মর, তবু দম দে’

মর, তবু দম দে’

বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই ‘পরিশ্রম সৌভাগ্যের প্রসুতি’ এই প্রবাদটি শুনেছো। প্রবাদটির অর্থ হলো, পরিশ্রম ও চেষ্টা-সাধনার মাধ্যমেই মানুষ সৌভাগ্য লাভ করে। পরিশ্রম তথা কাজ ছাড়া জীবনে কেউ সফল হতে পারে না। আর তাই তো ইসলাম ধর্মে কাজের ওপর বেশ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। কেবল পড়াশোনা করলেই চলবে না, নিজের অন্যান্য কাজগুলোও সাধ্যানুযায়ী করতে হবে। কারণ আমাদের প্রিয় নবী (সা.) এবং নবী বংশের মহান ইমামগণ নিজের কাজ নিজেই করেছেন। রাসূল (সা.) বলেছেন, “নিজের কাজে কখনো অপরের সাহায্য নেয়া উচিত নয়। আর কারো ভরসা করাও ঠিক নয়।” নিজের কাজ নিজে করার ব্যাপারে রাসূল (সা.) যেমন গুরুত্ব দিয়েছেন, তেমনি নিজে তা করিয়ে দেখিয়ে গেছেন।

বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই শুনেছো যে, নবুয়ত পাওয়ার পরপরই মক্কার কুরাইশরা রাসূল (সা.)-এর বিরুদ্ধে বাধার পাহাড় হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। এমন সময় সিংহপুরুষ আবু তালিবও ঘাবড়ে গিয়ে ভাতিজা মুহাম্মদ (সা.)-কে কুরাইশ নেতৃবৃন্দের সাথে একটি আপোসরফা করে চলার জন্য বলেন। তখন কি হলো জানো? আমাদের প্রিয় নবী কি ঘাবড়ে গিয়েছিলেন? মোটেই না। বরং দ্বিগুণ তেজে বলেছিলেন, “ওরা আমার এক হাতে যদি চন্দ্র এবং আরেক হাতে সূর্যকেও এনে দেয়, তবুও আমার পথ থেকে আমি এক চুল পরিমাণও বিচ্যুত হব না।” জীবনে এমন কঠিন অঙ্গীকার ছিল বলেই রাসূল (সা.) পরবর্তীতে সমগ্র জাহানের অধিপতি হতে পেরেছিলেন। এত অল্প সময়ে রাসূল (সা.)-এর অবিস্মরণীয় সাফল্যের পেছনে শুধুমাত্র আল্লাহর সাহায্যই নয়, বরং তার সুদৃঢ় আকাঙ্ক্ষা এবং সাধনাও মূল কারণ হিসেবে কাজ করেছে। আর তাইতো আমেরিকার সবচেয়ে সফল প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন বলেছেন, “যদি কেউ গভীরভাবে উকিল হওয়ার ইচ্ছা করে, তবে অর্ধেক ওকালতি পড়া হয়ে যায়, আর বাকি অর্ধেকটা তাকে বই পড়ে শিখতে হয়।” ঠিক তেমনি আটলান্টিকের ওপর দিয়ে সবার আগে উড়ে যাওয়া অ্যামেলিয়া আরহার্ট বলেছেন, “আমি আটলান্টিকের ওপর দিয়ে উড়ে গিয়েছিলাম কারণ আমি উড়তে ইচ্ছা করেছিলাম।”

বন্ধুরা, শুধু সুদৃঢ় আকাঙ্ক্ষা নিয়ে চুপটি করে সোফায় বসে থাকলেই সাফল্য আসবে? না, একদম না। তাহলে উপায়? হ্যাঁ, আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবায়ন করতে চাইলে দরকার চেষ্টা আর পরিশ্রম। একটি উদাহরণ দিলেই বিষয়টি তোমাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে। প্রায় এক হাজার নতুন বিষয়ের আবিষ্কারক বৈজ্ঞানিক এডিসনের মৃত্যুর পর নিউইয়র্ক পত্রিকায় লেখা হয়, “মানুষের ইতিহাসে এডিসনের মাথার দাম সবচেয়ে বেশি। কারণ এমন সৃজনশক্তি অন্য কারো মধ্যে দেখা যায়নি।” অথচ ১৮৭৯ সালের ২১ অক্টোবর তার আবিষ্কৃত পৃথিবীর প্রথম বৈদ্যুতিক বাতিটি যখন জ্বলে উঠলো, তখন ক’জন জানতো যে বিগত দু’বছরে তিনি এটি নিয়ে প্রায় দশ হাজার বার ব্যর্থ চেষ্টা করেছেন! সত্যি সাফল্যের পেছনে মানুষের কী নিদারুণ সাধনা আর পরিশ্রম!

বন্ধুরা, পরিশ্রম যেমন সাফল্য আনে, তেমনি অলসতা মানুষের ধ্বংস ডেকে আনে। অলস মানুষরা পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। এরপর মানুষ অলসতা করে। তো অলসতা নিয়ে আজকের একটি গল্প শোনাব। ‘মর, তবু দম দে’ আগেকার দিনে যারা লোহা লক্কড়ের কাজ করতো, মানে লোহা দিয়ে বিভিন্ন হাতিয়ার বানাত, তাদেরকে বলা হতো কামার। কামারেরা লোহাকে গরম করে পিটিয়ে সুন্দর সুন্দর জিনিস বানাত। কামারের কাজটাকে তাই শিল্পকর্মের মতো মনে করতো অনেকেই। বিশেষ করে গ্রামের মুরব্বিরা তাদের ছেলে সন্তানদেরকে এই কামারের কাছে দিয়ে দিতো যাতে তারা শিল্পের সাথে পরিচিত হতে পারে। সেইসাথে অলস কিংবা বেকার ঘুরাফেরা করার সুযোগ না পায়। ছেলেদের অভিভাবকেরা আরও একটা কাজ করত। তারা তাদের ছেলে সন্তানদের বাজারে পাঠাতো। এতে করে ছেলেরা কাজও শিখতো, সেইসাথে রোজগারেরও ব্যবস্থা হতো। সংসার চলে যেতো দিব্যি, সঞ্চয়েরও ব্যবস্থা হতো।

সেই সুদূর অতীতে এক কিশোর ছেলে ছিল ভয়াবহ রকমের অলস। কোনো কাজই সে করতে চাইত না। খালি খাওয়া আর ঘুরে বেড়ানোই ছিল তার কাজ। কাজের কথা শুনলেই সে মনমরা হয়ে যেত। ছেলের এই ভাবসাব দেখে বাবা চিন্তা করলো তাকে কামারের কাছে দেবে কাজ শেখার জন্য। কামারের কাজকর্ম শৈল্পিক হলেও বেশ কঠিন এবং পরিশ্রমের কাজ। ওই কাজে ছেলেকে দিলে ছেলের অলসতা বাপ বাপ করে পালাবে। বাবা একদিন ছেলের হাত ধরে নিয়েই গেল কামারের কাছে। কামার তার দোকানেই ছিল। সালাম এবং কুশল বিনিময়ের পর অলসের বাবা বলল: ওস্তাদ! ছেলেটা আমার যথেষ্ট চালাক চতুর! ভাবছি এই গ্রীষ্মের ছুটির অবসর দিনগুলোতে যেহেতু পড়ালেখা নেই, আপনার কাছে রেখে যাবো। আপনি ওকে ঠিক আপনার মতোই একজন দক্ষ শিল্পী বানিয়ে ছাড়বেন।

ওস্তাদ কামার ভদ্রলোক অলস ছেলেটার দিকে একবার অভিজ্ঞ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল: ‘এগুলো হচ্ছে আমার কাজের হাতিয়ার’। কোন্ হাতিয়ার কী কাজে লাগে ছেলেকে ব্যাখ্যা দিয়ে বোঝাল। এরপর ছেলেকে হাপর দেখিয়ে বাবাকে বলল: ‘আপনি চিন্তা করবেন না। আমার চেয়েও ভালো কামার বানিয়ে ছাড়বো ওকে! তবে শর্ত হলো কাজে মন বসাতে হবে।’ বাবা বলল: ‘ওস্তাদ! এই ছেলের অভিভাবক এখন থেকে আপনি। আপনি ভাববেন ও এখন আপনারই ছেলে। যেরকম প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন মনে করবেন দেবেন। আমি শুধু চাই ও এক সুদক্ষ কামার হোক।’

এই বলে বাবা তার অলস পুত্রকে ওস্তাদ কামারের কাছে সঁপে দিয়ে চলে গেল। বাবা চলে যাবার পর তার অলস ছেলে বুঝতে পারলো এটা অলসতা করার জায়গা নয়। তারপরও সে অলস মুহূর্ত কাটাবার ফাঁকফোকর খুঁজতে লাগলো। কী করে কাজ কম করা যায়, কীভাবে কম পরিশ্রম করে কম ক্লান্ত হওয়া যায় সেইসব উপায় খুঁজতে লাগল সে। ওস্তাদ কামার তার প্রশিক্ষণের কাজ শুরু করে দিল। অলস ছেলেকে কাজের সকল যন্ত্রপাতির সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। তারপর বলল, কোন্ যন্ত্র দিয়ে কী কাজ করা হয় এবং কীভাবে করা হয়।

সবশেষে হাপর দেখিয়ে বলল: “দেখ বাবা! আমরা যা কিছুই বানাতে চাই, প্রথমে লোহাকে এই গনগনে আগুনের ভেতর জ্বালাই। লোহা গরম হয়ে লাল রঙের হয়ে গেলে নরম হয়ে যায়। ওই নরম অবস্থায় তাকে পিটিয়ে পিটিয়ে যে ডিজাইন করতে চাই করি। এ কাজের জন্য হাপরের আগুন টকটকে লাল এবং প্রাণবন্ত হতে হবে। হাপরের ভেতরের আগুন যদি জ্বলজ্বলে না হয়, যদি মিটমিটে লাল হয়, তাহলে কোনো কাজই করা যাবে না, লোহাও নরম হবে না। এখন যাও, বিসমিল্লাহ পড়ে হাপরের কাছে গিয়ে বসো।”

বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই জানতে চাচ্ছো যে, হাপর কী? হাপর হলো এক ধরনের বায়ু উৎপাদন এবং প্রবাহের যন্ত্র। আজকাল যেমন বৈদ্যুতিক ফ্যানের সাহায্যে বাতাস উৎপাদনের ব্যবস্থা রয়েছে, সেকালে এরকম ছিল না। চামড়ার কয়েক স্তর বিশিষ্ট মুখ খোলা বেলুনের মতো একটা যন্ত্র ছিল। বেলুনের ওপরের স্তরে রশি লাগিয়ে উপরে কোথাও এমনভাবে ঘুরিয়ে নীচে আনা হতো যাতে ওই রশি ধরে টান দিলেই হাপরের ভেতরের বাতাস খোলা মুখ দিয়ে বেরিয়ে চুল্লির ভেতর যেতো আর কয়লার আগুন গনগন করে জ্বলে উঠত। ওস্তাদ তাকে ওই হাপরের রশি ধরে টেনে টেনে আগুন জ্বালাতে বলল। সবশেষে বলল: ‘আমরা কামারেরা এই কাজটাকে বলি ‘দম দেওয়া বা ফুঁ দেওয়া’। তুমি এখন হাপরে দম দিতে থাক।’

অলস ছেলে নিজেকে খুব কাজের লোক হিসেবে প্রমাণ দিতে বলল: ‘ঠিক আছে ওস্তাদ’। এই বলে হাপরের পাশে গিয়ে বসল এবং ওস্তাদের কথামতো রশি টেনে টেনে হাপরে বাতাস দিতে লাগল। রশি ধরে টান দিলেই চামড়ার বেলুনের ভেতর থেকে বাতাস হাপরের ভেতর যেত এবং কয়লার আগুন গনগন করে উঠত। এভাবে ঘণ্টাখানেক কেটে গেল। অলস ছেলে হঠাৎ কাজের চাপে ক্লান্ত হয়ে গেল। তাই ওস্তাদের দিকে তাকিয়ে বলল: ‘ওস্তাদ, ক্লান্ত হয়ে গেছি। আমার ডান পা’টা একটু লম্বা করে দম দিতে পারব’? ওস্তাদ তার কপালের ঘাম মুছে নিয়ে বলল: ‘এতো দ্রুত ক্লান্ত হয়ে গেছ? অসুবিধা নেই, ডান পা’টা লম্বা করে ছড়িয়ে দাও’! এর কিছুক্ষণ পরই অলস ছেলে বলে উঠল: ‘ওস্তাদ, বাঁ পা’টা একটু লম্বা করে ছেড়ে দেব?’

ওস্তাদ অনুমতি দিল বাঁ পা’টাও ছড়িয়ে দিতে। কিন্তু ছেলে তাতেও ক্ষান্ত হলো না। সে বিরক্ত হয়ে উঠতে লাগল। কাজটা যেন তার জন্য ভয়াবহ কষ্টের মনে হলো। বলেই বসল: ‘ওস্তাদ, একটু শুয়ে শুয়ে কাজ করতে পারব? অসুবিধা নেই, হাপরে দম দেয়ার কাজ হবে’। ওস্তাদ এবার এক ঝলকে মাথা ঘুরিয়ে ছেলেটার দিকে তাকাল। বলল: “এরকম কথা তো আর কখনো শুনি নি। শুয়ে শুয়ে বিশ্রামও নেবে কাজও করবে। ঠিক আছে, যদি তাতে তোমার সুবিধা হয়, সমস্যা নেই, কর।”

অলস ছেলে শুয়ে শুয়েই তার কাজ চালিয়ে যাচ্ছিল। কিছুক্ষণ পর সে মনে মনে বলল: ‘আমি তো সাংঘাতিক বোকা! হাপরের পাশে ঘুমিয়ে নিচ্ছি না কেন! ঘুমালেই তো পারি’। ছেলে অবসাদে হাই তুলতে তুলতে ওস্তাদকে বলল: ‘ওস্তাদ, আবহাওয়া বেশ গরম আজ। মানুষ অল্প কাজেই কেমন ক্লান্ত হয়ে যায়। যদি তুমি আমাকে অনুমতি দাও তাহলে হাপরের পাশেই ঘুমোতে ঘুমোতেই দম দেব’।

ওস্তাদ এবার অলস ছেলের কাণ্ড দেখে রেগে গেল। তার হাতের বিশাল হাতুড়িটা একপাশে রেখে বলল: ‘তুই মর, তবু দম দে’। এই ঘটনার পর থেকে যখনই কেউ কাজে মনযোগ না দিয়ে ফাঁকি দেওয়ার অজুহাত খোঁজে, তখনই বলা হয়: ‘দম দে, মর- তবু দম দে’।

ফিলিপ হিউজের বেদনাদায়ক মৃত্যু এবং আমাদের শিক্ষা

ফিলিপ হিউজের বেদনাদায়ক মৃত্যু এবং আমাদের শিক্ষা

পিঁপড়া ও অহংকারী রাজা

পিঁপড়া ও অহংকারী রাজা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *