ভূত দেখার গল্প

ছোটকালে আমরা গল্প শুনতে ভাল বাসতাম। এখনকার দিনেও ছোটরা গল্প শুনতে ভালবাসে। ছোটকালে আমরা একটু আড়াল অন্ধকার বেছে নিতাম গল্প জমাবার স্থান হিসেবে। তেমনি এখনকার ছোটরাও আড়াল-অন্ধকার বেছে নেয় গল্পের আসর বসাতে। সেই সুযোগটা এনে দেয় হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে গেলে। হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে গেলে অন্ধকারে তলিয়ে যায় সবকিছু। কেমোন ভৌতিক পরিবেশ সৃষ্টি হয় ক্ষণকালের জন্য। সেদিনও তেমনি বিদ্যুৎ চলে গেল। শহরে বিদ্যুৎ চলে যাওয়া নতুন আর কী! বিকল্প ব্যবস্থাও চালু আছে ঘরে ঘরে। কেউ মোমবাতি জ্বালে। কেউবা চার্জ লাইট জ্বেলে অন্ধকার তাড়ায়। আবার সামর্থ্যবানরা ব্যাটারী চালিত কিংবা জেনারেটর দ্বারা অন্ধকার দূর করে, পাখা ঘুরায়। আর এসব বিকল্প ব্যবস্থার মাধ্যমে ছোটদের পড়াশোনা, প্রয়োজনীয় কাজ অব্যাহত থাকে।
সেদিন হলো ভিন্ন ঘটনা। বিদ্যুৎ চলে গেছে। বিকল্প ব্যবস্থাও রেডি। চার্জার লাইট জ্বালানো হলো। তার মানে বিন্দি, অর্থি, অনিকের পড়াশোনা যথারীতি চলবে। কিন্তু ওদের মাথায় গল্প শোনার ভূত চেপে বসেছে। তিনজন মিলে এক সঙ্গে হাজির আমার কাছে। আমি তখন বিকল্প আলোতে একটা ঈদ সংখ্যা ম্যাগাজিনের জন্য লেখায় মশ্গুল। হাতে সময় নেই। গ্রীষ্মের আলু সেদ্ধ হওয়া ভ্যাপসা গরমে ঘেমে নেয়ে কলম চালিয়ে যাচ্ছি। একেতো হাতের সময় ফুরিয়ে এসেছে। উপরন্তু কাহিনীর এমন স্থানে এসে উপনীত একটা রোমাঞ্চ অনুভব করছি মনে মনে। লেখা তো শুধুই কল্পনার ফানুস উড়ানো নয়!
-আববু!
ছোট অর্থিটা জোরে ডাক দেয়। সম্বিৎ ফিরে পাই আমি।
আচমকা ভয় পাওয়ার মত খানিকটা ভড়কে যাই। লেখা থামিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি ওরা তিনজন দাঁড়িয়ে।
-কীরে! পড়াশোনা রেখে আমার এখানে কেন্। দেখছিস্ না লিখছি?
-কী লিখছ আববু? পাকা বুড়ি অর্থির প্রশ্ন।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও জবাব দিলাম- বড়দের জন্য উপন্যাস। আমাকে এখন জ্বালানো চলবে না। যা, পড়তে না চাস্ ছাদ থেকে ঘুরে আয়। ভেবেছিলাম এই আবদারটুকু নিয়েই বুঝি আমার দারস্থ হয়েছে। এসব অন্যায় দাবী তোলার সাহস মায়ের কাছে হয় না। স্কুলের জাঁদরেল শিক্ষিকা হেনা মিস্ট্রেস ওদের মা। মনে মনে ভাবলাম।
-আববু, তুমিও চলো না আমাদের সঙ্গে- তোমার ছোটকালের চিলেকোঠার গল্প শোনাবে! অ-নে-ক দিন বলেছ শোনাবে!
ভেবেছিলাম ছাদে যাওয়ার অনুমতি দিলেই বুঝি ওদের কবল থেকে বাঁচা যাবে। এখন দেখছি আমাকেসহ টান দিচ্ছে ওরা।
-আববু, তুমি না বলেছিলে তোমার ছোটকালটি কাটতো চিলেকোঠায়, শোনাবে সে গল্প? বিন্দি বলল।
বিন্দির আবার সাহিত্যের প্রতি ঝোঁক আছে। খুব ছোট কাল থেকেই সে দু’চারটে ছড়া-কবিতা লিখে এবং তা স্কুল ম্যাগাজিনে স্থান পেয়ে প্রতিভার স্বাক্ষর রাখে। ওর প্রতি দুর্বলতা একটু বেশি। অন্তত বিন্দির কথা রাখতে হয়।
-ঠিক আছে চলো ছাদে। বললাম।
সদলবলে চলে এলাম ছাদে। ছাদে এলে নিজেকে কেমোন মুক্ত মানুষ মনে হয়। সমাজের এতো বাঁধা-বন্ধন।
নিয়ম-শাসনের মধ্যে বাস করেও এই ছাদে এলে মনে হয়- মুক্ত মানুষ আমি। বিশেষ করে যখন আকাশের দিকে চোখ যায়। ‘আকাশ আমায় শিক্ষা দিলো উদার হতে ভাইরে’ পংক্তিটি মনে পড়ে।
জ্যৈষ্ঠের রাতের আকাশ। গভীর রাত নয়। কিছুটা মেঘ নীল আকাশের জমিনকে ঢেকে ঢুকে রেখেছে, কোথাও কোথাও। আকাশের সীমাহীনতা বড় আনন্দ জাগায়। চোখ যায় ঘুরে ঘুরে উত্তর-পূর্ব দিকে। চোখ পড়ে একটা নতুন তারার দিকে। কী যেনো নাম- কী যেনো নাম- মনে পড়েছে অভিজিৎ।
চোখ আরো একটু ঘুরিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে আনলাম। চোখে পড়ল আরেকটি তারা গুচ্ছ বৃশ্চিক রাশি। এর মাঝে জ্বল জ্বলে আরেক নক্ষত্রের উপস্থিতি জ্যেষ্ঠা নক্ষত্র।
-আববু, ঐ নক্ষত্রের নাম কী?
বিন্দির আকাশ রাজ্য নিয়ে আগ্রহ আছে। যেমনটি আমি অনুভব করি। মাঝে মধ্যে ছাদে উঠে আকাশের দিকে চোখ রেখে কতো মিনিট ঘণ্টা খরচ করি কেউ জানে না। বিন্দি জানে শুধু। সেও আমার সঙ্গে থাকে মাঝে মাঝে।
-কেন বলিনি, জেষ্ঠা নক্ষত্র! ওর নামেই তো এ মাসের নামকরণ।
-হয়েছে, আকাশ রাজ্য থেকে মুখ ফেরাও আমাদের দিকে। অনিক বলল।
অনিকের আবার ভারি ভারি বিষয়ে মাথা খেলে না। এমনিতে বয়সেও ছোট। কেবল থ্রিতে পা রেখেছে। তাও বয়স অনুপাতে এগিয়ে আছে খানিকটা।
-এই যে তাকালাম। এবার বলো কী গল্প শুনবে?
-আববু, ভূতের গল্প বলো না! ঐ যে তুমি বলেছিলে ছোট কালে মামার বাড়ি গিয়েছিলে ভূতের বাড়ি- যাদের নাম বললাম এরা সত্যিকার নয়। মানে নামের অন্তরালে অন্যরা। তবে এদের মতো অনেক ক্ষুদে পাঠক আছে দেশে। যারা গল্প শুনতে ভালবাসে। গল্প মানে ভূতের গল্প। ভয়ের রোমাঞ্চকর গল্প। একদম সাদামাটা গল্প এদের পছন্দ নয়। সময় পাল্টেছে। শিশু মাসেও বদলে যাচ্ছে। তবু সেই যে অদ্ভুত অদ্ভুত ভূতরে গল্প শোনার ছোটরা এখনো আছে। তেমন একটি গল্প শোনাবো। সঙ্গে বিন্দি, অর্থি, অনিক আছে।
ঊনিশশ’ ছেষট্টি সালের ঘটনা। আজ থেকে সাতচল্লিশ বছরের পুরনো দিনের কথা। আমি ক্লাশ ফাইভে পড়ি। হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষা সামনে রেখেই মামা বাড়ি বেড়াতে যাওয়া। আববা সরকারি চাকুরে। সরকারি চাকুরেদের নাকি কয়েক বছর পর পর বেড়াতে ছুটি দেয়। টাকাও দেয়। তেমন ছুটিতে আববা আমাদের নিয়ে বেড়াতে এলেন মামা বাড়ি।
আমরা সাধারণত মামা বাড়ি নানা বাড়ি বলতেই বুঝি গ্রামে কোথাও। আমার মামা বাড়ি মানে খুলনা শহরের প্রাণকেন্দ্রে। বৃটিশ আমলের ফরেস্ট রেঞ্জার নানাজান খুলনা শহরে বিশাল জায়গা কিনে বাড়ি করেছিলেন। বিশাল পুকুরসহ সে বাড়ির আয়তন বুঝি কয়েক বিঘে। আর তখন এ অঞ্চলটা ততো শহুরে মেজাজ হয়ে উঠেনি। শহরও তেমোন গড়ে উঠেনি। মদস্বলের আমেজ ছিল যত্রতত্র। নারকেল গাছের উদার আমন্ত্রণ। ফিন ফিন বাতাসের আদরমাখা প্রলেপ ছিল। মায়াময় পরিবেশ চারদিকে। মামা ছিলেন দু’জন। চার খালারা খুলনা শহরেই থাকেন। তার মানে মামাত খালাত মিলিয়ে আমরা ছোটদের বাহিনী বেশ বড়সড়। মামা বাড়ি বেড়াতে এসেছি মানে অবাধ স্বাধীনতা। মামাত খালাত ভাই-বোনদেরও এককথা- ওরা মামা বাড়ি বেড়াতে এসেছে, সাত খুন মাফ।
যদিও মাঝে মধ্যে খেলা নিয়ে গোল বেঁধে গেলে দু’চারটে কিল-ঘুষি জুটে যেতো। বিচার গড়াতো নানীজান পর্যন্ত। নানীর বিচার সোজা। মেহমানরা অপরাধ যাই করুক, শাসন করা যাবে না। মেহমানদের খালাস। আর যদি অপরাধী মেজবান হয় তবে নানীর আদর থেকে বঞ্চিত হবে সে। শাস্তি ওইটুকুই। তবে আমাদের মাঝে লাগালাগি মারামারি খুব একটা ছিলই না। হিংসা-বিদ্বেষও ছিল না আমাদের মাঝে।
দিনের বেলা কাটতো নানা ধরনের খেলায় মেতে। লুকোচুরি। ছিপ দিয়ে মাছ মারা। পুকুরে সাঁতার শেখা। ঝুনো নারকেল দু’টো বেঁধে বুকের মাঝামাঝি রেখে সাঁতার শেখার চেষ্টাটা চলতো। একবার সেই নারকেল সরে গিয়ে মাঝ পুকুরে আমি ডুবেই যাচ্ছিলাম। বড় মামা ছিলেন অন্য ঘাটে। গোসল করছিলেন। দেখেই ঝাঁপ দিয়ে সাঁতরে এসে আমাকে উদ্ধার করলেন। এরপর আর পুকুরে নামতে সাহস পাইনি। সেবার সাঁতার শেখাও হলো না। রাতের বেলা চলতো অন্য খেলা। বিছানায় গোল হয়ে বসে যেসব খেলা যায়। যেমন- এন্টি বেন্টি, তালগাছ কাটা, চোর-পুলিশ, ওয়ার্ড মেকিং, লুড় ইত্যাদি।
