ভূত ব্যাপারটা কি তোমরা বিশ্বাস করো? ভূত বলে কি কিছু একটা আছে? ছোটবেলায় তো কত রকমের ভূতের গল্প পড়েছ – মা ঠাকুমার কাছে নানা ধরনের গা ছমছম করা ভূতের গল্প শুনেছ। আর গ্রামের ছেলে হলে তো কথাই নেই – ঘরের কিংবা বাড়ির আনাচে কানাচে, বাগানে, সন্ধ্যে হলেই অনেক ছায়া ছায়া ভূতকে ঘুরতেও দেখেছ – তাই না? আমাদের ছোটবেলায় তো আমরা অনেক রকম ভূতকে জানতাম, যেমন ধরো – ব্রহ্মদত্যি বেল গাছের ডালে খড়ম পায়ে উবু হয়ে বসে গুড়ুক গুড়ুক করে থেলো হুঁকোতে তামাক খায় – ইয়া বড় বড় দাঁত – গলায় মোটা পৈতে – মাথার লম্বা টিকিতে গাঁদা ফুল ঝুলছে; রোগা সিড়িঙ্গে গেছো ভূত সড়াৎ করে সুপুরি গাছের মাথায় উঠে মেজাজে পা দোলায় আর গাছের নিচে দিয়ে রাত্রে কেউ গেলেই পায়ের বুড়ো আঙ্গুলের ফাঁকে চেপে ধরে; একানড়ে তাল গাছের মত খাড়া আর এক ঠেঙ্গা লম্বা – এক মাথা ঝাকড়া চুল – কপালের মাঝখানে একটাই গোল চোখ অন্ধকারে ধক ধক করে জ্বলে; শাকচুন্নী লাল কালো চৌকো কাটা গামছা গায়ে বিল অথবা জলাতে লম্বা লম্বা পা ফেলে পুঁটি মাছ ধরে সেগুলোকে কাদায় পুতে রাখে পচা পুঁটি মাছ খাবে বলে; স্কন্ধকাটার মাথা নেই – চোখ দুটো বুকের মধ্যে – সন্ধ্যের পর যখন তখন বাঁশবনের ধারের রাস্তা দিয়ে দৌড়ায় বাচ্চাদের ধরার জন্য; মামদো ভূত আধো অন্ধকারে লোক জনকে উটকো ভয় দেখিয়ে আনন্দে মাটিতে গড়াগড়ি খেয়ে বিটকেল আওয়াজে হাসতে থাকে; পেত্নী সন্ধ্যেবেলা বাড়ির আনাচে কানাচে ঘুরে থেকে থেকে খোনা গলায় পান্তাভাত খেতে চায়; আরো কত ধরনের ভূত আর এই ভূতেদের সংসারে ব্রহ্মদত্যি হলো সব থেকে সম্মানিত ভূত। তোমরা, আজকালকার কচি কাঁচারা, জানোও না বাঙ্গালী ভূত পরিবারের ইতিহাস – শুধু জানো বিদেশী ভূতেরা ঝুল ঝাড়নে চেপে ঘুরে বেড়ায়, নানা রকম চেহারাতে সবাইকে ভয় দেখায় আর নয়তো ছোট্ট সুন্দর ভূত ক্যাসপার বাচ্চাদের সাথে খেলতে আর মজা করতে ভালোবাসে – টিভিতে এই সব ভূতেদের গল্প কমিকই তো তোমরা দেখো। শহরে মাঝে মাঝে পড়ো বাড়িতে ভূতের খবর পাওয়া যায় কিন্তু একটু স্থিতু হবার আগেই প্রোমোটারের ভয়ে বেচারিদের পালিয়ে যেতে হয়। সত্যিই ভূতেদের দিনকাল আজকাল খুবই খারাপ যাচ্ছে – ওদের আর থাকার বিশেষ জায়গা নেই, ঘোরা ফেরা করার উপায় নেই। এই রকমই এক মনমরা ভূতের সাথে ঘটনা চক্রে আমার একবার দেখা হয়েছিলো – ওদের দুঃখের কথা শুনলে তোমাদেরও কষ্ট হবে।
