মনটা নাগরদোলার মতো ঘুরতে ঘুরতে এক সময় স্থির হয়ে যায়। তখন তার কল্পনার রেশটুকু আর থাকে না। কাদা-মাটি দিয়ে হাঁটার পালা চলে। হাঁটতে হাঁটতে এক সময় তার ক্লান্তি এসে যায়।
কয়েকদিন ধরে এমনটা হচ্ছে। কেন হচ্ছে, বুঝতে বাকি থাকে না মারিয়ামের।
তার এ ভজঘট শুরু হয়েছে হাবিব দুদিন ফোন করাতে।
মোবাইল নাম্বার তিনি কি করে পেলেন, এ নিয়ে তার কাছে রহস্য ঠেকছে।
তপু, রেবা ছাড়া তার মোবাইল নাম্বার ঢাকার কম লোকেই জানেন। হাশিমা ফুফুর সঙ্গে মোবাইলে দুতিনবার কথা হয়েছে তার। ফুফুর বাসায় মোবাইল নাম্বার থাকতে পারে। আর কারো কাছে তার নাম্বার আছে বলে তার জানা নেই।
আগে হাবিব কোনোদিন তাদের বাসায় এসেছিলেন কিনা, তার মনে পড়ছে না। হাবিবের সঙ্গে তার খুব ভালো জানা-শুনা বা মেলামেশা একটা ছিল না। তিনি আতিকের বন্ধু। সেই সুবাদে আতিকের সঙ্গে তিনি কয়েকবার বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এসেছিলেন। তখন তার সঙ্গে কথা হয়েছিল। তাও মাস্টার্স ফাইনাল ইয়ারের শেষের দিকে। হাবিব নিশ্চয় তপুর সঙ্গে দেখা করে তার মোবাইল নাম্বার নিয়েছেন। ওর কাছ থেকে নাম্বার নিলে এতদিনে তাকে জানানোর কথা।
মোবাইল বেজে ওঠল।
সেটটা তুলে নিয়ে রিসিভ করতেই রেবার কণ্ঠ ভেসে এল, আপা আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। মোবাইলের রিং-এ ঘুম ভেঙে যাবার পর সেটটা তুলে নেব, এ সময় লাইন কেটে গেল।
বাবার কথা কেউ তুললে মারিয়ামের মুখের চোয়াল শক্ত হয়ে যায়।
বাবার ব্যাপারে তিনি স্বাভাবিক থাকতে চাইলেও তা পারেননি। জন্মদাতা বাবার প্রতি এ নির্দয় আচরণ, তার মানসিক বৈকল্যের অন্য একটি রূপ। তা সব সময়ই প্রকাশ পায়।
আবেদ খন্দকার শয্যাশায়ী। প্রায় তিন বছর আগে তিনি স্ট্রোক করেছেন। তার বাঁ হাত-বাঁ পা অচল। ঢাকার বড় বড় ডাক্তারকে দেখানো হয়েছে। সুস্থ হননি। তপু চিকিৎসার জন্য তাকে ভারতেও নিয়ে গিয়েছিল। ওখানে তিন সপ্তাহ চিকিৎসা করানো হয়। এতে সুস্থ হওয়ার লক্ষণ না দেখে তপু তাকে দেশে ফিরিয়ে আনে।
মারিয়াম চাকরি-বাকরি করুক, আবেদ খন্দকার তা চাননি। তার নিজের ইন্ডাস্ট্রি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে। এতে সাত-আটশ লোক কাজ করে। তার মেয়ে এনজিওতে চাকরি করবে, মফস্বল শহরে থাকবে- এটা তার কাছে অস্বস্থিকর।
মারিয়ামকে চাকরি থেকে বিরত রাখতে আবেদ খন্দকার চেষ্টা করেছিলেন। এতে তিনি সফল হতে পারেননি। কোথায় যেন একটা আলগা ভাব লুকিয়ে ছিল, তার জন্য বাবা মেয়ের ওপর পুরোপুরি অধিকার প্রয়োগ করতে পারেননি।
মারিয়ামের চাকরিও হুট করে হয়নি। চাকরির জন্য তিনি মরিয়া হয়ে ওঠেন। শেষে তার একটা চাকরি মিলে গেল এনজিওতে। পোস্টিং ঠাকুরগাঁওয়ে।
আবেদ খন্দকার চাকরিতে না যাওয়ার জন্য যখন তাকে বলেছিলেন, তখন তিনি কোনো গুরুত্বই দেননি। বরং বাবার মুখের সামনে উদ্ধত স্বরে বলেছিলেন, আমার মতো করে আমাকে চলতে দাও।
প্রায় আট বছর ধরে তিনি নিজের মতো করে চলছেন।
এর মধ্যে তিনি তিনবার ঢাকায় গিয়েছিলেন। একবার তপুর বিয়েতে। ছোট ভাইয়ের বিয়েতে না গিয়ে তার উপায় ছিল না। গিয়ে তিনি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতে পারেননি। অনেকে বলাবলি করেছেন, ছোট ভাইয়ের বিয়ে হল, বড় বোনের হল না। কেমন একটা অবস্থা! দুএকজন তার দিকে বাঁকা চোখে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য করে বলেছেন, বিয়ের দরকার নেই তো, তাই-।
দ্বিতীয়বার গিয়েছিলেন আবেদ খন্দকারকে দেখতে। তখন তিনি সিএমএইচে। স্ট্রোক করার পর তাকে ওখানে ভর্তি করা হয়েছিল। তিনি অজ্ঞান অবস্থায় ছিলেন। সামরিক হাসপাতালে কড়াকড়ি নিয়ম, এর মধ্যেও বাবাকে দেখার একটু সুযোগ হয়েছিল। ডাক্তার বলেছিলেন, আশংকামুক্ত। উনি বেঁচে যাবেন। এ কথা জানার পর মারিয়াম আর থাকেননি। ঠাকুরগাঁওয়ের দিকে রওনা দেন।
সবশেষে গিয়েছিলেন বছর দেড়েক আগে। একটি সরকারি সংস্থার এক ট্রেনিংয়ে। এক সপ্তাহ থাকতে হয়েছিল ঢাকায়। থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেছিল অধিদফতর। তখন এক বিকালে বাসায় গিয়েছিলেন, ঘণ্টা দুয়েকের জন্য।
তিনি বাবার পাশে বসেছিলেন কিছুক্ষণ। বাবা তখন বোধ-শক্তিহীন অবস্থায় শুয়েছিলেন। তার পাশে দাঁড়িয়ে মারিয়াম বলেছিলেন, বাবা, আমি এসেছি।
মারিয়ামের কণ্ঠ শুনে আবেদ খন্দকার একটু সচকিত ভাব দেখালেন। এরপর আস্তে চোখ মেলে তার দিকে একবার তাকিয়ে আবার চোখ বন্ধ করলেন।
মারিয়াম বিছানায় বসে তার ডান হাতের ওপর হাত রেখেছিলেন। তখন তিনি কাঁদতে শুরু করেন। সে কান্না অনেকটা শব্দহীন। কিন্তু তা ভেতর থেকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে ওঠা। তার চোখ দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে।
সে মুহূর্তে রেবা আসে। তার হাতে নিউট্রিনের গ্লাস। চামচ দিয়ে নাড়াচ্ছিল। সে ঝনঝনে গলায় বলে ওঠে, বাবা, ডাক্তার না আপনাকে বলে দিয়েছেন দুচিন্তা না করতে। আর আপনি কাঁদছেন! পরক্ষণেই রেবা নরম গলায় বলে, আপনি আর কাঁদবেন না। কিছুুদিনের মধ্যে আপনি সুস্থ হয়ে যাবেন। ডাক্তার বলে দিয়েছেন।
রেবা প্রবোধ দেয়ার জন্য বাবাকে কথাগুলো বলেছে।
সেদিন রেবাকে তার খুব ভালো লেগেছে। মেয়েটি শ্বশুরের সেবা-যত্ন করছে মন দিয়ে। কর্তব্য পালন করলে যে অধিকার প্রয়োগ করা যায়, সেটা রেবার কথার মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে।
তপু মাঝে মাঝে হুমকি দেয়- আমি আমেরিকায় চলে যাব। তোমরা কেউই বাবার ইন্ডাস্ট্রি, ব্যবসা, সম্পত্তির দায়ভার নিতে চাওনা। আমি একা নেব কেন? ভাইয়া জার্মানিতে। জার্মান মেয়েকে বিয়ে করে বউয়ের বিশাল সম্পত্তির রাজত্বে বাস করছে। বাবার সম্পত্তির দিকে তার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। আর তুই, তোর চাকরি নিয়ে আছিস।
তপু যে আমেরিকা যাবার কথা বলে, এর মূলে রেবা। রেবা আমেরিকায় অনেকদিন ছিল। ওর মায়ের সঙ্গে। ওর মামারা ওখানে সেটেল্ট। বাবার সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হলে ওর মা আমেরিকায় চলে যায়, ওকে নিয়ে। রেবা ওখানে ও লেভেল পর্যন্ত পড়েছে।
যে মেয়ে আমেরিকায় বড় হয়েছে, সেখানে লেখাপড়া করেছে, ওর পক্ষে বাংলাদেশে থাকা কষ্টকর। তবু রেবা থাকতে পারছে। সংসারের অনেক দায়িত্ব পালন করছে।
তপুর হুমকি-ধামকিতে মারিয়াম একদিন বলে দিয়েছেন, আমি বাবার সম্পত্তি থেকে এক আধলাও নেব না। বাবাকে এ কথা বলে দিস। সে যেন সবকিছু তোকে দেবার বিধি-ব্যবস্থা করে দেয়। বাবা যদি এ কাজ না করে যায় তাহলে তার মৃত্যুর পর আমি আমার ভাগের অংশটা তোকে লিখে দেব।
তপু এর জবাবে বলেছে, বাবার প্রোপার্টি তাহলে ওয়াকফ্ স্টেট-এ চলে যাবে।
২.
অফিসে ঢোকার সময় ডান পাশের রুমের দিকে তাকাতেই তার চোখে পড়ল সোহাগকে। সে ঝিমুচ্ছে।
তার এ অবস্থা দেখে অবাক হলেন মারিয়াম। ছেলেটার মধ্যে সব সময় চঞ্চলতা ও উরু উরু ভাব লেগে থাকত। সেগুলো আর নেই। দুচিন্তা যেন বাসা বেঁধেছে, সেটা তার চোখ-মুখ দেখে বোঝা গেল।
এক সপ্তাহের ছুটি নিয়ে সে ঢাকায় গিয়েছিল। আজ জয়েন করেছে। যাবার সময় সে মারিয়ামকে বলে যায়নি। যাবার আগে অ্যাডমিনিস্ট্রিভ অফিসার আমজাদ সাহেবের কাছে একটা ছুটির দরখাস্ত দিয়ে চলে যায়। ছুটি গ্রান্ড হল কি হল না তার তোয়াক্কা করেনি সে। আর তিনি যে এ অফিসের প্রধান, যাবার আগে তাকে বলা উচিত ছিল, তাও গ্রাহ্যি করেনি সোহাগ। ভাবখানি ছিল, চাকরি থাকল বা না থাকল- তাতে তার যায় আসে না।
চাকরিতে তার ভ্রুক্ষেপ না করার কারণ, সে আমেরিকায় যাচ্ছে। আমেরিকা যাবার এ জোগাড়-আয়োজন করেছেন তার এক ফুফাত ভাই।
সে যে আমেরিকায় যাচ্ছে তা নিজের গাঁটের টাকায় নয়। আমেরিকান ইমিগ্রান্ট এক বাঙালি মেয়েকে ঢাকায় সে বিয়ে করবে। সেই সুবাদে কিছুদিন পর সে নিউইর্য়কে যাবার টিকিট পাবে।
শুধু মেয়ে নয়, মেয়ের বড় ভাই, বড় বোনেরা আমেরিকায় থাকেন। তারা ওখানে ব্যবসাপাতি নিয়ে জাঁকিয়ে বসেছেন। সোহাগ ওখানে গেলে তার ভাগ্যের চাকা ঘুরে যাবে। তার কাছে এনজিও অফিসের নদশ হাজার টাকার বেতনের চাকরি তুচ্ছ। সে অফিসের বস কী এমন-। এ রকম উন্নাসিক ভাব দেখিয়েছে।
অফিসও ঠিক মতো করেনি। সবার প্রতি ড্যাম কেয়ার ভাব ছিল তার। এখন সে অফিসে ঝিমুচ্ছে। ভেজা বিড়ালের মতো।
কলিংবেল টিপলেন মারিয়াম।
সঙ্গে সঙ্গে পুশিং দরজা ঠেলে হামেদ আলী মাথা ঢোকালে তিনি বলে দিলেন, সোহাগকে আসতে বল।
হামেদ যাবার পরপরই সোহাগের কণ্ঠ শোনা গেল। সে মিনমিনে স্বরে সালাম দিল।
মারিয়াম আস্তে মাথা নাড়িয়ে তার সালামের উত্তর দিলেন। ঢাকায় যাবার আগে সে সালাম দেয়ার কথা বুঝি ভুলে গিয়েছিল। আজ-
সোহাগকে বসতে বললেন না তিনি।
সে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকল।
– আপনি ঢাকা গিয়েছিলেন?
– জি ম্যাডাম।
– আপনি কার পারমিশনে এক সপ্তাহের ছুটি কাটালেন?
– ম্যাডাম, মা-নে। থেমে যায় সোহাগ।
– ও, আপনি কথা বলতে পারছেন না!
সোহাগ এবার শুষ্ক গলায় বলে, ম্যাডাম আমি তো আমজাদ স্যারের কাছে ছুটির দরখাস্ত দিয়ে গেছি-
– ছুটির দরখাস্ত দিলে যে গ্রান্ট হবে, তা কি করে ভাবলেন?
– ম্যাডাম তড়িঘড়ি করে-
– ঢাকায় যাবার জরুরি তলব পড়েছিল, তাই যেনতেন একটা দরখাস্ত দিয়ে কেটে পড়লেন! অ্যাকাউন্ট্যান্টের চাকরি করেন, গুরুত্ব বোঝেন না। আপনার ছুটি গ্রান্ট করা হয়নি। আপনি এখন আসতে পারেন।
সোহাগ পা না তুলে মারিয়ামের মুখের দিকে তাকাল।
মারিয়াম এবার একটু ধমকের সুরে বললেন, দাঁড়িয়ে থাকলেন কেন, যান। আপনার বিরুদ্ধে কি ধরনের ব্যবস্থা নেয়া যায়, এ নিয়ে আমি ভাবছি। আপনার মতো আন অ্যাফিসিয়েন্ট এমপ্লইকে দিয়ে-
সোহাগ এবার কাঁপাস্বরে বলে উঠে, ম্যাডাম-
– বলেছি না, আপনি আসতে পারেন।
ধমকের চোটে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না সোহাগ। মাথা নিচু করে বেরিয়ে গেল।
শব্দ করে হাসতে ইচ্ছে হল তার।
না, হাসতে পারলেন না তিনি। শিক্ষা এবং রুচির কারণে। মানুষের বিপদ ও পরিণতি দেখে হাসা এক ধরনের বর্বরতা- এটাই উপলব্ধি করেছেন তিনি ছোটকাল থেকে।
আট বছর ধরে এ অফিসে আছেন তিনি। প্রথমে সহকারী রিজিওন্যাল ম্যানেজার হিসেবে এখানে তিনি জয়েন করেছেন। প্রমোশন পেয়ে দুবছর আগে এ অফিসের পুরো দায়িত্ব পেয়েছেন।
এতদিন কাজ করার মধ্যে কারুর প্রতি তিনি কখনও দুর্ব্যবহার করেননি।
আজ একজন পুরুষ কর্মীকে তিনি ধমক দিলেন, শাসালেন!
৩.
সন্ধ্যার দিকে বিছানায় আধাশোয়া অবস্থায় চায়ে টোস্ট ভিজিয়ে ভিজিয়ে খাচ্ছেন মারিয়াম।
তাকে বেশ ফ্রেস লাগছে, ঘুম থেকে ওঠার পর। দুপুরে খেতে এসে আর অফিসে যাননি।
দুপুরের খাবার তিনি বাসায় খান। অফিস থেকে তার বাসা চার-পাঁচশ মিটার পথ। হেঁটে তিনি অফিসে যাওয়া-আসা করেন।
দুপুরে বাসায় এসে তার মাথা টনটন করছিল। কাপড় পাল্টিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে একটু খাবার মুখে দেন। অ্যাডমিনিস্ট্রিভ অফিসার আমজাদ সাহেবকে বলে দেন…। এরপর শুয়ে পড়েন।
তার ঘুম ভাঙে নাহিদার ডাকে। নাহিদার তখন সাজুগুজু অবস্থা। সে জানায়, আপা আমরা মুন্সিরহাট যাচ্ছি। ফিরতে দেরি হবে।
মুন্সিরহাটে নাহিদার মামার বাসা। মাঝে মধ্যে তারা ওখানে বেড়াতে যায়।
তারা চলে যাবার পরপর কাজের মেয়েটি আসে।
তাকে খালি চায়ের মগটি ধোয়ার জন্য দিতে হাত বাড়ালে, কলিংবেল বেজে ওঠে।
মগটি দিয়ে মারিয়াম বললেন, রহিমা দেখ তো কে এসেছে।
তিনি ভাবলেন, কে আবার এল? সন্ধ্যার দিকে মাঝে মাঝে আলমদের আত্মীয়-স্বজন আসেন। তারা তো বাসায় নেই।
রহিমা দরজার সামনে এসে জানাল, আফনার অফিস থাকি একটা নোক আইচে।
মারিয়াম অবাক হলেন। সন্ধ্যায় অফিস থেকে মানুষ!
তিনি ভাবলেন, আমজাদ সাহেব এসেছেন বুঝি। কোনো জরুরি কাজে।
রহিমা এসে বলল, আপা ছোয়াগ সায়েব আইছেন।
সোহাগের কথা শুনে তার কপালে ভাঁজ পড়ল। মুখও স্থির হয়ে গেল এমনিতে। একবার অস্ফুটস্বরে বলে ফেললেন, সোহাগ!
– মেহমানের জন্য চা বানামো? রহিমা বলল
– হ্যাঁ, তার জন্য চা তৈরি কর। আর তাকে এখানে আসতে বল।
তিনি শিথানের পাশে দুটা বালিশের ওপর হেলান দিয়ে চা খাচ্ছিলেন। সে অবস্থায় থেকে গেলেন।
দরজার সামনে শোনা গেল মিনমিনে গলা, ম্যাডাম-
মারিয়াম বললেন, আসুন।
সোহাগ ভেতরে ঢুুকলে একটু মাথা তুলে তিনি তার দিকে তেরছা চোখে তাকালেন। দেখলেন, সোহাগকে বিমর্ষ দেখাচ্ছে। মারিয়াম বললেন, বসুন।
সোহাগ আস্তে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে আশপাশে তাকাল।
তার তাকানোর কারণ বুঝতে বাকি থাকল মারিয়ামের। তার রুমে বসার মতো আশপাশে কোনো চেয়ার নেই। তাকে বসতে বলা হল যে, সে বসবে কোথায়?
পায়ের কাছে একটি ছোট্ট টেবিল আছে। সেখানে তো বসতে বলা যায় না।
পাশে ড্রেসিং টেবিলের সামনে একটি ফোম লাগানো টুল আছে। তাতে বসে মারিয়াম চুল আঁচড়ান। সাজগোজ করেন। সেখানে একজন পুরুষকে কি বসতে বলা যায়? তাও একজন অফিসের অধঃস্তনকে-
শেষে টুলটা দেখিয়ে দিয়ে মারিয়াম বললেন, ওখানে বসুন।
সোহাগ ওখানে না বসে ইতস্ততঃ ভাব নিয়ে মারিয়ামের মুখের দিকে তাকাল।
এবার তিনি একটু জোর দিয়ে বললেন, ওখানেই বসুন না।
সোহাগ বসে পড়ল।
মারিয়াম নড়েচড়ে বালিশের ওপর কনই রেখে বললেন, বলুন, কি মনে করে এসেছেন?
সোহাগ তার কথার জবাব না দিয়ে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরে।
– আপনি না বললেও আমার বুঝতে বাকি নেই। আপনি এসেছেন আপনার চাকরির প্রতি মায়া করে। কয়েকদিন আগেও আপনি যে চাকরিকে তুচ্ছ মনে করেছেন।
সোহাগ এবার একটু মাথা নামাল।
– কী, আমি ঠিক বলিনি?
সোহাগ সাড়া দিল না। বাধ্য ছেলের মতো মাথা নিচু করে থাকল।
– আপনার বিদেশ যাবার কি হল? মুখে চাপা হাসি নিয়ে বললেন মারিয়াম।
এবারও সাড়া দিল না সোহাগ।
– কথা বলছেন না কেন? এখানে কথা বলার জন্যই তো এসেছেন। না হলে তো আসতেন না। তাহলে চুপ মেরে থাকলে চলবে? বলুন-
-ম্যাডাম, আমি আর বিদেশ যাব না।
-এ কথা বলার জন্য কি এখানে এসেছেন?
-জি ম্যাডাম।
-এখন থেকে ঠিক মতো চাকরি করবেন?
-জি।
-আপনি কেন বিদেশ যাবেন না। সুযোগ পেলে সবাই তো-। আর আমি যতটুকু শুনেছি, আমেরিকা যাবার আপনার সব ঠিক হয়ে গেছে।
– ম্যাডাম তাহলে আপনি সব শুনেছেন!
– হ্যাঁ, শুনেছি।
তার সব কথা অফিস সহকারী জাবেদ আলী ও পিয়ন হামেদ আলীর কাছ থেকে তিনি শুনেছেন। তাদের কথা না তুলে বললেন, অফিসের একজন লোক বিদেশ যাচ্ছে। তা না শোনার কি আছে? অথচ আপনি নিজের থেকে কিছু জানাননি।
– সরি ম্যাডাম, আমি অতটা বুঝতে পারিনি।
চোখ স্থির করে তার দিকে তাকিয়ে মারিয়াম বললেন, আপনার বিদেশ যাওয়া হল না কেন? সমস্যা কি?
-আমেরিকান এক ইমিগ্রান্ট বাঙালি মেয়ের সঙ্গে বিয়ে ঠিক করেছিলেন আমার ফুফাত ভাই। বিয়ের পর মেয়ে পক্ষ আমাকে আমেরিকায় নিয়ে যাবে। কিন্তু-
– বলুন।
– মেয়ের ছবি দেখে পছন্দ হয়েছিল। মেয়েকে মুখোমুখি দেখার পর বিয়েটা করা আর সম্ভব হল না।
– কারণ?
– মেয়ের বয়স আমার চেয়ে পাঁচ ছবছরের বেশি।
মারিয়াম মিনমিনে গলায় বললেন, আপনার বয়স এখন কত?
– একত্রিশ।
মারিয়াম যেন থমকে গেলেন। আস্তে মুখ ফিরিয়ে নিলেন ড্রেসিং টেবিলের আয়নার দিকে। নিজের মুখ দেখলেন। তার বয়স ছত্রিশ বছর আট মাস। এতে পড়ন্ত যৌবনের ভাঁজ পড়েছে সারা মুখে। আগে তা কখনও উপলদ্ধি করেননি তিনি।
রহিমা এল। তার এক হাতে চায়ের কাপ। অন্য হাতে পিরিচসহ কয়েকটি বিস্কুট। রাখার জায়গা নেই বলে ওগুলো ড্রেসিং টেবিলের এক পাশে রাখল সে।
মারিয়াম রহিমাকে লক্ষ্য করে বললেন, পানি দিলে না?
সোহাগ বলল, আমি শুধু চা খাব।
রহিমা চলে গেলে সোহাগ চায়ের কাপ তুলে নিল।
এ রুমে ঢোকার সময় সোহাগের যতটা জড়তা ছিল এখন সেটা নেই। তা ঝেড়ে ফেলে দিয়েছে। সে এখন স্বাভাবিক। তার সামনে চা-বিস্কুট আসার পর।
সে আস্তে আস্তে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। মাঝে মাঝে আড় চোখে তাকাচ্ছে মারিয়ামের দিকে। চা শেষ করে সোহাগ কাপ রেখে মারিয়ামের মুখের দিকে তাকালো। স্বাভাবিক গলায় বললো, ম্যাডাম আসি।
– কেন এসেছিলেন, তা তো বললেন না। সপ্রতিভ প্রশ্ন মারিয়ামের।
ঠোক্কর খেল যেন সে। মারিয়ামের প্রশ্নে। মাথা নিচু করল সে।
সোহাগ হয়তো ভেবে নিয়েছিল, তার অফিসের বিষয়টি সুরাহা হয়েছে। ম্যাডামের কাছে আসাতে। বিনীতভাবে তার সঙ্গে কথা বলাতে তিনি তাকে ছাড় দিয়েছেন। ম্যাডাম নতুন করে প্রশ্ন করাতে বুঝতে পারল, সে নিষ্কৃতি পায়নি।
মারিয়াম মিটিমিটি হেসে আবার বললেন, বলুন, কেন এসেছেন?
সোহাগ এবার অসহায় দৃষ্টি ফেললো মারিয়ামের মুখের দিকে।
মারিয়াম সেটা তোয়াক্কা করলেন না। বললেন, আপনাকে যদি আমেরিকায় যাবার বিনিময়ে একজন কম বয়েসী মেয়েকে দিয়ে বিয়ে দেয়া হয়, আপনি এতে রাজি হবেন?
– না।
– কেন?
– আমি আর আমেরিকায় যেতে চাই না।
– দেশে থাকতে গেলে আপনার এ চাকরিটা থাকা চাই?
– হ্যাঁ।
উঠে দাঁড়াল সোহাগ। অনেকটা হাতজোড় করার ভঙিমায় বলল, ম্যাডাম, প্লিজ, আমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন না।
মারিয়াম এবার তার বসিং ভাবটা ফুটিয়ে তুলে বললেন, তা পরে দেখা যাবে। এখন আপনি আসতে পারেন।
মুহূর্তে বিনয়াচিতভাবে মাথা নিচু করল সোহাগ। এরপর সে বেরিয়ে গেল।
সে বেরিয়ে যাবার পর মারিয়াম পা দুটো মেলে দিলেন। এরপর উপুড় হয়ে পড়ে থাকলেন, নীরব হয়ে।
… আতিককে তিনি খুঁজে পেলেন তার মানসচক্ষে। তার গালে, ঠোঁটে চুমুর পর চুমু বসিয়ে দেয় আতিক। মারিয়াম … মুক্ত করতে মরিয়া হয়ে ওঠেন।
অনেক চেষ্টা করেও আতিককে থামাতে পারছিলেন না মারিয়াম। তাকে বাধা দিতে গিয়ে তার পাগলামি যেন আরও বেড়ে যায়।
ওইদিন তার মা আফসানা মারিয়াম বাসায় ছিলেন না। মগবাজারে গিয়েছিলেন তার ছোট বোনের বাসায়। ছোট বোন অসুস্থ, তাকে দেখার জন্য…।
আফসানা মারিয়ামও বড় লোকের মেয়ে। এ ছাড়া তিনি একজন শিল্পপতির স্ত্রী। কিন্তু তার জীবন-যাপন অতি সাদাসিধে। আবার অনেকটা রক্ষণশীল। তার মতো মহিলার কারো বলেল্লাপনা পছন্দ করার কথা নয়। তবে তার মেয়ের ছেলে বন্ধুরা আসবে। তারা ড্রয়িংরুমে বসে চা-নাশতা খাবে- এ পর্যন্ত তিনি পারমিট করতে পারেন। বেডরুমে যাওয়া তিনি কখনও বরদাশত করবেন না। মারিয়াম তা বুঝতে পেরেই আতিকের বায়না পূরণ করতে তিনি সময় নিয়েছিলেন।
সুযোগ পেয়ে আতিক যে এভাবে পাগলামি করবে তা বুঝতে পারেননি মারিয়াম। আতিকের সেই পাগলামি তার কাছে পুরুষের প্রথম স্পর্শ।
রহিমার কণ্ঠ শোনা গেল, আপা মুই চলি যাইম।
দরজা বন্ধ করে মুখ ফেরাতেই তার মোবাইল বেজে ওঠল। দ্রুতপায়ে ভেতরে ঢুকে মোবাইল তুলে নিয়ে তিনি কানের কাছে ধরলেন। রেবার কণ্ঠ ভেসে এল।- আপা-
– রেবা বল কি খবর?
– বাবার শরীরটা খুব খারাপ-
– কখন থেকে?
-কিছুক্ষণ আগে বাবা ঝিম মেরে গেছেন। কারুর সঙ্গে কথা বলছেন না। তার চোখ দুটো ঘোলা ঘোলা লাগছে। বাবাকে কেমন জানি মনে হচ্ছে।
– তুমি কোনো চিন্তা কর না, সব ঠিক হয়ে যাবে। বাবা তো এরকম আগেও ঝিম মেরে ছিলেন।
– তা ঠিক। কিন্তু আজকে কেমন জানি মনে হচ্ছে।
– আজ হঠাৎ এরকম হল কেন?
– আমিও বুঝতে পারছি না। শেষ বিকালে বাবাকে বারান্দায় বসিয়ে দেয়া হয়েছিল। এর মধ্যে দুজন লোক এলেন বাবার সঙ্গে কথা বলতে। বাবা তাদের বারান্দায় আসতে বলেন।
লোক দুটো বাবার সঙ্গে কথা বলল। তারা চলে যাবার পরপরই বাবার শরীর খারাপ হয়ে গেল।
– হাউস ফিজিসিয়ান ডাক্তার রকিবকে বলেছ?
– ফোন করেছি। উনি বললেন নটার দিকে আসবেন।
– আচ্ছা যারা বাবার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন, তারা কারা?
– আমি তাদের চিনি না।
মারিয়াম বললেন, তারা বাবার সঙ্গে কি কথা বলল?
– তারা বাবার সঙ্গে কি কথা বলেছে তা আমি শুনিনি। কাজের মেয়েকে দিয়ে আমি তাদের জন্য চা পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। কাজের মেয়ে তাদের সামনে চা দেবার আগে তারা উঠে দাঁড়ান। এরপর চলে যান।
মারিয়াম গম্ভীর গলায় বললেন, বাবার অবস্থার কথা কি তপুকে কি জানিয়েছ?
-না। শুনলে ও টেনশন করবে। ডাক্তার এসে বাবাকে আগে দেখে যাক। উনি কি বলেন, তারপর তপুকে জানাব।
– ডাক্তার এসে কি বলেন, তা আমাকেও জানাবে।
মোবাইল অফ করে মুখ স্থির করে ফেললেন মারিয়াম। মনে মনে বললেন, এরা দুজন তাহলে কারা!
সেটটা বিছানার ওপর রেখে তিনি ধীর পায়ে পায়চারি করতে শুরু করেন।
তাকে ধীর-শান্ত মনে হলেও তার ভেতরে ভেতরে অস্থিরতা চলছে।
পেছন থেকে সোহাগের কণ্ঠ ভেসে এল।
– ম্যাডাম, প্লিজ, আমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন না।
৪.
মারিয়াম জবুথবু হয়ে শুয়ে আছেন।
মোবাইল বেজে উঠল।
হাত বাড়িয়ে সেটটা তুলে নেবেন সে শক্তি যেন তার নেই। শরীরটা অসাড় ঠেকছে।
যখন সেটটা তুলে নেয়ার জন্য হাত বাড়ালেন তখন বন্ধ হয়ে গেল। আগের মতো শুয়ে থাকলেন তিনি।
ভাবলেন, রেবা রিং করল কিনা। ঘণ্টাখানেক আগে রেবা কথা বলেছে মোবাইলে। ও বলেছে, ডাক্তার এসে বাবাকে দেখে গেছেন। বলেছেন, তেমন কোনো সমস্যা নেই। একটু টেনশন করেছিলেন, তার জন্য একটু প্রব্লেম হয়েছিল। ডাক্তার ঘুমের ওষুুধ দিয়েছেন। ওষুধ খেয়ে বাবা এখন ঘুমোচ্ছেন।
বাবার শরীর আবার খারাপ করল কিনা, এ জন্য রেবা…
সেটটা তুলে নিয়ে বাটন টিপলেন। দেখলেন, রেবার নাম্বার থেকে রিং আসেনি। ভাবলেন, এত রাতে কে ফোন করল! ….
বিছানার পাশে, পায়ের দিকে একটি ছোট্ট টেবিলের ওপর পানির বোতল, গ্লাস আছে। গ্লাস নিলেন না তিনি। বোতলটি তুলে নিয়ে, কর্ক খুলে গল গল করে পানি খেয়ে নিলেন।
আবার পায়চারি করতে গিয়ে যেন তার ওপর ক্লান্তি ভর করে। আর দাঁড়িয়ে থাকতে ভালো লাগে না। বিছানায় শুয়ে পড়লেন তিনি।
হাত-পা মেলে ঘুমানোর চেষ্টা করলেন।
না, ঘুম আসছে না। তার মানসচক্ষে দেখা দিল সোহাগ।
সোহাগ তার বিছানায় গা ঘেঁষে বসে আছে। সে উপুড় হয়ে তার ঠোঁটে চুমু দিতে শুরু করে। এরপর গালে। এর পালা চলে কয়েক মিনিট।
সোহাগ আরও ঘনিষ্ঠ হতে শুরু করে।
মারিয়াম এবার তার উন্মত্ততায় বেশি সায় দিতে চাইলেন না। বললেন, আমি তরুণী-তম্বী নই। আমি ছত্রিশ বছর পেরোনো এক নারী। মারিয়াম এবার বসিং ভাব নিয়ে বললেন, তুমি আমার অর্ডার ফলো না করলে আমি তোমাকে চাকরিচ্যুত করব। দিস ইজ মাই লাস্ট ওয়ার্নিং। ফলো মাই অর্ডার।
মারিয়াম এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে সোহাগ আর দেরি করল না।
সেই মুহূর্তে মারিয়াম সম্বিত ফিরে পেলেন, মোবাইল বেজে ওঠাতে।
হাত বাড়িয়ে তিনি মোবাইল সেট তুলে নিলেন কানের কাছে। হ্যালো বলতেই, অপর প্রান্ত থেকে শোনা গেল হাবিবের কণ্ঠ- …।
হাবিব আমতা আমতা করে বলেন, আপনি কেমন আছেন?
– এ কথা জানার জন্যই কি রাত দুপুরে ফোন করলেন?
– না-মানে, আমি একটা কথা বলার জন্য …
– তা বলে ফেলুন।
– আপনি একটা সিম্পল ঘটনার জন্য জীবনটাকে কি নষ্ট করে ফেলবেন?
– এ কথা বলে কি আপনি আমার প্রতি মমত্ব দেখাতে চাচ্ছেন?
– আমি এ জন্য কথাটি বলিনি। অনেকে বলেন, আপনি জীবনটা নষ্ট করে দিচ্ছেন। আতিকও তাই মনে করে।
মারিয়ামের গলা ভারি হয়ে যায়।
– সত্যি বলতে কি, আমিও অনুতপ্ত ছিলাম আতিকের ঘটনায়। এ জন্য-। আর আতিক কেন যে আপনার বাবার ফাঁদে পা ফেলল!
– দেখুন, লোভী শকুনের সামনে মাংসের টুকরো বাড়িয়ে ধরলে শকুন ছোঁ মেরে নিয়ে যায়। এখানে ফাঁদ পেলেন কোথায়?
মোবাইল নামিয়ে নিলেন মারিয়াম।
৫.
ঝিমুনি আসছে তার। কাজে মন বসাতে পারছেন না তিনি। তাই চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে বসে থাকলেন।
কিছুক্ষণ আগে সুপ্রিয়া এসেছিল। সে বলেছে, ম্যাডাম আপনি কি অসুস্থ?
মারিয়াম চমকে ওঠার মতো ভাব করে বলেছেন, না তো!
– আপনার মুখটা কেমন জানি শুকনো শুকনো লাগছে। চোখ দুটো লাল। রাতে ভালো ঘুমোননি বুঝি।
মারিয়াম অবচেতন মনে বলে ফেললেন, হ্যাঁ।
একজন অধঃস্তন হয়ে ঊর্ধ্বতনের সামনে সব কথা বলা যায় না। কিন্তু সুপ্রিয়া সে সীমারেখা প্রায় অতিক্রম করে। এতে মারিয়াম ভেতরে ভেতরে বিরক্তি বোধ করলেও তা কখনও প্রকাশ করার চেষ্টা করেননি।
পুশিং দরজা ঠেলে সোহাগ মাথা ঢোকাল। – ম্যাডাম আসতে পারি?
সোহাগের কথা শুনে মারিয়াম সোজা হয়ে বসলেন।- আসুন।
সোহাগ স্মার্টলি লম্বা পায়ে তার টেবিরের সামনে এসে দাঁড়াল। তার হাতে অনেকগুলো কাগজপত্র।
সোহাগ কাগজপত্রগুলো দেখিয়ে দিয়ে বলল, ম্যাডাম এগুলো কি এখন দেখে দিতে পারবেন?
– সিওর।
সোহাগ কাগজপত্রগুলো তার সামনে রাখল।
মারিয়াম বললেন, বসুন।
সোহাগ বসলে তিনি একটা একটা করে কাগজপত্র দেখতে থাকেন। আর সিগনেচার দেন।
কাগজপত্রগুলোর মধ্যে বেশির ভাগ বিল-ভাউচার। কাগজপত্র দেখা এবং সিগনেচার দেয়ার ফাঁকে তিনি দুএকবার তেরছা চোখে তাকালেন সোহাগের দিকে। সোহাগের মধ্যে আজ কোনো জড়তা নেই। কাল সে বিনয়ের সঙ্গে দয়া প্রার্থনা করেছে। তাতে ম্যাডামের আর রাগ বা ক্ষোভ থাকার কথা নয়। এমনটাই ভাবছিল হয়তো সোহাগ।
কিন্তু তার ভাবনাটা মিথ্যায় পরিণত করে দিলেন তিনি। বল্লমের ফলা ছুঁড়ে মারার মতো বললেন, আপনার ছুটি কিন্তু পাস করা হয়নি।
এ কথা শুনে সোহাগ চুপছে গেলেন। ছুটি পাস না করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ থাকছে।
সোহাগ শুকনো গলায় উচ্চারণ করল, ম্যাডাম-
মারিয়াম ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি ফুটে তুলে বললেন, বলুন-
– আমার ভুলটা কি মাফ করে দেয়া যায় না?
মারিয়াম এবার গম্ভীর স্বরে বললেন, আপনি নিজেকে কতটা বোকা ভাবেন বলুন তো?
– বোকা!
– হ্যাঁ, বলুন, আপনি-
সোহাগ দৃঢ়তা নিয়ে বলে, আমি নিজেকে কখনও বোকা ভাবি না
– কোনো মানুষই নিজেকে বোকা ভাবেন না। সব সময় নিজেকে চালাক মনে করেন। এরপরও মানুষ বোকা। কেউ কম, কেউ বেশি।
মারিয়াম এ কথা বলে মুখে চাপা হাসি ফুটিয়ে তুললেন।
সোহাগের চোখে-মুখে বিস্ময় দেখা দেয়।
মারিয়ামের মোবাইল বেজে ওঠল।
হাত বাড়িয়ে সেটটা তুলে নিলেন তিনি। কানের কাছে ধরতেই হাবিবের কথা শোনা গেল।- আমি হাবিব বলছি।
– তা তো বুঝতে পারছি। বলুন-
– আতিক আপনার সঙ্গে দেখা করতে চায়।
– আমার সঙ্গে!
– হ্যাঁ।
মারিয়ামের মুখ স্থির হয়ে যায়। কি যেন বলতে চেয়ে তিনি থেমে গেলেন, সোহাগকে চোখে পড়াতে। বোঝা গেল সোহাগের সামনে তিনি কথাটি বলতে চাচ্ছেন না। বললেন, হাবিব ভাই, প্লিজ, একটু-। মোবাইল নিচে নামিয়ে সোহাগকে লক্ষ্য করে বললেন, আপনি এখন আসুন। পরে এসে এগুলো নিয়ে যাবেন।…
ওকে বলবেন, টাকার প্রয়োজন হলে যেন আমার সঙ্গে দেখাত করতে আসে।
– কি যে বলেন, ও এখন কয়েক কোটি ইয়েনের মালিক।
– অনেক দিন আগে শুনেছি ও ওখানে বিয়ে করেছে। জাপানি মেয়েকে কিনা, তা জানতাম না।
– বলে দিলাম তো। ও আমার সঙ্গে দেখা করতে পারে শুধু মাত্র টাকার প্রয়োজনে।
– ওর টাকার প্রয়োজন নেই।
– তাহলে আমিও চাই না ও আমার সঙ্গে দেখা করতে আসুক।
মারিয়াম মোবাইলের লাইন কেটে দিলেন।
অফিসে থাকতে ইচ্ছে করছে না তার। কিন্তু একটার আগে তিনি অফিস থেকে যেতে পারছেন না। সোয়া একটা থেকে দুটা পর্যন্ত লাঞ্চ-এর সময়।
ভাবলেন, এত তাড়াতাড়ি বাসায় যাওয়া ঠিক হবে না। এখন অফিস থেকে বেরিয়ে গেলে আমজাদ সাহেব, সুপ্রিয়া, নাজমাসহ অন্যরা কয়েক মিনিটের মধ্যে বেরিয়ে পড়বে। তখন অফিসে তিনজন পিয়ন ছাড়া আর কেউই থাকবে না।
চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজে নিলেন তিনি।
হাবিবের কথা তার মনের ভেতর বারবার দোলা দেয়।- আতিক আপনার সঙ্গে দেখা করতে চায়।
আতিকের চিত্রকল্পটা এবার চোখের সামনে ভেসে ওঠল। এ চিত্রকল্পটা তিনি পেয়েছেন মোক্তার আলীর কাছ থেকে। সে আবেদ খন্দকারের বিশ্বস্ত পিয়ন। বাসায় সব সময় সে যাওয়া-আসা করে। আফসানা মারিয়ামও তাকে পছন্দ করতেন।
মোক্তার আলী তাকে একদিন শুনিয়েছে, আতিক সায়েব স্যারের টেবিলের সামনে বইয়া ছিলেন। স্যার তার ডয়ার থাইকা এক এক কইরা পাঁচশত ট্যাকার বিশডা বান্ডিল বাহির কইরা রাইখলেন। স্যার আতিক সায়েবরে কইলেন, তোমারে আমি দশ লাখ দিয়া দিলাম। এই দিয়া তোমার বিদেশ যাওনের কোনো সমস্যা হইবো না।
আতিক সায়েব তখন মুখ দিয়া কথা না কইয়া মাথা নাড়াইয়া বুঝাইয়া দিয়াছে, হ, সমস্যা হইবো না। এরপর স্যার আমারে কইলেন, মোক্তার আলী ট্যাকার বান্ডিল গুলা কাগজ দিয়া প্যাকেট কইরা দাও। যাতে ছিনতাইকারিরা ভাবতে না পারে এগুলা ট্যাকা। ট্যাকা ছিনতাই হইয়া গেইলে আতিকের বিদ্যাশ যাওন হইবো না।
– আমি ট্যাকাগুলা প্যাকেট কইরা আতিক সায়েবের হাতে দিয়াছি।
আতিক সায়েব বাইর অহনের সময় স্যার চেয়ার থাইক্যা তার পেছনে পেছনে দরজা পর্যন্ত গেইলেন। আতিক সাহেবের পিঠ থাপরাইয়া কইলেন, তুমি একটা বুদ্ধিমান পোলা।
মোক্তার আলীর কাছ থেকে এ সব বয়ান শোনার পর মারিয়াম থ মেরে যান।
বাবার সামনে তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছিলেন, আমি আতিককেই বিয়ে করব। হোক না সে সাধারণ কৃষক ঘরের ছেলে। অন্য কাউকে দিয়ে আমার বিয়ের চেষ্টা করলে তোমরা সফল হতে পারবে না।
আতিককে নিয়ে তিনি বাবার সামনে এ ঔদ্ধত্য প্রকাশ করেছিলেন। মা আফসানা মারিয়াম সে সময় নিরপেক্ষ ভূমিকায় ছিলেন। তিনি স্বামীর পক্ষে যেমন সায় দেননি তেমনি মেয়ের পক্ষেও কথা বলেননি।
আতিক বেশ কয়েকবার বাসায় আসা-যাওয়া করাতে মা তাদের সম্পর্কের কথা জেনে যান। সে কথা বাবার কানে পৌঁছতে দেরি হয়নি।
এরপর শুরু হয় আতিকের পরিবারের খোঁজ-খবর নেয়া। সবকিছু জেনে নিয়ে আবেদ খন্দকার ঘোষণা দেন, ওই ছেলের সঙ্গে মারিয়ামের বিয়ে আমি দেব না।
মারিয়ামও তার অভিপ্রায়ের কথা জানিয়ে দেন বাবার মুখের ওপর।
এ নিয়ে বাসায় উত্তপ্ত অবস্থা বিরাজ করে। এক সময় বাবা-মেয়ের মধ্যে কথা বন্ধ হয়ে যায়। আফসানা মারিয়াম তখন নির্লিপ্ত।
কয়েকদিন পর আবেদ খন্দকারের মধ্যে পরিবর্তন দেখা দেয়। তার মধ্যে যে ক্ষোভ-রাগ ছিল, তা যেন অপসারিত হয়ে গেছে। দেখা দেয় অনেকটা বিজয়ের উচ্ছ্বাস।
বাবার এ পরিবর্তনের কারণ মারিয়াম প্রথমে তেমন একটা আঁচ করতে পারেননি। তবে আশংকা দেখা দিয়েছিল তার মনে।
একদিন ড্রয়িংরুমে আফসানা মারিয়ামের পাশে বসে নানা কথোপকথনে, আবেদ খন্দকার একবার কথাচ্ছলে বলে ফেলেন, তপুর মা কথায় আছে না- টাকা হলে বাঘের চোখ মেলানো যায়। এরপর তিনি চিত্র জগতের ভিলেনের মতো ভঙ্গিমা করে বলেন, টাকা দিয়ে যে, প্রেমের ঘোর কাটানো যায়- এ কথা কি তুমি কখনও শুনেছ?
আফসানা মারিয়াম তার কথার জবাব দেয়ার আগে আবেদ খন্দকার হো হো করে হেসে ওঠেন। আফসানা মারিয়াম কিছু একটা বলতে চেয়েছিলেন তা চাপা পড়ে যায় তার অট্টহাসিতে। তার এই হাসির রহস্য প্রথমে বুঝতে পারেননি মারিয়াম। পরে বিষয়টি তার কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়। মোক্তার আলীর কথায়।
আবেদ খন্দকার শিল্পপতি ও ব্যবসায়ী মানুষ। উনি যা কিছু করেন অনেক সময় তা সরাসরি করেন না। প্রকাশও করেন না সরাসরি। আতিকের বিষয়টি তিনি সরাসরি জানাতে চাননি। যাতে আতিকের প্রতি মারিয়ামের মোহ কেটে যায়- এ জন্য কথাটি তার বিশ্বস্ত কর্মচারী মোক্তার আলীকে দিয়ে বলিয়ে নিয়েছেন।
আড়মোড়া ভেঙে সোজা হয়ে বসলেন মারিয়াম।
কলিংবেল টিপলেন।
হামেদ আলী ভেতরে ঢুকলে তাকে বললেন, সোহাগ সাহেবকে আসতে বল।
কাগজপত্রগুলো সামনে পড়ে আছে। দেখার ইচ্ছে করছে না তার।
সোহাগ চটপটে পায়ে এল। টেবিলের সামনে এসে বলল, ম্যাডাম কাগজপত্রগুলো কি দেখা হয়েছে?
