ভূত।। সংগৃহীত গল্প – ০২ ।।

২০১০ সালের জুলাই মাসের ০৬ তারিখে আমরা চার বন্ধু সাতক্ষীরায় একটি একতলা বাড়ি ভাড়া নিয়েছিলাম ৩ মাসের জন্য। বাড়িটি অবস্থিত ছিল নির্জন স্থানে বিলের ধারে। আশেপাশে বাড়ি ছিল মাত্র দুটি। তবে ঐ দুটি বাড়ি আমাদের এই বাড়িটি থেকে অনেক দূরে অবস্থিত ছিল। সচরাচর ঐ দুইটি বাড়ির মানুষদের সাথে আমাদের দেখা হতো না।

আমাদের চার বন্ধুর মধ্যে তিন জন এক রুমে থাকতাম আর বিহীন নামে আমার আর এক বন্ধু একা এক রুমে থাকত।

আমরা রাতে বাইরে বের হতাম না। আর কোনদিন বের হলেও সবাই একসাথে বের হতাম। সন্ধ্যার আগে ফিরে আসতাম কারণ আমাদের পরীক্ষা চলছিল।

জুলাই মাসের ১৭ তারিখে আমাদের এই বাড়িতে এক অবাক করা ঘটনা ঘটে গেল। রাত আনুমানিক ২.৩০ মিনিটের দিকে আমাদের ঘরের দরজায় আঘাতের শব্দ হচ্ছিল খুব জোরে। আমাদের তিন বন্ধুর ঘুম ভেঙে যায়। আমরা তড়িঘড়ি করে দরজা খুলে দেখি বিহীন ঘর্মাক্ত অবস্থায় আমাদের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ওর সারা শরীর কাঁপছে চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে, মুখে কোন কথা নেই। দরজা খুলতেই আমাদের রুমের ভিতরে ঢুকে মেঝের ওপর দড়াম দিয়ে পড়ে গেল বিহীন। আমরা সবাই ভয় পেয়ে গেলাম। বিহীন অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে, চোখে মুখে পানি ছিটাতে লাগলাম আমরা। সাথে সাথে বাড়ি মালিককে ফোন দিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে বাড়ি মালিক আসল। বাড়ি মালিকের সাথে স্থানীয় মসজিদের এক ইমাম ছিল। আমরা তিন বন্ধু বুঝতে পারছিলাম না বাড়ি মালিকের সাথে ইমাম কেন। ইমাম বিহীনের চোখে মুখে বিড়বিড় করে কিসব পড়ে ফুঁক দিল, চোখে-মুখে পানির ছিটা দিল। মিনিট পাঁচেক পরে বিহীন তাকালো কিন্তু তখনো ওর চোখে আমরা একটি ভয়ের চিহ্ন দেখতে পাচ্ছিলাম। ওর যে কি হলো আমরা কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। ইমাম সাহেব ও বাড়ি মালিক বিহীনকে আমাদের রুমে রাখতে বলল। ঐ দিন সারা রাত আমাদের চোখে ঘুম ছিল না। উতকন্ঠার মধ্যে রাত কাটিয়েছিলাম আমরা তিন বন্ধু।

পরের দিন সকালে বিহীনের কাছ থেকে ঘটনাটি জানার চেষ্টা করলাম। ঘটনাটি শুনে আমরা সবাই অবাক হয়ে গিয়েছিলাম।

গায়ের লোম কাঁটা দিচ্ছিল আমাদের। রাতে আড্ডা শেষ করে বিহীন ওর রুমে চলে গিয়েছিল। ঘুমাতে যাওয়ার আগে বিহীন জানালা বন্ধ করে। কিন্তু রাত ২.২০ মিনিটের দিকে বিকট এক শব্দে বিহীনের ঘুম ভেঙে যায়। ঘুম ভাঙতেই জানালার দিকে চোখ যায় ওর। প্রথমে অবাক হয় বিহীন কারণ ঘুমানোর আগেতো সে জানালা বন্ধ করেছিল। কিন্তু জানালা খুললো কিভাবে। কিছু না ভেবেই আবার জানালা বন্ধ করতে উঠে যায় সে। কিন্তু জানালা বন্ধ করতে যেয়েই ঘটে বিপত্তি। বাইরে তাকাতেই সে দেখে যে, একজন লোক বাইরে মাটির ওপর উপুড় হয়ে বসে আছে। শুধু পেছন থেকে দেখা যাচ্ছে যে একজন মানুষ, পুরুষ কি মহিলা বোঝা যাচ্ছিল না। বিহীন চেচিয়ে উঠে জিজ্ঞাসা করে,কে ওখানে? তখন লোকটি উঠে দাঁড়ায়। লোকটি উঠে দাঁড়াতেই বিহীনের চোখ আমড়া আমড়া হয়ে যায়। নিথর হয়ে যায় বিহীনের সারা শরীর। বিহীন যে কতটা ভয় পেয়েছিল তখন তা আমাদের সাথে কথা গুলো বলার সময় আমরা বুঝতে পারছিলাম। কারন তখনও বিহীন প্রচন্ড ঘামছিল। লোকটি বিহীনের দিকে এগিয়ে আসছিল আস্তে আস্তে আর লোকটি যখন এগিয়ে আসছিল তখন বিহীন দেখল যে লোকটির কোন মাথা নেই শুধু শরীরটি তার দিকে এগিয়ে আসছে। বিহীন তখন বেসামাল অবস্থায় ঘরের আলো জ্বালে আর দরজা খুলে আমাদের দরজায় নক করে।

ঘটনাটি শুনে আমরা কোন কিছুই আবিস্কার করতে পারছিলাম না। কারণ আমরা ভুত, প্রেত বিশ্বাস করতাম না।

এই ঘটনার পর থেকে প্রায় রাতে বাড়ির ছাদে শিলবাটার শব্দ হতো। কখনও দূর থেকে ভেসে আসতো মেয়ে কন্ঠের হাঁসি। কখনও মুমূর্ষ রোগীর আর্তনাদ। কিন্তু এসব কিছুতে আমরা কর্ণপাত করতাম না।

সেপ্টেম্বর মাসের ০৩ তারিখে আবারও এক কাহিনী ঘটে আমাদের ঐ বাড়িতে। ঐ দিনও কাহিনীটি ছিলো বিহীনকে নিয়ে। বিহীন বিকাল বেলা কিছু কেনাকাটর জন্য শহরের উদ্দেশ্যে বের হয়। ঐ দিন সন্ধ্যায় আমরা তিনজন পড়ছিলাম। হঠাত করেই বিদ্যুত চলে যায়। তখন আমরা তিনজন গল্প করছিলাম অন্ধকারে। কিছুক্ষণ পর বিহীনের গলা শোনা যায়, হাবীব গেট খোল। তখন হাবীব চাবি নিয়ে যেয়ে বারান্দার গেট খুলে দেয়। বিহীন আমাদের রুমে ঢুকে ওর খাটের উপর বসে। হাবীব জিজ্ঞাসা করে, কিরে আজ এত দেরী হলো যে, কোথায় ছিলি? বিহীন উত্তর দেয়, ঐ একটু কাজ ছিল। বিহীন রুমে আসার মিনিট সাতেক পরে হাবীব বলে, দোস্ত সিগারেট দে, সিগারেট খাবো। বিহীন উত্তর দেয়, আমার কাছে নেই যা ছিলো শেষ হয়ে গেছে। রাজু বলে, আমার কাছে একটা আছে এইটা ধরা। তখন বিহীন বলে, দাঁড়া এখন ধরাতে হবে না আমি দোকান থেকে আর তিনটা নিয়ে আসি একসাথে ধরাবানে। আমরাতো অবাক হয়ে যায় বিহীন আমাদের পিছনে এক টাকা খরচ করে না আর সে আমাদের কে তিনটা সিগারেট খাওয়াবে। আমি বলি, বিহীন এটাকি জোকস্‌? তখন বিহীন উঠে দাড়িয়ে বলে, তোরা ওয়েট কর আমি আসছি। বিহীন চাবি নিয়ে তালা খুলে বেরিয়ে যায়। বিহীন আসবে ভেবে আমরা আর গেট লক করিনা। বিহীন বেরিয়ে যাওয়ার পর পরই বিদ্যুত চলে আসে। মিনিট বিশেক পরেও বিহীন আসে না। কিন্তু আমাদের ঐ বাড়ি থেকে মুদি দোকনে যেতে-আসতে বড়জোর দশমিনিট লাগবে। বিহীন আসছে না দেখে আমরা গেট লক করে দিই। ওকে নিয়ে না ভেবে আমরা আবার পড়তে বসি। কিছুক্ষণ পর বিহীনের ফোন আসে আমার ফোনে। বিহীন বলে, দোস্ত আমিতো এ্যাকসিডেন্ট করেছি।

তখন আমি বলি, কোথায়?

– শহরের ভিতরে মটর সাইকেলের সাথে।

– তুই আবার শহরে গেলি কখন?

– ক্যান তুই কি পাগল হয়ে গেছিস? বিকালেতো তোর সামনে দিয়েই আসলাম।

– তুইতো সিগারেট আনার নাম করে বেরিয়ে গেলি মিনিট বিশেক হলো। এখন বলছিস শহরে?

বিষয়টি আমাদের কাছে ঘোলাটে লাগছিল। আমরা সবাই বিহীনকে আনার জন্য বাড়িতে তালা লাগিয়ে বেরিয়ে পড়ি। হাসপাতালে গিয়ে সব কিছু বলি বিহীনের সাথে। বিহীন সবকিছু শুনে অবাক হয়। তখন আমাদের মনে একটি ভীতি ঢুকে যায়। ঐ দিন রাতে আমরা হাসপাতালেই থাকি সবাই। পরের দিন স্থানীয় মসজিদের ঐ হুজুরের কাছে বিষয়টি খুলে বলি। তখন সে আমাদের কাছে ঐ বাড়ি সম্পর্কে একটি ঘটনা খুলে বলে। সে বলে-

তোমাদের সাথে প্রতিনিয়তই যে ঘটনা গুলি ঘটছে সেটি নতুন কিছু নয়। এর আগেও এই বাড়িটি তিনবার ভাড়া হয়েছে। কিন্তু তারাও এরকম ঘটনার সম্মুখীন হয়েছে বিধায় বাড়ি ছেড়েছে। এই বাড়িটি সলেমান নামে এক ভদ্র লোক প্রথম ভাড়া নেয়। তারা স্বামী-স্ত্রী দুজন থাকত। বাড়িটি ভাড়া নেওয়ার ৪ মাসের মাথায় সলেমান নামের ঐ লোক তার স্ত্রীকে মেরে ফ্যানের সাথে টাঙিয়ে রেখে পালিয়ে যায়। তার পর থেকে যারা ঐ বাড়িটি ভাড়া নিয়েছে তারা বিভিন্ন সমস্যার কারণে বাড়িটাতে বেশিদিন থাকতে পারেনা।

এই সব ঘটনা শোনার পর ঐ দিনই আমরা বাড়িটি ছেড়ে দিই।

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!