ভৌতিক জঙ্গল

২০০৯ সালের এপ্রিল মাস। আমার এস, এস, সি পরীক্ষার পর আমি আমার খালার বাড়ি সাতক্ষিরার শ্যাম নগর থানায় বেড়াতে যাই। আমার মা বাবা দুজনই জব করেন, তাই আমাকে বাসে তুলে দেয়া হয় আর আমি একাই যাই। পথে আমাদের বাসটা নষ্ট হয়ে যায় এবং সেটা ঠিক করতে প্রায় ২ ঘণ্টার মত সময় লাগে। যখন আমি সাতক্ষিরায় পৌঁছাই তখন রাত প্রায় ১০ টা। আমি বাস থেকে নেমে দেখলাম আমার খালু আর খালাতো বোন আমাকে নিতে এসেছে। বাস স্ট্যান্ড থেকে আমার খালার বাসায় যেতে মিনিট দশেক সময় লাগে। আমরা মাটির রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলাম। কেন যেনও মনে হচ্ছিল রাস্তা ঘাঁট একটু বেশি নির্জন। আমার খালু একটু আগে আগে হাঁটছেন আর আমি আর আমার বোন পিছে পিছে। আমিই নিরবতা ভাঙলাম। আমার আপুকে জিজ্ঞেস করলাম রাস্তা এতো সুনসান কেন? আপু উত্তরে বলল, তাদের বাড়ির পাশের জঙ্গলে ২ দিন আগে একটা লোককে কে বা কারা যেনও খুব করে ফেলে রেখে গেছে। এই কথা শুনে আমার কেন যেনও একটু ভয় ভয় করতে লাগলো। কেন যেনও মনে হতে লাগলো পেছনে কেউ হাঁটছে। ২-৩ বার ভয়ে ভয়ে পেছনে ফিরলাম কিন্তু কিছুই দেখতে পেলাম না। এভাবে ভয় পেতে পেতে কোনোভাবে খালার বাসায় এসে পৌঁছলাম।

খালার বাসা ২ তলা। বিশাল এই বাড়িতে উনারা শুধুমাত্র ৩ জন থাকেন। আমার খালা, খালু, আর আমার খালাতো বোন। বাড়ির চারপাশে ঘন বনজঙ্গল। কেমন যেনও গা ছমছম করে। আবার নাকি কাকে সেখানে খুব করে ফেলে রেখে গেছে। ভাবতেই ভয় লাগছিল। সেদিন রাতে ফ্রেশ হয়ে খাওয়া দাওয়া করে কেমন যেনও ক্লান্তি অনুভব করছিলাম। খালাদের প্রকাণ্ড অট্টালিকায় নিচে ৫ খানা ঘর আর উপরে ৩ টি ঘর। এক একটি ঘর যেনও এক একটি খেলার মাঠ। যাই হোক, আমার জন্য নিচ তোলার একটি ঘরে থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রথমে একটু ভয় করছিলো একা একা থাকতে, কিন্তু মনে সাহস আনলাম। এবং এক সময় ঘুমিয়ে পড়লাম। রাত তখন কয়টা বাজে আমি জানি না, কিন্তু হটাত আমার ঘুম ভেঙ্গে গেলো।

গ্রীষ্মকাল ছিল তাই আমার মাথার কাছের জানালাটা খোলা ছিল। ঐ জানালা দিয়ে সেই জঙ্গলটা দেখা যায় যেখানে ২ দিন আগে খুনটা হয়েছে। যাই হোক, জানালার দিকে চোখ পড়তেই খুব ভয় পেলাম। ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যেও কোনো একটা অভয়বের উপস্থিতি লক্ষ্য করলাম মনে হল। সেটা নাড়াচাড়া করছিলো! আমি শুধু এতটুকু দেখেই ভয়ে জোরে চিৎকার করে উঠলাম। আমার চিৎকারের কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখি খালা, খালু ছুটে আসলেন। তারা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন কি হয়েছে। তো, আমি বললাম আমি কি দেখেছি। কিন্তু উনারা বললেন যে এটা মনের ভুল। আলো জ্বালানোর পর আমার কাছেও ব্যাপারটা হাস্যকর মনে হচ্ছিল। তাই আমিও সেই কথাটা মেনে নিলাম।

সেইদিন রাতে এরপর আমি আর আমার খালাতো বোন এক সাথে ঘুমাই। এরপর দিন দুপুরের পর আমাকে নিয়ে তারা বেড়াতে বের হন। আমরা বেড়াতে বেড়াতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো। বাড়ি ফেরার পথে আবার সেই জঙ্গলটা পড়ে। জঙ্গলটা দেখে আমার আবার গতরাতের কথা মনে পড়ে গেলো। খানিকটা ভয় ভয় করতে লাগলো। ভয় কাটানোর জন্য আমি আর আমার খালা গল্প করতে করতে এগুচ্ছিলাম। এর মাঝে আমরা খেয়াল করিনি যে আমার খালাতো বোন আমাদের সাথে নেই। আমরা যখন প্রায় বাড়ির কাছাকাছি তখন দেখলাম আপু আমাদের সাথে নেই। সবাই আপুকে খুঁজাখুঁজি শুরু করলাম কিন্তু আপুকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না।

শেষ মেশ কিছু মানুষজন জোগাড় করে সেই জঙ্গলে যাওয়া হল। সেখানে গিয়ে দেখা যায় আপু মাটিতে পড়ে আছে। তাকে সেখান থেকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। ২ দিন সেখানে থাকার পর আপু বাসায় ফিরে। সবাই জিজ্ঞেস করায় সে সবাইকে সেদিনের ঘটনা খুলে বলে। সেদিন সে আমাদের পেছন পেছন আসছিলো এমন সময় কে যেনও তাকে পেছন থেকে তার নাম ধরে ডাকছিল। সে পেছনে ফিরে দেখে কেউ নেই, কিন্তু ডাকটা বারবার কানে আসছে। তাই সে ডাক শুনে পেছনে যেতে লাগলো। সে নাকি বুঝতে পারছিল না যে সে কি নিজের ইচ্ছায় যাচ্ছে না কি কেউ তাকে সম্মোহন করে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।

যেখানে লাশটা পাওয়া গিয়েছিলো সেখানে গিয়ে আপু দেখল লাশটি মাটিতে পড়ে আছে। লাশটির দু চোখ খোলা এবং সেই দু চোখে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে আপুর দিকে তাকিয়ে আছে। আপুর নাকি এতো টুকুই মনে আছে। এরপর জ্ঞান ফিরলে সে নিজেকে হাসপাতালে আবিষ্কার করে। এরপরের দিনই আমি ঢাকায় ফিরে আসি। আমি সেই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা এখনো ভুলতে পারিনি।

রাত্রি ভয়ঙ্কর

ছাঁয়া

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *