ভূতের গাছ..

আমাদের গ্রামের পাশদিয়ে একটি কাঁচা সড়ক সরাসরি যুক্ত ছিল ফরিদপুর থানার সাথে। সড়কটা ছিল ৩টি গ্রামের কৃষকদের কৃষি জমির মাঝ বরাবর। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের কোন একসময় পাকিস্তানী সৈনিকদের একটি ছোটবাহিনী সেই রাস্তা দিয়ে গ্রামে প্রবেশ করার চেষ্টা চালিয়ে ছিল।কিন্তুআমাদেরগ্রামের সাথে রাস্তাটির সংযোগ সড়কেরএকটা অংশকাটা থাকায় তারা গ্রামে প্রবেশকরতে ব্যর্থ হয়। তারা সড়ক বরাবর থানারদিকে এগিয়ে যায় এবং স্বল্প সময়েও তাদেরহত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যায়। মৃতের সঠিকসংখ্যা কেউ বলতে পারে নি। কারনপাকিস্তানী সৈন্যরাহত্যা শেষে লাশগুলো রপাশে একটা গভীর কুয়ারমধ্যে ফেলে দিয়ে যায়। কুয়োটা ছিলএকটা হিজল গাছের পাশে। সেই হিজল গাছেরআশেপাশের ২/৩ মাইল শুধুই কৃষি জমি। কোনবাড়ি ঘর নেই। সেই কুয়োর কোন নিশানা আজপাওয়া না গেলেও হিজল গাছটা ঠিকইসাক্ষী হয়ে আছে সেইনৃশংস হত্যাযজ্ঞের।এইহিজল গাছ আর কুয়ো নিয়ে অনেক গল্প চালুরয়েছে গ্রামে। রাতের বেলা অনেকেইনাকি এই গাছের পাশ দিয়ে যাবার সময়“পানি, পানি” বলে আর্তনাদ করতে শুনেছে।আজও নাকি হিজল গাছের পাশ দিয়ে আসারসময় মানুষ পথ হাড়িয়ে ফেলে। হিজল গাছথেকে গ্রামের দুরত্ব আধা মাইলের মত।
ফরিদপুর থেকে রাতের বেলা বাড়ি ফেরারসময় আশরীর কণ্ঠ শুনেছে এমন অনেক মানুষেরদেখা পাওয়া যায় গ্রামে। এমনকি রাতেরবেলা গ্রামেফিরতে গিয়ে আধা মাইল পথসারা রাতেও পার হতে পারে নি, এমনমানুষও কম নেই গ্রামে।বেতুয়ান গ্রামের পাশের গ্রাম রামনগর।রামনগর গ্রামের আক্কাস নামের এক লোকতার ছাগল হারিয়ে ফেলেছে। সারা দুপুরছাগল খোজা-খুজির পরবিকেলে সে জানতে পারল তার ছাগলবেতুয়ানের সীমান্তে ঢুকে একজন কৃষকেরসবজিরক্ষেত নষ্ট করছিল, তাই বেতুয়ানেরচকপহরি (গ্রামে জমি পাহারা দেওয়ার জন্যনিয়জিত প্রতিরক্ষাবাহিনী) তার ছাগলধরে নিয় গেছে।ঘটনা শুনে রাগে ক্ষোভে কোন কিছু না ভেবেইবেচারা রওনা দিল বেতুয়ানের দিকে। তখনমাগরিবের আযান হয়ে গেছে।রাগের মাথায় রওনা দিলেও একসময় আক্কাসমিয়ার হঠাৎ করেই মনে পরে গেল হিজলগাছের কথা। আরে সামনেই তো হিজল গাছ! ঐ-তো দেখা যাচ্ছে।
সাথে সাথে তার সমস্তশরীরে কাঁটা দিয়ে উঠল। আক্কাস মিয়া আরসামনের দিকে অগ্রসর হল না। কারণ ছাগলেরচাইতে জীবন অনেক বড়। ছাগল তো কালকেওআনা যাবে। কিন্তু জীবন…ভয়ে তিনি বাড়ি ফিরে যাবার জন্য যেইপা বাড়াবেন ঠিক তখনি তার মনে হল কেউএকজন তাকে ডাকছে।-ভাই কি বেতুয়ান যাবেন?আক্কাস মিয়া চমকে উঠে জোর গলায় বলল,-কেডা আপনে?-ভাই আমি মোক্তার। আমার বাড়ি বেতুয়ানেরশেষ মাতায়। ঐ ইজল গাছের থেনে মাইলখানিক ফাঁকে। আপ্নের বাড়ি কোনে?-আর কয়েন্না বাই। আমার বাড়ি রামনগর।আপ্নেগরে গাওয়ের চকপোউরি আমারবরহি(ছাগল)খান দোইরা লিয়্যা গ্যাছে।সেই বরহি আইনব্যারি যাচ্ছিলাম তিন্তুকআজকা আর যাব লয়। রাইতম্যালা হয়্যা গেছে।-ঐ চিনত্যাতেই তো ভাই একা জাসসিন্যা।গেছিল্যাম আপ্নেগরেগাওয়েরহাঁটে।ফিরতি ফিরতি বেলাগরা আইলো। এহনএকা যাতি ক্যাবা জানি লাগতেছে।তারচে চলেন ভাই আমারবাড়িত যাই। রাইতখান থাইকা কাইলকা বরহি(ছাগল)লিয়্যা বাড়ি জায়েন্নে।আক্কাস মিয়া দেখল প্রস্তাবটা খারাপ না।তাছাড়া আকাশে মেঘও করেছে। এই অবস্থায়বাড়ি ফিরে যাওয়া ওঝামেলা। তাই সে আরকথা না বাড়িয়ে লোকটার সাথে রওনা দিলো।দুজনে গল্প করতে করতে এক সময় হিজল গাছেরপ্রায় কাছে চলে এলো।
এমন সময় হঠাৎ করেইমোক্তার নামের লোকটা কাঁদারমধ্যে পরে গেল। সাথেসাথে আক্কাসমোক্তারকেহাত ধরে তুলতে গিয়ে চমকে উঠল।একি, এই লোকটার হাত এতো ঠাণ্ডা কেন?মানুষের শরীর কি এতোঠাণ্ডা হয়?মোক্তার আস্তে করে উঠে দাঁড়িয়েবলল,-দুরা। সারা গায় ক্যাদো লাইগা গেল। চলেনভাই সামনের কুয়োত যাই। হাত মুকধুইয়া আসি।কথাটা বলেই মোক্তার আক্কাসের উত্তরেরঅপেক্ষা না করেই কুয়োর দিকে পা বাড়াল।আক্কাসের শরীরে ভয়ের শীতল স্রোতবয়ে গেল। কুয়োটা অনেক দিন আগে থেকেইপরিত্যক্ত।সেখানে পানি আসবে কোথা থেকে? হঠাৎআকাশে বিদ্যুৎ চমকে উঠল। বিদ্যুতেরআলোতে আক্কাস স্পষ্ট দেখতে পেল,মোক্তারের পা নেই।সারা শরীর কেমনজানি একটা ঝাঁকি দিয়ে উঠল আক্কাসের।তাহলে মোক্তার মানুষ না! আবারএতো রাতে তাকে কুয়োর দিকে নিয়ে যাচ্ছে;তার মানে কি সে আইষ্ঠাখোর ভূত!আক্কাস আর এক মুহূর্তও দেরি করল না।সোজা মাটির উপর চোখ বুজে টানটানহয়ে শুয়ে পড়ল।
(গ্রামে কথিত আছে, ভূতবা খারাপ আত্মা মাটিস্পর্শ করতে পারেনা।তাদের ক্ষমতা মাটির একহাত উপরে)কিছুক্ষণ পর আক্কাস শুনতে পেলো কেউ একজনন্যাকা সুরে আক্কাসকে উদ্দেশ্য করে বলছে,“কুত্তার বাচ্চা বাইছা গেলু। মাটির উপরনা শুলি আজক্যা তোক কুয়োরমদ্দি গাইরা থুল্যামনে।”ঠিক এভাবেই পরের দিনসকাল পর্যন্তমাটির উপর শুয়েছিল আক্কাস মিয়াঁ।হয়তো আজও রাতের বেলা কোন মানুষ সেইআধা মাইল পথ পার হতে পারেনি।।

ষ্টেশনের ভূত !!

একটি সত্য ভূতের ঘটনা..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *