল্লাহর স্মরণে ব্যস্ত ছিলেন, তাই আল্লাহ তাআলা দয়াপরবশ হয়ে তাঁকে মুক্তি দেন। যেমন আল্লাহ তাআলা কুরআন মাজিদে ইরশাদ করেন—
অর্থ: “সুতরাং তিনি যদি তাসবিহ পাঠকারীদের অন্তর্ভুক্ত না হতেন, তবে অবশ্যই কিয়ামত পর্যন্ত সে মাছের পেটেই অবস্থান করতেন।”
(সূরা আস-সাফফাত, আয়াত ১৪৩-১৪৪)
হযরত ইউনুস (আঃ)-কে পেটে নিয়ে মাছটি সাত সমুদ্রের গভীরে ভ্রমণ করেছিল। সেখানে থেকেও হযরত ইউনুস (আঃ) আল্লাহর নানাবিধ নিদর্শন দেখতে পান এবং অবিরাম যিকির ও তিলাওয়াত করতে থাকেন।
পবিত্র কুরআনে আরও ইরশাদ হচ্ছে—
অর্থ: “অবশেষে তিনি অন্ধকারের মধ্যে আহ্বান করলেন— ‘আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, আপনি পবিত্র, নিশ্চয়ই আমি অন্যায়কারীদের অন্তর্ভুক্ত।’ অতঃপর আমি তাঁর দোয়া কবুল করলাম এবং তাঁকে দুঃখ-কষ্ট থেকে মুক্তি দিলাম। আর এভাবেই আমি মুমিনদের মুক্তি দিয়ে থাকি।”
(সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত ৮৭-৮৮)
আল্লাহর নির্দেশে চল্লিশ দিন পর মাছটি হযরত ইউনুস (আঃ)-কে নদীর পাড়ে এনে শুকনো স্থানে উগরে দেয়।
মাছের পেট থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি শুকরিয়াস্বরূপ চার রাকআত নামাজ আদায় করেন। কথিত আছে, এই নামাজটি ছিল আসরের নামাজ।
যখন মাছ তাঁকে নদীর পাড়ে উগরে দেয়, তখন তাঁর দেহের বিভিন্ন অঙ্গ খুবই নাজুক ও দুর্বল হয়ে পড়েছিল। কিছুই খেতে পারছিলেন না। তখন আল্লাহ তাআলা সেখানে একটি লাউগাছ উৎপন্ন করেন, এবং গাছে সঙ্গে সঙ্গে লাউ ধরে। তিনি সেই লাউ খেতে থাকেন ও গাছের ছায়ায় অবস্থান করেন।
কিছুটা শক্তি ফিরে পাওয়ার পর আল্লাহ তাআলার নির্দেশে তিনি স্বীয় কওমের কাছে ফিরে যান। এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন—
অর্থ:
“অতঃপর আমি তাঁকে এক উন্মুক্ত ময়দানে স্থাপন করলাম, তখন তিনি অসুস্থ ছিলেন; এবং আমি তাঁর উপর একটি লতাযুক্ত ছায়াবৃক্ষ জন্মিয়েছিলাম। এরপর আমি তাঁকে এক লক্ষ বা ততোধিক লোকের প্রতি রাসূল করে পাঠিয়েছিলাম। অতঃপর তারা ঈমান আনল, তাই আমি তাদেরকে এক নির্ধারিত সময় পর্যন্ত ভোগ-বিলাসের সুযোগ দিয়েছিলাম।”
(সূরা আস-সাফফাত, আয়াত ১৪৫-১৪৮)
এভাবে কিছুদিন আল্লাহর প্রদত্ত সুমিষ্ট ফল খেয়ে ও পাহাড়ি বকরির দুধ পান করে হযরত ইউনুস (আঃ) তাঁর শরীরে যথেষ্ট শক্তি ও শান্তি ফিরে পান।
এরপর তাঁর প্রতি আল্লাহর নির্দেশ আসে—
“হে ইউনুস! তুমি সাগরের অপর পাড়ের দেশসমূহে যাও এবং সেখানে কিছুদিন দ্বীনের প্রচার করো। তারপর সেখান থেকে তোমার স্বদেশে ফিরে এসে স্বীয় কওমের লোকদের হিদায়াতের পথে আহ্বান করতে থাকো।”
ইতোমধ্যে একটি সামুদ্রিক জাহাজ উক্ত দ্বীপের উপকূলে নোঙর করল।
ঐ জাহাজটি সাগরের অপর পাড়ে যাত্রী নিয়ে রওনা হয়েছিল। হযরত ইউনুস (আঃ) সেই জাহাজে আরোহন করলেন এবং সাগরের অপর তীরে পৌঁছে গেলেন। অতঃপর তিনি লোকালয়ে প্রবেশ করলেন।
এই দেশের লোকদের স্বভাব-চরিত্র ছিল অত্যন্ত উত্তম। তারা পূর্ব থেকেই হযরত ইউনুস (আঃ)-এর নাম শুনেছিল এবং তাঁকে নিজেদের মাঝে পাওয়ার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল। ফলে তাঁকে পেয়ে তারা অত্যন্ত আনন্দিত হলো। হযরত ইউনুস (আঃ) তাদের কাছে আল্লাহর বিধি-বিধান ও ধর্মীয় উপদেশসমূহ তুলে ধরলেন, আর তারা আন্তরিকভাবে তা গ্রহণ করল।
এরপর হযরত ইউনুস (আঃ) দেশটির সর্বত্র ঘুরে ঘুরে ওয়াজ-নসিহত করতে লাগলেন।
একদিন তিনি এক বৃহৎ সমাবেশে ওয়াজ করছিলেন। এমন সময় ঐ এলাকার এক ধর্মভীরু ব্যক্তি এক নারীকে সঙ্গে নিয়ে সমাবেশে আগমন করলেন।
হযরত ইউনুস (আঃ) সামনের দিকে দৃষ্টি দিতেই দেখলেন— আগত সেই নারী স্বয়ং তাঁরই স্ত্রী!
নবী (আঃ) বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন।
ধর্মভীরু লোকটি হযরত ইউনুস (আঃ)-এর দিকে চেয়ে বলতে লাগলেন,
“হুজুর! কিছুদিন আগে আমি একদিন সমুদ্র উপকূলের চর এলাকায় মাছ ধরতে গিয়েছিলাম। সেখানে দেখলাম, এক মহিলা অর্ধমৃত অবস্থায় চরের উপর পড়ে আছেন। আমি তাঁর কাছে এগিয়ে যাই এবং দেখি— তাঁর জ্ঞান আছে, তিনি ক্ষীণস্বরে কিছু বলছেন, কিন্তু আমি তা বুঝতে পারিনি।
আমি তাঁকে নিজের ঘরে নিয়ে আসি এবং অনেক যত্নসহকারে সেবা-শুশ্রুষা করি। আল্লাহর মেহেরবানীতে কিছুদিনের মধ্যেই তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠেন। সুস্থ হওয়ার পর তিনি তাঁর নিজের পরিচয় দেন।
তাঁর পরিচয় জানার পর আমরা আপনার দেশের ঘটনার বিবরণসহ খবর পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু আপনি এই দেশে আগমন করার পূর্ব পর্যন্ত আপনার পক্ষ থেকে কোনো জবাব পাইনি।”
হযরত ইউনুস (আঃ) অভাবনীয়ভাবে তাঁর স্ত্রীকে ফিরে পেয়ে পরম আনন্দে আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করলেন।
বিবিও পুনরায় স্বামীর কাছে ফিরে আসতে পেরে আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া প্রকাশ করলেন। তবে এ সময় হারিয়ে যাওয়া তাঁদের পুত্রদ্বয়ের কথা মনে পড়ে দুজনের আনন্দ অশ্রুতে পরিণত হলো।
এর দুই দিন পর হযরত ইউনুস (আঃ) এক স্থানে বসে কয়েকজন লোককে উপদেশ দিচ্ছিলেন। এমন সময় একজন ব্যক্তি এসে বলল,
“হুজুর! কিছুদিন আগে আমরা প্রায় আঠারোজন লোক একসঙ্গে জঙ্গলে কাঠ কাটতে গিয়েছিলাম। হঠাৎ দেখি— একটি বাঘ মুখে করে এক বালককে নিয়ে দ্রুত জঙ্গলের ভিতরে প্রবেশ করছে!
