আমাদের ক্লাসে আমিই ছিলাম সব চাইতে আসর জমানো ছাত্র । মেজ মামার কাছে ছোটবেলা গল্প শুনতে শুনতে আমি ও গল্প বলায় বেশ তুখোর হয়ে উঠে ছিলাম । যে কোন বিষয়ে বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলায় আমার জুরি ছিল না । আর এর জন্য ক্লাসে আমার কদর ও ছিল বেশ। গল্প শুনাবার বাহানা দিয়ে কতো বার যে কতো জনকে দিয়ে হোম ওয়াক করিয়ে নিয়েছি তার কোন ইয়াত্তা নেই । কিন্তু আমার এই একক রাজত্বে ভাগ বসালো কোথা থেকে উড়ে আসা জামাল । ও আমাদের স্কুলে ভর্তি হবার পর আমার রাজত্বে ফাটল ধরতে শুরু করলো । এমনি তে জামাল বেশ চুপচাপ টাইপের ছেলে । কিন্তু যখন গল্প বলে তখন একেবারে সত্যিকারের মতো করে বলে । মিথ্যা বলবো না , ওর কিছু কিছু গল্প যে আমারও ভাল লাগতো না তা কিন্তু নয় । বিশেষ করে ভুতের গল্পগুলো জামাল বলতো একেবারে সত্যিকারের মতো করে । একবার শুনলে রাতে আর সহজে ঘুমানো যেতো না ।
তাই খুব দ্রুতই জামাল আমাদের ক্লাসে জনপ্রিয় হয়ে উঠলো । আমিও সব সময় ওকে নাজেহাল করার জন্য তর্কে তর্কে ছিলাম । পেয়েও গেলাম একবার সুযোগ । ছোট বেলা থেকেই শিখেছিলাম যুদ্ধে বিজয়ী হতে হলে শুধু বাহু বলে হয় না । মাথা ও খাটাতে হয় । তাই আমি আমার হারতে বসা রাজত্ব ফিরে পাবার জন্য মাথা একেবারে ঠান্ডা করে ফেললাম । একদিন টিফিনের পরে একটি ক্লাসের জন্য আমরা সবাই অপেক্ষা করছিলাম । ১০ মিনিট চলে যাবার পর আমাদের স্কুলের পিয়ন এসে বললো – আজ ক্লাসটা হবে না । কি এক কাজে জামান স্যার চলে গেছেন । হেড স্যার আমাদের সবাই কে চুপচাপ বসে থাকতে বলেছেন । নো হান্কি পান্কি । হেড স্যারকে আমরা আবার বেশ ভয় পাই । তিনি একবার রেগে গেলে আর রক্ষে নেই ,এক দু’জনকে নয় পুরো ক্লাসশুদ্ব পিটান । সুতারাং কোন রকম হান্কি পান্কি না করে আমারা জামালের কাছে গল্প শুনতে বসলাম । বৃষ্টির দিন হওয়ায় জামাল ভুতের গল্প বলতে শুরু করলো । একটি ভুতারা বাড়ীর গল্প । গল্পটা ঠিক এ রকম ।
এক ভদ্রলোক নিজের বাড়ীতে আরেকটি ঘর তুলেছেন ধান চাল রাখবেন বলে । কিন্তু ঘর তৈরির পর দেখা গেল তিনি কিছু আর সে ঘরে রাখতে পারেন না । যা ই রাখেন না কেন পরের দিন সে সব জিনিষ পাওয়া যায় ঘরের বাহীরে । এভাবে এক দিন , দুই দিন ,তিন দিন করে কেটে গেল বেশ কয়েক দিন । ভদ্রলোক কোন জিনিসই আর ঐ ঘরে রাখতে পারেন না । অবশেষে উপস্থিত সকলের বুদ্ধিতে ক্ষেত থেকে কেটে আনা ধান ঘরের ভেতর রেখে ঘরের জানালা গুলো সব বন্ধ করে দরজায় তালা দিয়ে দিলেন । সেই সঙ্গে পাহারা রাখলেন দু’জন লোককে । এবার সবাই বললো আর চিন্তা নেই । এতো দিন কেউ নিশ্চই মজা করেছে , কিন্তু আর না । দরজায় তালা থাকায় কেউ আর ঐ ঘর থেকে কিছু বেড় করতে পারবে না । কাজেই আর কোন চিন্তা নেই । সবাই যে যার মতো খেয়ে দেয়ে শুয়ে পরলো । শুধু দু’জন মোটাতাজা লোক থাকলো পাহারায় । পরের দিন ঘুম থেকে উঠে দেখা গেল ঘরের ভেতর রাখা সব ধান গুলো কে বা কারা যেন ভদ্রলোক যে ঘরে থাকেন সে ঘরের চালের উপড় তুলে রেখেছে । প্রায় ৪০ থেকে ৮০ মন ধান চালের উপড় তুলতে গেলে কম করে হলেও দশ বারো জন লোকের দরকার ।
তা ছাড়া কোন রকম শব্দ করা ছাড়া কি ভাবে ধান গুলো চালের উপড় তুলে রাখা সম্ভব হলো ? সেটা কেউ ভেবে পেল না । রাতে যারা ঘরে ঘুমিয়েছে তারা বিন্দু মাত্র কোন শব্দ শুনতে পায়নি । শেষে সবাই একবাক্যে স্বীকার করলো এটা ভুতের কান্ড । ভুত ছাড়া এমন কান্ড আর কারো পক্ষে ঘটানো সম্বভ নয় । তখন খোঁজ পরলো পাহারাদার দু’জনের । যারা রাতে ঘরটি পাহারার দায়িত্বে ছিল । কিন্তু, কোথাও পাওয়া গেল না তাদের । শেষে বিকাল বেলা বাড়ী লাগয়া ক্ষেত থেকে লোকজন এসে বললো -আপনাদের তাল গাছে মানুষের মতো কি যেন দেখা যায় । তাল গাছে লোক উঠিয়ে দেখা গেল ,তালগাছের উপড় পাহারাদার দু’জন অচেতন হয়ে পরে আছে । অনেক কষ্টে পাহারাদার দু’জনকে তাল গাছে থেকে নামিয়ে আনা হলো। ঘটনাটা গ্রাম ছাড়িয়ে আসে পাশের দশ গ্রামে ছড়াতে বেশি সময় লাগল না । বাড়িটি লোকে লোকারন্য হয়ে গেল । কেউ বলতে লাগলো -ভুতের কান্ড , কেউ বলতে লাগল জ্বিনদের কান্ড । তবে কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারলো না আসলে কার কান্ড ।
অনেক চিন্তা ভাবনা করেও কেউ যখন কোন উপায় বেড় করতে পারলো না । তখন গ্রামের ঈমাম সাহেব কে ডেকে আনা হলো । তিনি সব শুনে বললেন -এটা জ্বিনেদের কাজ । কোন কারনে হয়তো তাদের এ ঘরটি পছন্দ হয়েছে । আপাততো কিছু করার নেই । হুজার দোয়া কালাম পড়ে চলে গেলেন । মাস ছয় অতিবাহিত পরেও যখন ঘরটিতে কোন কিছু রাখা যাচ্ছিল না । তখন বাড়ির মালিক ভদ্রলোক ঠিক করলেন ঘরটি ভেঙ্গে ফেলবেন । ৪ জন মিস্ত্রি নিয়ে সন্ধ্যায় তিনি বারান্ধায় বসে কথা বলছেন , আগামি কাল কি ভাবে ? কখন ঘরটি ভাঙা হবে । এমন সময় দেখা গেল সাদা কাপড় পড়া একটা লোককে বাড়ীর বাহির থেকে ভেতর ঢুকতে , লোকটা বাড়ীর ভেতর ঢুকে সরাসরি চলে গেল ঘরটির কাছে তারপর দরজা দিয়ে ঘরটির ভেতরে চলে গেল । সঙ্গে সঙ্গে সবাই ছুটলো, লোকটা কে ? কেনইবা ঘরে ভেতর ঢুকলো তা দেখতে । কিন্তু পুরো ঘর তন্নতন্ন করে খুঁছেও কাউকে পাওয়া গেল না । এরে পরে কেউ আর ঘরটি ভাঙ্গতে সাহস করলো না । উপস্হিত মিস্ত্রি বিভিন্ন বাহানা করে চলে গেল ।
এর পর আরো বেশ কয়েকবার সাদা কাপড় পরিহিত লোকটিকে ঘরের ভেতর ঢুকতে দেখা গেছে । কিন্তু ভেতরে কারো অস্থিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি । সেই থেকে ঘরটি , তেমনিই পরে আছে । বাড়ীর মালিক ভদ্রলোক আর কিছু করার সাহস পায়নি । গল্পটি এখানে শেষ করে জামাল যখন বললো এটা একটি সত্য ঘটনা, তখন আমি পেয়ে বসলাম জামালকে । কেননা আমি জানি ভুত-প্রেত বলে কিছু নেই । তবে জ্বিন আছে । যার প্রমান স্বরুপ পবিত্র কুরআন শরীফে জ্বিন সূরাটি রয়েছে । আমি ফিরোজ ,বাপ্পী সবাই যখন বললাম ঘটনাটি মিথ্যা । এটা শুধুই গল্প । তখন জামাল খুব রেগে গেল , এবং বললো ও নাকি প্রমান দিতে পারে যে , ও মিথ্যা বলছে না । আমরাও কম যাই না । প্রমান চেয়ে বসলাম ।তখন জামাল বললো ভীতুরা শুন ঘটনাটা আমার দাদা বাড়ীর ।
গল্পের ভদ্রলোক আর কেউ নান আমার দাদা ভাই । এখন প্রমান চাইলে আমার সঙ্গে আমাদের দাদা রাড়ী চল দেখবো একেক জন কেমন সাহসি ? জামালের উল্টো চেলেন্জ ছুড়ে দেওয়ায় আমরা বেশ ভেবাচেকা খেয়ে গেলাম । জামাল মাথা নেড়ে নেড়ে আরো বললো কি ভীতুর দল ; এখন নেবেনা প্রমান । যাও বাসায় গিয়ে দুধু খাও । প্রমান চাইতে এসো না । এমন সময় একজন বললো পাহারাদারদের কি হলো ? তারা কি কিছু বলেনি কে তাদের গাছের উপড় তুললো ?রাতে কারাইবা ধান গুলো চালের উপড় তুলে রাখলো ? আমারা সবাই তাকালাম জামালের দিকে । আমাদের সবার চোখে মুখে একই প্রশ্ন আসলেই তো পাহারাদারদের কি হলো ? তখন জামাল বললো – পাহারা দারদের কাছ থেকে তেমন কিছু আর শোনা যায়নি । কেননা তাদের কে চিকিৎসার জন্য শহরে নিয়ে যাওয়া হলে , সুস্থ্য তারা আর কেউ গ্রামে ফিরে আসেতে রাজি হয়নি।
কারো কোন প্রশ্নের উত্তর ও দেয়নি । (২) আমি ফিরোজ , বাপ্পি ,তপন মিলে ঠিক করলাম আমরা যাবো জামালদের গ্রামের বাড়ী । সময়ক্ষন ঠিক করে আব্বা আম্মুকে বলে কয়ে একদিন রওনা ও হয়ে গেলাম । শীত কাল শুরু হয়ে গেছে । জামালদের বাড়ী গ্রামের বাড়ী ঝালকাঠি জেলায় । আমরা সদরঘাট থেকে লঞ্চে চড়ে বসলাম আমরা । জামালের বাবা আছেন আমাদের সাথে । লঞ্চে তিনি আমাদের সর্বক্ষন চোখে চোখে রাখলেন । দীর্ঘ এক রাত্রি লঞ্চে থাকার পর , পরের দিন সকাল ১১টার সময় আমরা গিয়ে পৌছালাম ঝালকাঠিতে । সেখান থেকে নৌকাতে করে যখন জামালদের বাড়ীতে পৌছালাম তখন দুপুর হয়ে গেছে । এ দীর্ঘ যাত্রাও আমাদের কোন ক্লান্তি নেই । চারিদিকে পানি আর নয়ন মুগ্ধকর দৃশ্য আমাদের সকল ক্লান্তি কেড়ে নিল । জামালের দাদা ভাই বেশ শক্ত পোক্ত মানুষ । আমাদের দেখে খুব খুশি হলেন । জামাল অবশ্য আমাদের আগেই বলে রেখেছে আমরা যেন আবার- জ্বিনদের ব্যাপারে দাদা ভাইকে কোন কিছু জিজ্ঞাসা না করি । কেননা তিনি এ বিষয়ে কোন কথা বলতে পছন্দ করেন না ।
যা দেখাবার জামালই আমাদের দেখাবে । আমরা ওর কথার কোন প্রতিবাদ করলাম না । জামালদের বাড়ীটি বেশ সুন্দর । ছায়া সু-নিবিড় যাকে বলে । বাড়ীর সামনে বিশাল একটি পুকুর । টলটলে পানি । নারিকেল বিথীকায় ঘেরা পুকুরে রাজ হাসের সাঁতার কাটা দেখার মতো একটি দৃশ্য । জামালের দাদা ভাই ঘরের বাম পাশেই রয়েছে ঐ ভুতুড়ে ঘরটি । দেখতে অতি সাধারন একটি একতলা টিনের ঘর । তবুও ঘরটি দেখে আমার শরীর কেমন ভয়ে ছম ছম করে উঠলো । নিজেকে ভয় পেতে দেখে , মনে মনে নিজেকেই তিরস্কার করলাম । ঘরটির জানালা গুলো সব বন্ধ । দরজাটাতে একটা ছোট্র তালা ঝুলছে । মনে হলো খুব জোরে একটা মোচড় দিলেই তালাটি খুলে যাবে ।দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর সামান্য একটু বিশ্রাম নিয়ে আমরা গ্রামটা ঘুরতে বেড় পরলাম । ধান কাটা শেষ হয়ে যাওয়ায় ক্ষেত গুলো খালি পরে আছে । ক্ষেত গুলোর মধ্যে এখানে সেখানে খর কুটো স্তুপ হয়ে আছে । আমরা ক্ষেতের আইল ধরে হাঁটতে হাঁটতে জামালকে প্রশ্ন করলাম – ঘরটাতে কখন ঢুকবো ? জামাল জানালো আগামীকাল হাটের দিন । দাদা ভাই সকালে হাটে যাবেন সেই সুযোগে আমরা ঘরটাতে ঢুকতে পরাবো ।
ক্ষেতের পর ক্ষেত ; বাড়ীর পর বাড়ী হেঁটে আমরা সন্ধ্যায় বাসায় ফিরলাম । বাসায় এসে দেখি দাদা ভাই পুকুর থেকে ইয়া বড় এক রুই মাছ তুলেছেন । আমাদের দেখার জন্য মাছটা না কেটে অপেক্ষা করছেন দাদিমা । মাছটা দেখে আসলেই আমরা চমৎকিত হলাম । এতো বড় মাছ সচারাচর দেখা যায় না । রাতে মাছের দোপেয়াজা দিয়ে দারুন খাওয়া দাওয়া হলো । জামালের দাদা ভাই আমাদের পেয়ে খুব খুশি হয়েছেন । তিনি খাওয়া দাওয়ার পর আমাদের নানান গল্প শুনালেন । গল্পের একফাকে ভুতড়ে ঘরের প্রসঙ্গ তুলতেই তিনি একেবারে চুপ হয়ে গেলেন । আমাদের এ সব বিষয়ে মাথা ঘামাতে না করে শুয়ে পরতে বললেন । আমরা উঠানের ওপাশে বার্থরুম থেকে ঘুরে এসে শুয়ে পরলাম । নতুন জায়গায় আমার সহজে ঘুম আসেনা । কিছুক্ষন ছটফট করতে করতে , কখন যে ঘুমিয়ে পরলাম বলতে পারবো না । ঘুম ভাংলো পরের দিন সকাল বেলা । চোখ খুলে দেখি আমি ছাড়া বিছানায় আর কেউ নেই । বাহিরে এসে দেখি বাপ্পি ,ফিরোজ ,তপন ওর উঠানে বসে গ্লাসে করে রস খাচ্ছে ।
হাত মুখ ধুয়ে এসে আমিও রস খেতে বসলাম । আমার কাছে খুব একটা ভাল লাগলো না । দাদা ভাই কোথায় খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম তিনি ফজরের নামাজের পর নদীতে ভাটার সময় হাটে চলে গেছেন । জামাল গেছে দাদিমার কাছ থেকে চাবি আনতে গেছে তাও নাকি অনেকক্ষন । কিছু সময় পরে জামাল দাদিকি নিয়ে হাজির । তিনি আমাদের অনেক বোঝালেন আমরা যেন ঘরটাতে না ঢুকি । দাদা ভাই শুনলে রাগ করবেন । তেনাদের বিরক্ত করা উচিত না । তেনারা মানে ভুত বা জ্বিনেরা । আমাদের হয়ে জামালই সব বললো । আমরা মোটেই তেনাদের বিরক্ত করবো না । ভেতরটা একবার দেখেই বেড় হয়ে আসবো । কিন্তু কিছুতেই তিনি আমাদের চাবি দিতে রাজি হলেন না । শেষ মেশ দাদি মা বলে গেলেন- আমারা যদি পারি তবে যেন দরজা ভেঙ্গে ভেতরে ঢুকি । তিনি কিছুতেই আমাদের চাবি দেবেন না । এই বলে তিনি হনহন করে হেঁটে রান্না ঘরের দিকে চলে গেলেন । আমাদের মন খারাপ হয়ে গেল । সাথে সাথে খুট করে একটি শব্দ শুতে আমরা চমকে উঠলাম । শব্দের উৎস লক্ষ্য করে তাকাতেই দেখতে পেলাম – ভুতুড়ে ঘরের দরজার তালাটি খুলে গেছে ।
আমরা অবাক হয়ে এক জন আরেক জনের দিকে তাকাতে লাগলাম । কিছুটা ভয়ও আমাদের গ্রাস করলো । কি করবো বুঝতে পারলাম না । কিছুক্ষন সবাই বাকহীন হয়ে বসে রইলাম । শেষটাতে ফিরোজই বললো চল- এখন ঢুকে দেখি ঘরের ভেতর কি আছে ? আমি মুখে বললাম চল ঠিকই কিন্তু মনে মনে সাহস পেলাম না । জামালই খুলে ফেললো দরজাটা । আমরা একে একে ভেতরে ঢুকলাম । ঘরের ভেতরটা কিছুটা অন্ধকার থাকায় জামাল আর আমি মিলে জানালা গুলো খুলে দিলাম । আলোতে ভরে উঠলো ঘরটি । ভেতরটা আহামরি তেমন কিছু না । মেজেটা মাটির । এখানে সেখানে ইদুর গর্তখুঁড়ে রেখেছে । গর্তগুলো থেকে মাটি উঠে আছে । ডান পাশে রয়েছে এটা বাঁশের মই । পাটাতনে উঠবার জন্য । বাপ্পি বললো সাবধান সাপটাপ থাকতে পারে । হঠাৎ করেই ভয় ডর সব চলে গেল । সবাই নানান বিষয়ে কথা বলতে শুরু করলাম । হাসাহাসি ও শুরু হয়ে গেল । সামান্য কথাতেই একে অন্যের শরীরে ঢোলে পরছি । ফিরোজ জামালকে কিছুটা ব্যঙ্গ করেই বললো- কিরে জামাল তোর ভুত বন্ধুরা কৈই ? নাকি আমাদের ভয়ে সব পালিয়েছে ? জামাল কিছু বললো না । হঠাৎ পাটাতনটা মচমচ করে উঠলো ।
মনে হলো কে যেন পাটাতনের এ মাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত হেঁটে গেল ।আমরা ভয় পেয়ে গেলাম । আমি দৌড় দেব কিনা ভাবছি । ফিরোজ বললো, ‘ইঁদুর টিইদুর হবে হয়তো ! এই দিনের বেলায় ভয় পাবার কিছু নেই । আমি দেখছি কি আছে উপড়ে’। বলে ফিরোজ মই বেয়ে উপড়ে উঠতে লাগল । আমারা সবাই দাঁড়িয়ে আছি ঘরের মাঝামাঝি । তাকিয়ে আছি ফিরজের দিকে । ও সিঁড়িতে আধেক উঠে দেখতে লাগলো পাটাতনে কে শব্দ করলো । আমরা ওর কোমড় পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছি । হঠাৎ ফিরোজ খুব দ্রুত উপরে উঠে গেল । আমি ভয় পেয়ে বলে উঠলাম- কি হয়েছে ? কি হয়েছে ? ফিরোজ উঠাতে পাটাতনের কাঠে ধুপ দাপ শব্দ হতে লাগল । আমি ভয় ডর ভুলে লাফ দিয়ে উঠলাম মই টাতে তারপর দু’টো স্ট্রিক উঠে উকি দিলাম পাটাতেন । দেখি পাঠাতনের ঠিক মাঝ খানটাতে চিৎ হয়ে মরার মতো শুয়ে হয়ে আছে ফিরোজ । হাত পা নাড়ছে না । আমি খুব দ্রুত উঠে গেলাম ওর কাছে । এই কি হয়েছে ? কি হয়েছে ? বলে চিৎকার করছি আর ওকে ঝাকাচ্ছি ।
হঠাৎ ফিরোজ হো হো করে হেসে উঠে বললো -কেমন ভয় পাইয়ে দিলাম ? তার পর হাসতে লাগলো । আমি ওকে ঘুষি মারার ভঙ্গি করলাম । ঠিক সেই সময় ফিরোজের শরীরটা অদ্ভুত ভাবে নড়ে উঠলো । তার পর চোখের পলকে উপড়ে উঠে গেল । আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই ছিটকে পড়লাম একপাশে । মনে হলো কেউ আমাকে তুলে ছুড়ে ফেলে দিলো । কয়েক সেকেন্ডের জন্য ফিরোজের শরীরটা শূন্যে ভেসে থেকে দুম করে কাঠের উপড় পরলো । কোন দিকে না তাকিয়ে আমি আর ফিরোজ ছুটে গেলাম নীচে নামার মইটার দিকে । তারপর হুরমুর করে নেমে গেলাম নীচে । সেখান থেকে সোজা বাহীরে । নীচে দাড়িয়ে থাকা জামাল,বাপ্পি,তপন ও ছুটলো আমাদের সঙ্গে । মাথার উপর পাঠাতনে খেয়াল করলাম কে যেনো খুব জোরে জোরে হাঁটছে । কাঠে মটমট করে শব্দ হচ্ছে । ভয়ে আমাদের আত্ম শুকিয়ে গেছে । এমন ভয় কোন দিন পাইনি । ঘর থেকে বেড় হয়ে উঠানে আসতেই ধুম করে ঘরের দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল । তার পর জানালা গুলো একে একে বন্ধ হতে লাগল আর খুলতে লাগল ।
আমরা উঠানে দাঁড়িয়ে ভয়ে চিৎকার করতে লাগলাম । আমাদের চিৎকার দাদিমা দৌড়ে এলেন তারপর আমাদের ভেতরের ঘরে নিয়ে গেল । (৩) এ ঘটনার পর যে তিনটি দিন আমরা জামালদের বাড়ীতে ছিলাম সে তিনটি দিন ভয়ে একেবারে কাঠ হয়ে ছিলাম । বিকালে দাদা ভাই হাঁট থেকে ফিরে , ‘সব শুনে, ফিরোজের দিকে তাকিয়ে বললেন- তোমার ওভাবে মজা করে কথা বলা ঠিক হয়নি । তোমরা যখন দাদিমাকে অনুরোধ করছিলে যে শুধু ভেতরটা দেখে বেড় হয়ে আসবে । তখন ও ঘরে যিনি থাকেন তিনি হয়তো তোমাদের কথা রাখতে চেয়েছেন । কিন্তু তোমরা যখন ভিতরে ঢুকে হাসাহাসি শুরু করলে , তেনাদের নিয়ে ব্যঙ্গ করছিলে তখন তিনি রেগে গিয়ে তোমাদের সঙ্গে এমন ব্যবহার করেছেন’; এখন চল আমার সঙ্গে তেনার কাছে মাপ চাইবে । দাদা ভাই এর পিছু পিছু আমরা ঘরটার দরজার কাছে গিয়ে হাত জোড় করে মাপ চাইলাম বললাম – আমাদের ভুল হয়ে গেছে । আমাদের মাপ করে দিন । আর কোন দিন এমন করবো না । পাঠক ; আপনারা হয়তো আমাদের ক্ষমা চাওয়ার দৃশ্যটি কল্পনায় দেখে হাঁসছেন ।
কিন্তু সেই সময়ে আপনারা যদি আমাদের সঙ্গে থাকতেন তবে আপনারাও হাত,পা,কান ,চোখ ,মুখ সব এক করে আমাদের মতো করে ক্ষমা চাইতেন । পরের দিন সকাল বেলা আমরা যখন ঢাকায় ফেরার জন্য জামালদের বাসা থেকে বেড় হচ্ছিলাম । রেডি হয়ে সবাই উঠানে দাঁড়িয়েছি ঠিক সে সময় ঘরের দরজাটা খুলে গেল । আমাদের চোখের সামনে ঘর থেকে বেড় হয়ে এলোন সাদা জোব্বা পরা একটি লোক । দাদা ভাই সালাম দিতে -ওলাইকুম আসসালাম বলে লোকটা আমাদের দিকে তাকিয়ে মৃর্দু হাসলেন । তারপর হন হন করে কিছুটা হেঁটে নেম গেল পুকুরে ঘাটলা দিয়ে । আমারাও পিছু পিছু গেলাম কি করেন দেখার জন্য । কিন্তু পুকুরে গিয়ে কাউকে দেখতে পেলাম না । লোকটি চোখের সামনে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল । পাঠক বিশ্বাস করুন । ঢাকায় আসার পর একমাস পর্যন্ত আমরা স্বাভাবিক ছিলামনা । কেমন যেন চুপচাপ শান্ত হয়ে গিয়েছিলাম । এরপর থেকে ভুত,পেত,জ্বিন পরীর প্রসঙ্গ উঠলে আমি এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করি ।।