রাতের খাবার গ্রহণের আগে চলতো এসব খেলা। খাওয়ার পর রাতটা একটু জমে এলে বসতো গল্পের আসর। প্রথম কয়েকদিন আমরা শ্রোতা। নানী, মামাত খালাত ভাই-বোনদের মুখে একের পর এক গল্প শুনছি, মানুষের গল্প, ভূতের গল্প। আর গল্প শোনার জন্য ধীরে ধীরে একটা নির্দিষ্ট স্থান হয়ে গেল। তা হলো- কামরুল ভাইয়ের ঘর। রাস্তার দিকে দোতলা বারান্দার একাংশ পার্টিশন দেওয়া ঘরটি কামরুল ভাইয়ের। আমাদের চেয়ে বছর দশেক বড় বলে সম্পর্কটা দূরবর্তী। তবে স্নেহের অধিকারে রুমটা আমরা দখল করে রাখতাম। কিচ্ছু বলতেন না তিনি।
রাত যতো গভীর হতো জমে উঠতো আমাদের যতো সব ভূতের গল্প। কে কতবার ভূত দেখেছে সেসব বর্ণনা। গায়ে কাঁটা দেওয়া সেসব ঘটনা।
একদিন আমাদের গল্পের মধ্যমণি হয়ে বসলেন কামরুল ভাই। আমাদের বললেন যদি তার সঙ্গে রাতে জেগে থাকতে পারি তবে দেখাবেন ভূত। মনে সাহস রাখতে হবে। তাছাড়া সময়টা গভীর রাত। ভোরের আজান হওয়ার কিছু আগে। কখনো মধ্য রাতেও দেখা যায়। মোট কথা গভীর রাতেই দেখা যায়।
-ভূত কী রকম দেখতে?
আমার মনে প্রশ্ন জাগল। জিজ্ঞেস করে বসলাম।
-ভূত তো অনেক রকম আকার-আকৃতি নিয়ে হাজির হয়। তবে আমি যে ভূতগুলো দেখেছি এ রাস্তায় যেতে ওরা ঘোড়ার মত। কিন্তু মাথাটা ঘোড়ার মত না-
-কী রকম? জানতে চাইলাম ফ্যাঁস ফ্যাঁস স্বরে। ভয় জমে গেছে বুকে।
-মানুষের মাথার মত। কিন্তু দেহটা একদম ঘোড়া। শাদা রঙের। খুরের শব্দও ঘোড়ার মত। টগ্ বগ্ টগ্ বগ্ শব্দ করে রাস্তা দিয়ে জোড়ায় জোড়ায় দৌড়ে চলে যায়। জানালা দিয়ে দেখা যায়। একদম পরিষ্কার।
-কামরুল ভাই, আপনি ভয় পাননা?
-ভয় একটু-আধটু লাগেই। কিন্তু যখন ভাবি, আমি তো দোতলা থেকে ওদের দেখছি, ওরা তো দেখছে না। আমাকে ওরা নাগাল পাবে কীভাবে?
আমরা সেই ভূত দেখব বলে আব্দার করলাম। কামরুল ভাই বললেন, একসঙ্গে সবাইকে দেখানো যাবে না। একে তো কামরুল ভাইয়ের ঘরে এতোজনকে রাতে ভূত দেখা উপলক্ষে নানীজান থাকতে দিবেন না। দ্বিতীয়ত: কামরুল ভাইয়ের মতো যারা ‘ভীতুর ডিম’ তাদের না থাকাই উচিত। শেষে গভীর রাতে ভয়ে ফিট্ হয়ে লঙ্কা কান্ড ঘটাতে পারে। এসব নানা বিষয় বিবেচনা করে ভূত দেখার সদস্য নির্বাচন করা হলো আমাকে এবং এক খালাত ভাই মুন্নাকে। মুন্না কথায় খুব সাহসী। আসলে ভীভুর দাদা। কিন্তু ভূত দেখার চান্সটা পেয়ে যায় বয়সের বদৌলতে। আমার বয়সী। ঘনিষ্ঠ বন্ধুও বটে।
-তারপর?
গলার স্বর নেমে এসেছে বিন্দির।
-কী ভয় করছে?
-বেশ ইন্টারেস্টিং, বলো তারপর কী হলো।
অর্থির গলায় সামান্য কম্পন। গা ঘেঁষে বসেছে ওরা। ছাদে এসে আমরা মাদুর পেতে বসেছিলাম। একটু আগে আমাদের বসার মধ্যে যে দূরত্বটুকু ছিল তা নেই। গা ঘেঁষে ঘেঁষে বসেছে ওরা। ঠান্ডা বাতাস প্রবাহিত হতে শুরু করেছে। বিল্ডিং এর গা ঘেঁষে দাঁড়ানো নারকেল গাছটার পাতার সির্ সির্ শব্দ। কোথাও কারো ছাদে ফুল ফুটেছে বোধ হয়। হাল্কা সুঘ্রাণ নাকে এসে লাগে। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখি আমাদের ছাদেই টবে ফুটেছে শাদা লিলি। আকাশের তারাদের মত অন্ধকারে জ্বলছে। দক্ষিণের বাতাস টেনে নিয়ে আসছে ওর সুগন্ধ। ছাদে আমার ভাল লাগার এটাও একটি বিষয়। আমাদের বিল্ডিংএর পঞ্চম তলার বাসিন্দা সৌখিন বাগান বিলাসীর কল্যাণে ফুলের সমারোহ ঘটেছে। অন্তত দু’শো টবে নানা প্রজাতির ফুল। আহ! কী সুগন্ধ!
-তারপর কী হলো বলো?
অনিকের তর সইছিল না। ঘুম ওর চোখে ভর করেছে বোধ হয়। এমন সময় ওর ছুটি হয়। খেয়ে দেয়ে বিছানায় কাৎ।
-বলছি। অনিক বাবুর ঘুম পেয়েছে বুঝি? আচ্ছা জলদি শেষ করব।
আমি নিজেও তাড়া অনুভব করছি লেখার টেবিলে ফিরে যেতে। তারপর আমি ও মুন্না কামরুল ভাইয়ের সঙ্গে থাকলাম রাতে। ছোট্ট চৌকি। তিনজন থাকা দায়। কামরুল ভাই উদারভাবে আমাদের শুতে দিয়ে তিনি চেয়ারে বসে। পড়ার টেবিলে বই নিয়ে নাড়াচাড়া। হ্যারিকেন জ্বালিয়ে পড়ার ভান করা। চোখে ঘুম নিয়ে পড়া হয়? তাছাড়া কামরুল ভাই একজন প্লেয়ার। মনোযোগ ফুটবলে বেশি। বইতে খুব কম। আমাদের ভালবেসে বিছানা ছেড়ে দিয়েছেন।
-ঘুমাস্ না কিন্তু স্বপন-মুন্না তাহলে মিস্ করবি।
– না, ঘুমাবো না।
খুব জোর দিয়ে বললাম।
ধীরে ধীরে রাত গভীরে প্রবেশ করতে থাকে। ছোট্ট জানালার কপাট খুলে তাকিয়ে আছি। দৃষ্টি যতো দূর যায় ততো দূর। দু’টো একটা মানুষের পদচারণাও আর নেই। একদম ফাঁকা রাস্তা।
কামরুল ভাই এক অদ্ভূত মানুষ। সাহসী এবং আমুদে। মামা বাড়ি বেড়াতে এসে কামরুল ভাইয়ের কল্যাণে মজার মজার জায়গা দেখা হয়েছে। এইতো গেল সপ্তাহে কামরুল ভাই নিয়ে গিয়েছিল ‘প্রেম কানন’ নামে একটি পার্কে। কী যে সুন্দর পার্ক। মজার ব্যাপার হচ্ছে ঐ পার্ক সাজানো হয়েছে গাছ লতা-পাতা দিয়ে; হাতি, ঘোড়া, বাঘ, ভাল্লুক, কুমির, ময়ূর ইত্যাদি প্রাণি দিয়ে। সমস্ত পার্ক জুড়ে ফুল ফুল আর ফুল। সুগন্ধ সুগন্ধ সুগন্ধ। নানা জাতের ফুল ফুটেছে।
নানা ফুলের মিলিত সুগন্ধে এক অচেনা সুবাসে ভরে আছে পার্ক। আমরা গিয়েছিলাম সদলবলে। ঘুরে ঘুরে দেখতে দেখতে হয়ে গেল রাত। কী সুন্দর লাগছিল পূর্ণিমা চাঁদের আলোয় পার্কটিকে। বন্য প্রাণির মেলা। আর অজস্র ফুলের সমারোহ। ভয় ভয় করছিল। একজন মালী এসে বলল- বাচ্চা লোক চল্ যাও রাতকো ইধার রাহনা মানা হ্যায়।
-মানা কেনো মালী ভাই?
বোকার মত প্রশ্ন করেছিলাম আমি।
-ফুলপরী আয়েগা ইধার, নাচ কারেগা, ফুল দে কারগে মালা গাঁথে গা।
-আমি ফুলপরী দেখবো।
আমি বললাম।
-দূর বোকা! ফুলপরী দেখতে নেই। ওরা তোর মত মানুষদের নিয়ে যায়। ওদের দেশে, পরীস্থানে। আর আসতে দেয় না। তাছাড়া রাতে এখানে খারাপ লোকজনও আসে। নেশাখোর।
সেই কামরুল ভাই আমাদের ভূত দেখাতে নিজের বিছানা রেখে চেয়ারে বসে নাক ডাকছেন।
-কামরুল ভাই, কামরুল ভাই।
-কী, কী, এসেছে?
-না, আসেনি। আপনি ঘুমালে দেখাবে কে?
-আমি ঘুমাইনি! পড়তে পড়তে চিন্তা করছিলাম। তোরা কিন্তু একটু ঘুমিয়ে নিতে পারিস। টেবিল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে এখন রাত এগারোটা পঁয়তাল্লিশ। অন্তত রাত আড়াইটার আগে আসবে না। তোরা দেড় ঘণ্টা ঘুমিয়ে নে। আমি ডেকে দেবো। জেগে আছি ততক্ষণ।
-আ…….আ…..হা…….ই…….।
মুন্না বড় ধরনের হাই তুলল। চোখ ছোট হয়ে এসেছে। আমার চোখের পাতাও ভারী। এতো রাত অবধি জাগার রেকর্ড নেই। সারাদিন খেলা খেলা নিয়ে দিন কাটে। শরীর ক্লান্ত।
-ঠিক আছে আমরা তাহলে এক ঘণ্টা ঘুমাই।
-তারপর কী হলো? তুমি বড্ড লম্বা করছ গল্প বলতে।
অর্থির চোখে ঘুম নেমে এসেছে। কথায় বোঝা গেল।
-তারপর? তারপর আমরা ঘুমিয়ে পড়লাম তো পড়লামই। সকালে উঠে কামরুল ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম- এসেছিল?
জবাবে বলল- আসেনি মানে আজকে সংখ্যায় অনেক, যাচ্ছে যাচ্ছে টগ্ বগ্ টগ্ বগ্ একের পর এক-
-তাহলে আমাদের দেখাওনি কেন্!
-তারা কুম্ভকর্ণের মত ঘুমাচ্ছিলি- কতো ডাকাডাকি করলাম। বেশি সময় তো থাকে না!
আমরা বুঝতে পারলাম ঘুমটাই আমাদের ভূত দেখার এমন সুযোগ থেকে বঞ্চিত করেছে। ঠিক হলো পরের দিন আবার রাত জাগা হবে কামরুল ভাইয়ের রুমে।
ও বলা হয়নি তোমাদের, খুলনায় বিখ্যাত ভূতের বাড়িতে গিয়েছিলাম একদিন। কামরুল ভাই নিয়ে গিয়েছিলেন। সে গল্পটা আরেক দিন বলব।
-আববু ঘুম পেয়েছে।
বিন্দি বলল। সবার চোখেই ঘুম।
-তাহলে গল্প?
কালকে শুনব বাকিটা। ছাদে তখন শীতল বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে জোরে। রাতে বৃষ্টি হতে পারে। চলে এলাম ছাদ থেকে আমরা। যে যার স্থানে এসে ঠাঁই নিলাম।

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!