ভূতের ছায়া

কয়েক দিন
ধইরা ঘরে খালি ছায়া দেখতাছি মামী ।
একটু আগে চা বানাইতেছি, তহনও
দেখছি। মনে হইল আমার
পিছনে কেডা জানি আইসা খাঁড়াইল।
ডরে আমার শইলের রোম সব
খাঁড়াইয়া গেছে, এই দেহেন মামী।
আমি কইলাম এই বাড়িতে আর কাম করুম
না। রাবেয়া রান্নাঘর থেকে এক
কাপ চা এনে কাপটা ঠক
করে টেবিলের ওপর
রেখে খানিকটা ক্ষিপ্ত হয়ে বলল।
নিগার সকালবেলায়
ডাইনিং টেবিলে বসেছিল। চায়ের
কাপটা টেনে নিতে নিতে ওর কপাল
কুঁচকে যায়।
রাবেয়া চলে গেলে মুশকিল।
পূর্ণিকে একা সামলাতে পারবে না ও।
শফিকুল ব্যবসার কাজে বেশির ভাগ
সময়ই ঢাকা কিংবা চট্টগ্রামেই
থাকে। রাবেয়ার বাড়ি চাঁদপুর;
আঠারো-উনিশের মত বয়েস, বেশ
বিশ্বাসী, হাটবাজার ওই করে,
টাকা-পয়সার হিসাব ঠিকঠাকই দেয়।
তা ছাড়া রান্নার হাতও
ভালো মেয়েটার।

আর সবচে বড়
কথা হল পূর্ণার সঙ্গে রাবেয়ার
চমৎকার অ্যাডজাস্ট হয়েছে। ওর
বাবা মারা যাওয়ার পর থেকেই
মেয়েটা কেমন গুটিয়ে গেছে …
নিগারের দুশ্চিন্তা ঘন
হয়ে উঠতে থাকে। চায়ের স্বাদ
বিস্বাদ ঠেকে। তার কারণ আছে।
শফিকুল আর পূর্ণিও ছায়া দেখে ।
পূর্ণি গতকাল বলল, “আম্মু, আম্মু
আজকে যখন তুমি বাথরুমে গেলে তখন
দেখলাম …” “কি দেখলি?”
“লাফ দিয়ে একটা কী যেন ঢুকল ঘরে।
ছায়ার মতন। সাদা …” “সাদা? তারপর
…” নিগারের বুক ঢিপঢিপ করে। “তারপর
ছায়াটা হাঁটল … জান আম্মু,
ছায়াটা না ঠিক আব্বুর মতন।“
“আব্বুর মতন মানে?
যাঃ!”
“হ্যাঁ। সত্যি। তুমি বাথরুম
থেকে এলে আর ওইটা চলে গেল
জানলা দিয়ে।“
“ওহ্ ।“ শফিকুলও ছায়া দেখে বলল ।
ডায়াবেটিসের ধাত আছে।
ভোরে ছাদে হাঁটাহাঁটি করে। দিন
কয়েক আগে ভোরবেলায়
ছাদে হাঁটছিল । তখন দেখল
সাদা একটা ছায়া নারকেল গাছ
থেকে টুপ করে লাফ
দিয়ে ছাদে নেমে এল।
কথাটা নিগারকে বলতেই নিগার
বলল, বুঝেছি, আপনি আজই চোখের
ডাক্তার দেখান।
বলে কোনওমতে ব্যাপারটা সামাল
দিয়েছে । (দ্বিতীয়
স্বামীকে ‘আপনি’করে সম্বোধন
করে নিগার) কিন্তু, ওই
ছায়াটা কিসের? সে যাই হোক।
ভারি সমস্যায় ফেলে দিল।
রাবেয়া এখন কাজ ছাড়ার
হুমকি দিলে বিপদে পড়তে হবে।
তবে নিগার এও ভাবে যে… এ বাড়ির
সবাই ছায়া দেখছে কিন্তু আমি …
আমি দেখি না কেন?
আজ সকালে সাধন আচার্য্যকে ফোন
করলেন। অনেক দিন পর। নিগার
ডিসপ্লেতে পরিচিত নামটা দেখেই
ভীষণ অবাক হয়েছে । বলল, হ্যালো,
কাকা, আদাপ। আমি তো এখন
কুমিল্লা থাকি। সাধন আচার্য্য
বললেন, আচ্ছা, আচ্ছা।
তা আমি কুমিল্লাতেই আছি মা।
আমি তোমার ওখানে আসছি ।
তুমি আমায় এখন ঠিকানাটা বল। ওহ্ !
আসুন কাকা। বলে ঠাকুরপাড়ার বাড়ির
ঠিকানা বলল নিগার। সাধন আচার্য্য
পেশায় তান্ত্রিক জ্যোতিষ।
নিগারের প্রথম স্বামী হাসানের
পরিচতি। বৃদ্ধ ভালোই তুকতাক
জানেন। বিয়ের পর নিগারের
নাভীতে ভয়ানক ব্যথা শুরু হয়েছিল।
সাধন আচার্য্য সে সময় কী এক
মন্ত্রপূতঃ কবজ দিয়েছিলেন।
কাইতনে বেঁধে বাহুতে পরা মাত্রই
ব্যথা সেরে গিয়েছিল। বৃদ্ধের
যে স্পিরিচুয়াল পাওয়ার আছে,
সে বিষয়ে নিগারের কোনও সন্দেহও।
ছায়ার
ব্যাপারটা ওনাকে খুলে বলতে হবে।
নিগার অনেকটা নিশ্চিন্ত বোধ করে।
বৃদ্ধ গুড়ের চা পছন্দ করেন।
রান্নাঘরে চা বানাতে ঢুকল
নিগার। গুড়ের
চা বানিয়ে ফ্লাক্সে ভরে রাখবে।
ঘরবাড়ি কেমন শুনশান করছিল। শফিকুল
ঢাকায়, ব্যবসার কাজে গিয়েছে,
কবে ফিরবে ঠিক নেই। পূর্ণি স্কুলে।
রাবেয়া ওকে আনতে গেছে। রোজ
অবশ্য নিগারই আনে। আজ শরীরে কেমন
আলস্য ভর করেছিল। কিন্ডারগার্ডেনট
া অবশ্য কাছেই।
তা ছাড়া স্কুলে গেলে ভালোই
লাগে নিগারের। মিসেস
তৌহিদা রহমান, মিসেস
ফাতেমা আখতার, শিপ্রা সেনগুপ্ত –
এরা সবাই পূর্ণির ক্লাসমেটের মা,
এদের
সঙ্গে কথাবার্তা বলে সময়টা বেশ
কেটে যায়। পূর্ণি এবার ক্লাস
টুয়ে উঠল।
সাধন আচার্য্য এলেন সকাল
সাড়ে দশটার দিকে ।
গাট্টাগোট্টা শক্ত সমর্থ শরীর।
পরনে হলদে রঙের খদ্দেরের
পায়জামা আর সাদা রঙের ধুতি। বয়স
ষাটের কাছাকাছি হবে।
চোখে কালো ফ্রেমের পুরু লেন্সের
চশমা । গায়ের রং শ্যামলা। মাথায়
টাক, পিছনের দিকে অবশ্য
খানিকটা পাকা চুল আছে । গলায়
কালো রঙের কাইতনে শিবের নৃত্যরত
ভঙ্গির ছোট একটি ব্রোঞ্জের মূর্তি।
বাঁ হাতের কব্জিতে তামার বালা,
ডান হাতের অনামিকায় লাল
টকটকে একটি প্রবাল। চিরকুমার বৃদ্ধ
থাকেন পাবনার গুরুসদয় আশ্রমে ।
পোশাক-পরিচ্ছদ বেশ ধোপদুরস্ত। বৃদ্ধের
কাছে নিগারের মোবাইল নম্বর
আছে। মাঝে-মাঝে ফোন করে খোঁজ
খবর নেন। আজই অনেকদিন পর ফোন
করলেন। বেঁচে থাকতে হাসান একবার
বলেছিল … এ দেশে যারা তান্ত্রিক
জ্যোতিষবিদ্যা চর্চা করে সাধন
আচার্য্য তাদের গুরু। আগে নাকি গুরু
ছিলেন লালমাই পাহাড়ের নারায়ণ
শিবশাস্ত্রী। ইনিই সাধন আচার্য্যর গুরু।
তাঁর
মহামন্ত্রপূতঃ তুলসী নাকি মহা রক্ষাকবজ।
এমন কী মৃতের জীবনও দান
করতে পারে- নারায়ণ শিবশাস্ত্রীর
ভক্তদের মধ্যে এমন বিশ্বাস
নাকি প্রচলিত ছিল।
সাধন আচার্য্য
কে ড্রয়িংরুমে বসিয়ে চা দিয়েছে নিগার।
গুড়ের চা দেখে উৎফুল্ল বৃদ্ধ। চায়ে চুমুক
দিয়ে বৃদ্ধ বললেন, মা, অনেক দিন হল
তোমাকে দেখি না, তাই ভাবলাম
এদিকে যখন এসেছি মায়ের
সঙ্গে একবার দেখা করেই যাই।
কুমিল্লায় কোথায় এসেছিলেন
কাকা? চায়ে চুমুক দিয়ে সাধন
আচার্য্য বললেন, লালমাই
পাহাড়ে মা। সদাশিব মোহান্ত
নামে এক তান্ত্রিক সন্ন্যাসীর
কাছে। বিচিত্র ধরণের
একটি নাগিনী সাপের নীলাভ
নাগমনি নাকি তিনি সংগ্রহ
করেছেন, তাই আমাকে একবার
দেখাতে চাইলেন। দেখলেন?
হ্যাঁ। বড় আশ্চর্য জিনিস। নীল রঙের।
পুরাণে নাগমনির কথা পড়েছি এটির
কথা। কিন্তু বাস্তবে যে আছে তাই
জানতাম না। সে যাক। আজকাল
আমি আবার ঘন ঘন হাসানকে স্বপ্ন
দেখছি। আহ্, ছেলেটি আমাদের
ছেড়ে অকালে চলে গেল। মহেশ্বর
কার
কপালে যে কী লিখে রেখেছেন।
ছোট থাকতে প্রখর স্মরণশক্তির
অধিকারী ছিল হাসান। জান তো,
আমাদের বাড়ি একই পাড়ায় ছিল।
জানি কাকা। আঁচলে চোখ
মুছে নিগার বলল। এই মুহূর্তে বৃদ্ধ
জ্যোতিষীর মুখটা কেমন যেন
ঝাপসা দেখাচ্ছে। আমিই
ওকে এসরাজে হাতেখড়ি দিয়েছি …
ও যখন রাগ পটদীপ বাজাত …আহ! নিগার
চুপ করে বসে থাকে। হাসানের
প্রসঙ্গে চোখে জল আসে। হাসানের
বাবার যখন যশোরে পোস্টিং ছিল,
সে সময় সাধন আচার্য্য হাসানদের
প্রতিবেশি ছিলেন। হাসানকে খুব
স্নেহ করতেন বৃদ্ধ।

হাসানের
বাবা যশোর
থেকে বদলী হয়ে গেলেও বৃদ্ধ সর্ম্পক
রেখেছেন। বৃদ্ধ অনেকবারই
এসেছিলেন ফকিরহাটের বাড়িতে ।
তবে একটা কথা মা। সাধন আচার্য্য
বললেন। জ্বী কাকা, বলুন । হাসান …
হাসান ঠিক মারা যায়নি মা।
নিগার চমকে ওঠে। অস্ফুট স্বরে বলল,
কি …কি আপনি কি বলছেন কাকা!
হাসান মারা যায়নি মানে? উত্তর
না দিয়ে সাধন আচার্য্য
চায়ে কাপে চুমুক দিলেন। তারপর
কাপটা টেবিলের ওপর
নামিয়ে রাখলেন। ফ্লাক্স
থেকে গুড়ের চা ঢেলে নিচ্ছেন।
জানালা দিয়ে রোদ ঢুকেছে ঘরে।
বৃদ্ধের মুখোমুখি একটি সোফায়
সিদে হয়ে বসে থাকা নিগার
কাঁপছিল। বৃদ্ধের দিকে অপলক
চোখে চেয়ে আছে। কখন যে বলে উঠল,
কি বলছেন কাকা হাসান
মারা যায়নি? নিগারের কন্ঠস্বর
কেমন দূর্বল শোনায়। হাসানের মরদেহ
পাওয়া গেছে? বৃদ্ধ পালটা প্রশ্ন
করলেন। নিগারের চোখে চোখ
রেখে তাকিয়ে আছেন। না কাকা।
তাহলে?
নিগারের শরীরের শীতল স্রোত
ছড়িয়ে পড়ে। পলক
না ফেলে বৃদ্ধকে দেখছে। বৃদ্ধ ঠিকই
বলেছেন। অ্যাক্সিডেন্টের পর
হাসানের ডেডবডি পাওয়া যায়নি।
হাসান ছিল উপ-
সহকারী কৃষি কর্মকর্তা। ফকিরহাট
উপজেলায় পোস্টিং।
সুভাড্যা থেকে রামপাল যাবার
পথে অ্যাক্সিডেন্টটা হয়। কালভার্ট
ভেঙে বাস খালের মধ্যে পড়ে যায়।
না, হাসানের লাশ পাওয়া যায়নি।
হাসানের সহকর্মী শহীদুল আলম
হাসানের সঙ্গেই একই বাসে ছিলেন।
সেটি তিনি কনফার্ম করেছেন।
শহীদুল আলমও দূর্ঘটনায় গুরুতর আহত
হয়েছিলেন। তাহলে? নিগারের
কপালে ঘাম ফুটে উঠছিল।নিঃশ্বাস
দ্রুতগামী হয়ে উঠেছে। হাসান …
হাসানকে ও ভুলতে পারেনি। সুন্দর
একটা মন ছিল ওর। ওর এসরাজটা এখনও
যত্ন করে রেখে দিয়েছে। হাসান
মেয়েটাকে প্রচন্ড ভালোবাসত।
হাসান যখন মারা গেল সে সময় পূর্ণির
বয়স পাঁচ। কীভাবে যে নিগার
একা সামলেছে সেই কঠিন শূন্যতায়
ভরা দিনগুলি।
নিগারের বাবা ফকিরহাট
এসে মেয়েকে নরসিংদী নিয়ে গেলেন।
ভদ্রলোক চট্টগ্রাম
রেলওয়েতে চাকরি করলেও
নরসিংদীতে জমি কিনে টিনশেডের
বাড়ি করেছিলেন। তিনিও এক বছরের
মাথায় মারা গেলেন। স্ট্রোক
করেছিলেন। হয়তো মেয়ের নিস্করুণ
বৈধব্যে রূপ দেখেই … নিগারের অথই
সমুদ্রে ভাসছিল। মাথার ওপর
অবিভাবক না থাকলে যা হয় …
অনেকটা আকস্মিৎ ভাবেই নিগারের
বড় চাচা কুমিল্লার এক বিপত্নিক
ব্যবসায়ীর সঙ্গে নিগারের
বিয়ে ঠিক করেন। দ্বিতীয়
স্বামী শফিকুল ইসলাম ভালো মানুষ।
(তবে ভীষণ কাজপাগল … সংসারে মন
নেই, এ কারণেই হয়তো হাসানের
এসরাজ নিয়ে কোনও প্রশ্ন করেন নি)
কুমিল্লা শহরে কান্দিরপাড়ে প্রেস
আছে। ঠাকুরপাড়ায় চারতলা বাড়ি।
মাস গেলে প্রায় অর্ধ লক্ষ
টাকা ভাড়ার টাকা নিগারের
হাতেই জমা হয় ।
ভিতরে ভিতরে হাসানের জন্য মন
পুড়লেও দ্বিতীয় স্বামীর
সংসারে নিগারের অন্তত সুখ-
স্বাচ্ছন্দ্য আছে। এখন বৃদ্ধ তান্ত্রিক
জ্যোতিষী এসে কী কথা শোনালেন?
সাধন আচার্য্য বললেন, আমি তোমার
কাছে একটা জরুরি কথা বলতে এসেছি মা।
বলেন কাকা। বলে আঁচল
দিয়ে কপালের ঘাম মুছে নিল
নিগার। বুকটা ঢিপঢিক করছে।
ভোরে ছাদে হাঁটাহাঁটি করার সময়
শফিকুলও ছায়া দেখেছে ।
ছায়াটা নারকেল গাছ থেকে টুপ
করে লাফ দিয়েছিল। আসলে কি ছিল
ওটা? এক তীব্র কৌতূহল আচ্ছন্ন
করে নিগারকে। সাধন আচার্য্য
পাঞ্জাবির পকেট থেকে ছোট
একটি নকশাদার রুপোর ঢিবে বের
করলেন। তারপর সেটি খুলে এক টিপ
খইনি বার করে মুখে ফেললেন ।
বাতাসে শুকনো তামাকের গন্ধ ছড়ায়।
খইনি চিবুতে চিবুতে বৃদ্ধ বললেন,
তুমি কি ঘরে ছায়া দেখ মা?
ছায়া? হ্যাঁ, ছায়া। ধূসর ছায়া।
নিগারের শরীর কাঁপছে। না কাকা,
ছায়া আমি দেখি না। তবে আমার
স্বামী, কাজের ঝি আর আমার
মেয়ে দেখে। এ নিয়ে আমি ক’দিন
ধরে ভীষণ টেনশনে আছি কাকা। হুমম।
আমি কিন্তু ছায়া দেখি না কাকা।
তোমাকে একটা মন্ত্রপূতঃ কবজ
দিয়েছিলাম না মা?
হ্যাঁ, কাকা।
ওটা কি তুমি এখনও বাহুতে ধারণ কর?
হ্যাঁ, কাকা। এই যে।
বলে ক্লালো রঙের ব্লাউজের
হাতা সামান্য তুলে কালো কাইতন
দেখাল নিগার।
সাধন আচার্য্য মাথা নেড়ে বললেন,
বুঝতে পেরেছি। ওই জন্যেই …
কিন্তু, কিন্তু, ছায়ার
কথা আপনি জানলেন
কী ভাবে কাকা?
শোন মা, আমি দীর্ঘদিন যাবৎ জগতের
আদি-রহস্যের সন্ধানে ব্রতী হয়েছি।
তারা মায়ের আরাধনা করছি। শিবত্ম
অর্জনের জন্য যোগসাধনা করছি। ভূ-
ভারতে কত তান্ত্রিক- কাপালিকের
সঙ্গে গূহ্য শাস্ত্র আলোচনা করেছি।
তন্ত্রসাধনা করলে এসব জানা কঠিন
কিছু বিষয় নয় মা। তন্ত্র
আসলে বিজ্ঞান। অপরা বিজ্ঞান।
ওটা ওটা কিসের ছায়া কাকা?
হাসানের ছায়া মা।
হাসানের মানে??? নিগারের
মাথা টলে উঠল। হাসান এখনও
ছায়া হয়ে পৃথিবীতে বেঁচে আছে।
নিগারের শ্বাস
আটকে যায় প্রায় । ও অস্ফুটস্বরে বলল,
হাসান ছায়া হয়ে আছে মানে?
আপনি কী বলছেন কাকা?
সাধন আচার্য্য
খইনি চিবুতে ভুলে গেছেন যেন। চোখ
বুজে ধ্যানস্থ হয়ে আছেন।
জানালা দিয়ে রোদ
পড়েছে চৌকো মুখের ওপর। মসৃণ টাক
চকচকে দেখায়। কপালের
বাঁ পাশেকালো রঙের জন্মদাগ।
মাঝখানে একটি আঁচিল। হঠাৎ চোখ
খুলে বৃদ্ধ বললেন, হ্যাঁ, মা। বাস
দূর্ঘটনায় আঘাত ওর মৃত্যুর জন্য যথেষ্ট ছিল
না। আবার আগের মতন বেঁচে থাকাও
সম্ভব ছিল না। তান্ত্রিক গূহ্যশাস্ত্র
অনুযায়ী এমন অবস্থায় মানুষ যথার্থ
লোকে যেতে পারে না,কায়া তখন
ছায়ায় রুপান্তরিত হয়। হাসান এখন
ছায়া হয়ে রয়েছে। এই ছায়াজীবন খুব
কঠিন মা। খুব
যন্ত্রণা পাচ্ছে ছেলেটা।
বলতে বলতে বৃদ্ধের মুখ কুঁকড়ে গেল ।
কপালে ভাঁজ পড়ল। বৃদ্ধ
হাসানকে ভীষণ ভালোবাসতেন। ওই
দেখ। সাধন আচার্য্য হাত তুলে বললেন।
নিগার চট করে ডান
পাশে ফিরে তাকায়। পর্দার
ওপাশে কী যেন সরে যায় । দ্রুত।
কালো মতন। নিগারের শরীর ঝনঝন
করে বেজে ওঠে।
কী ওটা?
বৃদ্ধ কিছু বলার আগেই
টুং টাং ডোরবেল বাজল। নিগার
চমকে ওঠে। তারপর
উঠে দাঁড়িয়ে কেমন ঘোরের
মধ্যে দরজার কাছে চলে আসে। বুক
ভীষণ ধড়ফর করছে। দরজা খুলে দেখল
রাবেয়া, হাতে স্কুলের ব্যাগ আর
পানির বোতল। কিন্তু, পূর্ণি কই?
নিগারে বুক ধক করে উঠল। মুখ
থেকে ছিটকে বেরিয়ে এল, কি রে!
পূর্ণি কই? রাবেয়া হাসে। ঠিক তখনই
পিছনে পূর্ণি বেরিয়ে আসে, স্কুল
ড্রেস পরা, হাসছে।
রোদে ঘেমে গেছে। ছোট ফর্সা মুখ
লাল হয়ে আছে। অন্য সময়
হলে মেয়েকে কিছুক্ষণ
জড়িয়ে ধরে রাখে। আজ আর আদর
করতে ইচ্ছে করছিল না। নিগার বলল,
যাও মা, এখন গোছল করে নাও।
পূর্ণি একবার সাধন আচার্য্যর
দিকে তাকিয়ে চলে যায়। মনে হল
না বৃদ্ধকে দেখে খুশি হয়েছে। বৃদ্ধও
যেন পূর্ণি কে দেখে চমকে উঠলেন।
নিগারের একবার মনে হল
যে পূর্ণিকে বলে, সালাম দাও।
তোমার মনে নেই? দাদু।
কী মনে করে সামলে নিল। তার
বদলে রাবেয়া কে বলল, পূর্ণির গোছল
শেষ হলে ওকে ফ্রিজ থেকে স্যুপ বের
করে গরম করে খেতে দিবি। আইচ্ছা।
বলে রাবেয়া চলে যাবে। নিগার
আবার বলল, শোন, এখন ডিপ
থেকে রুইমাছ করে ভিজিয়ে রাখ।
দুপুরে মেহমান খাবে ।
রাবেয়া চলে যায়। নিগার সোফায়
এসে বসল।

ওর
মোবাইলটা পাশে পড়ে আছে,
সোফারওপর। পরিচিত নকিয়ার
রিং টোন বেজে উঠল। নিগার
মোবাইল তুলে নিয়ে বলল, হ্যালো।
কার সঙ্গে যেন ক্ষাণিক ক্ষণ কথা বলল।
ওর মুখের ভাব কেমন
বদলে যেতে থাকে। একটুপর ফোন অফ
করে সাধন আচার্য্যর
দিকে তাকিয়ে চাপা স্বরে নিগার
বলল, ফোন করেছিলেন হাসানের
সহকর্মী শহীদুল আলম । ইনি উপ-
সহকারী কৃষি কর্মকর্তা। ফকির
হাটে আমরা পাশাপাশি ছিলাম।
এখন অবশ্য ভদ্রলোকের
পোস্টিং মনিরামপুর উপজেলায়।
আচ্ছা। শহীদুল
আলম অ্যাক্সিডেন্টের সময় হাসানের
সঙ্গে একই বাসে ছিলেন।
আচ্ছা। তা কি বলল সে?
বললেন যে, কিছুদিন
ধরে তিনি নাকি ছায়া দেখছেন।
ছায়াটা কখনও মানুষের আকৃতি নেয়।
তখন অনেকটা হাসানের
মতো দেখায়। ওহ্ ।
তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন
ছায়া আমিও দেখি কিনা।
তা কি বললে তুমি? আমি বললাম
না আমি ছায়াটায়া দেখিনা।
খামাখা ওনাকে আতঙ্কগ্রস্থ করার
কী লাভ বলেন?
তুমি ঠিকই বলেছ মা।
কিন্তু … কিন্তু এখন কী করব
আমি কাকা?
ভাবছি।
নিগারের মোবাইল ফোন বাজল।
মিসেস ফাতেমা আখতার। পূর্ণার
ক্লাসমেট ফারিয়ার মা। রানির
বাজার এলাকায় থাকে। ভদ্রমহিলার
স্বামী সেলিম আখতার
কুমিল্লা শহরের একজন প্রথম সারির
ব্যবসায়ী। জ্বী আপা, বলেন।
নিগারের গলা কাঁপছিল। আপা, আজ
তো ফারিয়ার জন্মদিন। আপনার
মেয়েকে আমি আমার বাসায়
নিয়ে এসেছি। দুপুরে খাইয়ে আমার
গাড়ি দিয়ে পাঠিয়ে দেব। আপনার
মেইডকে আমি বিদায় করে দিয়েছি।
ও আপনাকে বলেনি। আপনি ফোন
করলেন না বলে আমিই ফোন করলাম।
আপা প্লিজ ওকে আবার
আপনি বকাঝকা করবেন না যেন … ওহ্
নো। নিগারের হাত থেকে মোবাইল
পড়ে যায় মেঝের কার্পেটের ওপর।
কী হল মা? সাধন আচার্য্য
ঝুঁকে পড়লেন। পূর্ণি আমার মেয়ে …ও …
ও…অন্য কেউ … ও আমার মেয়ে না …
নিগারের কন্ঠস্বর ফুটছিল না।
হ্যাঁ, সেটা তখনই বুঝেছি।
বলে দ্রুত পায়ে দরজার
কাছে চলে এলন সাধন আচার্য্য। পিছন
পিছন নিগার। ওর
দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে।
মাথা কেমন টলছে। খাওয়ার ঘরে কেউ
নেই। ওরা রান্নাঘরে দিকে যায়।
রাবেয়া চুলার সামনে। চুলায়
একটা সসপ্যান । সুপ গরম করছে মনে হল।
পূর্ণি কই? নিগারের কন্ঠস্বর কেমন
খসখসে শোনালো। গোছলখানায়
মামী।
রাবেয়া ফিরে তাকিয়ে বলল।
নিগারের মুখ দেখে কিছুটা হতভম্ব
হয়ে গেল। নিগার প্রায়
দৌড়ে বেডরুমে চলে আসে।
পিছনে সাধন আচার্য্য। এদিক ওদিক
তাকাচ্ছেন। বিড়বিড় করে কী যেন
জপছেন।

কেটে হাত
দিয়ে রক্ষাকবচটি দেখে নিলেন।
নিগারের আঁচল খসে পড়েছে।
সে দিকে ভ্রুক্ষেপ নেই।
বেডরুমে কেউ নেই। বাথরুমের
দরজা বন্ধ। তবে ভিতর পানির
কিংবা সাড়াশব্দ
শোনা যাচ্ছে না। নিগার দরজার
কাছে গিয়ে বলে, অ্যাই পূর্ণা, পূর্ণা।
কি করছ তুমি?
ভিতর থেকে একটি পুরুষ কন্ঠ বলল,
আমি গোছল করি।
নিগার সাধন
আচার্য্যরে দিকে তাকালো।
ফিসফিস করে বলল, হাসানের গলা।
বৃদ্ধ মাথা নাড়লেন। বললেন,
তাকে জিগ্যেস করো তো,
সে কি চায়?
হাসান কি চাও তুমি? নিগারের
গলা কাঁপছিল।
আমি ফিরে যেতে চাই …
কোথায়?
মৃত্যুর পরে মানুষ যেখানে যায়।
সেখানে যাও না কেন?
যেতে পারছি না যে!
কেন যেতে পারছ না?
আমি যে বেঁচে আছি।
আমি যে মরিনি।
নিগার সাধন আচার্য্যর
দিকে তাকালো। ওর
চোখে মুখে অসহায় ভাব। সাধান
আচার্য্য পাঞ্জাবির পকেট
থেকে কী একটা বের করলেন। তারপর
উবু হয়ে বসে জিনিসটা বাথরুমের
দরজার ফাঁক দিয়ে ঢুকিয়ে দিলেন।
তখনই ভিতর থেকে ভয়ঙ্কর চিৎকার
শোনা গেল। যেন এক হিংস্র শ্বাপদ
ভয়ানক আক্রোশে ক্রদ্ধ গর্জন করছে।
যে সব ভেঙেচুরে ফেলবে সে।
নিগার থরথর করে কাঁপছিল। চিৎকার
শুনে রাবেয়া রান্নাঘর
থেকে ছুটে এসেছে। এই
মুহূর্তে নিগারকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে।
সাধন আচার্য্য বিড়বিড় করে মন্ত্র
জপছেন। একটু পর ক্রদ্ধ গর্জন থেমে গেল।
নিগারকে ভয়ানক
ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। ও
ফ্যাঁসফ্যাঁসে স্বরে জিগ্যেস করল,
ওটা … ওটা কি ছিল কাকা? তখন
দরজার তলা দিয়ে কী দিলেন?
সাধন আচার্য্য মৃদু হেসে বললেন,
মহামন্ত্রপূতঃ তুলসী মা। আজ
থেকে চল্লিশ বছর আগে আমার গুরু
স্বর্গীয় নারায়ণ
শিবশাস্ত্রী দিয়েছিলেন ।
বলে দু’হাত জড়ো করে কাকে যেন
প্রণাম করলেন। তারপর বললেন,
মহামন্ত্রপূতঃ তুলসী এক মহা রক্ষাকবজ
মা। বলে বাথরুমের দরজায় কাঁধ
দিয়ে জোরে ধাক্কা দিলেন সাধন
আচার্য্য। বৃদ্ধ হলেও প্রত্যহ
যোগসাধনা করেন বলে শক্ত সমর্থ মানুষ
। দরজার ছিটকিনি খুলে যায়।
ভিতরে কেউ নেই।
অমাঃ। মামী! পূর্ণায় গেল কই?
রাবেয়া আর্তচিৎকার করে ওঠে।
লাল প্লাস্টিকের বড়
বালতিটা ওলটানো। মেঝের ওপর
পানি। মগটাও মেঝেতে পরে আছে।
ওপাশের দেয়ালে গভীর ফাটল,
ওপরের ছোট জানালার কাঁচ ভাঙা। হু
হু করে রোদ ঢুকেছে। তোমার মেয়ের
একবার খোঁজ নাও তো মা।
স্নিগ্ধকন্ঠে সাধন আচার্য্য বললেন। বৃদ্ধ
ঘেমে গেছেন। পকেট থেকে রুমাল
বের করে কপালের ঘাম মুছে নিলেন।
মোবাইলটা ড্রইংরুমের মেঝের ওপর
পড়ে ছিল। নিগার
দৌড়ে ড্রইংরুমে আসে। তারপর
মিসেস ফাতেমা আখতারকে ফোন
করে ।
হ্যালো, আপা, পূর্ণির
কি খাওয়া হয়ে গেছে?
হ্যাঁ হ্যাঁ। ও এখনি রওনা দেবে। আপনার
মেয়ে তো কিছুই খেল না আপা। এত
কষ্ট করে কাশ্মীরী পোলাও আর
টমেটো চিকেন করলাম, আপনার
মেয়ে ছুঁয়েও দেখল না, ডিমের
মিহিদানাও না, আমার শ্বশুরবাড়ির
রসভরি পিঠাও না । যা একটু ওই
আপেলের সালাদ খেল …

দুঃখিত!