মধুমক্ষী পালন প্রকল্প

ভুলু আঙুল উঁচিয়ে উত্তেজিত হয়ে বলল, চপ্পল, সামনের ওই ভদ্রলোককে দ্যাখ একবার। এমন দেখেছিস কোনওদিন? আমার নাম চপ্পল নয়, চপল। কিন্তু হতচ্ছাড়া ভুলু কিছুতেই সে নামে ডাকবে না আমাকে। তবে মেজাজ চটকে গেলেও ভুলুর কথায় সামনের দিকে তাকিয়ে চোখ সত্যিই ছানাবড়া হয়ে গেল। পাহাড়ী পাকদণ্ডী পথ বেয়ে এক ভদ্রলোক শিস দিতে দিতে নিশ্চিন্ত ভঙ্গিতে নেমে আসছেন। তাঁর গোটা শরীরে মৌমাছির ঝাঁক। কিন্তু ওঁর দুলকি চালে হাঁটা দেখেই পরিষ্কার যে মৌমাছি নিয়ে চলতে ওঁর কোন অস্বস্তি হচ্ছে না।
আমি চোখ বড় বড় করে বললাম, এই ভদ্রলোককে তো ব্রেভারি আওয়ার্ড দেওয়া উচিত রে! গরুবাথানে চড়ুইভাতি করতে এসেছি আমরা। জায়গাটা দারুণ। সবুজ পাহাড় আর তার কোল ঘেঁষে ছটফটে এক নদী। সেই নদীর ধারেই বসেছি সকলে। ব্রেকফাস্ট সেরে রান্নার ঠাকুর নেপুকে সাহায্য করতে বসে পড়লেন মাসিমা-কাকিমারা। বড়রা কেউ বসে গেলেন তাস খেলতে, কেউ বেরিয়ে পড়লেন জায়গাটা ঘুরে আসতে। মিমি, দোলা, কুহুরা গোল করে বসে অন্তাক্ষরি খেলতে আরম্ভ করল। আমি, ভুলু, তমালরা বেরিয়ে পড়েছিলাম একটা চক্কর মেরে আসতে।
হেঁটে হেঁটে চড়াই দিয়ে উঠছিলাম, তখনই চোখ চলে গেছে এই আশ্চর্য দৃশ্যের দিকে। আমাদের দেখে দাঁড়িয়ে পড়লেন ভদ্রলোক। মুখের সামনে এনে হাতটা নাড়লেন আলগোছে। মৌমাছির ঝাঁকটা সরে গেল মুখ থেকে। এবার দেখা গেল তাঁর মুখটা। ছোট ছোট চোখ, ভোঁতা নাক, পরিষ্কার গায়ের রং ভদ্রলোকের। মিটিমিটি হাসছেন, যেন মজা পাচ্ছেন আমাদের ভয় দেখে। তমাল ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া গলায় বলল, আঙ্কল, মৌমাছিগুলো আপনার কোনও ক্ষতি করছে না কেন? ভদ্রলোক ভাঙা বাংলায় বললেন, কারণটা খুব সহজ। আমি এদের ভালবাসি বলে। তোমরা যদি মৌমাছিদের ভালবাসো তোমাদেরও কোনও ক্ষতি করবে না ওরা। ভদ্রলোক নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, আমার নাম জংবাহাদুর থাপা। দু’-পা হাঁটলেই আমার বাড়ি। সেখানে মৌমাছির চাষ করে কৃত্রিমভাবে মধু তৈরি করি আমরা। আপাতত সরষে আর মূলো থেকে মধু তৈরি করা চলছে।
তোমরা দেখতে চাইলে আসতে পারো আমার সঙ্গে। ওঁর পিছন পিছন এসেছি আমরা। পাহাড়ী বাড়ি যেমন হয়, তেমনি ছোট সাদা রংয়ের বাড়ি। মাথার ওপরে সবুজ টিনের চাল। বড়সড় উঠোন। সেখানে কাঠের তৈরি একটা বাক্সের সঙ্গে সমান্তরালভাবে কয়েকটা কাঠের কাঠামো রাখা রয়েছে। দেড় ফুট ব্যাসের শক্ত কাঠের গুড়ির ভেতরটা ফাঁকা করে দিয়ে দু’দিকে কাঠ লাগিয়ে বন্ধ করে দেওয়া আছে। বোঝা গেল, এখানেই মৌমাছি পালন করা হয়। ভুলু জানতে চাইল, গুঁড়ির গায়ে দুটো ছোট ফুটো দেখছি। ওগুলো