মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমী (র)

বিশ্বের অন্যতম সেরা সাধক কবি জালাল উদ্দিন রুমী (র) এর পিতার নাম বাহাউদ্দিন ওয়ালিদ। তিন ছিলেন সে সময়কার বিখ্যাত কবি ও দরবেশ। িইরানের রুম দেশের অন্তর্গত কুনিয়ার শাসক আলাউদ্দিন কায়কোবাদ দরবেশ বাহাউদ্দিনকে কুনিয়ায় আসার দাওয়াত দেন। দাওয়াত পেয়ে বাহাউদ্দিন সপরিবারে কুনিয়ায় চলে আসেন এবং সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন। রুম প্রদেশের নাম অনুসারে জালাল উদ্দীন রুমী নামে খ্যাতি লাভ করেন।

জালালউদ্দিন ১২০৭ খৃষ্টাব্দে ২৯শে সেপ্টেম্বর বলখ নগরে জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলা থেকেই তার মধ্যে অলৌকিক বিষয় দেখা যেত। তিন খেলাধুলা ও আমোদ প্রমোদে লিপ্ত থাকা পছন্দ করতেন না। বরং ধর্মীয় আলোচনা পছন্দ করতেন। ৬ বছর বয়স থেকে রোজা রাখতে শুরু করেন। ৭ বছর বয়সে তিনি সুমধুর কণ্ঠে কোরআন তেলাওয়াত করতেন। এ সময় তার দু’চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তো।

 

৬ বছর বয়সে তিনি পিতার সাথে ভ্রমনে যান। নিশাপুর গিয়ে বিখ্যাত কবি ও সুফী সাধক শেষ ফরিদ উদ্দিন আত্তারের সাথে সাক্ষাৎ করেন। শেষ ফরিদ উদ্দিন আত্তার বালক জালা উদ্দিনের চেহারা দেখে তার উজ্জল ভবিষ্যত বুঝতে পেরে তার জন্য দোয়া করেন। তিনি তার প্রতি বিশেষ নজর রাখার জন্য পিতার প্রতি উপদেশ দেন। নিশাপুর ভেড়ে পিতা বাহাউদ্দিন পুত্র জালাল উদ্দিনকে সাথ নিয়ে হজ্ব পালন করেন। পরে বাগদাগ সহ বিভিন্ন দেশ ভ্রমন করেন। এ সফর কালে পিতা পুত্রকে বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা দান করেন।

১২৩১ সালে বাহাউদ্দিন ইন্তেকাল করেন। পিতার মৃত্যুতে জালাল উদ্দিন ভেঙ্গে পড়লেন। এর ফলে তার পড়ালেখায় বিঘ্ন ঘটে। পিতার মৃথ্যুর আগে মাও ইন্তেকাল করেছিলেন। ফলে তিনি একদম ইতিম হয়ে পড়েন। এ সময় তার পিতার ছাত্র ও মুরিদ সৈয়দ বোরহান উদ্দিন তার পাশে এসে দাঁড়ালেন। তিনি জালাল উদ্দিনকে আবার পড়া লেখায় নিয়োজিত করলেন। তিনি তাঁকে ৭/৮ বছর পর্যন্ত শিক্ষাদান করেন।

 

উচ্চতর শিক্ষা লাভের জন্য তিন  চলে যান সিরিয়ায়। দামেস্কে গিয়ে তিনি সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ে ৭ বছর পড়ালেখা করেন। িএরপর ৪০ বছর বয়স পর্যন্ত জ্ঞানের সন্ধানে তিনি নানান দেশে যান। যেসব বিখ্যাত সাধক ও পন্ডিতদের সাথে তার সাক্ষাৎ হয় তাদের মধ্যে ছিলেন, সাধক শামসুদ্দিন তাব্রীজ (র) ইবনে আল আরাবী (র) সালাউদ্দিন ও হুসামউদ্দিন। এসব ব্যক্তি তার সময়ের শ্রেষ্ঠ পন্ডিত ও সাধক ছিলেন।

পিতার মৃত্যুর পর তিনি নিজেকে জ্ঞানীরূপে গড়ে তোলেন। বিভিন্ন দেশ থেকে হাজার হাজার লোক তাঁর কাছে আসতে থাকে। তিনি তাদের শিক্ষা দান করেন। তিনি বহু মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেন। এর মধ্যে উল্লেখ যোগ্য হল, মসনবী ও দিওয়ান। এ দু’টি গ্রন্থ তাকে অমর করে রেখেছে। বাংলা ভাষাসহ বিভিন্ন ভাষায় এই মসনবীর অনুবাদ হয়েছে।

 

ৈইরানে পবিত্র কোরআন ও হাদিসের পর মসনবীকে যথার্থ পথ প্রদর্শক বলে মনে করা হয়। ‍দিওয়ানে রয়েছে ৫০ হাজার শ্লোক। এগুলো সবই আধ্যাত্মিক গজর।

জালাল উদ্দিন ছিলেন মহাপন্ডিত। একই সাথে তিনি তাঁর মাবুদ আল্লাহ পাককে সঠিকভাবে চিনতে পেরেছিলেন। এক্ষেত্রে তিনি যুক্তি তর্ককে প্রাধান্য দেননি। বরং বিশ্বাস ও ভক্তির উপর জোর দিয়েছেন। তিনি স্রষ্টাকে ভালবাসার মাধ্যমে পেতে চেয়েছেন। আর সেভাবেই তাকে তিনি লাভ করেছেন।

খোদাকে চেনার জন্য জ্ঞানকে বলা হয় ইলমে মারেফাত। আর খোদার দেয়া বিশেষ জ্ঞানকে বলা হয় ইলমে লাদুনি। এই জ্ঞান থাকতেল যেকোন বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া যায়। জালাল উদ্দিনের মধ্যে এ দুটি জ্ঞানই পুরা মাত্রায় ছিল।

 

মানুষের দেহ মানবাত্মা ও আল্লাহর মধ্যে মিলনের সবচেয়ে বড় বাধা। দেহের মধ্যে যে কামনা ও বাসনা রয়েছে তা মানুষকে সব সময় সত্যপথ থেকে আলাদা করে দেয়- যা মানুষকে ব্যক্তিত্ব বা অহংকার প্রদান করে এবং তাকে ভোগ করার লিপ্সায় মত্তা করে দেয়। এই জৈব আকাংখার নাম নফ্‌স। নফস কে ধ্বংস করলে দেহের কর্তৃত্ব আর থাকে না। এর ফলে আত্মার স্বাধীনতা পূর্ণতা লাভ করে। তাই নফসের বিরুদ্ধে মানুষকে আজীবন সংগ্রাম করে যেতে হয়। জালালউদ্দিনও তার সারাটা জীবন নফসের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে গেছেন।

জালাল উদ্দিন মনে করতেন বুদ্ধি, যুক্তি ও ভক্তি এক নয়। বুদ্ধি ও যুক্তি দিয়ে আল্লাহকে চেনা বোঝা ও পাওয়া যায় না। এর জন্য প্র্রয়োজন বিশ্বাস ও ভক্তি। ভক্তি হচ্ছে আল্লাহর প্রতি ভালবাসার পথ। আর ভক্তির উৎস হল প্রেম ও আসক্তি। তাঁর মতে আল্লাহকে বুঝতে ও চিনতে হলে ভক্তি ও বিশ্বাসের প্রয়োজন। তাহলেই মনদিয়ে আল্লাহকে বুঝতে পারবে। মানুষ যখন মারেফাতের উঁচু স্তরে উঠে তার নিজের মধ্যে আল্লাহর প্রকাশ অনুভব করে তখন তার ব্যক্তিত্বের সীমারেখা কোথায় ভেসে চলে যায়। তিনি তখন সসীম হয়েও অসীমের ভেতর নিজেকে হারিয়ে ফেলেন। অন্য কথায় বলা যায় তিনি নিজের সীমার ভেতরেই অসীমের সন্ধান পান। তখন তিনি চরম আনন্দ লাভ করেন। এ সময় পৃথিবীর সকল ধন ঐশ্বর্য্য ও তার কাছে আসার বলে মনে হয়। মারেফাতের স্তর আর বাড়লে এমন এক পর্যায়ে আসে যখন মানুষের আত্মা ও আল্লাহর মধ্য আর কোন ভেদাভেদ থাকে না। অবস্থার নাম হল- হাল। মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমীই এসব কথা মানুষকে জানিয়েছেন। এই পৃথিবীতে থেকে মানুষের দেহ বজায় রেখে বান্দ কিভাবে আল্লাহ পাকের সাথে মিলে যেতে পারে তার নজিরও তিনি দেখিয়েছেন।

 