– না। বসুন।
সোহাগ বসল না। মারিয়ামের মুখের দিকে তাকাল।
– দাঁড়িয়ে থাকলেন কেন?
সোহাগ বসল।
মারিয়াম বললেন, আপনাকে একটা কথা বলব?
মনের ভেতরে হয় তো এখনও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার ভীতিটা আছে। তাই মিনমিনে গলায় বলে, বলুন ম্যাডাম।
– আমার মনে হয় আপনার বিদেশ যাবার খুব ইচ্ছে। কিন্তু মুখে বলছেন অন্য কথা।
তার কথার জবাব না দিয়ে মুখ স্থির করে ফেলে সোহাগ।
মারিয়াম টিপ্পনি কেটে বললেন, কী, আমি ঠিক বলিনি?
সোহাগ এবারও তার কথার জবাব না দিয়ে সুবোধ বালকের মতো চুপ করে থাকল।
– আমি কি কথাটি ঠিক বলিনি?
-অত টাকা কোথায় পাব ম্যাডাম।
– সে টাকারও ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
– কোত্থেকে?
– আমি দেব।
– ম্যাডাম, আপনি দেবেন!
– হ্যাঁ।
দোনোমনা ভাব করে সোহাগ।
– আপনি বুঝি শর্তের কথা ভাবছেন?
আস্তে আস্তে সে মাথা নাড়ে।
– শর্ত ছাড়াই যদি আমি টাকা দেই?
– তাও নেব না।
-কেন?
– সেটা হবে দয়া। আমি কারো দয়া নিতে চাই না ম্যাডাম।
চট করে উঠে দাঁড়াল সোহাগ। দপদপ করে পা ফেলে দরজার দিকে যায়।
৬.
বঙ্গবন্ধু সেতু পার হবার পর শা-শা করে দ্রুত গতিতে গাড়ি চলছে।
সেতু পার হবার পর রাস্তা অনেকটা ফাঁকা থাকে। তাই দূরপাল্লার গাড়ির গতিও বেড়ে যায়।
রাস্তা যত কমছে, তার উৎকণ্ঠা ততই বাড়ছে। এ জন্য পথ তার কাছে দীর্ঘ মনে হচ্ছে।
মোবাইল বেজে ওঠল।
মারিয়াম তড়িঘড়ি করে ভ্যানেটি ব্যাগ থেকে মোবাইল সেটটা বের করে কানের কাছে নিতেই রেবার গলা শোনা গেল।- আপা, আপনার গাড়ি এখন কোথায়?
– এলেঙ্গায়।
-আমি বাসস্ট্যান্ডে গাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি। এ কথা বলেই সে মোবাইলের লাইন কেটে দিল। মারিয়ামকে আর কথা বলার সুযোগ দিল না।
কথা বলার সুযোগ পেলে তিনি বলতেন, রেবা গাড়ির দরকার নেই। আমি একটা ট্যাক্সি ক্যাব নিয়ে চলে যাব।
পরক্ষণই ভাবলেন, রেবা ঠিক কাজটি করছে। কল্যাণপুর পৌঁছতে রাত প্রায় বারটা বেজে যাবে। অত রাতে ট্যাক্সি পেতে সমস্যা হতে পারে। আর ট্যাক্সি পেলে কি একা যাওয়া ঠিক হবে? ট্যাক্সিতে এখন কত রকমের অঘটন ঘটে। সে খবর প্রকাশ পায় পত্রিকার পাতায়। তিনি মেয়ে মানুষ। একা একা যাওয়ার সময়, যদি কিছু একটা…।
দুপুরে খাবার পর তিনি অফিসে ঢোকার পাঁচ-সাত মিনিট পর রেবা তাকে রিং দেয়। সে কথা বলতে পারছিল না, শুধু হুহু করে কাঁদছিল। মারিয়াম তখন জোরে জোরে বলছিলেন, বল রেবা বল, কি হয়েছে?
-বাবা-। আর কথা বলতে পারছিল না ও, শুধু কাঁদছিল।
– বল রেবা, বাবার কি হয়েছে?
– বাবা চোখ মিলতে পারছেন না। কত করে ডাকছি, বাবা কোনো সাড়া দিচ্ছেন না। মনে হয় সেন্স হারিয়ে ফেলেছেন। হাউস ফিজিসিয়ানকে পাওয়া যাচ্ছে না। উনি তার গ্রামের বাড়ি কুমিল্লায় গেছেন।
– ভেঙে পড় না রেবা।
– আমি এখন একা একা কি করব। অফিসের ম্যানেজারকে ফোন করে বাসায় আসতে বলেছি। আপা, আপনি এক্ষুণি চলে আসুন। প্লিজ আপা-
মারিয়াম মনে মনে বললেন, পরের মেয়ে এমন আর্তি নিয়ে বলছে! অস্থির করে তুলল তাকে সে আর্তি।
অ্যাসিস্টেন্ট ম্যানেজার জয়নুল আবেদীনকে ডেকে নিয়ে জানালেন, আমাকে এক্ষুণি ঢাকায় যেতে হচ্ছে। কয়েকদিন দেরি হতে পারে। এদিকে আপনি সব সামলিয়ে নেবেন।
রেবা বলল, আপনি এক্ষুণি চলে আসুন। কিন্তু তা কি করে সম্ভব? ঠাকুরগাঁও থেকে ঢাকার দূরত্ব চারশ সত্তর কিলোমিটার। বাসে প্রায় নদশ ঘণ্টার পথ। এখন ঢাকা যাবার বাস পাওয়া যাবে কিনা, তাও তিনি জানেন না।
আবার ফোন দেয় রেবা। বলে, আপা আপনি এক্ষুণি-
– হ্যাঁ, রওনা দিচ্ছি।
বাসায় এসে সাইডব্যাগে কয়েকটা কাপড় ঢুকিয়ে নিয়ে তড়িঘড়ি বাসস্ট্যান্ডে চলে আসেন মারিয়াম। এসে তিনটার বাস পেয়ে যান।
বাস ছাড়ার পরপরই রেবা আবার ফোন করেছিল।
রেবার সঙ্গে কথা বলে মারিয়ামের ধারণা হয়, এবার বাবার একটা বড় ধরনের ঘটনা ঘটে গেছে। এ জন্য রেবা ভেঙে পড়েছে। অত সহজে ভেঙে পড়ার মতো মেয়ে নয়। ওর মনটা বেশ নরম। তবে বাস্তববাদী। আবেগপ্রবন নয়। ছোটখাটো কিছু ঘটলে ও তপুর কাছে ফোন করত না।
হাইওয়ে পাশে খাবার রেস্টুুরেন্ট ফুড ভিলেজে গাড়ি থামে। সেখানে বিশ-পঁচিশ মিনিট দেরি করে। যাত্রীরা ফ্রেস হয়ে চা-নাশতা খান। গাড়ি থেকে নেমে মারিয়াম ফুড ভিলেজের ভেতরে ঢুকবে, এ সময় অপুর ফোন এল জার্মানি থেকে।- মারিয়াম শুনেছিস?
– কী? এক অজানা আশংকায় তার বুক কেঁপে ওঠে।
– তপু থাইল্যান্ড থেকে ফোন করেছিল। বাবা খুব সিরিয়াস! ও খুব কান্নাকাটি করছে।
– তা শুনেছি। আমি তিন ঘণ্টার মধ্যে ঢাকায় পৌঁছাবো।
– আমি দেশে যাব। স্যান্ডিনাও আমার সঙ্গে যাবে। তবে তিন দিন পর। বাবার কি হয় জানাবি।
** ** **
গাড়ি এসে থামল কল্যাণপুরে।
গাড়ি থেকে নামতেই ড্রাইভার মোতালেব এগিয়ে এল। বলল, ছোট আম্মা আমি গাড়ি লইয়া আইছি। ছোট ম্যাডাম কইয়া দিছেন আপনারে হাসপাতালে লইয়া যাইতে।
মারিয়ামকে ছোটকাল থেকে মোতালেব ড্রাইভার ছোট আম্মা বলে ডাকে। আজ অবধি তার আম্মা ডাকটা রয়ে গেছে।
এনজিওতে চাকরি নিয়ে ঠাকুরগাঁওয়ে যাবার পর এই প্রথম বাবার গাড়িতে ওঠলেন মারিয়াম। এর আগে তিনি তিনবার এসেছেন। বাবার গাড়িতে ওঠেননি। একবার বাসা থেকে বাসস্ট্যান্ড যাবেন, রেবা তখন বলেছে, আপা মোতালেব চাচা গাড়িতে আপনাকে বাসস্ট্যান্ডে লিফ্ট দিয়ে আসুক।
তিনি বলেছেন, প্রয়োজন নেই।
গাড়ি এসে থামল একটি প্রাইভেট হাসপাতালের সামনে।
লিফট থেকে নেমে তিনি আট নাম্বার ক্যাবিনে আস্তে টোকা মারতেই দরজা খুলে গেল।
ভেতরে পা দিয়ে দেখলেন, আবেদ খন্দকারের হাতে স্যালাইনের ড্রিপ, নাকের ভেতরে পাইপ। তার চোখ বোজা, মুখ ঈষৎ হাঁ করা। দেখে বোঝা গেল তার সঙ্গীন অবস্থা। মারিয়াম অস্ফুটস্বরে বললেন, বাবা!
রেবা তাকে দেখে যেন স্বস্তি খুঁজে পেল। ওর চোখ-মুখ দেখে তা বোঝা গেল।
মারিয়াম বেড-এর কাছে গিয়ে একটু উপুড় হয়ে মৃদু সুরে বললেন, বাবা-
আবেদ খন্দকারের সাড়া মিলল না।
মারিয়াম বাবার অবাধ্য মেয়ে থেকে গেছেন। এ জন্য বুঝি তার খানিকটা অনুশোচনা হচ্ছে।
বাবার জন্য তার আবেগ দেখা দিল।
আবেদ খন্দকারের মুখের কাছে মুখ নিয়ে গেলেন তিনি। চাপা কান্না নিয়ে বললেন, বাবা, দেখ, আমি তোমার কাছে এসেছি। এখন তোমার ওপর আমার কোনো রাগ বা ক্ষোভ নেই।
এবার তিনি ফুঁপে ফুঁপে ওঠলেন। বললেন, বাবা, তুমি একবার চেয়ে দেখ আমার দিকে। বাবা-
বোঝা গেল আবেদ খন্দকার কোমায় যাননি। মারিয়ামের ডাকে আস্তে সরু করে চোখ মেললেন। কিন্তু তা স্থায়ী হল না। আবার চোখ বুজে নিলেন।
আবেদ খন্দকার চোখ মেলে তাকে যে একটু দেখল, এতে বাবার প্রতি তার আবেগ আরও উথলে ওঠল। হু হু করে কেঁদে ওঠে বাবাকে জড়িয়ে ধরতে হাত বাড়ালেন।
এতক্ষণ বাবার প্রতি মেয়ের আবেগকে সায় দিয়ে গেছে রেবা। সেই বলে মৃত্যু পথযাত্রীকে জড়িয়ে ধরে একজন কাঁদবেন, সেটা রেবা গ্রহণ করতে পারছে না। মারিয়ামকে ধরে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে ও। আর বলে, এরকম করলে বাবার যে কষ্ট হবে!
এ মুহূর্তে জামিলও মুখ খুললেন। গম্ভীর স্বরে বললেন, মারিয়াম শান্ত হ।
ম্যানেজার সাবির আহমেদ বেরিয়ে গেলেন। তার পিছে পিছে বেরিয়ে গেলেন, অন্য কর্মকর্তাটিও।
রেবা মারিয়ামের একটি হাত ধরে টেনে এনে বসিয়ে দিল একটি চেয়ারে। বলল, কাঁদলে বাবার ডিস্টার্ব হবে।
মারিয়ামের কান্না ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে আসে।
রোগীর পাশে আর একটি বেড আছে, রেবা সেটি দেখিয়ে দিয়ে বলল, আপা আপনি ওখানে বসে রেস্ট নিন। জার্নি করে এসেছেন, আপনার বেশ ধকল গেছে। কিছুক্ষণ পর আপনি সামিনার মাকে সঙ্গে নিয়ে বাসায় যাবেন।
মারিয়াম বললেন, আমি বাসায় যাব না। এখানে থাকব।
– তা হয় না। আপনি টায়ার্ড। বাসায় কাটাবেন। রাতে আমি বাবার কাছে থাকব। কাল সকালে আপনি আসবেন।
জামিল বললেন, তাই কর। মাও সকালে আসবে। তার শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। তোমরা থাক, আমি একটু বাইর থেকে ঘুরে আসছি।
জামিল বেরিয়ে যাবার পর মারিয়াম রেবাকে জিজ্ঞেস করলেন, বল তো বাবার এ অবস্থা হল কেন?
রেবা বলল, বাবাকে প্রতিদিন দুপুরে খাইয়ে দিয়ে হুইল চেয়ারে করে নিয়ে যাওয়া হয় ড্রয়িংরুমে। বাবার ইচ্ছায় ওখানে একটি খাট পাতানো হয়েছে। উনি দুপুরটা ওখানে শুয়ে থাকতে চান। তার কথা মতো তাকে শুয়ে দিয়ে টেলিভিশন অন করে দেয়া হয়। তখন ছোট কাজের মেয়ে আজিনা তার আশপাশে থাকে। বাবার ফুট-ফরমায়েশীর জন্য।
– উনি পছন্দ করেন ডিসকোভারি এবং ন্যাশনাল জিওগ্রাফি চ্যানেল। এ দুটোর যে কোনো একটি তিনি দেখেন। দেখে দেখে তিনি কোনোদিন ঘুমিয়ে পড়েন।
বাবাকে শুয়ে দিয়ে আমি খাবার টেবিলে গেছি। সে সময় একজন লোক এলেন বাবার সঙ্গে দেখা করতে। আমি আজিনাকে জিজ্ঞেস করলাম, কে এসেছে? সে বলল, আমি তারে চিনি না। ভাবলাম, মাঝে মাঝে পুরনো কর্মচারীদের কেউ কেউ বাবার সঙ্গে দেখা করতে আসেন। তাদের কেউ হয় তো এসেছেন…
– খাওয়া শেষ হতে না হতে আজিনা চিৎকার দিয়ে বলে ওঠে, আপা, সায়েব ক্যামুন জানি করতাছেন। আইয়া দ্যাখেন।
তার চিৎকারে খাবার টেবিল থেকে উঠে দ্রুত ড্রয়িংরুমে গিয়ে দেখলাম, বাবার মুখ থেকে লালা বেরোচ্ছে। একটু একটু গোংরাচ্ছেন আর কাঁপছেন। লোকটি এরমধ্যে বেরিয়ে গেছেন।
বাবাকে অনেক ডাকাডাকি করলাম। উনি কোনো সাড়া দিলেন না। আর বাবার তখন সাড়া দেয়ার মতো অবস্থা ছিল না। এরপর বাবা নিস্তেজ হয়ে পড়লেন। ম্যানেজার সাহেবকে ফোন দিলাম। বাবাকে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিয়ে আসতে।
আমার চোখ গেল, কাগজে মোড়ানো একটি প্যাকেটের দিকে। প্যাকেটটি বাবার গা ঘেঁষে পড়েছিল। প্যাকেটটি হাতে নিয়ে প্রথমে আন্দাজ করতে পারিনি, ওর ভেতরে কি আছে। খোলার পর দেখতে পেলাম, এক হাজার টাকার নোটের দশটি বান্ডিল।
রেবার কথা শুনে মারিয়াম প্রথমে চমকে উঠার মতো ভাব করলেন। এরপর অবচেতন মনে বলে ফেললেন, দশ লাখ!
মারিয়াম বড় বড় চোখে রেবার দিকে তাকিয়ে থাকলেন।
রেবা বলল, আপা বুঝলাম না, লোকটি কেন বাবাকে দশ লাখ টাকা দিয়ে গেল?
মারিয়াম রেবার কথার জবাব না দিয়ে নির্বিকার থেকে গেলেন।
লেখক : সাংবাদিক
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।