ভূতের সন্ধানে একদিন

স্কুলের বার্ষিক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে এই সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রেখেই মঞ্চ থেকে নেমে পড়লেন কমলেশ। আর নেমে পড়া মাত্রই সই শিকারীরা তাঁকে ঘিরে ধরল। সবই স্কুল পড়ুয়ারা। সই নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এটা ওটা কথাও হচ্ছে।

এমন সময় একটি ছোট্ট মেয়ে, খুব বেশী হলে বছর আট নয়েকের হবে, সামনে এগিয়ে এসে বলল, ‘তুমি ভূতের গল্প লেখো না কেন?
কমলেশ হেসে ফেললেন, বললেন, ‘ভূতের গল্প পড়তে তোমার ভালো লাগে? তুমি ভূতে ভয় পাও না?’

‘একটু একটু পাই কিন্তু পড়ি। আমার ভূতের গল্প খুব ভালো লাগে। বলো না তুমি ভূতের গল্প লেখো না কেন?’

‘আমি জানতাম না তো যে তুমি এত ভালোবাস ভূতের গল্প পড়তে তাই বোধহয় লিখি নি।’

‘এবার লিখবে তো?’

‘তুমি এত করে বলছ যখন তখন তো লিখতেই হবে।’

বলে চলে গেলেন বটে কিন্তু কথাটা তাঁকে ভাবিয়ে তুলল। সত্যিই তো কেন তিনি ভূতের গল্প লেখেন না? আর ওই ছোট্ট মেয়েটা সেটা খেয়ালও করেছে!

কমলেশ সেন একজন শিশু সাহিত্যিক। বেশ নামডাক আছে ওনার। কত বছর হয়ে গেল লিখছেন। শুধু ছোটোদের জন্যেই লেখেন। কিন্তু এতদিনে জানলেন যে নানা ধরণের গল্প লিখলেও ভূতের গল্প একটাও লেখেন নি। খুবই আশ্চর্যের! বাড়ি ফিরে এসেও কথাটা মাথায় ঘুরতে লাগল।

পরের দিনই বসলেন লিখতে ভূতের গল্প। কিন্তু লিখতে গিয়ে মনে হল নেহাতই সব মামুলি প্লট মাথায় আসছে। এসব লিখলে চলবে না, বেশ অভিনব গল্প হতে হবে। হাজার হোক তাঁর একটা খ্যাতি আছে। সেই স্ট্যাণ্ডার্ড মতো তো লিখতে হবে। তখনকার মতো লেখা বন্ধ রেখে ক’দিন খালি ভূতের গল্প পড়লেন। না, এরকম ধরণের হলেও চলবে না। একদম নতুনত্ব চাই। পরিচিত জনেদের সঙ্গে ভূত নিয়ে আলোচনা করতে লাগলেন, কারুর কোনো প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আছে কিনা তাও জানতে চাইলেন। কিন্তু সেখানেও নিরাশ হলেন। দেখা গেল ভূতের গল্প শুনতে সবাই ভালোবাসলেও ভূত কেউই দেখে নি। দেখা তো দূরের কথা ভূতের অস্তিত্ব টের পাওয়ার মতো অনুভূতিও কারুর হয় নি।

এসব করতে করতে হঠাৎ মনে পড়ল ওনাদের গ্রামে একটা পুরোনো জমিদার বাড়ি ছিল। লোকে বলত ওখানে ভূত আছে। কবে কোন কালে ওই জমিদার বাড়ির এক অল্প বয়সী বউ বাড়ির পুকুরেই ডুবে আত্মহত্যা করেছিল। তারপর থেকেই তার অতৃপ্ত আত্মা নাকি ওই বাড়িতে ঘুরে বেড়ায়। অনেকে নাকি দেখেছে। ছাদের কার্ণিশে বিপজ্জনক ভাবে দাঁড়িয়ে আছে শাড়ি পরা এক ছায়ামূর্তি, তারপর মুহূর্তেই সেখান থেকে উধাও, চুড়ির রিনরিন আওয়াজ তুলে কে যেন পাশ দিয়ে চলে গেল বা মাঝরাতে পুকুরের জলে ডুবে যাচ্ছে এক মহিলা – এসব ছোটোবেলায় অনেকবার শুনেছেন|

ভাবলেন একবার গ্রামে গিয়ে দেখলে হয় আদৌ আছে কিনা বা থাকলেও তার কি অবস্থা। যেমন ভাবা তেমন কাজ। ব্যাগপত্তর গুছিয়ে একদম রেডি যাওয়ার জন্যে। বেশীদিনের তো ব্যাপার নয়, দুদিনের মধ্যেই ফিরে আসবেন।

কমলেশের স্ত্রী মণিকা তো শুনেই রেগে গেলেন, বললেন, ‘ভূত খুঁজতে যাওয়ার দরকার কি? ভূত তো তোমার মাথাতেই চেপেছে দেখছি। কোন স্কুলের কে এক পুঁচকে মেয়ে কি বলল আর তুমিও তাই নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লে! লিখতে হয় তো লেখো, এতদিন যেমন করে লিখেছ। তা নয় চললে ভূতের খোঁজে। ভূত কি সেলিব্রিটি যে তুমি গেলেই তারা ইন্টারভিউ দিতে রাজি হয়ে যাবে?’

কমলেশ স্ত্রীর কথা শুনে হাসলেন কিন্তু প্ল্যান বদলালেন না। একাই গেলেন গ্রামে। গ্রামে পুরোনো চেনাশোনা দুচারজন এখনো আছে। তাদেরই একজনের বাড়িতে উঠলেন। সেখানে তো শোরগোল পড়ে গেল। বিখ্যাত শিশু সাহিত্যিক কমলেশ সেন এসেছেন। ছোটোরা এসে গল্প শোনার আবদারও করে গেল। এসবের মধ্যে একটু ফাঁক পেয়েই কমলেশ নিজের কাজ শুরু করে দিলেন, জমিদার বাড়ির খোঁজখবর নিলেন। শুনলেন বাড়িটা এখনো আছে, তবে একেবারে জরাজীর্ণ অবস্থা, পুকুরটাও প্রায় বুজে গেছে। বিকেলে কমলেশ বেরোলেন বাড়িটা দেখতে।

‘কি ব্যাপার বলো তো? এত বছর বাদে গ্রামে এলে, এসে থেকেই জমিদার বাড়ির খোঁজ করছ, এখন বলছ দেখতে যাবে, তুমি কি জমিদার বাড়িটার খবর নিতেই এসেছ?’ যার বাড়িতে উঠেছেন সেই ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন।

‘আরে না না, জমিদার বাড়িতে আছে কি দেখতে আসব?’ কমলেশ হেসেই উড়িয়ে দিলেন, ‘আসলে কি জানো, ঘিঞ্জি শহরে থাকতে থাকতে মাঝে মাঝে মনে হয় মাথাটা যেন আর কাজ করছে না। তাই মাঝে মাঝে বেরিয়ে পড়ি। এবার এখানে এলাম। ভাবলাম অনেক বছর হয়ে গেল আসা হয় নি, যাই ঘুরে আসি। তাছাড়া এখনকার ছোটোদেরও গ্রামগঞ্জ সম্পর্কে জানানো দরকার। কত গল্প ছিল বলো তো আমাদের ছোটোবেলায় ওই জমিদার বাড়িটাকে নিয়ে? আমরা তো সব সত্যি বলে বিশ্বাস করতাম। এখনকার ছেলেমেয়েরা তো এসব জানেই না। সাহিত্যিক হিসেবে আমাদেরও তো একটা কর্তব্য আছে, নাকি? তাই ভাবলাম যাই একবার গ্রামে ঘুরে আসি, গ্রাম নিয়ে, জমিদার বাড়ি নিয়ে যদি একটা কিছু দাঁড় করানো যায়।’

‘তুমি আমাদের গ্রাম নিয়ে গল্প লিখবে! বাহ! এ তো খুব ভালো কথা। সব ঠিকঠাক লিখো কিন্তু, গ্রামের কথা, আমাদের ছোটোবেলার কথা। হাজার হোক তুমি এখানকার ছেলে, নিজের গ্রামের জন্যে এইটুকু তো করাই উচিত,’ ভদ্রলোক বেজায় খুশী।

কমলেশ তাড়াতাড়ি ওনার পাল্লা থেকে বেরিয়ে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালেন। কিন্তু জমিদার বাড়িটা গ্রামের এক প্রান্তে। সেই পর্যন্ত যেতে যেতে রাস্তায় আরো অনেকের সঙ্গে দেখা হল। তাদের ‘কেমন আছেন?’ ‘কোথায় যাচ্ছেন?’ থাকবেন তো ক’দিন?’ ইত্যাদি আর নানান প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে যখন জমিদার বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছলেন তখন সূর্য সেদিনকার মতো বিদায় নিয়েছে। অন্ধকার অন্ধকার মতো জায়গাটা। কমলেশের সঙ্গে যদিও টর্চ ছিল। যা দেখলেন তা মোটেই আশাপ্রদ নয়। একেবারেই ভাঙা বাড়ি, জঙ্গলে ভর্তি। রাত কাটানো তো দূরের কথা, সন্ধ্যেবেলা থাকাও নিরাপদ নয়। কিছুক্ষণ ওখানে ঘোরাঘুরি করে আশাহত হয়ে ফিরে এলেন।

বাড়ি ফিরতেই মণিকা বললেন, ‘কি হল, ভূতের দেখা পাওয়া গেল? মুখ দেখে তো মনে হচ্ছে না।’

কমলেশ একটু দমে গেলেও হাল ছাড়েন নি। তিনি স্থির করে নিয়েছিলেন যে বানিয়ে নয়, প্রথম ভূতের গল্প নিজের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকেই লিখবেন। চেনাশোনা কয়েকজনকে বলেওছিলেন যে ভূতুড়ে বাড়ির বদনাম আছে এরকম কোনো বাড়ির কথা জানা থাকলে বা শুনলে তাঁকে বলতে। কিছুদিন বাদে এক প্রতিবেশী এসে তাঁকে জানালেন যে তাঁর মামার বাড়ির পাশের গ্রামে এরকম একটা বাড়ি আছে। এটাও একটা পুরোনো বাড়ি। অনেক লোক নাকি বাজি ধরে ওই বাড়িতে রাত কাটাতে গিয়ে মাঝ রাতেই ভয়ে ফিরে এসেছে, নয়তো সকালে তাদের বাড়ির বাইরে অজ্ঞান অবস্থায় পাওয়া গেছে। শুনে কমলেশ অত্যন্ত উৎসাহিত হয়ে উঠলেন। বলাবাহুল্য মণিকার বারণ না শুনেই রওনা হয়ে গেলেন।

প্রতিবেশী ভদ্রলোকই গ্রামে জানিয়ে রেখেছিলেন, তাই কমলেশের কোনো অসুবিধে হল না। বাড়িটার অবস্থাও অতটা খারাপ নয়। একটা ঘর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে খাটিয়া পাতার ব্যবস্থা করা হল। সন্ধ্যের কিছুক্ষণ পরে কমলেশ হ্যারিকেন, মোমবাতি, দেশলাই, টর্চ আর একটা লাঠি সঙ্গে নিয়ে ভূতুড়ে বাড়িতে রাত কাটানোর জন্যে গেলেন। তাছাড়া মোবাইল ফোন তো সঙ্গে আছেই। একটা লোক গিয়ে খাটিয়ায় ভালো করে বিছানা পেতে, এক কুঁজো জল আর খাবার রেখে দিয়ে গেল।

মুশকিল হচ্ছে সময় আর কাটে না। বসে থাকতে থাকতে একটু তন্দ্রা মতো এসেছিল এমন সময় খটখট কি একটা আওয়াজে সেটা ভেঙে গেল। দেখলেন খোলা জানলা দিয়ে দুজন লোক উঁকি মারছে!

‘কে? কে ওখানে?’ কমলেশ চেঁচিয়ে উঠলেন।

‘ভয় পাবেন না, আমরা ভূত নই। এ গ্রামেরই লোক,’ একটা লোক হ্যারিকেনটা উঁচু করে তুলে ধরে বলল, ‘আপনার মাথায় কি খেয়াল চাপল, এখানে রাত কাটাতে চলে এলেন। ভূত আছে কিনা জানি না কিন্তু খালি বাড়ি বেশী দিন পড়ে থাকলে উলটোপালটা লোকজনের আড্ডা হয়ই। কিছু হলে তো তখন আমাদের গ্রামেরই বদনাম হবে। তাই একবার দেখে গেলাম।’

ওরা চলে গেলে কমলেশ আবার বসে বসে ঢুলতে লাগলেন। মাঝে মাঝে জেগেও থাকেন যদি ভূত আসে এই আশায়। কিন্তু ভূত তো দূরের কথা, একটা কুকুর বেড়াল পর্যন্ত এল না।

সকাল হয়ে গেল। কমলেশ ফিরে গেলেন। ফিরে গিয়েই জ্বরে পড়লেন। রক্ত পরীক্ষায় ম্যালেরিয়া ধরা পড়ল। পোড়ো বাড়িতে রাত কাটানোর ফল।

‘হয়েছে তো শিক্ষা? ভূত দেখতে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ানো? আর যদি ভূতের নামও করেছ,’ মণিকা তো খুব রেগে গেছেন।

মাসখানেক তো লেগে গেল সম্পূর্ণ সুস্থ হতেই। তাও দুর্বলতা তখনো পুরো কাটে নি। বাধ্য হয়ে কমলেশকে ভূতের গল্প লেখার কথা মাথা থেকে তাড়াতে হয়েছে। কি করবেন, প্রথম গল্পটা তিনি যে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ছাড়া লিখবেন না! মাঝে মাঝে ওই ছোট্ট মেয়েটার কথা মনে পড়ে, ‘তুমি ভূতের গল্প লেখো না কেন?’ কি ভাবছে সে?

এর মধ্যে বর্ধমানে এক সাহিত্য সভার আমন্ত্রণ এল। সাহিত্য সভা আর বর্ধমান বলেই বোধহয় মণিকা আর আপত্তি করলেন না। কমলেশ গেলেন। আয়োজকরা স্টেশন থেকেই বেশ খাতির করে নিয়ে গেলেন। তখন দুপুর বারোটা বেজে গেছে, এক বাড়িতে এলাহি মধ্যাহ্ন ভোজনের আয়োজন। তার দুটো বাড়ি পরেই একটা বাড়িতে কমলেশের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। বেশ সুন্দর দোতলা বাড়ি। দোতলায় লোক থাকে, নীচেটা খালি।

‘আপনি অসুস্থ ছিলেন, তাই একটু ফাঁকায় ফাঁকায় আপনার থাকার ব্যবস্থা করেছি,’ বললেন এক ভদ্রলোক, ‘কোনো অসুবিধে হবে না দেখবেন। ওপরে তো এনারা আছেনই। দরকার হলেই ডাকবেন। কবি সত্যপ্রকাশ মল্লিককে চেনেন তো?’

‘ওনার কবিতা পড়েছি। সাক্ষাত হয় নি কখনো, আলাপও না,’ কমলেশ বললেন।

‘উনিও আসছেন। উনি তো আবার গ্রামের মানুষ। শহরের গোলমালে আসতেই চান না। অনেক কাণ্ড করে রাজি করিয়েছি। উনি আপনার পাশের ঘরে থাকবেন। এই কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে পড়বেন। না না আপনার কোনো অসুবিধে হবে না। ওনার ঘরে ঢোকার দরজা ওদিকে। আপনি দরজা বন্ধ করে বিশ্রাম নিন। সন্ধ্যে থেকেই তো আবার কত লোক দেখা করতে আসবে। কোনো দরকার হলেই আমাদের ফোন করবেন। রাতে একটি লোক শোবে এখানে, কোনো অসুবিধে হবে না।’

কমলেশ দরজা বন্ধ করে এসে বিছানায় বসলেন। বেশ পরিপাটি করে বিছানা করা, মশারিও আছে। চেয়ার, টেবিল, জলের জগ – সব ঠিকঠাক রাখা আছে। সব ঝকঝকে তকতকে। না, ব্যবস্থা এরা ভালোই করেছে। কাল সাহিত্য সভা, আজ বিশ্রাম নেওয়াই ভালো। কমলেশ একটা ম্যাগাজিন নিয়ে শুয়ে পড়লেন। একটু পরে পাশের ঘর থেকে গলার আওয়াজ পেলেন। সত্যপ্রকাশ মল্লিক মনে হয় এসে গেছেন। শুয়ে শুয়ে যখন ঘুম আসছে না তখন আলাপ করে এলে হয়। যেমন ভাবা তেমন কাজ। পাজামা তো পরাই ছিল, পাঞ্জাবিটা গায়ে চড়িয়ে আর পায়ে চটিটা গলিয়ে পাশের ঘরের দরজায় ঠকঠক করলেন।

ধুতি পাঞ্জাবি পরা এক বয়স্ক ভদ্রলোক দরজা খুললেন। কমলেশের চেয়ে বয়েসে বড়ো বলেই মনে হল।

‘নমস্কার, আলাপ করতে এলাম। আমি কমলেশ সেন।’

‘নমস্কার নমস্কার। আপনি তো বিখ্যাত লোক। আসুন আসুন। আমি হচ্ছি………’

‘জানি জানি। আপনার কবিতা পড়েছি আমি।’

‘বসুন বসুন।’

‘এই মাত্র এলেন বুঝি? এসে বিরক্ত করলাম না তো?’

‘না না বিরক্ত কিসের? আমরা পাড়াগাঁয়ের লোক। লোকজন এলে বিরক্ত হই না। বসুন বসুন।’

অল্প সময়ের মধ্যেই দুজনের গল্প জমে গেল। কমলেশের তো বেশ ভালো লাগছে। অনেকদিন বাদে এরকম গল্প করছেন। সত্যপ্রকাশ বোধহয় এসেই লিখতে বসেছিলেন। টেবিলের ওপর খাতা খোলা, পেনটাও খাতার ওপর খোলা পড়ে রয়েছে। কমলেশের হঠাৎ মনে হল, ইনি তো গ্রামের মানুষ, এনাকে জিজ্ঞেস করা যাক কোনো ভূতের অভিজ্ঞতা আছে কিনা।

‘ভূত? সে তো আছেই। কিন্তু সবাই কি তাদের দর্শন পায়? পায় না,’ সত্যপ্রকাশ বললেন।

‘আপনার কোনো অভিজ্ঞতা আছে?’

‘সে তো কতবারই কত রকম অনুভূতি হয়েছে। কিন্তু বললে তো কেউ বিশ্বাস করবে না যতক্ষণ না নিজেদের হচ্ছে।’

‘তা যা বলেছেন। আমরা শহুরে মানুষ, আমরা এসব হেসেই উড়িয়ে দিই। কিন্তু জানেন তো আমার ছোটোবেলা গ্রামে কেটেছে। ওখানে একটা ভূতুড়ে বাড়ি ছিল। আমরা অনেক রকম গল্প শুনেছি তার।’

‘গ্রাম শহরের ব্যাপার নয়। আপনার কপালে থাকলে এখানেও দর্শন পাবেন আপনি।’

কমলেশ হেসে উঠলেন, ‘কি বলেন! এই বেলা চারটের সময় এই ঘিঞ্জি শহরে ভূত? ভালো রসিকতা করছেন মশাই!’

‘রসিকতা? আমার কথা রসিকতা মনে হচ্ছে আপনার? সত্যপ্রকাশ যেন রেগে গেলেন, ‘ওই যে বললাম যতক্ষণ না নিজে বোঝে ততক্ষণ বিশ্বাস করে না কেউ। কিন্তু নিজে থেকে দেখতে না পেলে তাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে হয়। খুব ভূতের গল্প লেখার শখ না? তাও আবার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে! লিখুন তো আজ যা দেখলেন।’

সত্যপ্রকাশ টেবিলের একদম সামনেই একটা চেয়ারে বসেছিলেন আর তার একটু দূরে কমলেশ। সত্যপ্রকাশের কথা শেষ হতে না হতেই তিনি উধাও! কোথায় সত্যপ্রকাশ? চেয়ারে তো কেউ বসেই নেই! চেয়ারে কেন, সারা ঘরেই কমলেশ ছাড়া আর কেউ নেই! কিন্তু খাতার পাতায় পেনটা নিজে নিজেই লিখে চলেছে, লিখেই চলেছে! পাতা শেষ হলে পাতা নিজে নিজেই উলটে গেল, পেনও নিজে থেকে লিখে চলল!

আর কে যেন জোরে জোরে হেসে বলতে লাগল, ‘কি লিখবেন তো এবার? লিখতে পারবেন তো?’

কমলেশ কাঁপতে কাঁপতে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন। কোনো মতে নিজেকে দরজা অবধি টেনে নিয়ে গিয়ে দরজাটা খুললেন। খুলেই বারান্দায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন।

যখন জ্ঞান ফিরল দেখলেন বিছানায় শুয়ে আছেন। আশে পাশে অনেক লোক। কোনো রকম চারপাশে চোখ বুলিয়ে বুঝলেন যে এটা তাঁরই ঘর।

‘কি হয়েছিল? হঠাৎ শরীর খারাপ করল নাকি? আমরা তো সত্যপ্রকাশবাবুকে পৌঁছতে এসে দেখি আপনি বারান্দায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন,’ এক ভদ্রলোক বললেন।

কি হয়েছিল মনে করতে গিয়ে আরেকবার শিউরে উঠলেন কমলেশ।

কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, ‘ঘরে ভালো লাগছিল না তাই বাইরে বেরিয়ে ছিলাম। হঠাৎ কি করে যেন মাথাটা ঘুরে……..’

‘কথা বলবেন না, কথা বলবেন না। আপনি বিশ্রাম নিন। আমরা সব বাইরেই আছি।’

এই সময় কমলেশ শুনলেন সামনের বারান্দায় দাঁড়ান একজনের প্রশ্নের উত্তরে আরেকজন বলছেন, ‘ওপরে যাঁদের বাড়ি তাঁরাই থাকেন। নীচে ভাড়া ছিল। এক বয়স্ক ভদ্রলোক আর তাঁর স্ত্রী থাকতেন। ভদ্রলোক লেখালিখি করতেন। ভালোই লিখতেন। হঠাৎ ভদ্রলোক মারা গেলেন। ওনার স্ত্রী ছেলের কাছে পাটনাতে চলে গেছেন। ওখানেই ওনাদের ছেলে চাকরী করে। কয়েকদিনের মধ্যেই আবার ভাড়া এসে যাবে। আপনাদের থাকার ব্যবস্থা করতে দুতিন দিনের জন্যে ওনারা একতলাটা আমাদের দিয়েছেন।’

এতক্ষণে কমলেশ বুঝলেন কার দর্শন পেয়েছিলেন উনি। চোখ বন্ধ করতে করতে ভাবলেন ভূতের গল্পটা এবার ভালোই লেখা যাবে। সেই ছোট্ট মেয়েটার মুখটা আবার মনে পড়ল। গল্পটা নিশ্চয়ই ওর ভালো লাগবে।

দুঃখিত!