আমার জীবনের প্রথম চাকরি ছিলো মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভের – নতুন বলে কোম্পানি শহরে জায়গা দেয় নি – পাঠিয়ে দিয়েছিলো গ্রামে গঞ্জে ডাক্তারদের ফ্রি স্যাম্পলের লোভ দেখিয়ে বিক্রী বাড়ানোর জন্য। বেশীর ভাগ জায়গাতেই যাতায়াতের জন্য সাইকেল রিক্সা আর না হলে ভ্যান রিক্সা। এই ভাবে ভবঘুরের মত ঘুরতে ঘুরতে একটা গঞ্জে এসে হাজির হয়েছিলাম। রাতে থাকার মত হোটেল বলতে তেমন কিছু নেই – এক খাবার হোটেলে অনুরোধ করতে ওরা দোতলার একটা ছোট্ট ঘর দেখিয়ে বললো, ঘরটা অনেক দিন ব্যবহার হয় নি – একটু ম্যানেজ করে নিতে হবে। পুরাতন খাড়া কাঠের সিঁড়ি – প্রতি ধাপেই ক্যাঁচ কোঁচ আওয়াজ করে। ওপরে গিয়ে দেখি ঘরটা অনেক দিন নয় বেশ কয়েক বছর বোধ হয় ব্যবহার হয় নি – চারদিক ধুলো আর মাকড়সার জালে ভরা। একটা নেওয়ারের খাট আর নড়বড়ে কাঠের টেবিল ও চেয়ার – দেওয়াল আলমারিটার একটা পাল্লা কব্জা থেকে খুলে ঝুলছে। ঘরে আলোর ব্যবস্থাও নেই – হ্যারিকেন জ্বালাতে হবে। এক রাতের মাথা গোঁজার জন্য ওখানেই যতটা সম্ভব ঝাড়া ঝাড়ি করে শোবার মত ব্যবস্থা করতে হলো। রাতে নিচের হোটেলে খেয়ে একটা হ্যারিকেন নিয়ে ওপরে এসে খুব সাবধানে চেয়ারটায় বসলাম যাতে ভেঙ্গে না যায়। হ্যারিকেনের আলোতে ঘরে আলো থেকে ছায়ার খেলাই বেশী। চুপচাপ বসে ভাবছিলাম কালকে কোনদিকে যাওয়া যায় হঠাৎ শুনি কোথা থেকে বাচ্চা কুকুরের কুঁই কুঁই-এর মত আওয়াজ আসছে – ভাবলাম কুকুরের বাচ্চাটা নিচে দোকানে না হলে রাস্তায় হবে। আওয়াজটাকে পাত্তা না দিয়ে আস্তে করে নেওয়ারের খাটে পা তুলে যতটা সম্ভব আরাম করে বসার চেষ্টা করতে চেয়ার ও খাট দুটোই মনে হলো একটু প্রতিবাদ করলো। এবার ওই কুঁই কুঁই আওয়াজটা একটু জোরেই এলো – কে যেন নাকি সুরে কাঁদছে আর আওয়াজটা আসছে দেওয়াল আলমারির ভেতর থেকেই। এবার কৌতুহল মাথা চাড়া দিলো – তবে একটু ভয়ও হলো, কি জানি গ্রাম গঞ্জের ব্যাপার – কিসে থেকে কি হয়! হ্যারিকেনের আলোটা বাড়িয়ে দিয়ে জোরে গলা খ্যাঁকারি দিয়ে বললাম,
‘কে রে ওখানে কুঁই কুঁই করে?’
সাথে সাথে কান্না থেমে গেলো, কে যেন কাঁপা কাঁপা খোনা গলায় বললো,
‘আঁলোঁটাঁ কঁমিঁয়েঁ দাঁও – চোঁখেঁ লাঁগঁছেঁ – আঁমিঁ ভূঁতঁ।’
গলা শুনেই বুকের ভেতরটা ভয়ে গুড় গুড় করে উঠলো তবে বাইরে খুব সাহস দেখিয়ে রাগের ভান করে বললাম,
‘তা আলমারির ভেতরে বসে কেঁদে যাচ্ছো কেন? জ্বালাতন করার আর জায়গা পেলে না? সারা দিন খেটে খুটে এসে একটু ঘুমাবো তারও উপায় নেই দেখছি।’
[এর পরে ভূতের কথা বার্তায় এত চন্দ্রবিন্দু দিলে ছাপাখানার অসুবিধা হবে – ওটা তোমরাই বসিয়ে নিও]
‘এত বছর পর ঘরে আলো জ্বলতে দেখে ভাবলাম তুমি আমাকে ধরতে এসেছো – সেই ভয়ে আমার কান্না পেয়ে গেলো।’
‘আমি জানতামই না তুমি এখানে আছো।’
‘তুমি মনে হচ্ছে বাইরের লোক তাই বোধহয় জানো না। কিছুদিন হলো এক ওঝা এখানে এসে ভূত ধরার ব্যবসা শুরু করেছে – ধরতে পারলেই ভালো পয়সা। ও ব্যাটা কি করে যেন টের পায় কোথায় আমরা লুকিয়ে আছি। তারপর মন্ত্র পড়ে হাঁড়ির মধ্যে ঢুকিয়ে মুখ বন্ধ করে খালের জলে ফেলে দেয়। আমি কোন রকমে পালিয়ে এই ঘরে আশ্রয় নিয়েছি – একটু যে বাইরের হাওয়ায় ঘুরবো তারও উপায় নেই। একা এই আলমারিতে থাকতে থাকতে মাঝে মাঝেই ভীষণ মন খারাপ হয়ে যায়।’
‘তা তুমি অন্য কোন জায়গায় পালিয়ে গেলে না কেন?’
‘কোথায় যাবো বলো? আমাদের ভূতেদের সেই রবরবা তো আর নেই – এখন গ্রামে গঞ্জে সব জায়গায় ইলেকট্রিকের আলো জ্বলে – এত আলো আমাদের সহ্য হয় না। তাছাড়া এক কালে লোক জনকে ভয় দেখিয়ে বেশ আনন্দেই দিন কাটতো – এখন বাচ্চা ছেলে মেয়েরা পর্যন্ত ভূতের কথা শুনলে হাসে – কোন পাত্তাই দেয় না – আসলে ওরা তো বাঙ্গালী ভূতের কথা জানেই না। এ রকম নিরানন্দ ভূতের জীবন কি ভালো লাগে।’
‘তা হলে আর কী করবে বলো। আপাততঃ তুমি আলমারির মধ্যে ঢুকে যাও। কালকে আমার অনেক কাজ – একটু ঘুমাতে দাও, কাল রাতে আবার কথা হবে। তবে কুঁই কুঁই করে একদম কাঁদবে না আর কোন রকম বদমাইসি করার চেষ্টাও করো না।’
পরেরে দিন এখানকার ডাক্তারদের পেছনে ঘুরেই সময় গেলো। এই সব গ্রাম গঞ্জের ডাক্তারদের মধ্যে কত জন সত্যিকারের ডাক্তার বলা মুস্কিল – নামের শেষে এক গাদা লেজুড় লাগিয়ে রেখেছে কিন্তু তা এ্যালোপ্যাথি না হোমিওপ্যাথি না আয়ুর্বেদিক কে জানে। সারাদিন ঘুরে ক্লান্ত হয়ে রাতের খাওয়া শেষ করেই ঘরে ফিরলাম। সারাদিনের চক্করে আর ডাক্তারদের সাথে ভ্যানর ভ্যানর করে ভূত ব্যাটার কথা মনেই ছিলো না। হাত মুখ ধুয়ে চেয়ারে আরাম করে বসতেই খেয়াল হলো বাবা জীবন তো ঘরেই আছেন।
‘কৈ হে – কোথায় গেলে?’
‘এই যে, আমি তোমার অপেক্ষাতেই আছি। কালকে তোমার সাথে কথা বলে খুব ভালো লেগেছে – অনেক দিন পর কথা বলার সঙ্গী পেলাম।’
‘দ্যাখো বাবা, আমাকে আবার ভূত বানিয়ে দিও না।’
‘কি যে বলো! সবাই বলে ভূতে ঘাড় মটকায় – আদপেই তা নয় – আমরা একটু ভয় টয় দেখাই এই পর্যন্ত। আমাদের দেখতে পায় না বলেই লোকে এত ভয় পায়। তা ছাড়া বদনামটা হয়েছে শুধু এই ছিঁচকেমি আর পেছনে লাগার জন্যই।’
‘আমি কিন্তু কালকে ভোরে উঠেই ভোঁ কাট্টা – একটু দূরের একটা শহরে যেতে হবে। আমার কাজই এই – সারা বছর ঘুরে বেড়ানোর – কোথাও একটু স্থিতু হয়ে বসার উপায় নেই। তুমি তো এই ঘরেই থেকে যাবে, তাই না?’
‘কালকেই চলে যাবে? আবার একা একা মনমরা হয়ে আলমারিতে পড়ে থাকতে হবে। তারপর কোন দিন ওঝা ব্যাটা টের পেয়ে আমাকেও হাড়িতে ঢুকিয়ে খালে ফেলে দেবে – ও তো ভূত ধরার জন্য হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। (একটু চিন্তা করে) আমাকে একটু সাহায্য করবে?’
‘বলে ফ্যালো – পারলে করবো।’
‘আমাকে নিয়ে চলো না তোমার সাথে। তুমি তো একা একাই ঘোরো – গল্প টল্প করতে পারবে অবসর সময়ে – আমিও ওঝার হাত থেকে বেঁচে যাবো। তোমার ওই ঝোলা ব্যাগের মধ্যেই ঢুকে যাবো – কেউ টেরও পাবে না।’
‘হ্যাঃ, আমি সারা জীবন একটা ভূতকে ঘাড়ে নিয়ে ঘুরে বেড়াই। টের পেলে জনতা তো আমাকে পিটিয়ে ভূত বানিয়ে ছাড়বে।’
‘না না, আমি কথা দিচ্ছি কেউ টেরই পাবে না। আর সুবিধে মত জায়গা পেলে আমি নিজেই চলে যাবো।’
‘বুঝলাম – এতে তোমার তো জান বাঁচবে – কিন্তু আমার কি লাভটা হলো?’
‘দ্যাখো, আমরা একেবারে ফ্যালনা নই – আমাদেরও কিছু কিছু গুণ আছে। আমি হয়তো তোমার সাহায্যও করতে পারি – তাছাড়া পাহারাদারের কাজও করবো। কথা দিচ্ছি কোন রকম নষ্টামি করবো না – আমাদের কথা কিন্তু খুব পাক্কা।’
ভূতের কথাটা মনে ধরলো – একটু মজাও লাগছিলো একটা সত্যিকারের ভূতকে ব্যাগের মধ্যে নিয়ে ঘুরে বেড়াবো বলে – তাছাড়া আমার তো কোন অসুবিধা হচ্ছে না ওকে নিয়ে ঘুরতে। এতে ওর যদি কোন উপকার হয় তো ভালোই। যেখানে সুবিধা মত জায়গা পাবো সেখানে না হয় ছেড়ে দেবো।
‘ঠিক আছে, তুমি আমার ঝোলা ব্যাগটাতে ঢুকে যাও – তারপর দেখা যাবে কি হয়। তবে বুঝবো কি করে তুমি ব্যাগে আছো কি না?’
‘তুমি ব্যাগের ওপর টোকা মারলেই আমি তোমার হাতে টোকা দেবো।’
সকালে উঠে চা টা খেয়ে ব্যাগটা ঘাড়ে নিলাম তারপর আস্তে টোকা দিতে আমার হাতেও টোকা লাগলো। একটা সাইকেল রিক্সা ধরে বাস ষ্ট্যান্ডে এসে একটু ছায়া দেখে দাঁড়ালাম বাসের জন্য। বুঝি একটু অন্যমনস্ক ছিলাম হঠাৎ ভূত বললো,
‘বাস আসছে, তাড়াতাড়ি এগিয়ে যাও – বসার জায়গা পাবে।’
খেয়াল করি নি যে বাস আসছে – তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে বাসে উঠে বসার জায়গাও পেয়ে গেলাম – না হলে কম পক্ষে ঘন্টা দুয়েক দাঁড়াতে হতো। ধীরে ধীরে ভূতের সাথে বন্ধুত্ব হয়ে গেলো। একা একা থাকার বিরক্তিটা আর ছিলো না – বিশেষ করে রাত্রে বেশ গল্প করেই সময় কেটে যেতো। হিসেব করে দেখলাম ওর মানুষ আর ভূত জীবন মিলিয়ে বয়সে প্রায় আমার সমানই। এর মধ্যে দুবার আমাকে খুব বাঁচিয়েও দিয়েছে। একবার রাস্তা পেরুবার সময় খেয়াল করি নি উলটো দিক থেকে আসা একটা ট্রাককে – ভূত না বললে ধাক্কা খেয়ে হাসপাতালে যেতে হতো। আর একবার গ্রামের আধো অন্ধকার রাস্তায় হাঁটার সময় দেখতে পাই নি কাল কেউটে সাপটাকে ঝোপের পাশে – একটু হলেই লেজে পা পড়তো। হঠাৎ দেখি সাপটা আমার সামনে হাওয়াতে দোল খাচ্ছে – ভূত ওটার লেজ ধরে ছুঁড়ে ফেলে দিলো দূরে। এর কিছুদিন পরে হঠাৎই হেড অফিস থেকে চিঠি – ভয়ে ভয়ে খুললাম – কি জানি চাকরি থেকে ছাঁটাই করে দিলো কি না। দেখি কোম্পানির মার্কেটিং ম্যানেজার আমার কাজের প্রশংসা করে জানিয়েছেন আমার প্রমোশনের কথা। আর গ্রামে গঞ্জে ঘুরতে হবে না – শহরের অফিসেই বসতে হবে তবে খোদ কলকাতাতে নয় – একটা মাঝামাঝি ধরনের মফস্বল শহরে। ভূতকে রাত্রে বললাম,
‘তোমার জন্যই হয়তো আমার কপাল ফিরেছে না হলে এত তাড়াতাড়ি কাউকেই প্রমোশন দেয় না। এবার আমাকে শহরের অফিসেই বসতে হবে।’
ভূতের মনে হলো মনটা বেশ খারাপ হয়ে গেলো।
‘বন্ধু, এবার আমাকে কোথাও ছেড়ে এসো। শহরের আলো আর ভিড়ে তো আমি থাকতে পারবো না।’
ভূত যে চলে যাবে এটা আমার মাথাতেই ছিলো না – ও আমার প্রতি মুহূর্তের সঙ্গী হয়ে গিয়েছে – মনটা খুব খারাপ হয়ে গেলো। তারপর ভাবলাম ওই মফস্বল শহরে তো কলকাতার মত আলো, ভিড় ভাট্টা নেই তাহলে ভূত বন্ধু কেন থাকতে পারবে না।
‘দ্যাখো, আমার মনে হয় তুমি আপাততঃ আমার সাথেই চলো – ওখানে সত্যিই যদি তোমার ভালো না লাগে তা হলে না হয় তোমাকে অন্য কোথাও ছেড়ে আসার কথা ভাববো। আসলে কি জানো, আমাদের প্রায় বছর খানেকের এই মেলা মেশাতে তুমি আমার খুব কাছের লোক হয়ে গিয়েছো – তোমার সাথে গল্প করে সন্ধ্যেবেলা গুলো বেশ ভালোই কেটে যায় তার ওপর তুমি তো আমাকে অনেক ভাবেই সাহায্য করেছো তাই তোমাকে ছেড়ে থাকতে আমার ঠিক মন চাইছে না।’