তিনি ভাগ্য ও পুরষ্কার সমস্যার সহজ সমাধান দিয়েছেন। তিনি বলেন, মানুষের সব কাজের নিয়ন্ত্রণ কারী আল্লাহ। আল্লাহ মানুষকে কতগুলো কাজের স্বাধীনতা দিয়েছেন। মানুষ এসব বিষয়ে নিজেই তার কর্মপন্থা নির্ধারনের অধিকার রাখে। এসব কাজের ফলাফলের জন্যও মানুষ দায়ী। কারণ এগুলো করা বা না করার এখতিয়ার মানুষকে দেয়া হয়েছে। অবশ্যই কর্মকরার শক্তি আল্লাহই তাকে দিয়েছেন। জালাল উদ্দিন এসব বিষয় সুন্দরভঅবে মানুষকে জানিয়ে দিয়েছেন। তিন নিজেও যেমন পন্ডিত ছিলেন তেমনিই ছিলেন মহাসাধক। তিনি ছিলেন খোদার প্রেমে পাগল মহান এক ব্যক্তি।

জালালউদ্দিন সাদাসিধে ভাবে চলাফেরা করতেন। যতটুকু না হলে চলে না ততটুকুই তিনি ব্যবহার করতেন। কোন কিছুতেই তার চাকচিক্য বা জাঁকজমক ছিল না। তিনি দুনিয়ার ধন সম্পদ আর মালসামানাকে কোন গুরুত্ব দিতেন না। ভোগ বিলাস তো দূরের কথা। তিনি প্রয়োজনের চেয়ে সামান্য বেশী সম্পদও গ্রহণ করতেন না। তিন খোদাকে চেনা ও জানার এবং তার সাথে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। এ কারণে তার কাছে দুনিয়অর যাবতীয় সম্পদ তুচ্ছ বলে মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। তার ইন্তেকালের সময় তার সঞ্চিত কোন ধন সম্পদ ছিল না।

 

সারা জীবনতিনি জ্ঞান অর্জন করেছেন এবং সে জ্ঞান অনুযায়ী নিজেকে পরিচালিত করেছেন। এভাবে ৬৬ বছর বয়সে তিনি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। জালাল উদ্দিন অসুস্থ।  একথা সর্বত্র করেছেনকভ রাষ্ট্র হয়ে পড়লো। এর ফলে তার অগনিত ভক্ত চারদিকে থেকে ছুটে আসল তার কাছে। সে যুগের বড় বড় চিকিৎসকরা স্বেচ্ছায় এগিয়ে এলন তার চিকিৎসা করতে। এদের মধ্যে চিলেন বিখ্যাত চিকিৎসক শেখ সদরুদ্দিন, আকমল উদ্দিন ও গজনফার। কিন্তু তারা ব্যর্থ হলেন। তাদের চিকিৎসা েএই খোদা প্রেমিকের দেহে কোন কাজেই এল না। এ সময় জালালউদ্দিন চিকিৎসক শেখ সদরুদ্দিকে লক্ষ্য করে বললেণ, আশেক ও মাশুকের মধ্যে ব্যবধান রয়েছে একটি মাত্র পর্দার। আশেক চাচ্ছে তার মাশুকের কাছে চলে যেতে। পর্দাটা যেন দ্রুত উঠে যায়। শেখ সদরুদ্দিন বুঝতে পারলেন, জালালউদ্দিন এই পৃথিবী ছেড়ে আল্লাহর সাথে মিলিত হতে চাচ্ছেন। তাঁর আয়ু শেষ হবার পথে। জালাল উদ্দিন তার মাশুক আল্লাহর কাছে চলে যাওয়া প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এ সময় তিনি তার ভক্ত মুরিদদের সান্তনা দদিয়ে কিছু উপদেশ দিলেন।

 

তিনি বললেন, নিজের মন মত চলা বাদ দিতে হবে। পাপ পথ ছাড়তে হবে। নামাজ ও রোজা কখনো কাযা করা যাবে না। মনের মধ্যেও যেমন আল্লাহর ভয় রাখতে হবে তেমনিই বাইরেও আল্লাহর ভয় থাকতে হবে। বিপদ এলে সবর করতে হবে। বিদ্রোহ ও প্রতিশোধ গ্রহণের ইচ্ছা রাখা চলবে না। ঘুম একথা বলার ব্যাপারে সংযম অবলম্বন করতে হবে। কাউকে কোন রকম কষ্ট দেওয়া যাবে না। সব সময় সৎ লোকদের সাথে থাকতে হবে। যার দ্বারা দেশ ও জাতির কল্যাণ হয় সে রকম মানুষই শ্রেষ্ঠ। তিনি আরো বলেন, মানুষের দেহ নশ্বর। কিন্তু তার আত্মা অবিনশ্বর। দেহ ধ্বংস হবে। কিন্তু আত্মা বা রুহের কোন ধ্বংস নেই। জালালউদ্দিন ১২৭৩ খৃষ্টাব্দে ১৬ই ডিসেম্বর ইন্তেকাল করেন।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!