বাঁশ বাগানের হ্যাংলা ভূতগুলোর কি যেনো হয়েছে। কঠিন কোনো ব্যামোয় ধরেছে কিনা কে জানে। সবার মন খারাপ। ছোট বাচ্চা বাচ্চা ভূতগুলো খেলাধূলা বাদ দিয়ে মন খারাপ করে বসে থাকে বাগানের এক কোণে। স্কুলেও যাচ্ছে না তারা দুদিন ধরে। অভিভাবকরা দারুন চিন্তিত তাদের ভবিষ্যত নিয়ে। এখনই বাচ্চাগুলো হাসতে ভুলে গেছে। সামনের কঠিন সময় পার করবে কি করে?
রোগটা ওই ভূতেশ্বর বাবুর স্কুল থেকেই ছড়িয়েছে। সেদিন স্কুলে বাচ্চারা ‘ভয় দেখানোর প্রাথমিক শিক্ষা’ পড়ছিল। এমন সময় হঠাৎ করে কোথা থেকে হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটে এলো ভূতো। এসেই কিছু না বলে ধড়াম করে পড়ে গেল। জ্ঞান হারিয়ে গোঁ গোঁ করতে লাগল। লম্বা কালো কালো দাঁতগুলো তার এমনভাবে পরস্পরের সাথে লেগে আছে যে ভূতের মাস্টার ও ডাক্তার ভূতেশ্বর বাবুও ছাড়াতে পারেনি। অনেক কষ্টে তার জ্ঞান ফিরিয়ে আনা গেল। কি হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই ‘মানুষ’ বলেই আবার জ্ঞান হারালো সে। দাঁতে দাঁতে বাড়ি খেয়ে দাঁতগুলো ভাঙার জোগাড় হলো। পরে জ্ঞান ফিরলে সে যা বলল তাতে সবাই চমকে উঠল। মানুষকে ভয় দেখাতে গিয়ে সে নাকি উল্টো ভয় পেয়েছে!
গ্রামের সহজ সরল মানুষগুলোকে ভয় দেখানো খুব সোজা। একটা বেশ ধরে সামনে গিয়ে সময় মতো বেশ বদলালেই হলো। এইতো সেদিন একটা কালো বেড়াল হয়ে সন্ধ্যার দিকে সে রাস্তার পাশে ঘুরঘুর করছিল। জেলে পাড়ার অতুল বাবু সদাই নিয়ে ফিরছিল। কাছাকাছি হতেই ভূতো বেশ বদলে একটা ফুটফুটে একটা সাদা ছাগলের বাচ্চা হয়ে গেল। তারপর হাসতে হাসতে বেড়ালের মতো করে ডেকে উঠতেই অতুল বাবু পড়িমড়ি করে সেকি দৌড়। ভয়ে আধমরা হয়ে গেছিল। বাড়ি পর্যন্ত গিয়ে দেখে এসেছিল বেচারার মুখ দিয়ে গ্যাজা বেরিয়ে গেছে। অথচ আজ সে মানুষের ভয়ে আধমরা হয়ে গেছে।
ভূত সমাজের মুখে কালি লেপে দিয়েছে ভূতো। সবাই লজ্জায় মরে যেতে লাগলো। চিন্তায় মুখের দাঁতাল হাসি নিভে গিয়ে অন্ধকারের প্রদীপ জ্বলে উঠল। বুড়োরা বলে উঠল, ‘এতো বিষম দায় হলো! মানুষ দেখে এভাবে ভয় পেলে তো ব্যবসা গুটিয়ে না খেয়ে মরতে হবে। বালবাচ্চা নিয়ে পথে বসতে হবে। কি হয়েছে, ভালো করে ঝেড়ে কাশ দেখি বাপু। এমন ভয় পেলে চলবে? ভয় কারবারই হলোগে আমাদের পেশা, মানুষ এ পেশায় নামলে তো মহা সর্বনাশ। জলদি বল দেখি।’ ‘জলদি বল’, ‘জলদি বল’ নাকি সুরের হল্লা ওঠে চারিদিকে। এবার মুখ খোলে ভূতো।
শহর থেকে কয়েকটা ছেলেমেয়ে এসেছে এই গ্রামে। ভূতো গিয়েছিল তাদেরকে দেখতে। নদীর ধারে কয়েকটা তাবু পেতেছে তারা। সুযোগ বুঝে ভয় দেখানোই তার উদ্দেশ্য ছিল। তবে ছেলেমেয়েগুলোর হাবভাব দেখে তার শুরু থেকেই কেমন যেনো অস্বস্তি লাগছিল। দামড়া দামড়া ছেলেমেয়েরা সবাই হাফপ্যান্ট আর শার্ট পরে আছে। সবার চুলই লম্বা, ছেলে মেয়ে আলাদা করে চেনার উপায় নেই। সবারই দুকানে কি যেনো গোঁজা রয়েছে। তালে তালে অদ্ভুতভাবে হাঁটছে তারা। মনে হচ্ছে গানের তালে তালে হাঁহাঁটি করছে।
ভূতো একটা কালো বেড়ালের বেশ ধারণ করে তাবুর আশপাশে ঘুরঘুর করতে থাকে। একটি মেয়ে তাকে দেখতে পেয়ে কোলে তুলে নেয়। সে ছাড়ানোর চেষ্টায় জোরে ঝাড়া মারে কিন্তু তাকে কিছুতেই ছাড়ে না মেয়েটি। বরং গলায়, মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আদর করতে থাকে। আদরের লোভে ভূতো আর কিছু বলে না। কিন্তু সবাই যখন ওকে দেখতে পেয়ে রৈ রৈ করে ওঠে তখন সে একটু ঘাবড়ে যায়। একজন বলে, ‘আরে বিষয়টা দেখেছিস মাম্মা, মালটা এক্কেবারে ব্লাক। ম্যাগনেট থাকতে পারে। বেচে দিলে ভালো পাত্তি পাওয়া যাবে।’
আরেকজন এসে ভূতোর চোখে মুখে এক গাল গাঁজার ধোঁয়া ছেড়ে বলল, ‘আরে তাইতো, পুরাই কালা। মালটার পিকচার খিইচ্চা ল। ফেচবুকে দিয়া দিমুনে, কামে আইব।’ সবাই তখন কি একটা যন্ত্র বের করে তার দিকে তাক করে ধরে। একটা করে আলোর ঝলকানি হয় আর কেমন যেনো ধারালো খচ খচ করে শব্দ হতে থাকে। অনেকে আবার ভূতোর সঙ্গে সেলফি তুলতে চায়। সেলফি কি না বুঝতে পেরে আর ওদের কর্মকাণ্ড দেখে ভয়ে ভূতোর গায়ের রোম দাঁড়িয়ে যায়। সে দেখে প্রত্যেকের হাতে একটা করে নতুন নতুন ভূতো। চমকে ওঠে সে। একি হচ্ছে!
সবাই মোবাইলে ছবি দেখতে ব্যস্ত এই সুযোগে ভূতো বেশ বদলে একটা ধবধবে সাদা ছাগলের বাচ্চা হয়ে যায়। সেই মেয়েটিই তাকে সবার আগে দেখে কোলে তুলে নেয়। ‘ওলে আমার কিউটি কিউটি লে’ বলে আদর করা শুরু করে। ভূতো ভয় দেখানোর জন্য মিউ মিউ করে ডেকে ওঠে। সবাই তখন অবাক হয়ে পরস্পরের দিকে তাকাতে থাকে। তারপর এককজন কোলে নিয়ে পোজ দিয়ে ছবি তুলতে থাকে। বেড়ালের মতো ডাকা ছাগল ছানা এই প্রথম দেখছে তারা। কে কার আগে ছবি তুলে ফেসবুকে দেবে তার প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। কেউ কেউ ভিডিও করতে শুরু করে। সেই ভিডিও দেখে ভয়ে দাঁত কপাটি লেগে আসে ভূতোর। তাকে বন্দি করে ফেলেছে মনে করে এবার সে কেঁদে ওঠে। তবে গলা দিয়ে এবার ছাগলের ডাকই বের হয়। সবার তাতে সেকি উল্লাস।
এরপর ছেলেমেয়েগুলো একটা খাঁচা বানিয়ে ভূতোকে আটকে রাখে। তাকে শহরে নিয়ে গিয়ে কি কি করা হবে শুনে ভয়ে আত্মারাম খাঁচা ছাড়া হয়ে যায় ভূতোর। তারা বলে, ‘একটা ভূত পেলে আরো ভালো হতো। বেচে দেওয়া যেত অনলাইনে। ব্যাপক বিনোদন হইত।’ ওদের কথা শুনে স্বরূপে ফিরতেই সাহস হলো না ভূতোর। ওদের চোখ এড়িয়ে সে একটা ছোট্ট পাখির রূপ নিয়ে বেরিয়ে আসে। তারপর ছুটতে ছুটতে ভূতেশ্বরের স্কুলে গিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।
তার কাছে এ গল্প শুনে সবাই নড়ে চড়ে বসে। বলে কি ভূতো! শহরের মানুষেরা এতো বোকা হলো কি করে ভেবে পায় না তারা। ভূতের বেশ বদলকে তারা এতো হাল্কাভাবে নিচ্ছে কেমন করে? একেবারে যে দামই দিচ্ছে না! নাকি তাদের মাথায় কিছু নেই? এটা যে ভূতের কাণ্ড সেটা তারা বোঝে না নাকি? চিন্তায় মাথার পোকা বেরিয়ে যাবার জোগাড় হলো বুড়ো ভূতগুলোর। আর ভূতোর কথা শোনার পর থেকে বাচ্চা বাচ্চা ভূতগুলো ভয়ে ভয়ে আছে। তাদের মুখের হাসি নিভে গেছে। বুড়োরা ভাবতে বসল, যে করেই হোক বাচ্চাদের মুখে হাসি ফোটাতে হবে।
সবাই বসে ভাবছে এমন সময় একটা শাকচুন্নি এসে জানাল, ছেলেমেয়েগুলো নাকি আরো কিছুদিন নদীর পাড়ে থাকবে। তারা নাকি ওই বেড়াল এবং ছাগলছানাটিকে খুঁজছে। এ কথা শুনে ভূতোর আবার ভিমরি খাওয়ার জোগাড়। বুড়োরা ভাবতে বসল। ভাবতে ভাবতে চিন্তার ভারে অনেকেরই মাথা টুপটাপ করে খসে পড়তে শুরু করল। আবার সেগুলো নিজে থেকেই মুণ্ডুতে গিয়ে জোড়া লেগে যেতে লাগল।
‘ব্যাস পেয়ে গেছি’ নাকি সুরের তিক্ষ চিৎকারে সবার তন্দ্রা ছুটে টুটে খান খান হয়ে গেল। পালের গোদা বুড়ো ভূতটা তার বড় বড় লাল আগুনের গোলার মতো চোখ বের করে চারিদিকে তাকাল। ‘কে চিৎকার করল?’ তার জলদ গম্ভীর কথার ভারে সবাই চুপ মেরে গেল। একটা অল্প বয়েসী পেত্নি ভিড় ঠেলে সামনে এসে দাঁড়াল। ‘আমি স্যার’ বলে তার মুণ্ডুটা খুলে হাতে নিয়ে দাঁড়াল। ‘কি পেয়েছিস বল’। বুড়ো ভূতের নির্দেস পেয়ে পেত্নিটা বলতে শুরু করে। কিভাবে ভয় দেখালে ওরা পালাবে। কথা শুনে বুড়োটা পেত্নির পিঠ চাপড়ে দেয়। চাপড় খেয়ে পেত্নির হাতে থাকা মাথাটা বনের মধ্যে গিয়ে পড়ে। নাকি সুরে কান্না করতে থাকে মাথাটা। সবার মুখে একটু হাসি দেখা দেয়।
পেত্নি কথা মতো সেদিন রাতে বাঁশ বনের সব ভূত এক সঙ্গে যায় নদীর ধারে তাবুর কাছে। গিয়ে দেখে একটা আগুন জ্বেলে গোল হয়ে বসে আছে মানুষগুলো। কারো কারো কানে হেড ফোন লাগানো। আবার কেউ কেউ হাতে থাকা মোবাইল টেপাটিপি করছে। হঠাৎ একটা কাটা মুণ্ডু গিয়ে পড়ে আগুনের মধ্যে। এরপর একটা একটা করে পড়া শুরু হয়। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে মুণ্ডুর বৃষ্টি। কাণ্ড দেখে মানুষগুলো ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। পরদিন ভোর থাকতেই তল্পি তল্পা ফেলে, জান নিয়ে পালাল তারা। যাওয়ার সময় পথে একটা কালো বেড়াল দেখল, খানিক দূর যাওয়ার পর একটা দুধ সাদা ছাগলছানা দেখতে পেলো। ছানাটি বেড়ালের মতো করে ডাকছে, তার মুখে হাসি হাসি ভাব।