ভূতপল্লী

বাস থেকে যখন ফুলতলী স্টেশনে নামলাম তখন রাত ১০টা। পথে দুবার বাসের ইঞ্জিনে ত্রুটি দেখা দেয়ায় এতটা দেরি হয়েছে, না হয় আরো আগেই পৌঁছানো যেত। বাজারের ওদিকটায় একটা রিক্সা দেখে এগিয়ে গেলাম। এত রাতে রিক্সা যায় কিনা এটাই ভাববার বিষয়। রিক্সা না গেলে পুরো ৪০মিনিট ধরে হেঁটে বাড়ি পৌছতে হবে। চালক রিক্সার হুড উঠিয়ে দিয়ে তার মধ্যে বসে বিড়ি ফুঁকছে। গায়ে একটি মোটা চাদর জড়ানো। ঢাকাতে শীত খুব একটা অনুভব না করলেও এখানে এসে শীতের আমেজটা বেশ জোরেশোরেই গায়ে লাগছে। রিকশাচালক একবার আমাকে দেখে আবার মুখ ফিরিয়ে নিল; ভাব দেখে মনে হচ্ছে এই শীতের মধ্যে এক পা নড়ারও ইচ্ছা তার নেই। তারপরও কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম। যা ভেবেছিলাম তাই, এত রাতে হিজলতলী গাঁয়ে যেতে সে রাজী হল না। লোকটাকে দ্বিতীয়বার বলার ইচ্ছা হল না। আশেপাশে তাকিয়ে আর কোন রিক্সা দেখতে না পেয়ে হেঁটেই হিজলতলীর পথ ধরলাম। চাঁদ না থাকলেও আকাশটা বেশ পরিষ্কার, তাই পথ চলতে খুব একটা কষ্ট হবে না।
রাত ১০টা হিজলতলীর জন্য গভীর রাত। কেউ কেউ এরই মধ্যে এক ঘুম দিয়ে উঠেছেন। গাছগাছালিতে ঘেরা এ গাঁয়ে বিদ্যুৎ সংযোগ না থাকায় সন্ধ্যার পরপরই অন্ধকার ছেয়ে যায়। তার ওপর আবার হিজলতলী মানেই ভূতপল্লী। সবার ধারণা এ গাঁয়ে যে কটি হিজল গাছ আছে তার প্রত্যেকটিতে এক একটি ভূত বাস করে। আর রাতেই তারা বেরিয়ে পড়ে একে অন্যের খোজ খবর নিতে। তাদের পথের মাঝে যদি কেউ বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় তবে তার রক্ষে নেই। এসব কুসংস্কার এদের মধ্যে এতটাই বদ্ধমূল হয়েছে যে সন্ধ্যার পর কেউ বাসার বাইরে বেরুবার চিন্তাই করতে পারে না। এই আতঙ্ক এখন শিক্ষিত সমাজেও ছড়িয়ে পড়েছে। সেবার এসে শুনলাম, সুবোল মাষ্টারকেও নাকি ভূতে ধরেছিল। অনেক কষ্টে ছাড়া পেয়েছে সে। এরকম আতঙ্কের কারণও আছে। বছর দুই আগের ঘটনা, সেন্টু মোল্লার মেঝ মেয়ে রেণু। সবে দশম শ্রেণীতে উঠেছিল। একদিন সকালে বাড়ির পিছনের হিজল গাছটায় তাকে গলায় ফাঁস দেয়া অবস্থায় পাওয়া যায়। তার গলায় নাকি বড় বড় নখের আঁচড় পাওয়া গেছে। এর পরপরই সেন্টু মোল্লা হিজল গাছটা কেটে ফেলে। তাতে সেই ভূত আরও ক্ষেপে গেছে। এখনও নাকি মোল্লার টিনের চালে প্রায় রাতেই ঢিল ছোঁড়ার শব্দ পাওয়া যায়। অথচ এই ভূত প্রেতের কার্যকলাপ এখন পর্যন্ত আমার সামনে পড়েনি। তাই বিশ্বাস করা তো দূরের কথা এসব শুনলেই গা জ্বলে উঠে। এই আধুনিক যুগেও মানুষ এসব কুসংস্কারের ঊর্ধ্বে যেতে পারে নি! ভাবতেই অবাক লাগে। আমাদের বাড়িতেও এর ব্যতিক্রম নয়। এই তো সেদিন মা চিঠিতে লিখেছেন,” বাবা, বেলা থাকতেই বাড়ি চলে আসবি। আসতে আসতে আবার রাত করিস না। গত সোমবার রাতে তোর জাফর চাচার কালো গাভীটার ঘাড় মটকে খালের পাঁড়ে গেঁথে রেখে গেছে।“ আমি এখন সেই খালের পাঁড় ধরেই হাঁটছি। হঠাত করেই মনের মাঝের দুর্বলতার পেন্ডুলামটা খানিকটা দুলে উঠল। অথচ এমনটি আর কখনোই ঘটে নি। কলেজে যখন পড়তাম তখন মায়ের নিষেধ সত্যেও প্রায়ই বন্ধুরা রাত করে আড্ডা দিতাম। কই তখন তো এমনটি হয় নি।
প্রায় বাড়ির কাছাকাছি চলে এসেছি। আর মিনিট দশেক হাঁটলেই আমাদের বাড়ি। এই দিকটায় রাস্তার দু-ধারে হিজল গাছ বেশী থাকায় কেমন যেন অন্ধকার অন্ধকার লাগছে। হঠাত করেই রাস্তার এপাশ থেকে কিছু একটা দৌড়ে ওপাশের ঝোপটায় ঢুকে পড়ল। হয়তো বিড়াল জাতীয় কিছু হবে। দু-চার পা এগিয়ে যেতেই মনে হল আমার পেছন পেছন কেউ হাঁটছে। ঘুরে দাঁড়িয়ে কাউকেই দেখতে না পেয়ে আবার হাঁটতে লাগলাম। আবার সেই একই শব্দ। মা’কে বলতে শুনেছি, কখনো এমন হলে পিছন দিকে উল্টোভাবে লাথি মারতে হয়। মায়ের কথামত পিছন দিকে না তাকিয়ে একটি লাথি মেরে হাঁটতে লাগলাম। আশ্চর্য! এখন আর সেই হাঁটার শব্দ শোনা যাচ্ছে না। তাহলে কি—– ধুর! কুসংস্কার দেখি আমার দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছে। মনে আরও সাহস যুগিয়ে নিলাম। আমাদের বাড়িটা এখান থেকে দেখা যাচ্ছে। বাড়ির প্রথম ঘরটাই আমাদের। বারান্দার বেড়ার ফাঁক থেকে একটি ক্ষীণ আলো চোখে এসে পড়ছে। মা বোধহয় এখনো আমার অপেক্ষায় বসে আছেন।
হাত দশেক সামনে একটি অবয়ব দেখে থমকে দাঁড়ালাম। কেউ একজন আমার সামনে সামনে হেঁটে যাচ্ছেন। এতক্ষণ লোকটিকে দেখিনি হঠাত করেই বা লোকটি কোথেকে আসল। এত রাতে কে হতে পারে! আরও একটু সামনে এগিয়ে লোকটির অবয়ব আরও স্পষ্ট হল। কিছুটা কুঁজো হয়ে লাঠিতে ভর দিয়ে হাঁটছেন। গাঁয়ে একটি লম্বা চাদর জড়ানো। চাদরের এক কোণ মাটিতে লুটিয়ে যাচ্ছে। কেন যেন হাঁটার গতিটা বাড়িয়ে দিলাম। ঠিক যখনি লোকটিকে পাশ কাঁটিয়ে যাচ্ছি অমনি আমার একটি হাত পিছনে আঁটকে গেল। অনুভব করলাম হাড্ডিসার একটি হাতের পাঁচ আঙুল আমার হাত আঁকড়ে ধরে আছে। ভয়ে ভয়ে ঘুরে দাঁড়ালাম। লোকটির চোখদুটো অক্ষিকোটরে ঢুকে গেছে। গালের হাড়গুলো যেন বাইরে বেড়িয়ে এসেছে; দেখে মনে হচ্ছে একটি দাঁতও অবশিষ্ট নেই। গাছ ছাড়িয়ে খোলা আকাশের নিচে আসতেই আমার শরীরের সব রক্ত যেন হিম হয়ে গেল। এ যে মোল্লা বাড়ির জলু মোল্লা। গত আশ্বিনে আমি নিজেও এই লোকের জানাজায় অংশগ্রহণ করেছিলাম। ১১০ দশ বছর বেঁচেছিল। জীবদ্দশায় কারো কোন উপকার করেছিল বলে শুনিনি। জলু মোল্লা কম্পিত স্বরে জিজ্ঞেস করল-
-শিকদার বাড়ির কবরস্থানটা কোনদিকে?
হঠাত করেই এরূপ অপ্রত্যাশিত ঘটনায় আমি বেশ ভড়কে গিয়েছিলাম। তারপরও কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে বললাম।
– এইতো, একটু সামনে এগিয়েই বায়ের পথ।
বলে আমি হাঁটতে যাবো অথচ লোকটি এখনো আমার হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে। এমন বৃদ্ধ লোকের শীর্ণ দেহে এত শক্তি থাকতে পারে তা ভাবাই যায় না। পরক্ষণেই খেয়াল হল এতো আর সেই ভূমি দস্যু জলু না, এযে তারই অশুভ প্রেতাত্মা। আমি হাঁটছি তো সেও হাঁটছে। আমি একটু হাঁটার গতি বাড়িয়ে দেই তো সে টেনে ধরে রাখে। জলুর নিঃশ্বাসের সাথে সাথে গলা দিয়ে গড় গড় শব্দ বেরুতে থাকে। ইতিমধ্যে ভয় আমাকে পুরোপুরি আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। ভিতরটা কেমন ফাঁকা হয়ে আসছে। একবার ভাবলাম চিতকার দেব। এখান থেকে চিৎকার দিলে ঠিক আমাদের বাড়ি থেকে শুনাবে, আবার সাহস হল না। জলুর গোঙ্গানির শব্দ আরও বড়ে গেছে। সামনের বাকেই যা করার করতে হবে। জলুর গন্তব্য বায়ে আর আমারটা ডানে। নানা রকম চিন্তা করতে করতে যখন ঠিক বাকে এসে দাঁড়িয়েছি অমনি হাতটাকে জোরে ঝাঁকুনি দিয়েই দৌরে বাড়ির উঠোনে গিয়ে উঠলাম। মা ইতিমধ্যে হ্যারিকেন হাতে বেরিয়ে এসেছেন। পিছনে তাকিয়ে অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেলাম না। অথচ সেই জলুর অবয়ব এখনও আমার দুচোখে আতঙ্কের রেখা টেনে যাচ্ছে।

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!