মহুয়ার সুন্দর দৈত্য

আমার পাঁচ বছর বয়সী মেয়ে মহুয়া যেমন চঞ্চল তেমনই বুদ্ধিমতি। সারাটাক্ষণ সে হইচই করে যেন বাড়িটি মাথায় তুলে রাখে। এ নিয়ে তার মায়ের অনুযোগের কোন শেষ নেই। বাবার অতিরিক্ত আহ্লাদে মেয়েটি আমার নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বলে ওর মায়ের আশঙ্কা। রাতে আমাকে জড়িয়ে না ধরলে ঘুমাতে পারে না মহুয়া। আর প্রতি রাতেই নতুন নতুন গল্প না বললে তো তার ঘুমই আসে না। সকালে আমি দৈনিক পত্রিকা পড়তে বসলে সে-ও আমার মতো পত্রিকা হাতে নিয়ে পড়ার চেষ্টা করবে, পত্রিকার ছবিগুলোকে রং পেন্সিল দিয়ে নিজের মতো করে রাঙাবে।
পত্রিকার ছবির উপর ছবি আঁকতে নাকি তার খুবই ভালো লাগে। আবদারের সুরে প্রায়ই বলে, ‘আব্বুয়া, এই ছবিটা নতুন করে আঁকি?’ আমাকে ভালোবেসে সে ‘আব্বুয়া’ বলে। আমি তাতে না করি না, মিষ্টি সুরের আলতোভাবে ডাকটাকে বেশ উপভোগই করি। আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের ছবিতে সে যেভাবে মনের মাধুরী মিশিয়ে রং লাগিয়ে নতুনত্ব আনে তা দেখে ওর মা সেদিন রসিকতা করে বলছিলো, ‘নেতারা তোমার মেয়ের আঁকা ছবি দেখলে দেশে বাস করাই তো দায় হবে।’ আমার কাছে শুনে শুনে দৈত্য আর ভূতের গল্প মহুয়ার খুবই প্রিয় হয়ে ওঠে মহুয়ার। আমার কাছে সে আরব্য রজনীর চেরাগে হাতের স্পর্শে দৈত্যের জন্মের গল্প শোনে, জেলের জালের বোতলের ছিপি খুলতেই দৈত্যের জন্ম নেওয়ার গল্প শোনে অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে। দৈত্যের গল্প শুনতে শুনতে সে প্রায়শই রং পেন্সিল নিয়ে বসে যায় বিভিন্ন ধরনের দৈত্যের ছবি আঁকতে। আমি সে ছবি দেখে হাসব না কাঁদব বুঝে উঠতে পারি না। কিন্ত মুখে সে ছবির খুব প্রশংসা করি, ‘এক্সিলেন্ট’ বলতে হয়। তা না হলে মুখ গোমরা করে বসে থাকে মহুয়া। তো একদিন ভোরবেলায় আমাকে ঘুম থেকে জোর করে ডেকে তুলে সে সুন্দর এক দৈত্যের অদ্ভুত কাহিনী শোনাল। ‘জানো আব্বুয়া, গতকাল না আমার কাছে একটা সত্যি সত্যি একটা সুন্দর দৈত্য এসেছিলো। আমি তো আমার বন্ধু এষা, রাইসা, ঐষীদের সাথে খেলছিলাম। সেসময় সুন্দর দৈত্যটা এসে আমাকে বলে কি, তুমি কি মহুয়া? আমি তো দৈত্যটাকে দেখে অবাক। জানো আব্বুয়া সেই কালো, লম্বা, লম্বা শিংওয়ালা দৈত্যটাকে দেখে আমি তো মোটেই ভয় পাইনি। কিন্ত এষা, রাইসা, ঐষীরা সবাই ভয় পেয়ে কাঁপছিলো। তো সেই দৈত্যটা আমাকে বলল, মহুয়া, আজ থেকে আমি তোমার কেনা গোলাম। তুমি আমাকে যখনই যা যা করতে বলবে আমি তোমার কথামতো তাই তাই করবো। দৈত্যটাকে আমি তো প্রথমেই বললাম, আমার বন্ধুদের ভয় দূর করে দাও। আর সঙ্গে সঙ্গেই না ওরা ওদের হাত প্রিয় ছবি আঁকার ম্যাজিক পেন্সিল, রংয়ের বক্স, খাতায় ভরে গেল। ফলে ওরা সবাই ভীষণ খুশিতে হেসে উঠলো। জানো আব্বু, দৈত্যটা না, না চাইতেই আমাকেও সেসব দিলো।
আমাকে আরও দিলো চকলেট, চিপস, চুইংগামের বড় একটা বক্স। এরপর দৈত্যটা আমাদের পাশে বসে বলল, তোমরা সব খাও আর আমার ছবি আঁকো, আমি বসে বসে দেখবো। যে আমার সবচেয়ে সুন্দর আর ভালো ছবি আঁকবে আমি তাকে আরো অনেক উপহার এনে দেব। আমি ছবি আঁকতে আঁকতে পানি খেতে চাইলে দৈত্যটা করলো কি জানো? পানি খাবো বলার সাথে সাথেই কোথা থেকে যেন অনেক জুসের প্যাকেট এনে আমার সামনে হাজির করলো। আর আমার চালাক বন্ধু এষা তো আইসক্রিম খেতে খুব পছন্দ করে। আমার দেখাদেখি সেও দৈত্যটাকে বলল, আমি আইসক্রিম খাবো। সুন্দর দৈত্যটা এষার জন্যও না ততক্ষণই অনেক আইসক্রিম নিয়ে এলো। আমরা সবাই সে সব খাবার ভাগাভাগি করে খু-উ-ব মজা করে খেলাম। জানো, সে সময় আমরা কিন্ত মোটেই হইচই করিনি।’ একটানে এত কথা বলার পরও মহুয়াকে একটুও ক্লান্ত লাগছিলো না। কিন্ত এবার আমি জানতে চাইলাম, ‘তোমরা হইচই করোনি কেন মা?’ মহুয়া আবার বলতে শুরু করলো, ‘আম্মু যদি টের পেয়ে যায়, তাই আমরা একটুও জোরে কথা বলিনি। জানো তো, আম্মুটা না এসব আমাদের মজা করে খেতে দিতো না, সব কেড়ে নিয়ে ধমক লাগাত আর বলত-, বেশি বেশি খেলে শরীর খারাপ করবে। আম্মুটা যে কী, তোমার মতো একটুও বোঝে না।’ আমি আবার জানতে চাইলাম, ‘তা তোমার সুন্দর দৈত্যটা এরপরে কি করল? মহুয়ার উৎসাহ বেড়ে গেল, ‘আমরা তো মজা করে খাচ্ছিলাম আর দৈত্যের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে তার ছবি আঁকছিলাম। জানো আব্বুয়া, কে কত সুন্দর ছবি এঁকে দৈত্যটাকে উপহার দিতে পারে সেই প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছিলো আমাদের মধ্যে। দৈত্যটা চুপচাপ বসে ছিলো আর আমাদের আঁকা দেখছিলো। আমাদের ছবি আঁকা শেষ হলে দৈত্যটাকে আমরা দেখতে দিলাম।
রাইসা না দৈত্যটাকে লাল আর হলুদ রঙে এঁকেছিলো। আর আমি সাদা আর সবুজ রঙে এঁকেছিলাম। সেইসব ছবি দেখে দৈত্যটা যে কী মহা খুশিই না হলো। সবাইকেই সে ভালো বলল আর ছবির পিছনে সকলের নাম ঠিকানা লিখে দিতে বলল। আমরা তো মহাখুশিতে লিখে দিলাম। এরপর দৈত্যটা আমাদের সবার হাতে একটা করে গোলাপ ফুল উপহার দিলো। বলল, ভয় নেই তোমাদের, কোনো কাঁটা নেই এই গোলাপে, সেই বসরা নগরী থেকে এনেছি তোমাদের জন্য। দৈত্যটা আমাদের বলল, তোমরা সবাই চোখ বন্ধ করে নাকের কাছে নিয়ে গোলাপের গন্ধ নাও তো! আমরা যেই না গন্ধ নিতে চোখ বন্ধ করেছি, অমনি দেখি একটা দারুণ মিষ্টি গন্ধে ঘরটা ভরে গেছে। জানো আব্বুয়া, দৈত্যটা না ভীষণ দুষ্টু। আমরা চোখ খুলতেই দেখি সে আর আমাদের সামনে নেই। সে আমাদের সব ছবি কোথায় যেন চলে গেল। সবাই মিলে অনেক খুঁজেও আমরা আর দৈত্যটার দেখা পেলাম না। শেষে জোরে জোরে ‘সুন্দর দৈত্য, সুন্দর দৈত্য’ বলে ডাকাডাকি শুরু করতেই আম্মু এসে ‘কোথায় দৈত্য’ ‘কোথায় দৈত্য’ বলে আমাদের বকাবকি শুরু করলো।’
ভোরের আলোয় বিছানায় আমি মহুয়াকে বুকে টেনে নিলাম। বললাম, ‘এখনো কি গোলাপের গন্ধ টের পাচ্ছো মামনি?’ বিস্মিত মহুয়া আমাকে বলল, ‘তুমি কি করে বুঝলে আব্বুয়া? তুমিও কি আমার মতো এখনো গন্ধ টের পাচ্ছো?’ আমার আর বুঝতে বাকি থাকল না মেয়েটি আমার বাপের কাছে দৈত্যের গল্প শুনতে শুনতে ভোর রাতে ঘুমের মধ্যেও দৈত্যকে নিয়ে সুন্দর একটি স্বপ্ন দেখেছে। যে কাহিনীটি সে এইমাত্র আমাকে শোনাল ।

এশিয়ান হাইওয়ে ও একটি দৈত্যের গল্প।

প্রদীপের দৈত্য ও ইচ্ছে পুরনের গল্প

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *