রংধনু আসরের কাছের ও দূরের শিশু-কিশোর বন্ধুরা, কেমন আছো তোমরা? আশা করি যে যেখানে আছো ভাল ও সুস্থ আছো। তোমরা নিশ্চয়ই জানো যে, বর্তমান বিশ্বের ৭০০ কোটি মানুষ প্রায় ছয় হাজার ভাষায় কথা বলে। কিন্তু কোনো মানুষই সব ভাষা জানেন না। তবে সবাই এ কথা জানেন যে, ভাষা শেখার গুরুত্ব অপরিসীম। পৃথিবীর সর্বপ্রথম মানুষ হযরত আদম (আ.)কে স্বয়ং আল্লাহতায়ালা ভাষা শিখিয়েছেন। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, “অসীম দয়াবান আল্লাহ । তিনি কুরআন শিক্ষা দিয়েছেন। মানুষ সৃষ্টি করেছেন। তাকে কথা বলতে শিখিয়েছেন।”
আল্লাহতায়ালা আরো বলেছেন, “আমি যখনই কোনো রাসূল পাঠিয়েছি, সে নিজের জাতীয় ভাষায় জনগণকে আমার আহ্বান পৌঁছিয়েছে। এ ব্যবস্থা আমি এ জন্যে করেছি , যাতে করে সে খুব সুন্দর করে পরিস্কারভাবে তাদের বুঝতে পারে।” এ আয়াত থেকে আমরা ভাষা শেখার গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারি। ইসলামের ইতিহাস থেকে জানা যায়, রাসূল (সা) তাঁর নিযুক্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী যায়েদ ইবনে সাবেত আনসারীকে ইহুদীদের ভেতর দ্বীনের দাওয়াত দেয়ার জন্যে তাদের ভাষা হিব্রু শিখতে বলেন। যায়েদ (রা.) মাত্র তের দিনে হিব্রু ভাষা আত্মস্থ করেন।
বন্ধুরা, ভাষা শেখার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি জানলাম। রংধনু আসরে আমরা ভাষা না জানলে কী ধরনের সমস্যা হতে পারে সে সম্পর্কে একটি গল্প প্রচার করেছি। গল্পটি নেয়া হয়েছে মাওলানা রুমীর বিখ্যাত গ্রন্থ মসনবী থেকে।
একবার এক শহরে চার দেশের চারজন ভিক্ষুক একত্রে মিলিত হলো। তারা কেউ কারো ভাষা বুঝতো না। কেবল ভাষাগত দিক থেকেই নয় বরং বর্ণ এবং জাতিগত দিক থেকেও এদের একজন আরেকজন থেকে ছিল আলাদা। ভিক্ষুকদের একজন ছিল ইরানী, একজন ছিল আরব, অপরজন ছিল তুরস্কের আর বাকিজন ছিল গ্রীক দেশীয়। কেউ কারো ভাষা না জানলেও আকারে-ইঙ্গিতে ভাব বিনিময় করতো তারা। যা কিছু দেখতো তা-ই নিজ নিজ ভাষায় একে অপরকে শেখাতো। যেমন-ইরানী ভিক্ষুক পানি দেখিয়ে বলতো, ফার্সিতে একে বলে ‘অব’। আরব বলতো, আমরা একে বলি ‘মা’। তুর্কী ভিক্ষুক জানাতো তাদের দেশে একে বলে ‘সূ’। এভাবেই তারা পরস্পর ভাব ও ভাষার আদান-প্রদান করে ঘনিষ্ঠ হতে লাগলো।
একদিনের কথা। দুপুরে চার ভিক্ষুক এক জায়গায় এসে জড়ো হলো। যার যার খাবারের পুঁটলী খুলে রাখলো সামনে। সবার হাতেই এক টুকরো করে রুটি। ইরানী ভিক্ষুক বলল :
ইরানী : “আমি বাপু এ রকম শুকনো রুটি খেতে পারিনে। গলা দিয়ে নিচে নামতেই চায় না। আমার কাছে টাকাও নেই যে, আঙ্গুর বা অন্যকিছু কিনে রুটির সাথে মিশিয়ে খাবো। যদি কারো কাছে টাকা-পয়সা থাকে তাহলে কিছু একটা নিয়ে এসো। আগামীকাল না হয় আমি তোমাদের পুষিয়ে দেব।”
ইরানী ভিক্ষুকের কথা শুনে বাকী তিন ভিক্ষুক জানালো তাদের হাতেও কোনো টাকা-পয়সা নেই। কী আর করা! উপায়ন্তর না দেখে সবাই শুকনো রুটিই চিবানো শুরু করলো। ঠিক এ সময় ঐ পথ দিয়ে যাচ্ছিলো এক পথিক। ভিক্ষুকদের শুকনো রুটি খেতে দেখে তার মনে দয়া এলো। পথিক পকেটে হাত দিয়ে কয়টি টাকা দিলো একজনের হাতে। টাকা পেয়ে ভিক্ষুকরা খুশী হয়ে পথিকের জন্য দোয়া করলো।
পথিক চলে গেলে ইরানী বললো :
ইরানী : বন্ধুরা! টাকা তো আমাদের হাতে এসে গেছে। চলো এ টাকা দিয়ে বাজার থেকে আঙ্গুর কিনে আনি। আঙ্গুর দিয়ে রুটি খেতে খুব মজা!
কিন্তু অন্য তিনজন বেঁকে বসলো। তাদের একজন বললো, আমরা আঙ্গুর খাব না।
আঙ্গুর আবার খাওয়ার জিনিস হলো নাকি!
ওরা আসলে আঙ্গুর কি ধরনের ফল তা জানতো না। আরব লোকটি তখন বললো :
আরব : আঙ্গুর বাদ দাও। তারচে বরং ‘ইনাব’ কিনি।
এমন সময় তুর্কী ভিক্ষুক বাধ সাধলো। সে বললো:
তুর্কী : আমি বাপু ‘ইনাব’ খেতে চাই না। তোমরা যদি আমার মতামত চাও তাহলে আমি বলবো-ওযোমের কথা। ওযোম খুবই মজার এবং সুস্বাদু একটি ফল।
বাকি থাকলো আর গ্রীক ভিক্ষুক। শেষ পর্যন্ত সেও অন্য সবার মত্ অগ্রাহ্য করে ‘ইস্তাফিল’ খেতে চাইল। এ সময় ইরানী ভিক্ষুক বললো :
ইরানী : আরে বাবা! এক দিনে কি সবার মন রাখা যাবে? তারচেয়ে তোমরা বরং আমার কথা শোন। আমি হচ্ছি তোমাদের সবার চেয়ে বয়সে বড় এবং অভিজ্ঞ। আমিই বলছি আঙ্গুর ফল খেতে খুব সুস্বাদু। আজ না হয় আঙ্গুরই খাই।
এ কথা শুনে আরব লোকটি রেগে গেল । সে বলল :
আরব : তুমি বড় হয়েছো তো কি হয়েছে? রেখে দাও তোমার মুরুব্বীয়ানা। তাছাড়া জানোইতো আরবরা কারো কাছে মাথানত করে না। আমার কথা খুবই স্পষ্ট- আজ আমরা ‘ইনাব’ই খাব।
এ কথা শুনে তুর্কী বেচারার ধৈর্য ভেঙ্গে গেল। সে বলল :
তুর্কী : দয়া করে এখানে আরব-আজমের ঝগড়া বাধাবে না। যদি ঝগড়া করার প্রশ্নই ওঠে, তাহলে জেনে রাখো-তোমাদের মতো দু’চারজনকে কুপোকাত করার মত শক্তি আমার গায়ে আছে। আমি তুর্কী, কাউকে সমীহ করা তুর্কীদের কাজ নয়। তর্ক যখন বেধেছে তাহলে জেনে রাখো- ওযোম ছাড়া অন্য কিছুই খাব না।
এবার গ্রীক ভিক্ষুক মুখ খুললো। সে বলল :
গ্রীক : আহ্হা। কেন তোমরা রাগারাগি করছো? তারচেয়ে চলো-এ টাকা ভাগাভাগি করে কিছু আঙ্গুর, কিছু ইনাব, কিছু ওযোম আর কিছু ইস্তাফিল কিনে আনি। ঝগড়া করার কি আছে বুঝতে পারলাম না।
আরব ভিক্ষুক তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল :
আরব : এখানেও ফিরিঙ্গিবাজী করতে চাও-তাই না? ‘ভাগ কর, শাসন কর’- এ নীতি তোমাদের ইউরোপীয়দের এক ধরনের দুর্নীতি। তা এখানে চলবে না। আমরা সবেমাত্র একে অপরের বন্ধু হয়েছি। এখানে ওই ফিরিঙ্গিপনা বাদ দাও।
আরব ভিক্ষুকের কথায় গ্রীক বেচারার মেজাজ গেল বিগড়ে। সে চেঁচিয়ে ওঠে বললো:
গ্রীক : ফাজলামী শুরু করেছো-তাই না? ফিরিঙ্গিদের সঙ্গে লাগতে আসবে হিসাব করে। বেশি বাড়াবাড়ি করলে থাপ্পড় দিয়ে তোমার দাঁত ফেলে দেব।
ব্যস, শুরু হয়ে গেল-তর্ক-বিতর্ক, শোরগোল ও চেঁচামেচি। সে সময় ঐ পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন এক বৃদ্ধ। ভিক্ষুকদের ঝগড়াঝাটি শুনে তাদের কাছে এগিয়ে এলেন। তিনি তাদের কাছে ঝগড়ার কারণ জানতে চাইলেন।
ভিক্ষুকরা বৃদ্ধকে বললো-আমাদের একজন চায় আঙ্গুর, একজন চায় ইনাব, একজন ওযোম আরেকজন চায় ইস্তাফিল। কিন্তু আমাদের কাছে যে টাকা আছে তা দিয়ে সব তো কেনা যাবে না। কিন্তু কেউ কারো কথা রাখছে না। ঝগড়ার এটাই কারণ।
বৃদ্ধ ছিলেন লেখাপড়া জানা মানুষ। তিনি আরবী, ফার্সি, তুর্কী আর গ্রীক ভাষাও মোটামুটি জানতেন। ভিক্ষুকদের কথা শুনে বৃদ্ধ লোকটি অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন। বৃদ্ধকে হাসতে দেখে ভিক্ষুকরা আশ্চর্য হয়ে গেল। তারা হাসির কারণ জানতে চাইলে বৃদ্ধ বললেন :
বৃদ্ধ : আমি হাসছি তোমাদের বোকামী দেখে। তোমরা যদি জানতে আঙ্গুর, ইনাব, ওযোম আর ইস্তাফিল একই ফল তাহলে নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করতে না। তোমরা একে অপরের ভাষা জানো না বলেই এই সমস্যা হয়েছে।
বৃদ্ধের কথা শুনে সবার মুখে হাসি ফুটে উঠলো। তারাও স্বীকার করলো- কেউ কারো ভাষা না বুঝার কারণেই এ রকম পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এরপর তারা সবাই মিলে আঙ্গুর ফল কিনে সবাই মিলে মজা করে খেলো।
ওই ঘটনার পর চার ভিক্ষুকের মধ্যে সম্পর্ক আরো গভীর হলো। তারা পরস্পরের ভাষা শেখার সিদ্ধান্ত নিল। কয়েক বছরের মধ্যেই তারা ভাষা শেখা শেষ করলো এবং সবাই মিলে চার ভাষায় অভিধান তৈরির কাজ শুরু করলো। #