‘আমারও তাই – তোমাকে ছেড়ে কি ভাবে আবার একা একা থাকবো সেটাই চিন্তা করছিলাম। ওই শহরে অন্য কোন ওঝার দৌরাত্ম্য মনে হয় থাকবে না তাই একটু স্বাধীন ভাবেই থাকতে পারবো। ঠিক আছে চলো শহরে গিয়েই দেখা যাক।’
মফস্বল শহরটা খুব একটা বড় নয় – হাজার পঞ্চাশেকের মত লোকের বাস তাই ওখানকার অফিসটা ছোটই। শহরের একটু বাইরের দিকেই বাড়ি নিলাম যাতে ভূত বন্ধুর কোন অসুবিধা না হয় – ওখান থেকে সাইকেলেই অফিস যাতায়াত করতে পারবো। ছোট খাটো আলাদা বাড়ি বেশ বড় একটা আম বাগানের গা ঘেঁসে আর পেছন দিকে ধান ক্ষেত। বাড়িটা পাবার আগে কয়েক দিন ওকে ঝোলার মধ্যে নিয়েই অফিসে যেতাম তবে সারা দিন বেশ ভয়ে ভয়ে থাকতে হতো যদি কোন কারণে কেউ টের পেয়ে যায় তা হলে কি হবে? তা ছাড়া ঘাড়ে ঝোলা নিয়ে অফিসারকেও ঠিক মানায় না – প্রথম দিনই অফিসের দু-একজন ভুরু কুঁচকে তাকিয়েছিলো যেন কোথা থেকে এই ঝোলা ঘাড়ে গেঁয়ো ভূত এসে জুটলো। বাড়ি দেখে ভূত বন্ধু খুব খুশি –
‘এই বাড়ি সব দিক দিয়ে খুব ভালো – আমি সারাদিন ওই আম বাগানে খোলা বাতাসে ঘুরে বেড়াতে পারবো। এত দিন ধরে ওই ঝোলার মধ্যে থেকে থেকে হাঁপিয়ে উঠেছিলাম – তাছাড়া তোমাকেও আর সারাদিন আমার জন্য অস্বস্তিতে কাটাতে হবে না।’
আমি অবশ্য ওকে একটু সাবধান করে দিলাম,
‘দ্যাখো, স্বাধীনতার আনন্দে সব ভুলে আবার তোমাদের নষ্টামী মানে লোক জনদের ভয় দেখানো শুরু করো না – তাহলে লোকে বুঝতে পেরে আবার কোন ওঝা নিয়ে আসবে।’
‘আরে না না – ওঝার যা তাড়া খেয়েছি আর ওসব ব্যাপারে নেই – আমি খুব ভালো ভূতের মতই থাকবো। আশে পাশের কেউ টেরটিও পাবে না যে আমি এখানে আছি।’
পরদিন ওকে বাড়িতে রেখেই অফিস গেলাম তবে সারা দিন মনের মধ্যে একটু খচ খচ করতে লাগলো যদি ওর কোন অসুবিধা হয় অথবা এত দিন পর হঠাৎ ছাড়া পেয়ে কোন নষ্টামী না করে বসে সেই চিন্তায় তবে সব থেকে বড় বাঁচোয়া ওকে কেউ দেখতে পাবে না। সন্ধ্যেবেলা বাড়ি ফিরে এসেই হাঁক পাড়লাম,
‘কোথায় বন্ধু? আজ দিনটা কেমন কাটলো?’
‘বুঝলে আজ পুরো এলাকাটা খুব সাবধানে ঘুরে দেখলাম – মনে হয় ভয় পাওয়ার মত কিছু নেই। আম বাগানে খুব ভালো জাতের আমের সব গাছ আর খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। সারা দুপুর ওখানেই সব থেকে বড় গাছের মগডালে বসে আরাম করেছি। এত দিন পর বাইরের খোলা হাওয়াতে ঘুরে খুব ভালো লাগছে।’
ভূত বন্ধুর সাথে কথা বলতে বলতে চা বানাচ্ছিলাম আর ও চায়ের কৌটো, চিনির কৌটো এই সব এগিয়ে দিচ্ছিলো – বাইরের কেউ দেখলে নির্ঘাৎ ভির্মি খাবে কারণ ভূত বন্ধুকে দেখা যায় না বলে মনে হবে কৌটো গুলো হাওয়াতে ভেসে ভেসে আসছে।
‘জানো, দুপুরে একবার আমাদের ডান পাশের বাড়িতে ঢুকেছিলাম হাল চাল দেখতে।’
শুনেই আমি চমকে উঠলাম – কাপের চা ছলকে উঠলো।
‘ঠিক কোন বদমাইসি করেছো?’
‘আরে তুমি ঘাবড়াচ্ছো কেন – আমি তো কথা দিয়েছি কোন দুষ্টামী করবো না। আসলে খুব সুন্দর রান্নার গন্ধ বেরুচ্ছিলো তাই ওদের রান্নাঘরের জানালাতে বসে দেখছিলাম বাড়ির মহিলা কি রান্না করছেন। রান্নার ধরন আর গন্ধতেই মনে হলো মহিলার হাতের রান্না খুব ভালো। মাছের মুড়ি ঘন্ট বানিয়েছিলো ভালো গোবিন্দভোগ চাল দিয়ে – কি সুন্দর তার গন্ধ তোমাকে বলে বোঝাতে পারবো না – আমি পুরোটা শিখে নিয়েছি – এই রবিবারে বড় দেখে মাছের মুড়ো নিয়ে এসো তারপর আমি বলবো আর তুমি বানাবে। ভেবেছিলাম একটু খানি তোমার জন্য নিয়ে আসি তবে তুমি যদি রেগে যাও তাই আনি নি।’
‘খুব ভালো করেছো আনো নি – মহিলারা চট করে বুঝতে পারে বাটিতে কেউ হাত দিয়েছে কিনা। পরে বেড়ালে মুখ দিয়েছে বলে হয়তো এত কষ্টের রান্না ফেলেই দিতো। ঠিক আছে একদিন বানানো যাবে না হয় তবে তুমি তো খেতে পারো না – আমার একা একা খেতে মোটেই ভালো লাগবে না।’
‘তুমি শুধু শুধু ভাবছো – কথায় আছে না ‘ঘ্রানেনঃ অর্ধ ভোজনং’ – রান্নার গন্ধেই আমি খুশি। আজ তো ওই মহিলার রান্না মুড়ি ঘন্টের গন্ধেই যেন আমার পেটটা ভরে আছে। এখন রোজ ওই মহিলার রান্না নজর দিয়ে দেখবো তাহলে তোমাকে অনেক রকমের রান্না শেখাতে পারবো আর আমারও বেশ গন্ধ শোঁকা হবে।’
পরদিন বিকেলে বাড়ি ফিরতে ভূত বন্ধু পাড়ার আর এক বাড়ির গল্প শুরু করলো। আমি হেসে ফেললাম,
‘তুমি তো দেখছি বুড়ি পিসীমার মত পাড়া-বেড়ানি হয়ে গেলে – সবার হাঁড়ির খবর নিতে শুরু করেছো।’
ভূত বন্ধু মনে হলো একটু লজ্জাই পেয়েছে,
“যাঃ, তুমি যা ভাবছো তা মোটেই নয়। এদিক ওদিক ঘুরতে ঘুরতে যা নজরে পড়ে তাই তোমাকে বলি। ওই মহিলা না ভীষণ ছুঁচিবাই গ্রস্ত তার উপর আবার হাড় কেপ্পন – সারা দিনে তিন চারবার সমস্ত বাড়িটা ধোয়া পোঁছা করেন ফলে রান্না করার দায়িত্ব বেচারি কর্তার ওপর – শুধু পাতলা করে মুগের ডাল আর ভাত তার সাথে কাঁচা লঙ্কা – ছেলে মেয়ে দুজনের তো হেনস্তার শেষ নেই। এদিকে সারাদিন জল ঘেঁটে ঘেঁটে ভদ্রমহিলার হাতে পায়ে হাজা হয়ে গিয়েছে – সত্যিই সংসারে কত রকমের লোকই না হয়।’
বেশ চলছিলো আমাদের সংসার – ভূত বন্ধুর দৌলতে অনেক রকম ভালো ভালো রান্না শিখে গিয়েছি আর ওর সব থেকে বড় গুণ ছিলো গন্ধ শুঁকে বলে দিতো রান্নাতে কি গোলমাল হয়েছে। আমের দিনে প্রায় রোজই একটা দুটো ভালো ল্যাংড়া আম চলে আসতো বাগান থেকে। আমি বারণ করলে ভূত বন্ধু হাসতো,
‘আরে মিছি মিছি ঘাবড়াচ্ছো কেন। বাগানে হাজার হাজার আম থেকে একটা দুটো গেলে কে ধরতে পারবে? বাদুড়ে তো অনেক বেশী আম নষ্ট করে।’
কয়েকদিন ধরেই মনে হচ্ছিলো ভূত বন্ধু একটু আনমনা, সেদিন দেখি কথা বলতে বলতে হঠাৎই চুপ হয়ে কি যেন ভাবছে – সাধারণতঃ ও খুবই বাক্যবাগীশ তাই জিজ্ঞেস করলাম,
‘কী হলো? আজ মনে হচ্ছে তোমার গল্প করতে ভালো লাগছে না – কী ব্যাপার?’
‘না মানে – এই আর কি।’
একটু অভিমান দেখিয়েই বললাম,
‘ঠিক আছে, আমাকে বলতে না চাইলে বলো না।’
‘না না – তা নয়। কদিন ধরেই ভাবছি তোমাকে বলবো তবে ঠিক ভরসা পাচ্ছি না।’
‘তা বলতে এত দোনামনা কেন?’
‘না – – মানে – – একটু লজ্জাই করছে।’
‘সে কি? আমাকে বলতে লজ্জা করছে?’
তারপর ওর মুখের টুকরো ঘটনা থেকে জানতে পারলাম, সপ্তাহ খানেক আগে ওই আম বাগানে হঠাৎই এক পেত্নী মানে মেয়ে ভূতের সাথে ওর দেখা হয় – সে বেচারি অনেক জায়গা থেকে তাড়া খেয়ে ঘুরতে ঘুরতে এই আম বাগানে এসে হাজির হয়েছে। প্রথম দেখাতেই দুজনের দুজনকে পছন্দ হয়ে গিয়েছে। এখন আমার বন্ধুটি একেবারে হাবুডুবু খাচ্ছেন – ইচ্ছে দুজনে বিয়ে করে বরাবরের মত ওই আম বাগানে বাসা বাঁধে।
‘আরেঃ, এই কথা বলতে তোমার এত লজ্জা। এত খুবই ভালো কথা – তোমার যদি উপযুক্ত সঙ্গিনী জোটে তবে আমিই সব থেকে বেশী আনন্দিত হবো। তা একদিন নিয়ে এসো না আলাপ করাতে – অবশ্য দেখতে তো পাবো না তবে কথা বলতে আপত্তি কিসের।’
‘না – – মানে – – ও তো খুবই লাজুক। আজ অবশ্য এক রকম জোর করেই নিয়ে এসেছি – ঐ তো ঘরের কোনার মোড়াতে বসে আছে।’
আমি তো পেত্নীকে দেখতে পাচ্ছি না তাই মোড়ার দিকে হাত তুলে নমস্কার করে বললাম,
‘আমার এই বন্ধুর মত ভূত আপনি আর পাবেন না। প্রার্থনা করি আপনারা সুখে শান্তিতে সংসার করুন। আমি যতদিন এখানে আছি এই বাড়ির দরজা আপনাদের জন্য খোলা রইলো। মাঝে মাঝে নিশ্চয়ই দেখা হবে।’
খুব আস্তে একটু চাপা গলা ভেসে এলো,
‘আপনার কথা ওর কাছে অনেক শুনেছি। আপনাদের বন্ধুত্বের তুলনা হয় না – আমরা মাঝে মাঝে নিশ্চয়ই আসবো এখানে গল্প টল্প করতে।’
‘ঠিক আছে বন্ধু – এবার তাহলে বিদায়।’
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।