দিয়ে কী হয়? জংবাহাদুর বললেন, প্রত্যেকটা মৌমাছির কেক একজন করে রাণী মৌমাছি রাখতে হয়। নইলে কিন্তু কর্মী মৌমাছিরা বাক্সে চাক বাঁধার কাজ শুরু করে না। আশেপাশের মৌমাছির চাক থেকে রাণী মৌমাছিকে খুঁজে বের করে গুঁড়ির ফুটো দিয়ে ঢুকিয়ে দিলেই অন্য মৌমাছিরা আপনা আপনি চলে আসে। ওই যে পাশের কাঠটা দেখছ, মধু তৈরি হয়ে গেলে ওই কাঠটা খুলে নিয়ে মধু বের করে আনতে হয়। বর্ষা পেরিয়ে গেলেই শুরু হয় মধু সংগ্রহের কাজ। তমাল বলল, কী রকম মধু পাওয়া যায় এখান থেকে? জংবাহাদুর বললেন, প্রত্যেকটি মৌমাছির ঘর থেকে বছরে এক-দু’বার দুই থেকে তিন লিটারের মতো মধু পাওয়া যায়। সেই মধু তো বটেই, এমনকি মৌমাছিও বিক্রি করি আমরা। ভুলু চোখ গোল গোল করে বলল, মৌমাছিও বিক্রি করেন? জংবাহাদুর বললেন,
তোমরা যদি নিতে চাও তাহলে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারো। আমাকে চেক পাঠালে আমি দিন সাতেকের মধ্যেই তোমাদের ঠিকানায় বাক্স সমেত মৌমাছি পাঠিয়ে দেবো। ভুলু ভদ্রলোকের ফোন নম্বর একটা কাগজে লিখে নিল। জংবাহাদুর থাপাকে বিদায় জানিয়ে ফিরে এলাম আমরা। আমাদের দেরি হচ্ছে দেখে বড়রা আমাদের খুঁজতে বেরিয়ে পড়েছিলেন। সকলে একসঙ্গে জানতে চাইলেন, কোথায় গিয়েছিলে তোমরা? সবিস্তারে সব জানালাম বড়দের। ভুলুর ছোটকাকু সুনন্দ নন্দী ছিলেন ওখানে। আইনস্টাইনের মতো একমাথা এলোমেলো চুল ওঁর। সারাদিন পড়াশোনা নিয়েই থাকেন। বিয়ে-টিয়ে করেননি। ভুলুদের বাড়ির পাশের হলদে বাড়িটাই ওঁর। পতঙ্গবিদ্যার ওপর সুনন্দকাকু আর্টিকল লেখেন নামী ম্যাগাজিনে।
বাড়িতে কীটপতঙ্গ নিয়ে শখের রিসার্চ-টিসার্চও করেন শুনেছি। সুনন্দকাকু আমাদের বুঝিয়ে বললেন, মধু পাবার জন্য যে মৌমাছি পোষা হয় তার নাম এপিস মেলিফেরা। এই এলাকায় অবশ্য এপিস ইন্ডিকার চাষ করা হয়। সেটা খুব ইন্টারেস্টিং। একটা মৌচাকে একটাই রাণী মৌমাছি থাকে। সঙ্গে থাকে সাতটা পুরুষ মৌমাছি। বাকিরা সব কর্মী মৌমাছি। ভুলু বলল, চপ্পল, একটা ব্যাপক আইডিয়া মাথায় এসেছে। ক্লাবঘরের পিছনের ফাঁকা জায়গাটায় আমরা তো দিব্যি মধুমক্ষী পালন প্রকল্প করতে পারি। তাহলে বেশ ভাল ইনকাম করা যাবে। আর খেলাধুলোর প্রচুর সরঞ্জাম কিনতে পারব সেই লাভের টাকা দিয়ে। কী বলিস? আমি চোখ কপালে তুলে বললাম, কী প্রকল্পের কথা বলছিস? ভুলু কান পর্যন্ত হেসে বলল,
মধুমক্ষী পালন প্রকল্প। মানে সাদা বাংলায় যাকে বলে মৌমাছির চাষ। আমি ব্যাজার মুখে বললাম, ওসব ভাবনা ছাড় ভুলু। এর আগে আমরা আমুপাখির ব্যবসা করতে গিয়ে কীরকম ঘোল খেয়েছিলাম তোর মনে নেই? ভুলু বলল, সেবার হোমওয়ার্কে খামতি ছিল বলে একটু গণ্ডগোল হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এবার তো নিজেরাই গিয়ে দেখে এলাম সব। ভুলু হাতে বরাভয় মুদ্রা ফুটিয়ে বলল, বুঝলি চপ্পল, মৌমাছির থেকে সহজ জিনিস পৃথিবীতে আর কিছু নেই। এবার আর কোনও গণ্ডগোল হবে না দেখে নিস তুই। সুনন্দকাকু আমাদের কথা থামিয়ে দিয়ে বললেন, এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে, তোমরা এখন খেতে বসে যাও। পরে এসব নিয়ে কথা বলা যাবে।   গরুবাথান থেকে ফিরে এসেছি আমরা। মৌমাছির চাষের ব্যাপারটা একরকম ভুলেই গিয়েছিলাম সকলে। ভুলু কয়েকদিন আসছিল না ক্লাবে। একদিন বিকেলবেলা ব্যাডমিন্টন খেলছিলাম। ভুলু এল যুদ্ধজয়ের হাসি মুখে ঝুলিয়ে। বলল, সনাতনকাকু আজ চেক পাঠিয়ে দিয়েছেন গরুবাথানে। এই সপ্তাহের মধ্যেই আমাদের মৌমাছি পাঠিয়ে দেবেন জংবাহাদুর থাপা। আমি চোখ কপালে তুলে বললাম, মানে? ভুলু বলল, আপাতত স্পেসিমেন হিসেবে মাত্র একটা বাক্সই জংবাহাদুর থাপাকে পাঠাতে বলা হয়েছে।
 মৌমাছির পালনের কাজটা রপ্ত করে নিলে পরে বড় করে প্রজেক্টটা করা যাবে। ছোটকাকুর ঠিকানাতেই পার্সেলটা আসবে। উনিই বলে দেবেন কী কী করতে হবে। তমাল নাক কুঁচকে বলল, মৌমাছি দেখলে আমার গা ঘিনঘিন করে। তোর এই মধুমক্ষী পালন প্রকল্পের মধ্যে আমি কিন্তু নেই। ভুলু বত্রিশটা দাঁত বার করে হাসল, তোদের কাউকেই থাকতে হবে না। ক্লাবের প্রেসিডেন্ট সনাতনকাকুর পুরো আস্থা আছে আমার ওপর। ছোটকাকুও পাশে আছে। এই প্রকল্পের সাফল্য নিয়ে একটুও টেনশান নেই। সেদিন স্কুল ছুটি ছিল। ভুলুর বাবা-মা এক আত্মীয়র বাড়ি বেড়াতে গেছেন। সকালে গেছেন, সন্ধ্যেবেলা ফেরার কথা। দুপুরে ভুলুদের বাড়ির ছাদে ক্যারম খেলছিলাম আমি, ভুলু, বাবু আর তমাল। এমন সময় একটা টেম্পো এসে দাঁড়াল নিচে। ক্যুরিয়ার সার্ভিসের নীল পোশাক পরা এক ভদ্রলোক নেমে এলেন গাড়ি থেকে। হাতে আয়তকার ধরণের একটা বাক্স।
সাদা ফিনফিনে একটা কাপড় দিয়ে সেটা মোড়া। তার গায়ে মার্কার পেন দিয়ে প্রেরক ও প্রাপকের ঠিকানা লেখা। ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন, সুনন্দ নন্দীর নামে একটা পার্সেল এসেছে। ওঁর বাড়ি তালাবন্ধ দেখতে পাচ্ছি। উনি নেই? ভুলু এগিয়ে গিয়ে বলল, ছোটকাকু দিল্লিতে গেছেন একটা সেমিনারে। আজই বিকেলে ফেরার কথা। পার্সেলটা আপনি আমাকে দিতে পারেন। আমি ছোটকাকুকে দিয়ে দেব। ভুলু সই করে ডেলিভারি নিয়ে নিল। সম্ভবত আগেই চেক পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল বলে পার্সেলটা ছাড়াতে কোনও টাকা দিতে হল না। ভদ্রলোক ভুলুকে বাক্স বুঝিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। আমি বললাম, বাক্সটা ঘাঁটাঘাঁটি করিস না। সুনন্দকাকু আসুন, তারপর যা করা করা যাবে। ভুলু ফিনফিনে সাদা কাপড়টা এক টানে ছিঁড়ে ফেলে বলল, দেখেছিস চপ্পল, কাঠের বাক্সটার মধ্যে খুব ছোট ছোট ফুটো করা রয়েছে মৌমাছিদের শ্বাস নেবার জন্য। তারপর উঁকিঝুঁকি মারতে মারতে বলল, ভেতরে একটা রাণী মৌমাছি, সাতটা পুরুষ মৌমাছি আর কিছু কর্মী মৌমাছি থাকার কথা। জংবাহাদুর সেগুলো সব ঠিকঠাক দিলেন কিনা কে জানে! আমি বললাম, তুই এখন বাক্সটা রেখে দে। নইলে কিন্তু অঘটন ঘটবে একটা।

অঘটন যে সত্যি সত্যিই ঘটবে সেটা ভাবতে পারিনি। ভুলুর টানাটানিতে বাক্সের একটা কাঠ আলগা হয়ে গেল কীভাবে। সঙ্গে সঙ্গে বড় বড় হলদে রঙের কী যেন বেরিয়ে এল ভনভন শব্দ করে। ভুলুর বুকের কাছে কামড়ে দিল একটা। দু’-চারটে উড়ে গিয়ে বসল পাশের পেয়ারাগাছের ডালে। ভুলু তারস্বরে চিৎকার করতে করতে ছটফট করছে। বাবু আও তমাল ভুলুকে পাঁজাকোলা করে নিয়ে এল ঘরের মধ্যে। ভুলুর সোয়েটার আর শার্ট খুলে দিলাম আমি। সোয়েটারের নিচে শার্টের পকেটে আটকে ছিল মৌমাছি নয়, হলদে রঙের একটা পতঙ্গ। ভিমরুলের মতো দেখতে হলেও সাইজে অনেক বড়। সেটা কামড় দিয়ে মরে পড়ে ছিল। ভুলুর বুকের মধ্যে দেখা গেল গর্তের মতো একটা গোল দাগ হয়ে রয়েছে। বাবু ছুটল সবুজ সংঘের প্রেসিডেন্ট সনাতনকাকুকে খবর দিতে। ওদিকে ভুলু গোঁ গোঁ করছে আর ব্যথায় কাতরাচ্ছে। একটু বাদে সনাতনকাকু দৌড়ে এলেন।

মোবাইল থেকে ফোন করলেন সুনন্দকাকুকে। উনি ফ্লাইট থেকে সবে নেমেছেন বাগডোগরা এয়ারপোর্টে। সব শুনে চিন্তিত গলায় বললেন, এক্ষুনি ভুলুকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। পাড়ার ডাক্তারবাবু ভুলুকে দেখে উদ্বিগ্ন গলায় বললেন, ওষুধগুলো খাও আর রেস্ট নাও। তবে ইউরিন দিয়ে ব্লাড এলে কিংবা শ্বাসকষ্ট শুরু হলে আর দেরি করা যাবে না। সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু ভর্তি করাতে হবে হাসপাতালে। বিছানায় শুয়ে আছে ভুলু। আমরা ওর চারপাশে মুখ বেজার করে বসে আছি। এমন সময় বাইরে গাড়ির শব্দ পেলাম। চলে এসেছেন সুনন্দকাকু। উদ্বিগ্নমুখে ঘরে এসে প্রথমে ভুলুর ক্ষতস্থানটা দেখলেন। তারপর ভুলুকে যে ভিমরুলটা কামড়েছে সেটাকে খুঁটিয়ে দেখলেন। ভুলুকে বললেন, তুই কিন্তু জোর বাঁচা বেঁচে গেছিস আজ। তোকে যেটা কামড়েছে সেটা যে সে ভিমরুল নয়, তার নাম এসিয়ান জায়েন্ট হর্নেট। আমরা একসঙ্গে বললাম, এই ভিমরুলের বিষ কি খুব মারাত্মক ধরণের? সুনন্দকাকু চোখের একটা ভঙ্গি করে বললেন, ওরে বাবা সাংঘাতিক বিষ এদের। কাগজে দেখেছ নিশ্চয়ই চিনের শাংক্সি প্রদেশের হানঝং আর শাংলু শহরে এই বিশেষ প্রজাতির দৈত্য আকৃতির ভিমরুলগুলো প্রচুর লোকের প্রাণ নিয়েছে। এই প্রজাতির কয়েকটা ভিমরুল যদি ভুলুকে একসঙ্গে কামড়াতো তবে ওর যকৃৎ আর কিডনি বিকল হয়ে মৃত্যু অবধারিত ছিল। আমি বললাম, কিন্তু জংবাহাদুর থাপার তো মৌমাছি পাঠানোর কথা। ভদ্রলোক খামোখা ভিমরুল পাঠাতে গেলেন কেন? সুনন্দকাকু ভুরু কুঁচকে বললেন, সেটাই তো ভাবছি। আচ্ছা, এই কাঠের বাক্সে কোনও অ্যাড্রেস ট্যাগ ছিল না? সেটা কোথায়? বাবু ছুটে বেরিয়ে গেল বাইরে। কিছুক্ষণ পর হাঁফাতে হাঁফাতে ফিরে এল। হাতে সেই সাদা কাপড়টা যেটা দিয়ে কাঠের বাক্সটা মোড়া ছিল। সুনন্দকাকু সেটার দিকে তাকিয়ে ভুলুকে বললেন, কী আশ্চর্য, সই করে পার্সেলটা নেবার সময় প্রেরকের নামটা চোখে পড়েনি তোর? ভুলু ঠোঁট চেটে নার্ভাস গলায় বলল, না, মানে ওটা তো খেয়াল করিনি। সুনন্দকাকু বললেন, বাক্সটা আদৌ জংবাহাদুর পাঠান নি। মুরলিধর কৃষ্ণমূর্তি নামে চেন্নাই থেকে আমার এক পতঙ্গবিজ্ঞানী বন্ধু এশিয়ান জায়েন্ট হর্নেটের কয়েকটা স্পেসিমেন পাঠিয়েছিলেন আমার রিসার্চওয়ার্কের জন্য।
তুই সেটাই ভুল করে খুলে ফেলে এই কান্ডটা ঘটিয়েছিস। সুনন্দকাকু উঠে পড়লেন। আমরা ওঁর পিছন পিছন এলাম বাইরে। ভুলুও এসেছে দুর্বল শরীরে। গেট খুলে নিজের বাড়িতে ঢুকতে যাবেন সুনন্দকাকু, এমন সময় একটা টেম্পো এসে দাঁড়াল। ক্যুরিয়ার সার্ভিসের নীল পোশাক পরা সেই ভদ্রলোক গাড়ি থেকে নেমে এলেন। ওঁর হাতে সাদা কাপড়ে মোড়া আয়তকার একটা বাক্স। সুনন্দকাকুকে বললেন, আপনি ফিরেছেন দিল্লি থেকে? ভালই হয়েছে। আবার একটা পার্সেল এসেছে আপনার নামে। জংবাহাদুর থাপা নামে একজন গরুবাথান থেকে এটা পাঠিয়েছেন। সুনন্দকাকু সই করে পার্সেলটা নিয়ে নিলেন। টেম্পোটা কালো ধোঁয়া ছেড়ে বেরিয়ে গেল। বাক্সটা হাতে নিয়ে সুনন্দকাকু ভুলুর দিকে তাকিয়ে স্মিতমুখে বললেন, অবশেষে সেই এপিস ইন্ডিকা এসে পৌঁছল। যাক, এবার দু’-চারদিন রেস্ট নিয়ে তুই একটু চাঙ্গা হয়ে নে। তারপর আমরা মৌমাছি চাষের কাজ শুরু করব, কেমন? ভুলু ফ্যাকাশে মুখে দাঁড়িয়ে ছিল আমার পাশে। আতঙ্কিত গলায় বলল, পার্সেলটা তুমি বাড়িতে নিয়ে যাও ছোটকাকু। মৌমাছির চাষ করো, রিসার্চ করো, উড়িয়ে দাও বাক্স খুলে।
মোট কথা যা ইচ্ছে তাই করো। ওসবের মধ্যে আমি আর নেই। আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, বলিস কি? এ তো ভূতের মুখে রাম নাম! ভুলু দু’হাতে নিজের কান ধরে নিমতেতো গলায় বলল, এই যে কান ধরলাম। মধুমক্ষী পালনের শখ আমার জন্মের মতো ঘুচে গেছে। আজ থেকে মৌমাছির নাম পর্যন্ত নেব না আমি আর।

সাফাই অভিযান

একটি বোকা ছেলের করুণ পরিণতি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *