একদম বেশি টেনশন করবে না। ঠিক আছে?
– ওকে ম্যাম।
-আর বেশি প্রেশার দিবেনা মাথাকে। সবসময় যেটা ঘটে গেছে সেটাকে জোর করে ভোলার চেষ্টা করবেনা। তাহলে হয়তো আরো বড় কোন সমস্যা হতে পারে।
– যেমন?
-এই যেমন তোমার মস্তিষ্ক হয়তো তোমার দেওয়া অতিরিক্ত চাপের ফলে হঠাৎ করেই দুর্বল হয়ে যেতে পারে। ফলে যেহেতু শরীরের সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো মস্তিষ্কই নিয়ন্ত্রণ করে, একদিন হয়তো দুর্বল মস্তিষ্ক সেটা আর করতে পারবেনা। ফলে তোমার শরীরের যেকোন অংশই যে কোন সময় অবশ হয়ে যেতে পারে।
-ও!
-আর শোন। ভাব যে আমাকে তোমার যেসব সমস্যা বললে তার মধ্যে কোন জিনিসটা তোমাকে বেশী কষ্ট দিচ্ছে। সমস্যা সমাধানের জন্য সমস্যা কোনটা সেটা জানা খুবই দরকার।
-ওকে ম্যাম। থ্যাংকস্! আমি আপনার কথাগুলো মেনে চলার চেষ্টা করবো।
– আমার কথা মেনে চলার কোন ব্যাপার নেই এখানে। আমি কেবল তোমাকে বোঝাতে পারি যে তুমি কি করলে তোমার সমস্যাটা থেকে বের হয়ে আসতে পারবে। সমস্যার সমাধান করে দিতে পারিনা। টিএসসির দোতলা থেকে নামতে নামতে কাউন্সিলরের কথাগুলো আবার একবার নতুন করে ভাবছিল মিতু। আসলেই কি সে নিজের ওপর বেশি প্রেশার দিয়ে ফেলছে? বুঝতে পারেনা ও ওর দোষটা কোথায়। চারপাশে এত ঘটনা ঘটে চলছে প্রতিদিন যে টেনশন না করতে চাইলেও করা হয়ে যায়। ও কি করে টেনশন না করে থাকবে? এইতো এই মাসেই একের পর এক কতগুলো ঘটনা ঘটে গেল। মাহমুদ ওর সাথে প্রচন্ড বাজে ব্যবহার করলো। ওদের ফ্রেন্ডশীফটা ভেঙে গেল। ইস! এত দিনের বন্ধুত্বটা কি সহজেই না শেষ হয়ে গেল! এরপর থেকে ক্যাম্পাসে একেবারে একা হয়ে গেল ও। তাও তো একরকম চলছিল। কিন্তু এই কয়দিন আগে রানা প্লাজার ঘটনাটা ঘটার পরে আরো সমস্যায় পড়তে হলো ওকে। বাবাকেও বারবার বলল ওখানে না যেতে। একে বাবার বয়স বেশি, তার ওপর মানসিকভাবে অতটা শক্ত ও নেই এখন বাবা। কিন্তু কিসের কি! কোন কথাই শুনলোনা সে। চলে গেল জেদ ধরে ওখানে। আর সন্ধ্যার দিকেই বাসায় ফিরে এলো অজ্ঞান অবস্থায়।
মা মারা গেছেন অনেক আগে। বাবার পাশে তাই মিতুকেই থাকতে হল অগত্যা। ওদিকে ক্লাসে না যেতে পারায় ওর এটেন্ডেন্স মার্কস তো কমে গেলই, লেকচারগুলোও হাতছাড়া হয়ে গেল। ক্লাসের ছেলে-মেয়েগুলোও এমন! লেকচার চাইলে মনে হয় যেন এমন অদ্ভুত কথা ওরা বুঝি এই প্রথম শুনছে। বেশি জোরাজুরি করলে স্রেফ বলে দেয় ওদের নিজেদের করুণ অবস্থার কথা। ক্লাসে বসে বসে লেকচার তোলার বদলে ঘুমানোর কথা। মাহমুদ থাকলেও হয়তো কোন সমস্যা হত না। গত সেমিস্টারে রেজাল্টটাও খুব খারাপ এসেছে মিতুর। মাহমুদ থাকলে হয়তো একসাথে বেশি করে পড়া যেত। আবার খবর এসেছে অনেক আগে বাবা ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে গ্রামের বাড়িতে যেই জমি কিনেছিল, মায়ের চিকিৎসায় যেটা চলে গেছে, সেই ব্যাংকের অফিসারেরা দু-একদিনের মাঝেই আসছে লোনের টাকার জন্যে। চটফট করে মিতুর ভেতরটা। কাউকে যে কথাগুলো বলবে তারো উপায় নেই। মাহমুদকেই কেবল এসব কথা শেয়ার করা যায়। কিন্তু এখন তো সেটাও করা যাচ্ছেনা। তার ওপর ইদানিং কেন যেন মাঝে- মাঝেই হাত- পা গুলো চলতে চায়না। ক্ষুধা লাগেনা, পড়তে ভালো লাগেনা। তাই সেদিন অনেক ভেবে কাউন্সিলরের কাছে গেছিলও। যদি কোন উপায় হয়। মনটা একটু হালকা হয়। কিন্তু কিসের কি? এতগুলো সমস্যা শোনার পরেও মিতুকে কাউন্সিলর ম্যাম কোন উপায় না দিয়ে সরাসরি বলে দিলেন টেনশন না করতে। মিতু বুঝে পায় না। ম্যাম কি ওটা কথার কথাই বললেন? নাকি না বুঝেই…এতসব কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে ক্লাসে ঢুকে পড়েছে মিতু টেরই পায়নি। স্যার ওযে ওর সাথে সাথেই ক্লাসে এসেছেন সেটাও না। অনেকদিন বাদে আজ ক্লাস করা হচ্ছে। তাই সমস্ত ভাবনা বাদ দিয়ে লেকচারে মন দিলও।
এর কিছুদিন পরের কথা। এই নিয়ে দুই সপ্তাহ হলো মিতু মাহমুদের সাথে কথা বলছেনা। কথা বলছেনা অথচ এক ক্লাসেই বসছে, হাসাহাসি করছে। মিতুর মনে এই কয়দিনের হাল্কা ধাক্কাগুলো বড় হতে শুরু করলো যখন ও দেখলো মাহমুদ ওর দিকে একবার ও তাকাচ্ছেনা। মোবাইলে একবার ও খোঁজ নিচ্ছেনা ওর। এমনকি একটা মিসড কল ও দিচ্ছেনা। তাহলে কি একেবারেই ভুলে গেল ওকে মাহমুদ? তবে যে সেদিন বলল ও মিতুকে ভালোবাসে? ও! তাহলে এতদিন এই জন্যেই মিতুর সাথে বুন্ধত্ব করেছেও? মিতুর আরো খারাপ লাগতে শুরু করে। মাহমুদকে ও ভালোবাসেনা। তবুও ওর খুব ইচ্ছা করতে থাকে একবার গিয়ে মাহমুদকে হ্যালো বলে আসতে। যাবে নাকি? ভাবে ও। নাহ! এত গায়ে পড়া ভাব দেখালে মাহমুদ ভাববে মিতু ওর প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েছে। পেছনে বন্ধুদের সাথে গল্পরত মাহমুদকে রেখে ও জোর করেই সামনে এগিয়ে যায়। আর তখনই টের পায় ওর ডান পা টা ঠিক ওর মত চলছে না। ও ভাবছে এবার বামে যাবে, তো পা চলে যাচ্ছে ডানে। আর খানিক পরে তো মনে হলো পা আর চলছেই না। ও একবার পেছন ফিরলো। তাহলে কি আর কিছু না? মাহমুদকেই ও ভালোবাসে? তাই ওকে ভুলতে গিয়েই মিতুর এই অবস্থা? আগে কখনো ভালোবাসেনি কাউকে মিতু। তাহলে এটাই কি ভালোবাসা? ও বুঝতেই পারেনি? আর পারলোনা মিতু। প্রথম প্রেমে পড়ার আনন্দে আর মাহমুদের থেকে দুরে থাকার কষ্টে একেবারে সিনেমার নায়িকাদের মতই মিতু এবার দৌড়ে ছুটে গেল মাহমুদের দিকে। মাহমুদ বোকার মত চেয়ে আছে। হয়তো ভাবছে কি হল মিতুর? ওর দিকে এভাবে দৌড়ে আসছে কেন ও? ও কি তাহলে ওকে ভালোবাসে। মিতু বুঝলো ব্যাপারটা ছ্যাবলামির পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। তবুও থামলো না ও। দৌড়ে চলল ও মাহমুদের দিকে। মাহমুদ করিডোরের একেবার ঐ প্রান্তে। মিতুর মনে হচ্ছিল ওখানে যেতে এখন বুঝি আর কেউই ওকে আটকাতে পারবেনা। ও ছুটছে…মাহমুদ তাকিয়ে আছে…ও ছুটছে……মাহমুদ তাকিয়ে আছে….. কিন্তু হঠাৎ কি হল? মিতু থেমে গেল। অবাক হয়ে একবার নিজের পায়ের দিকে তাকালো। তবে সেটা এক মুহুর্তের জন্যেই। তারপর আবার ছুটতে শুরু করলো ও। তবে এবার আর মাহমুদের দিকে নয়। ওর উল্টোদিকে। রোকেয়া হলের দিকে। হাতে নিজের স্যান্ডেল দু’টো ঝুলছে ওর। এখন ওর গন্তব্য আর মাহমুদ নয়। রোকেয়া হলের পাশে বসা জুতো সেলাইওয়ালা মামা। এতক্ষণে বুঝতে পেরেছে ও, মাহমুদ নয়, ওর এই সমস্যা মেটাতে পারে একমাত্র জুতো সেলাইওয়ালা মামাই। সামান্য একটা জুতোর হঠাৎ ছিঁড়ে যাওয়া আজকে আটকে দিল ভালোবাসার মতন স্বর্গীয় একটা ব্যাপারকে।
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।