আমরা সবাই অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে বাঘটিকে ধাওয়া করলাম। কিছু দূর গিয়ে বাঘটিকে ভয় দেখাতে পারলে সে বালকটিকে ফেলে পালিয়ে যায়।
বালকটির অবস্থা ছিল মুমূর্ষু। আমি তাঁকে আমার ঘরে নিয়ে আসি এবং বহু চিকিৎসা ও সেবা-শুশ্রূষা করি। আল্লাহর মেহেরবানীতে সে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠে।
সুস্থ হওয়ার পর সে আমাদের সব কথা খুলে বলে এবং জানায়— সে আপনারই পুত্র!
হুজুর! আমার সাথীরাও তার সঙ্গে এখানে আসছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা এসে উপস্থিত হবে।”
কিছুক্ষণ পরেই বালকটি সেখানে উপস্থিত হলো।
হযরত ইউনুস (আঃ) নিজের পুত্রকে এভাবে অলৌকিকভাবে ফিরে পেয়ে আনন্দে পরিপূর্ণ হয়ে গেলেন। তিনি আল্লাহর দরবারে লাখো শুকরিয়া আদায় করলেন। তাঁর দুই চোখ থেকে তখন অবিরলভাবে আনন্দাশ্রু প্রবাহিত হতে লাগল।
এর পরদিন হযরত ইউনুস (আঃ) এক বিশাল জনসমাগমে ওয়াজ করছিলেন। এক পর্যায়ে কিছুক্ষণ বিশ্রামের জন্য তিনি বসে পড়লেন। ঠিক সেই সময় এক ব্যক্তি দণ্ডায়মান হয়ে শ্রোতাদের উদ্দেশে বলল—
“হে উপস্থিত ভাইয়েরা! কয়েক দিন আগে একটি শিশু নদীতে ভাসমান অবস্থায় পাওয়া গেছে। কারও শিশুসন্তান হারিয়ে থাকলে, দয়া করে এসে শিশুটিকে নিয়ে যান।”
লোকটির কথায় উপস্থিত কেউ কোনো সাড়া দিল না। কিন্তু হযরত ইউনুস (আঃ) লোকটিকে জিজ্ঞাসা করলেন,
“বল তো, কোথায় এবং কীভাবে শিশুটিকে পেয়েছ?”
লোকটি উত্তর দিল,
“হুজুর, আমি নদীতে গোসল করছিলাম। হঠাৎ দেখি— একটি ভাসমান ঝোপের উপরে একটি শিশু পানির স্রোতে ভেসে যাচ্ছে। তাকে দেখে মনে হলো সে মৃত নয়। তখন আমি দ্রুত শিশুটিকে পানি থেকে তুলে নিই। তবে সে কথা বলতে পারছিল না, তাই তার পরিচয় জানা সম্ভব হয়নি। এখন ছেলেটিকে নিয়ে আসছি।”
এ কথা বলে লোকটি অদূরে দাঁড়ানো আরেকজন ব্যক্তির কোল থেকে শিশুটিকে নিয়ে হযরত ইউনুস (আঃ)-এর সামনে উপস্থিত করল।
হযরত ইউনুস (আঃ) শিশুটিকে দেখামাত্র চিৎকার করে উঠলেন—
“হে আমার রব! তোমার কী অপার মহিমা!”
এ কথা বলতে বলতে তাঁর নয়নদ্বয় বেয়ে অশ্রুবিন্দু ফোঁটা ফোঁটা ঝরতে লাগল।
অতঃপর কিছুটা স্থির হয়ে হযরত ইউনুস (আঃ) তাঁর স্ত্রী ও দুই পুত্রের হারিয়ে যাওয়া এবং পুনরায় ফিরে পাওয়ার বিস্তারিত ঘটনা উপস্থিত সবার সামনে বর্ণনা করলেন।
সমবেত জনতা এই বিস্ময়কর ঘটনা শুনে গভীর শ্রদ্ধা ও ভাবনায় নিমগ্ন হয়ে গেল। সবাই পরম ভক্তি নিয়ে আল্লাহ তাআলার কুদরতি মহিমা ও অসীম শক্তির কথা চিন্তা করতে লাগল।
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।