মজার দুষ্টু বিদ্রোহ

মধুমতি নদী থেকে উঠে আসা বড়খালের জোয়ার ভাটার পানিতে সাঁতার কাটার সময় ওরা এক আলাদা জগত তৈরি করে। ওরা সবাই প্রায় কিশোর বয়সের। তবে ভালো সাঁতার জানা ছোটদের কেউ কেউও ওই খেলায় খেলার সুযোগ পায়। দেখলে মনে হবে ওরা বুঝি পৃথিবীর সবচেয়ে আনন্দদায়ক ওই খেলা খেলছে আর সে খেলায় ওরাই সবচেয়ে সেরা। এই খেলায় অন্যসব খেলার মতো কোন নির্দিষ্ট সংখ্যা দিয়ে সীমিত নয়। সংখ্যাটি এখানে উন্মুক্ত। যে কেউ যখন খুশি তখন এই খেলায় অংশ নিতে পারে অন্যদেরকে শুধু আনুষ্ঠানিক একটা জানান দিয়ে। সাঁতার কাটার সময় হলেই এই খেলায় ওরা মেতে ওঠে। কবে কখন কোথায় এই খেলা প্রথম চালু হয়েছিল তার কোন ইতিহাস যদিও বা কেউ বলতে পারে না। তবে পৃথিবীর যাদেরই জলের পাশাপাশি বসবাস তারা প্রায় সবাই বলতে গেলে অমন সব জলখেলা খেলে অভ্যস্থ। কারণ এই খেলায় কোন সরঞ্জাম লাগে না। শুধু সাঁতার জানলেই চলে। দলনেতা নির্বাচনটাও হয় ঝটপট। দলের কোন একজন খালপাড় থেকে একটু মাঝখানে গিয়েই নিজেকে নেতা হিসেবে ঘোষণা দেয়। নেতার প্রস্তুতি শেষে রেডি ওয়ান টু থ্রি বলার পর অন্যরা তার উদ্দেশ্যে ছুট লাগায়। এই খেলায় জলের উপরে মাথা থাকা অবস্থায় যে প্রথম নেতার মাথা ছুঁয়ে দিতে পারবে সে-ই হবে পরবর্তী টার্গেট ম্যান বা পরবর্তী নেতা । জলের নিচে মাথা ছুঁয়ে দিলে বা জোড় করে নেতাকে আটকে রাখলে তাকে ওই খেলা থেকে পরবর্তী নেতা নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত বহিস্কার করা হয়। নতুন নেতা নির্বাচিত হলে বহিস্কার হওয়া খেলোয়ার আবারো এই খেলায় অংশ নিতে পারে।

সাধারণত দুপুর বারোটায় এই খেলা সবচেয়ে বেশি জমে। কারণ তখন খেলোয়ারের সংখ্যা থাকে অনেক অনেক বেশি। বেশি খেলোয়ারকে কে কতো বেশি সময় ধরে খাটাতে পারল, তা দিয়েই এই খেলায় নিজ নিজ শ্রেষ্ঠত্ব যাচাই করা হয়। এমনিতে কেউ একজন স্বেচ্ছায় প্রথমে নিজেকে নেতা ঘোষণা দেয়। অন্য কারো আপত্তি না থাকলে তাকে দিয়েই খেলা শুরু হয়। আর যদি প্রথম নেতা হবার জন্য একাধিক আগ্রহী প্রার্থী থাকে তখন ওরা টস করে নেতা নির্বাচন করে। নেতা নির্বাচন শেষেই শুরু হয় খেলা। যদি কেউ কোনোদিন প্রথম বারের মতো নেতা নির্বাচিত হতে না চায়, তাহলে অন্যরা সবাই মনে মনে ধরে নেয় হয়তো আগের রাতে সে মাওলানা সাহেবের সাথে ঘুমিয়েছিল। আর যে-ই মাওলানা সাহেবের সাথে রাতে একবার ঘুমায় পরের দিন সে নেতা হওয়া তো দূরের কথা রহস্যময় এক কারণে ওই দিন সে আর জলেই নামে না। মাওলান সাহেবের সাথে ঘুমানোর পরের দিন সে নিজেকে এই আনন্দদায়ক খেলা থেকে নিবৃত রাখে। আর তখন তীরে বসে সে কেবল অন্যদের উৎসাহ যোগায়। তাছাড়া এই খেলায় জোড়জবরদস্তি করে কাউকে নেতা বানানোর নিয়ম নেই।

ধীরে ধীরে হোস্টেলের প্রায় সবাই মাওলানা সাহেবের মধ্যরাতের আলো আঁধারি শরীরি পাঠে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। কিন্তু দিনের বেলায় ওসব নিয়ে রা করার মতো দুঃসাহস দেখায় না কেউ। ভিতরে ভিতরে সবাই মাওলানাকে সায়েস্তা করার ইচ্ছা পোষণ করলেও ছাত্রদের প্রায় প্রত্যেকেই মনে করে বিষয়টা সম্ভবত অন্য কারো বেলায় হয়তো ঘটে না। পাছে অন্যদের কাছে নিজের ইজ্জত বিষয়ক গোপন খবর রাষ্ট্র হয়ে গেলে ইমেজ সংকটের বারোটা বাজে আর তখন মাদ্রাসা ত্যাগ না করে কি উপায় আছে? ফলে ভিন্ন ভিন্ন রাতে ভিন্ন ভিন্ন ছাত্রের সাথে মাওলানা সাহেবের মধ্যরাতের ওইসব ব্যাপার স্যাপার ধামাচাপাই থাকে। সেই সুযোগে গহরডাঙ্গা এবতেদিয়া মাদ্রাসার রেসিডেন্সিরাল পরিচালক মাওলানা কুতুব উদ্দীন দুপুরে খানাপিনা সেরে নাকে তেল দিয়ে ঘুমান। ভুক্তভোগীরা সেই সুযোগ হাতছাড়া করে কিভাবে? এমনিতে ফজরের আজানের পর থেকেই কঠোর সব নিয়ম কানুনের মধ্যে কখন যে দুপুর গরিয়ে যায়। এরপর ঘন্টা খানেকের একটা বিরতি। ওই সময়টা খেলাধূলা আর সাঁতারে সবাই ব্যস্ত হয়ে পরে। তারপর যোহরের আযান, নামাজ, দুপুরের খাবার। একেবারেই টাইট সিডিউল।

ফলে লান্সের পর একটু না ঘুমালে সন্ধ্যায় পড়ার আসরে যাদের চোখ ঢুলু ঢুলু, তাদের মধ্যে কোনো একজনের ওই রাতে মাওলানা সাহেবের সঙ্গে ঘুমানোর নিয়ম। দুপুরে খাবারের পর আছরের আযান পর্যন্ত যারা না ঘুমিয়ে দুষ্টামি বা অন্য কোনো কাজে ব্যস্ত থাকে, তারা কেউ আজ পর্যন্ত মাওলানা সাহেবের চোখ ফাঁকি দিতে পারেনি। আশ্চর্য জাদুর কৌশলে মাওলানা কুতুব উদ্দিন সেই সব ছাত্রদের চট করেই বাছাই করতে পারেন। লম্বা চিকন কাঁচা বেতের দু-চার ঘা পরলেই না ঘুমানোর কারণটাও বেরিয়ে যায় দ্রুত। তারপর রাতের খাবার পর্যন্ত তাদের দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়ার নিয়ম। পড়া না পারলে আবার বাড়তি শাস্তি তো রয়েছেই। কোনো কোনো দিন এমন হয় যে, শাস্তির মাত্রা তীব্র হলে ওইসব ছাত্ররা ঠিকমতো রাতের খাওয়া দাওয়া পর্যন্ত ঠিক মতো করতে পারে না। আর তখন স্নেহের পরশে মাওলানা সাহেব সেই ছাত্রটিকে ওইরাতে নিজের সঙ্গে ঘুমানোর প্রস্তাব করেন। ওই প্রস্তাবে আজ প্রর্যন্ত যারাই দ্বিমত পোষণ করেছে তারা বরং আরো ভয়ংকর শাস্তিও পেয়েছে। আর শেষ পর্যন্ত ওই সব ছাত্রের মাওলানা সাহেবের সহশয্যা এড়ানো খুবই কঠিন ব্যাপার।

তাই মাওলানা সাহেবের ওপর হোস্টেলের প্রায় সকল ছাত্রেরই একটা কমোন ক্ষোভ রয়েছে। যে করেই হোক মাওলানা সাহেবকে একটা কঠিন শিক্ষা দেওয়া চাই। ক্ষোভ ধীরে ধীরে বিক্ষোভে রূপ না নিয়ে কৌশলের দিকে গড়াল। ওরা আবিষ্কার করল যে মাওলানা সাহেব দিনের বেলায় অনেকটা মরার মতো পরে পরে ঘুমান। পাশাপাশি ভয়ংকর রকম নাক ডাকেন। কৌশল আর কুশলীদের যৌথ প্রযোজনায় ঠা ঠা রোদের কাঁঠালপাকা গরমের মধ্যেও ওরা আমগাছের ডালে এক এক করে সবাই জড়ো হয়। যেন আজ এই মাদ্রাসায় মাওলানা কুতুবউদ্দীন সাহেব ছাড়া কোনো ছাত্রেরই কোনো ভাবেই দুপুরের ঘুম আসে না। ঘটনা সরাসরি দেখতে পাওয়ার আনন্দই আলাদা। পূর্ব পরিকল্পনা মতো রমজান আর সুলতান বিড়ালের মতো নিঃশব্দে হেঁটে হেঁটে ঘুমন্ত মাওলানা কুতুবউদ্দিন সাহেবের পায়ের কাছে গিয়ে বসে। অন্যরা কেউ বা বাইরের জানালায় দাঁড়িয়ে। কেউ বা আম গাছে। কেউ বা মাঠ এবং রাস্তায় পাহারা দিচ্ছে। যাতে মাওলানা সাহেবের কাছে কেউ আসলে ওরা নিরাপদে কেটে পরতে পারে।

এক নাম্বার নাইলনের বারো নম্বর সুতা। সুতা দিয়ে ফাঁস বানানোর কাজে রমজানরা প্রায় সবাই ওস্তাদ। দ হাতে মাওলানা সাহেবকে ওরা ফাঁসের টোপে বেঁধে চুপচাপ বাইরে এসে আমগাছের তলায় অপেক্ষা করতে থাকে।

অপেক্ষা খুবই অসহ্য ব্যাপার। কারো কারো মাথায় হঠাৎ বুদ্ধি চাপল, আযান হতে পারে এক নম্বর ওষুধ। এই একটা বিষয়ে ওরা মাওলানা সাহেবকে খাঁটি মাবুদের বান্দা মানে ওরা। যতো বেহুসের মতোই মাওলানা ঘুমাক না কেন, আযানের সুর শোনা মাত্র তাঁর ঘুম ভাঙবেই। বেলালের আযান শুনেই মাওলানা কুতুব উদ্দিন সাহেব পাশ ফিরে শরীরের আলস্য ছাড়ানোর চেষ্টা করেন। অমনি মাওলানা সাহেবের লিঙ্গে সুতার টান পরে। ঘুমের ঘোরে ব্যাপার বুঝতে না পেরে মাওলানা সাহেব উঠে বসার চেষ্টা করেন। কিন্তু পারেন না । লিঙ্গ তার কঠিন ভাবে বাঁধা পরেছে। ছাড়ানোর চেষ্টা করলেই নিশ্চিত ওটা দ্বিখন্ডিত হবে।

বাইরে আমগাছে আর মাদ্রাসা প্রাঙ্গনে তখন আনন্দের উৎসব বয়ে যায়। আজ যেন রমজানদের উৎসব করার দিন। আজ অন্তত মাওলানার ওপর একটা যুতসই বদলা নেওয়া গেছে। উৎসব আর হৈ হুল্লোর দেখে প্রতিবেশীদের ভীড় বাড়ার আগেই ওরা যে যার মতো মাদ্রাসা ছেড়ে পালায়।

দুঃখিত!