ছবিতে রঙ দিতে তখনো বাকি আছে কিছুটা। মুখটা প্যাঁচার মতো গোমড়া করে বসে আছে রশ্মি। কোথাও যেন একটু ভুল হয়েছে। অসমাপ্ত ছবির দিকে তাকিয়ে মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে বারবার। ছবিটি সত্যি মন খারাপের। “না আর রঙ দিয়ে লাভ নেই। অসমাপ্তই থাকুক ছবিটা।” মনে মনে একথা বলে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো রশ্মি।
বাইরে তাকিয়ে মনটা আরও বেশি খারাপ হয়ে গেলো রশ্মির। গতরাতের ঝড়ের তাণ্ডব ছবির চেয়েও মন খারাপের। হঠাৎ ওর মনে পড়ে গেলো মহুয়ার কথা। মহুয়ার কথা মনে পড়তেই মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেলো ওর। মহুয়ারা থাকে পাশের মহল্লার ছোট্ট একটা খুপড়ি ঘরে। বাবার মুখে সকালেই শুনেছে হাজার হাজার ঘর-বাড়ি ধ্বংস হয়ে গেছে ঝড়ের তাণ্ডবে। শত শত মানুষের জীবন কেঁড়ে নিয়েছে নিষ্ঠুর এই ঝড়।
মহুয়া রশ্মীর ক্লাসমেট। হতদরিদ্র একটা মেয়ে । কিন্তু কত ভালো একটা মন ওর। স্কুলের সময়টুকু বাদে সারাদিন ও বাবার সাথে চায়ের দোকানে সময় দেয়, বাবাকে সাহায্য করে। ঘরে তার মা অসুস্থ। ঘরের সব কাজও নিজের হাতে সামলায়। শত প্রতিকূলতাকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে পরীক্ষায় খুব ভালো ফলাফল করে আসছে। স্বপ্ন দেখে বড় হয়ে ডাক্তার হবে। নিজের হাতে মাকে সারিয়ে তুলবে।
মহুয়ার কথা ভেবে চোখের জল আটকাতে পারলো না । ‘ইস! না জানি কি করে রাতটা কাটিয়েছে ওরা। না জানি কেমন আছে এখন।’ হুহু করে কেঁদে ফেললো।
-’ কিরে মা? কাঁদছিস কেন? কি হয়েছে তোর?’ রশ্মির মা মিসেস কবীর এসে পাশে দাঁড়ালেন।
ও কোন জবাব দিতে পারলো না। মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো অঝোরে।
মিসেস কবীর আবার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ মাকে বল কি হয়েছে? ‘
-’ মা বিধাতা এতো নিষ্ঠুর কেন?’
মায়ের চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,’ আজ যদি সবার আমাদের মতো মজবুত ঘর থাকতো, তবেতো কেউ এই কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হতো না মা। কেউ তার স্বর্বস্ব হারিয়ে , বাঁচার সম্বলটুকু হারিয়ে হাহাকার করতো না। আমাদের মতো আর্থিক সচ্ছলতা থাকলে কেউতো দিনের পর দিন না খেয়ে পরের দুয়ারে দুয়ারে হাত পাততো না? ”
– ‘এটাই যে বাস্তবতা মা।’ মিসেস কবীর বললেন,’নিষ্ঠুর হলেও এই সত্যকে কেউ অস্বীকার করতে পারে না। মেনে নিতে হয়।’
রশ্মি মায়ের বুকের মধ্যে মুখ লুকিয়ে নিষ্ঠুর পৃথিবীর গল্প শুনলো। ধনী দেশগুলোর সুখের মাসুল নাকি আমাদের মতো দেশগুলোকে গুনে যেতে হচ্ছে। ওর অশ্রু শুকালো না, বেড়েই চললো। একদলা জমানো ঘৃণা ছড়িয়ে বললো, ‘ছিঃ! মানুষ ছিঃ!’
মাকে নিয়ে ও মহুয়াদের মহল্লায় গেলো। পথের বীভৎস দৃশ্য ওকে আরও কাতর করে ফেললো। খুব চিন্তা হতে লাগলো মহুয়ার জন্য।
যখন মহুয়াদের পাড়ায় পৌছালো, নিজেকে সামলে রাখতে পারলো না। এই মহল্লার একটা বাড়িও টিকে নেই। চিৎকার করে কাঁদছে অসহায় মানুষগুলো, অভিশাপ দিচ্ছে ভাগ্যকে, ধিক্কার জানাচ্ছে সৃষ্টিকর্তাকে । নির্মম,নিষ্ঠুর সে দৃশ্য ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। অজানা শঙ্কায় মাকে জড়িয়ে ধরলো রশ্মি। ওর চোখ মহুয়াদের বাড়িটা খুঁজে ফিরছে। অসহায় মানুষের ক্রন্দন আর আহাজারিতে থমথমে হয়ে আছে চারদিক। এই বিদ্ধস্ত মহল্লায় মহুয়াদের লাল টিনের ছোট্ট খুপড়িটা খুঁজে পাচ্ছে না রশ্মি।
-’ওখানে এতো ভীড় কেন মা?’ মাকে দেখিয়ে বললো,’ওইতো মহুয়াদের ঘরটা পড়ে আছে। এতো মানুষ কেনো ওখানে?’
ছুটে গেলো ওরা। একটা চাপা কান্নার আওয়াজ ভেসে এলো,ভীড় ঠেলে এগিয়ে গেলো ওরা। ওইতো দেখা যাচ্ছে মহুয়ার বাবাকে, মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। ওইতো ওর মা, চিৎকার করে কাঁদছে। কেনো? কি হয়েছে? রশ্মি ছুটে গেলো। মায়ের সামনে লাল জামা পরে কে শুয়ে আছে? ‘মহুয়া?’ রশ্মি চিৎকার করে ছুটে গেলো জড়িয়ে ধরলো মাটিতে শুইয়ে রাখা নিথর দেহটিকে।
-’মহুয়া? কি হয়েছে তোর… কথা বল মহুয়া। কথা বল…প্লিজ কথা বল…’ মহুয়ার নিথর দেহটাকে জড়িয়ে ধরে রশ্মি ডাকছে মহুয়াকে। কিন্তু মিষ্টি মেয়ে মহুয়া সাড়া দিলো না।
একবুক স্বপ্ন নিয়ে সংগ্রামী এক মহুয়া নিয়তির নাও ভাসিয়ে হারিয়ে গেলো দূর অজানার দেশে। যেখানে বিভেদের চোরাগলিতে হিংসা-বিদ্বেষ নেই, যেখানে নেই হারানোর কিছু। হারিয়ে যাওয়া মানুষের সাথে নতুন এক অচেনা জগতের পথে মহুয়া। পিছে পড়ে রইলো তার বুকভরা স্বপ্ন আর অনেক অনেক প্রিয়জন।
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।