রাস্তায় নামতেই হইহই করে উঠলো লোকগুলো। ওই দিকে যাবেন না।ঠিক বুঝে ওঠার আগে একটা ধাক্কায় ছিটকে পড়ল রাস্তা থেকে নিচে। ওই দিকটা অনেকটা ঢাল হয়ে নেমেগেছে নিচের দিকে। তাই টাল সামলাতে পারেনি। আর একটু গড়ালেই হল। একদম জলে। নয়ানজুলির। কোনরকমে নিজেকে সামলে সোমনাথ উঠে এলো আবার রাস্তায়। ভিড়টা আরও ঘন হয়েছে। মৌমাছির গুঞ্জন। তখনও কিছু বুঝে উঠতে পারেনি। সবে বাস থেকে নেমেছে। তার মধ্যেই হইহই। এমন সময় ভিড়টা ঠেলে বেরিয়ে এলো মণিদীপা।
—আরে সোমনাথদা, তুমি এখানে! কবে এলে, কখন এলে,জানাওনিতো — অনেকগুলো প্রশ্ন একসাথে করে তবে থামল।
সোমনাথ একটু দম নিয়ে বলে, আরে দাঁড়াও। তুমিতো একসাথে অনেকগুলো প্রশ্ন করলে তা একটু সময়তো দেবে উত্তর দেবার জন্য। বলে হাসতে থাকে সোমনাথ। লজ্জা পেয়ে যায় মণিদীপা।
—না না ঠিক আছে, তুমি ধীরেসুস্থে বল। আসলে…
সোমনাথ মণিদীপার লজ্জা কাটাবার জন্য বলে, লজ্জা পাবার কিছু নেই। অনেকদিন পর দেখা হলে এমন হয়। আমি সবে এলাম। দেখতো জামাকাপড়ের কি অবস্থা হল।
এতক্ষণে মণিদীপার নজর যায় সোমনাথের পোশাকের উপর। তাইতো সোমনাথদা! আমি খেয়ালই করিনি। ভীষণ বাজে ব্যাপার। কি হয়েছে ? প্রশ্নটা ছুঁড়ে দেয় সোমনাথের দিকে।
সোমনাথ হাসতে হাসতে বলে তেমন কিছু না। এই একটু গড়িয়ে পড়েছিলাম আর কি।
—মানে! কোথায় পড়ে গিয়েছিলেন। উদ্বিগ্ন হয় মণিদীপা।
সোমনাথ হাত দিয়ে ইশারায় দেখায় রাস্তার ওপাশটা। তা কি করে পড়লেন ওখানে মণিদীপার প্রশ্ন। সোমনাথ বাস থেকে নামার পরের ঘটনাগুলো পর পর বলে মণিদীপাকে। মণিদীপা চুপ করে যায়। বুঝতে পারে । তার আগেই খেয়াল করা উচিত ছিল। সোমনাথদা মনে মনে নিশ্চয় কিছু ভাবছে। মুখে না না ভাব দেখাচ্ছে। ‘এতবড় একটা মেয়ে তার কোনোদিকে হুঁশ নেই ! সামনে একটা জলজ্যান্ত মানুষ দাঁড়িয়ে অথচ তার পোশাকের দিকে কোনও নজর পড়ল না। এ কেমন ধারার মেয়েরে বাবা।’ মনে মনে ভাবে মণিদীপা। লজ্জার ব্যাপার।
চলুন, বলে সোমনাথকে এগোতে ইশারা করে। সোমনাথ মন্ত্রমুগ্ধের মতো মণিদীপার সঙ্গে চলে। রাস্তাটা বড় রাস্তা থেকে অনেকটা নেমে তারপর আবার উঁচু হয়ে গেছে। বড় রাস্তার গায়ে বলে বসতির ঘনত্ব বেশি। অনেক গাড়িও যাতায়াত করে। ইদানীং অনেক দোকান হয়েছে। বেশকিছু খাবার দোকানও হয়েছে। এস টি ডি বুথ,সিম কার্ড, টপআপে ছেয়ে গেছে। দোকানগুলোর কোনটার তলার কিছু অংশ ইট তারপর বাকিটা দরমা। মাথায় টালি। আবার কোনও কোনটা শুধুই দরমা আর মাথায় খড় বা টালি। সম্পূর্ণ পাকাও আছে অনেকগুলো। সেই আগের চেহারাটা এখন আর নেই। পালটেগেছে অনেক কিছুই। মণিদীপা কি আগের মতো আছে। পাশাপাশি হাঁটছে দু’জনে। ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না সোমনাথ। অনেক প্রশ্ন সোমনাথের মাথায় ঘুরপাক খায়। দূরত্ব কি বেড়ে গেছে অনেক। হঠাৎ একটা গাছের কাছে এসে দাঁড়িয়ে পড়ে। খেজুর না !
হ্যাঁ, ছোট্ট উত্তর দেয় মণিদীপা। তুমি দাঁড়াও আমি কুড়িয়ে নিচ্ছি। বলে মণিদীপা ঝুঁকে পড়ে মটির উপর। অনেক বড় হয়ে গেছে মণিদীপা। ছোটকালের শিউলি তোলার কথা মনে পড়ে। তখন বয়স আর কত হবে ! বড়জোর আট কী দশ হবে। এরকম গাছতলা থেকে কতবার যে খেজুর কুড়িয়ে খেয়েছে। মাঠ ঘাট বাদাবন। অনেক দিন অনেক সময় অনেক কথা। কত স্মৃতি মনের মধ্যে ভাসতে থাকে। কয়েকটা বছর বাদ গেছে মাত্র।
সোমনাথদা না ! বলে সুধন্য এগিয়ে আসে। সোমনাথ প্রথমে চিনতেই পারেনি। মণিদীপা মনেকরিয়ে দেয়। আরে ও তো সুধন্য। মিত্তির কাকার ছোটো ছেলে। এ বছর বারো ক্লাস পাস করে কলেজে পড়ছে। খেলাধুলায় খুব ভালো। কিন্তু মন নেই। মন রয়েছে আঁকায়।
মন্দ কি ! অনেক লাইনতো আছে। মনোযোগী হতে হবে কাজটায়। দেখার চোখ চাই। নিয়মিত চর্চা করেযেতে হবে। কথাগুলো বলে সোমনাথ। আসলে অনেকদিন দেখিনিতো তাই ঠিক মনে করতে পারছিলাম না।
—তা কিছুদিন থাকবেনতো সোমনাথদা। সোমনাথ সম্মতিসূচক ঘাড়নেড়ে হ্যাঁ বলে। পোশাকের দিকে একবার ভালোকরে চোখ বুলিয়ে সুধন্য বলে— এটা কি করে হল! সে অনেক কথা পরে শুনবি বলে কাটিয়ে দেয় মণিদীপা। সুধন্য আর কথা না বাড়িয়ে বাধ্য ছেলের মতো বলে— আমি এখন যাই পরে দেখা হবে। সোমনাথ ঘাড় নাড়ে। ভাবটা এমন অনেক হয়েছে । এবার এসো। অনেকটা সময় যেন ওর নষ্ট হয়ে গেল। আসলে মণিদীপার সঙ্গে এই সময়টায় আর কেউ ভাগীদার হোক এটা সোমনাথের মনপছন্দ নয়। কিন্তু তাই বলে হুট করেতো কাউকে চলে যেতে বলা যায় না। যখন অনেকদিন পর তার সঙ্গে দেখা। সে যতই না চাক। আর সবকিছুতো তার চাওয়া পাওয়ার উপর নির্ভর করছে না।
মণিদীপা সোমনাথের মনোভাব আঁচ করার চেষ্টা করে। এদিকে সোমনাথ ভাবতেও পারেনি যে এভাবে মণিদীপার সঙ্গে তার দেখা হয়ে যাবে। বেশ কয়েকটা বছর কেটে গেছে ঠিকই কিন্তু মনের ভেতরের সেই জায়গাটা আজও থেকে গেছে।
বড় রাস্তা থেকে এলি —প্রশ্নটা মণিদীপার দিকে ছুঁড়েদেয় মিত্তির কাকা। মানে সুধন্যর বাবা।
—হ্যাঁ, উত্তর দেয় মণিদীপা। কিছু বুঝতে পারলি লাশটা কার।
—না, তবে সবাই আলোচনা করছিল আমাদের এ দিকের কেউ না। তা তোর সঙ্গের ছেলেটাকে খুব চেনা চেনা লাগছে। চোখেও এখন কম দেখি। সোমনাথ কী।
—হ্যাঁ, উত্তরটা সোমনাথই দেয়। কেমন আছেন ?
—ভালো। তবে বয়সতো হচ্ছে।
তাতো বটেই সোমনাথ বলে। একটু আগে সুধন্যর সঙ্গে দেখা হয়েছিল । বলল মণিদীপা। তাই! মিত্তির কাকু বললেন। তা কিছু কথা হল সুধন্যর সঙ্গে। ছেলেটা তো পড়াশোনায় মন বসাতেই চায় না। ছবি আঁকায় মন গেছে। কি করি বলত বাবা সোমনাথ ?
—চাইছে যখন চেষ্টা করে দেখুক। আপনি না বললে যদি শোনে তো আলাদা কথা। নাহলে আপনি আর কি করবেন বলুন। তবে লেগে পড়ে থাকলে একটা না একটা রাস্তা নিশ্চয় বের হবে। আপনি ভাববেন না। মিত্তির কাকু হাতের লাঠিটা ঠুকতে ঠুকতে বড় রাস্তার দিকে হাঁটা লাগালেন। কৌতূহলও বয়সের বাধা মানতে চায় না।
গাছের ছায়া ধরে এগোয় ওরা দু’জন। বেলা কম। মেঘের আনাগোনা চলে। রোদের পরশ গা সওয়া। রাস্তার দু’পাশে সার দিয়ে গাছ। উপরের নীলের সঙ্গে সবুজ মন ভরায়। ভালোলাগে সোমনাথের। কংক্রিটের জঙ্গল নেই। সীমাহীন আকাশ। চেনা-অচেনা নানা পাখির নানা ডাক। ছোটবেলা মাঝে মাঝে তাকে জড়িয়ে ধরে।
পাশের ধানিজমি ছুঁয়ে ফুরফুরে বাতাস মণিদীপার চুল অবিন্যস্ত করে দেয়। একটা ছাগলছানা মাঠ থেকে ব্যা ব্যা করতে করতে রাস্তায় উঠে আসে। মণিদীপা এক ছুটে ছাগলছানাটাকে কোলে তুলেনেয়। সোমনাথ মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে মণিদীপার দিকে। মণিদীপা ছানাটাকে জড়িয়ে ধরে।