মধ্যরাত, স্তব্ধ নীরবতা, চার দিকে গুমট অন্ধকার। পথের দু’ধারে গাছ- গাছালি ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে। অমাবস্যার রাত, কঠিন পিনপতন
নীরবতা। পথে কোনো মানুষজন নেই। শুধু একা নূরু। হ্যাঁ, নূরুর কথাই বলছি। নূরুদের ফ্যামিলিকে ছোট ফ্যামিলিই বলা যায়। বাবা মারা গেছেন সেই অনেক আগে। মা আছেন, কোনো বোন নেই। তিন ভাইয়ের মধ্যে নূরু দ্বিতীয়, রান্নাবান্নায় মাকে সবসময় সাহায্য করে। গ্রামের নাম হীরাপুর। নাম হীরাপুর হলেও এ গ্রামে কিন্তু কোনো হীরার খনি নেই। আছে এক ভয়ঙ্কর অন্ধকার বাগান। বাগানের মধ্য দিয়ে চলে গেছে একটি রাস্তা। প্রায়
৫০০ গজ লম্বা হবে রাস্তাটি। এইটুকু রাস্তা দিনের বেলায় একা একা পার হওয়া বড় বীরত্বের ব্যাপার। কেননা ভরদুপুরেও এই রাস্তায়
পড়ে না সূর্যের আলো। থাকে রাতের মতো অন্ধকার। আমাদের পুরো গ্রামে নূরু ছিল সবচেয়ে সাহসী ছেলে। কঠিন কঠিন সব বাজি ধরে জয় লাভ করে সে হয় গ্রামশ্রেষ্ঠ বাহাদুর। গভীর রাতে এই বাগান দিয়ে ঘুরে আসা তার জন্য কোনো ব্যাপারই ছিল না। ভূত- পেতনী কোনো কিছুকেই
সে পরোয়া করে না। শুধু হাতে একটি ম্যাচ থাকলেই হলো। সেই দিন ছিল বৃহস্পতিবার, চন্দ্রগঞ্জ হাট। সপ্তাহে দুই দিন বসে এই হাট , রবি ও
বৃহস্পতিবার। বাকিটা নূরুর মুখ থেকেই শুনি। অমাবস্যার রাত, বাজারে ইলিশ মাছ খুব সস্তায় বিক্রি হচ্ছে জেনে আম্মু বলল, কিছু ইলিশ মাছ কিনে আনতে। তাই সন্ধ্যার পর বের হই বাজারের দিকে। আমাদের বাড়ি থেকে বাজারের দূরত্ব প্রায় তিন মাইল। হেঁটেই রওনা হই। রাত
বেশি হলে মাছ বিক্রেতারা সস্তায় বিক্রি করে দেয় মাছ। সুযোগটা হাত ছাড়া করতে চাই না। রাত ১০টার পর বেশ কিছু ইলিশ মাছ কিনে বাড়ির দিকে রওনা হই। হেঁটেই আসছি। রাস্তার দু’ধারে টি-প্লান্টেশনের চারাগাছ লাগানো। তবে অন্ধকারে কোনো কিছুই দেখা যাচ্ছে না। হাঁটতে হাঁটতে অনেক পথচলে এলাম। মাঝামাঝি পথ আসতেই শরীর কেমন যেন ভার ভার মনে হচ্ছে। পেছন থেকে কেউ যেন আমাকে অনুসরণ করছে। কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়িয়ে পকেট থেকে ম্যাচটা বের করি। একটি কাঠিতে আগুন ধরাই। কিন্তু না, কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। আবার হাঁটা শুরু করি। শরীর যেন আরো ভার হয়ে এলো। একটু ভয় ভয়ও করছে। পুরো পথে কোনো মানুষের সাথে দেখা হয়নি। বাকি পথে দেখা হবে কি না, তাও জানি না। শরীরে একটু শক্তি সঞ্চার করলাম। মনে মনে বললাম, দূর-কিশের ভয়! আবারো হাঁটা শুরু করলাম। শরীর একটু হালকা হালকা মনে হচ্ছে এবার। কিন্তু
না, কিছু পথ পার হতেই আবার মনে হচ্ছে কেউ একজন যেন আমাকে অনুসরণ করছে। এবার আর পিছে তাকালাম না, হাঁটতেইথাকলাম। হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম ভয়ঙ্কর নির্জন বাগানটার কাছে। বাগানের মাঝামাঝি আসতেই কে যেন আমার হাতে থাকা মাছের ব্যাগটি টান দিলো। চতুর্দিক
ঘুরে বলতে লাগলাম কে কে কে? হঠাৎ করে একটি আওয়াজ এলো খামোশ! আর এক পাও আগাবি না। দেখতে না দেখতেই আমার এক হাত
সামনে এক ভয়ঙ্কর মানুষরূপী জীব দাঁড়িয়ে গেল। পথের দু’ধারে দুই পা রেখে আমাকে উদ্দেশ করে বলে উঠল, সাহস থাকলে আমার দু’পায়ের মাঝ দিয়ে যা। আর না হয় হাতের মাছগুলো এুনি মাটিতে রেখে সোজা বাড়ি যা। আমি একটু ঘাবড়ে গেলাম। এত বিশাল হাত-পাওয়ালা মানুষ আমি আগে আর কখনো দেখিনি। চোখ দু’টি টেনিস বলের চেয়েও বড় বড়। আগুনের মতো জ্বল জ্বল করছে। আমিও প্রশ্ন ছুড়লাম কে তুমি? উত্তরে মানুষ আকৃতির বিশাল ভূতটি বলল, তোর বাবা! যা বলছি এক্ষুনি তা পালন কর, আর না হয় গলা চেপে ধরলাম। মহাবিপদে পড়লাম। আশপাশে কোনো মানুষজনও নেই। হাত- পা অবশ হয়ে আসছে। মনে পড়ল দাদুর কাছে শোনা ভূতের গল্পটি। ভূতেরা নাকি মানুষকে তাদের দু’পায়ের মাঝখান দিয়ে যেতে বলে। আর কেউ না জেনে দু’পায়ের মাঝখানদিয়ে যেতে গেলেই চেপে ধরে মেরে ফেলে। ভয় আরো বেড়ে গেল। হঠাৎ মনে পড়ল আগুন
দেখলেই ভূতেরা পালায়। আর আমার বুক পকেটে তো ম্যাচ আছে। আস্তে আস্তে ম্যাচটা হাতে নিলাম, একটা কাঠি বের করলাম, এক
ঘষাতে আগুন জ্বলে উঠল। ভূতটি এক লাফে দশ হাত দূরে সরে গেল। কিন্তু ভূতটি আরো ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করল। চিন্তা করলাম এটাকে বেশি খেপানো ঠিক হবে না। যদি কোনো অঘটন করে বসে। তাই প্রশ্ন করলাম তুই কী চাস? ভূত বলল, তোর হাতের মাছগুলো। এগুলোর জন্য
আমি বাজার থেকে তোর পিছে পিছে এ পর্যন্ত এলাম। আমি বললাম, মাছ আমি তোকে খেতে দেব। তবে তোকে আমার সাথে বাড়ি পর্যন্ত যেতে হবে। তোরা ভূতেরা তো সব সময় কাঁচা মাছ খাস। এখন তুই আমার সাথে আয়, আমি তোকে রান্না করা মাছ খাওয়াব। ভূত রাজি হলো এবং আমার পিছু পিছু আসতে লাগল। ভূতকে বললাম, তুই আমাদের ঘরে ঢুকতে পারবি না। পাকঘরের বেড়ার পেছনে থাকবি।
রান্না হলে আমি তোকে হাঁ করতে বলব। আর তুই হাঁ করলে আমি তোর মুখে রান্না করা মাছ ঢেলে দেব। ভূত বলল ঠিক আছে। এবার
আমি একটি বুদ্ধি আঁটলাম। ঘরে একটি বড় লোহার শাবল ছিল। চুলায় আগুন ধরিয়ে শাবলটা চুলায় দিয়ে গরম করতে লাগলাম। আর এই
ফাঁকে আমি মাছ কুটে রান্না চড়ালাম। কিছুক্ষণ পরপর ভূত বলতে লাগলো এখনো হয়নি, এখনো হয়নি। আমি বললাম, আরেকটু অপেক্ষা করো। এই
হয়ে যাচ্ছে। যখন দেখলাম শাবলটা চুলার ভেতর আগুনের মতো লাল হয়ে গেল, তখন আমি ভূতকে বললাম হাঁ করো। বেড়ার
ফাঁক দিয়ে ভূত হাঁ করে থাকল। ভূতের টকটকে লাল জিহ্বা দেখা যাচ্ছে। আর এই ফাঁকে আমি আগুনের মতো লাল গরম শাবলটা কোনো রকম একটা কাপড় দিয়ে ধরে ভূতের মুখে ঢুকিয়ে চেপে ধরলাম। কিচ… করে খুব জোরে একটি চিৎকার শুনতে পেলাম। পরের দিন সকালে পাকঘরের বেড়ার বাইরে দেখলাম একটি বড় বিড়াল মরে পড়ে আছে।
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।