ভুতূড়ে জাহাজ নিয়ে যত লোককাহিনী প্রচলিত আছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত দি ফ্লাইং ডাচম্যান।এই “ফ্লাইং ডাচম্যান” নামটি আসলে জাহাজটিকে উদ্দেশ্য করে নয়,বরং জাহাজের ক্যাপ্টেনকে উদ্দেশ্য করে দেয়া। লোকমুখে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত কাহিনী থেকে জানা যায় যে দি ফ্লাইং ডাচম্যান জাহাজের ক্যাপ্টেন ছিলেন হেনড্রিক ভ্যানডার ডেকেন। হেনড্রিক ১৬৮০ সালে এই জাহাজে করে আমস্টার্ডাম থেকে বাটাভিয়া এর দিকে যাচ্ছিলেন।
যখন জাহাজ আফ্রিকা এর কেপ টাউনে পৌছালো, ততক্ষণে আবহাওয়া খারাপ হয়ে পরেছিল। তা দেখে হেনড্রিককে জাহাজের অপর নাবিকরা নিষেধ করল জাহাজ ছাড়ার জন্য। কিন্তু হেনড্রিক যেন উন্মত্ত হয়ে পড়েছিলেন। সবার নিষেধাজ্ঞা– হুঁশিয়ারি বাণী উপেক্ষা করে তিনি জাহাজ ভাসালেন কেপ টাউনের উত্তাল সাগরের বুকে। হারিকেন এর মাঝে পরলো ফ্লাইংডাচম্যান। হেনড্রিককেও যেন হারিকেন এর সাথে যুদ্ধ করার নেশায় পেয়ে বসলো।
তখনও জাহাজের সব নাবিকেরা হেনড্রিককে অনুরোধ করেছিল কেপ টাউনে ফিরে যাবার জন্য, কিন্তু তাঁর যেন কোন কথাই কানে গেল না। হারিকেন এর সাথে লড়াই অব্যাহত রাখলেন। মাঝে মাঝে ঝড় এতই বেড়ে যেত যে হেনড্রিক নিজেকে জাহাজের নেভিগেশন হুইলের সাথে বেঁধে রাখতেন, যাতে ঢেউ তাঁকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে না পারে।
এভাবে ঝড়ের সাথে যুঝতে যুঝতে হেনড্রিক সৃষ্টিকর্তাকে অভিসম্পাত করেছিলেন যে যত বড় বাধাই সৃষ্টিকর্তা তৈরী করুন না কেন, হেনড্রিক থামবেন না যতক্ষণ পর্যন্ত না তিনি পৃথিবীর শেষ প্রান্তে পৌছান। এই অভিসম্পাতই হয়তো হেনড্রিকের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। তাঁর এই পাগলামি দেখে নাবিকদের মধ্যে বিদ্রোহী দল গড়ে ওঠে এবং তারা জাহাজ দখল করার প্রচেষ্টা চালায়। কিন্তু বিদ্রোহী দলের নেতাকে হেনড্রিক গুলি করে মেরে ফেলেন ও পানিতে তার লাশ নিক্ষেপ করেন।
পরবর্তীতে জাহাজটিকে ঘিরে কিছু অংশে ঝড় স্তিমিত হয়ে যায় আর জাহাজের উপর এক ভূতের আবির্ভাব ঘটে। সেই ভূতের আবির্ভাবের সাথে সাথে কোন কারণ ছাড়াই জাহাজের সকল নাবিক মারা যায়, শুধু হেনড্রিক ছাড়া। হেনড্রিক দমবার পাত্র ছিলেন না। তিনি ভূতটিকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে চেষ্টা করেন।গুলি ছোড়া মাত্রই হেনড্রিকের হাতে বন্দুকের ভিতরে বিস্ফোরণ হয় এবং তাঁর হাত অবশ হয়ে যায়। তারপরে হেনড্রিকের কি হয় তা জানা যায়নি। কেবল জাহাজটি ঝড়ের মাঝে হারিয়ে যায়।পরে ভুতূড়ে জাহাজ হিসেবে এই জাহাজটিকে সমুদ্রে দেখা যায়।
এটিই ফ্লাইং ডাচম্যানকে নিয়ে গড়ে ওঠা একমাত্র লোককাহিনী না। অপর লোককাহিনী বলে যে কেপ টাউনেরদিকে বাণিজ্য উপলক্ষে যাবার পথে ক্যাপ্টেন এর মনে হয় যে ডাচ ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানির সাথে এই বাণিজ্য সংক্রান্ত একটি পাকা চুক্তি করে নেয়া প্রয়োজন। কিন্তু ভাবতে ভাবতেই জাহাজটি ঝড়ের মাঝে পরে যায়, জাহাজ ঘুরানোর সুযোগ আর হয়না।
পরে ঝড় এর মাঝে জাহাজ টিকে থাকলেও ঝড় থামার পর ডুবোপাথরে ধাক্কা খেয়ে জাহাজটি ডুবে যায়, কিন্তু জাহাজের ক্যাপ্টেন নিজেই অভিসম্পাত করে যান যে তিনি এই জাহাজকে কেপ টাউনের দিকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবেনই, সেটা যেভাবেই হোক। ব্যস, সেই থেকে ফ্লাইং ডাচম্যানকে ভুতূড়ে জাহাজ হিসেবে দেখা যায়।
অপর কাহিনী বলে যে ১৭২৯ সালে ফ্লাইং ডাচম্যান এর ক্যাপ্টেনকে কোন কারণে অসন্তুষ্ট হয়ে শয়তান অভিসম্পাত করেন যে এইজাহাজ নিয়ে ক্যাপ্টেন অনন্তকাল সমুদ্রে ভাসবে।
তাঁর মুক্তির একমাত্র উপায় হচ্ছে কোন বিশ্বস্ত নারীর সত্যিকার ভালবাসা। তাই ধারণা করা হয় যে ফ্লাইং ডাচম্যান তার ক্যাপ্টেন সহ মাঝে মাঝে আবির্ভুত হয় সেই বিশ্বস্ত নারীর খোঁজে, মুক্তির আশায়।
লোকমুখে শোনা যায় যে দি ফ্লাইং ডাচম্যান কে নাকি পরবর্তীতে ভূত-জাহাজ হিসেবে বেশ কয়েক বার সমুদ্রে দেখা যায়, বিশেষ করে ঝড়ের মধ্যে। ফ্লাইং ডাচম্যানকে স্বচক্ষে দেখেছেন বলে কেউ কেউ দাবিও করেছেন। ১৮৩৫ সালের একটি ব্রিটিশ জাহাজের ক্যাপ্টেন এর লগবুক রেকর্ড থেকে প্রথম জানা যায় এই ভুতূড়ে জাহাজের অস্তিত্বেরকথা।
লগবুকে লেখা ছিল যে তারা সমুদ্রের মাঝখানে ঝড়ের মধ্যে আবৃত একটি জাহাজ দেখতে পেয়েছিলেন যেটা সোজা তাদের জাহাজের দিকে ঝড় সহ এগিয়ে আসছিল। এক পর্যায়ে এত কাছে এসে পরেছিল সেই ঝড়-আবৃত জাহাজটি যে তারা ভয় পেয়ে যান যে এখনি জাহাজ দুটিতে সংঘর্ষ হবে। কিন্তু হঠাৎ করেই ঝড়সহ ভুতূড়ে জাহাজটি গায়েব হয়ে যায়।
পরবর্তীতে ১৮৮১, ১৯১১, ১৯৩৯ ও১৯৪২ সালে ফ্লাইং ডাচম্যানকে আরও অনেকেই দেখতে পান, সবাই একই বর্ণনা দেন জাহাজটির এবং সবাই বলেন যে জাহাজটি এক পর্যায়ে অদৃশ্য হয়ে যায়। ফ্লাইং ডাচম্যানকে সর্বশেষ দেখা গিয়েছিল ১৯৪২ সালে কেপ টাউনের উপকূলে, নোঙর ফেলে দাঁড়িয়ে ছিল টেবিল বে – তে এবং আকস্মিকভাবে জাহাজটি অদৃশ্য হয়ে যায় দর্শকদের চোখের সামনে।আজও ফ্লাইং ডাচম্যানকে নিয়ে কৌতুহলের শেষ নেই।
আসলেই কি ঘটেছিল জাহাজটিতে তা সঠিকভাবে কেউ জানেনা। আজও আফ্রিকার সমুদ্র উপকূলে অনেকে জাহাজ নিয়ে যেতে ভয় পায়। কারণ সবার ধারণা ফ্লাইং ডাচম্যান অশুভ প্রেতাত্মা বহন করছে, যার সন্নিকটে গেলে যেকোন জাহাজ ক্ষতিগ্রস্থ হবে।অনেক নাবিকেরা মনে করেন যে ফ্লাইংডাচম্যান সমুদ্রে কোন অমঙ্গল বা ঝড় হবার পূর্বে দেখা দেয় মানুষকে সতর্ক করার জন্য।