ভালবাসা শূণ্য

আঁকা-বাঁকা নদীর স্রোতে ভেসে বেডানো খড-কুটোর মত আমারো ডিম্বাকার পৃথিবীর কোথাও স্থান হচ্ছেনা। এই তীরে ধাক্কা খেয়ে ওই তীরে; সেখান হতে অন্য তীরে, ওখানেও নয়! কোথাও নয়। আমার বয়েস আমার মা’র মতে নয় ছুঁই ছুঁই অবস্থা। যখন আমি আমার বাবার নিয়ন্তিত নীরব আয়েশি নদীতে সুখের ভেলা ভাসিয়ে কিশোরত্বের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলাম। আবার আমার দৃষ্টি হারানো দাদীর মতে তখন নাকি আমার বয়েস দশ পার হয়ে এগারোতে পদার্পণ করেছিল। কার মন্তব্যটা ধণাত্মক এখন আর তা জানার দরকার পড়েনা। অবশ্য মাঝে মাঝে যখন পথে-ঘাটে কেউ জানতে চায় বয়স কত?… তখন আমি নিরুত্তর থেকে ভ্যাবা-চ্যাকায় পডতে বাধ্য হই। ভেবে উঠতে পারিনা, মা’র নাকি দাদীর মন্তব্য প্রকাশ করব। ইশ..বাবা যদি আলসেমি না করে জন্ম তারিখটা দেয়ালের বুকে কচু পাতা দিয়ে লিখে রাখত তাহলে আজ এই দশা হতনা আমার। যাই হোক মুলত: যখন সুখ নামক অদৃশ্য বস্তুটা আমাকে অক্টোপাসের মত ঘিরে রেখেছিল, তখন থেকে একটু পরের এবং বর্তমান অবদিকার কথা গুলো স্মরণ করছি। আমি উঠানের ঈষাণকোনে পাশের বাডির আমার জনৈক চাচাতো ভাইয়ের সঙ্গ নিয়ে বৈশাখী মেলা থেকে বাবার কিনে দেয়া হরেক রকমারি খেলনা দিয়ে খেলা করছিলাম। হঠাৎ গেটের বাহির থেকে ব্যস্ত স্বরে কে যেন ডেকে বল্লেন, ‘ভাবি… ভাবি… গেট খোলেন; সর্বনাশ হয়ে গেছে!…. বুঝতে পারলাম,

 
ইনি আমার বাবার ঘনিষ্ঠ বন্ধু আদুরে মাওলা আঙ্কেল। মা রান্না ঘর থেকে দৌডে আসার আগেই আমার খেলার সঙ্গী চাচাতো ভাইটা গেট খুলে দিল। আমি মাটি ল্যাফটিয়ে বসেছিলাম; এখনো বসে আছি। মাওলা আঙ্কেল ভিতরে ডুকতেই মা জিজ্ঞেস করলেন – ‘কি হল মাওলা ভাই, আপনি এত কাঁপছেন কেন?’ মাওলা আঙ্কেল হাউমাউ করে কঁেদে বললেন – ‘ভাবি আপনি হাসপাতালে চলুন; আপনার স্বামী এক্সিডেন্ট করেছে!… মা আঁচলে মুখ চেপে কঁেদে উঠলেন। একটু স্তব্ধ হলেন। শিথিল হয়ে দৌডে ঘরে ডুকে বোরকা পডে বের হলেন। অত:পর আমার হাত ধরে বললেন ‘তুইও যাবি, চল’। বিশ মিনিট লাগল বোধহয় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স অবদি পৌঁছাতে। বাবার বেডের পাশে দাঁডিয়ে কে কি দেখতে পেল তা আমার বোধগম্য নয়। আমি যা দেখেছি, সেটি হল- “রক্তাক্ত একটি দেহ; যেটির হাত সহ ডান পাশ্বটা চুর্ণ-বিচুর্ণ এবং গালে রক্ত জমাট বাঁধার ফলে চেনা মুশকিল”! হ্যাঁ…. আমার বাবার মৃত্যু হয়েছে। মা নিস্তেজ হয়ে গেলেন। অচেতন মা’কে আগে-আগে বাড়ি প্রেরণ করে দেয়া হল, সাথে আমিও ফিরলাম। ধিরে ধিরে আত্মীয়-স্বজনেরা আসতে লাগলেন শোকের খবরে। ফুফুরা আমাকে জডিয়ে ধরে কান্না আর বিলাপে বললেন -পোড়া কপাল! তোর কি হবেরে এবার..তোর কি হবে”!… ফুফুদের কথার মর্মার্থ তখন বুঝতে ব্যার্থ হলেও, একখন সম্পূর্ণ ভাবে উপলদ্বি করতে পারি। রাত দশটার সময় বাবার লাশ আসলো বাডিতে। সডক দুর্ঘটনায় জরাকীর্ণ হওয়া দেহটার উপর আরেকবার আঘাত হানলো “পোস্টমর্টেম” শব্দটা। এটা আমার বাবা নয় যেন! “লাশ” নাম ধরে একটা দেহ আসলো বাডিতে। পরদিন সূয্য যখন মাথা বরাবর অবস্থান করছিল, ওই সময় ধর্মীয় বিধি মতে বাবাকে কবরস্থ করা হল। আর এর সাথে সাথেই আমার সুখ রবিটা পশ্চিমে হেলান না দিয়ে বিপরীত দিকেই মুখ করে নিল। এখনো আর রবির দেখা পাইনি। বাবার সঞ্চিত টাকা পয়সা যতক্ষন ছিল, মা’ও ততদিন পর‌্যন্ত আমাকে স্নেহ দিলেন। সম্পদ পুরাবার সাথে সাথে যেন আমার মাতৃ স্নেহও পুরিয়ে গেছে!… মা অন্যত্র বিয়ে করে নিজের সুখের নতুন আবাস গড়ে নিলেন। এতিম ছিলাম; এখন আরেকটু বড মাপের এতিম হলাম। মনে হল,বেদনার অভাব নাই। বোধহয় প্রশান্তে রাখলে তাও ঠাসা ঠাসা হবে। বাবার বিটে’য় এখন আমি আর আমার দৃষ্টিহীন দাদী অবশিষ্ট আছি। আমার বাবা ছাডা দাদির আর কোন পুত্র সন্তান নেই। সুতরাং ফুফুরা দাদির দায়িত্ব নিলেন। মাঝে মাঝে এসে দাদিকে খরচার জন্য কিছু টাকা এবং চাল-ডাল কিনে দিয়ে যান। দাদি-নাতি মনে হল মোটামুটি আনন্দ বিষাধে আছি। বাবা বিয়োগ, তারপর মা অন্যত্র ঘর বাঁধলেন। এবার শেষ তরীটাও গেল ডুবে; দাদী বিয়োগ! এই ক্রান্তিকালে ছোট ফুফু এগিয়ে আসলেন। মাথায় হাত রেখে বললেন- ‘জন্মের পর প্রথম চোখ মেলে কার চেহারা দেখেছিলিস? হতভাগা!… কি করবি তুই- আমার সাথে চল; তাই গেলাম। কিন্তু ফুফা যেন আমাকে তাঁর বাড়ির এরিয়াতে পেয়ে ক্রমাগত তার অলসতার পরিমান বাড়াতে লাগলেন: বাজারের কেনাকাটা থেকে শুরু করে, মাঠ থেকে গরু আনার দায়িত্বটা পর‌্যন্ত আমার ঘাঁডে বোঝাই করে দিলেন অনুরোধের ছল করে করে। ফার-ফরমায়েশ আর ভাল লাগেনা। তাই একদিন ওঁনাদের কাউকে কিছু না জানিয়ে পাড়ি জমালাম ফাতেমা খালার বাডী; মা’র আপন ছোট বোন তিনি। কোথাও বুঝি আমার সুখ নেই, এখানেও নয়। মনছুর ভাইয়া কথায়-কথায় চড-কিল-ঘুষি-লাত্থি লাগিয়ে দেন আমার এই পুষ্টিহীন শরীরটায়। ভাল লাগেনা। গেলাম বড় ফুফুর বাডি। এখানে ফুফু ছাডা কাজের মেয়ে একটা ব্যাতীত অন্য কেউ নেই। ফুফা এবং সরওয়ার ভাইয়া ঢাকা থাকেন। ফুফা ব্যবসা করেন আর ভাইয়া কি একটা দামী কলেজে পডেন। খুব ভাল লাগে এখানে।

 

ফুফু বললেন – বছরটা ফুরিয়ে যাক, আগামী বছরের শুরুতে তোকে স্কুলে ভত্তি করিয়ে দিব’। ফুফুর কথায় যেন দু:খাক্রান্ত খরস্রোতা নদীতে হারিয়ে যাওয়া সুখের ভেলা টার পুন:জাগরিত হতে লাগল, আমি আবার পড়া-লেখা করব; এই আশাতে। আসলে তা নয়, আমি সত্যি হয়ত ভুলে গিয়েছিলাম যে-বাবাকে হারানোর পর আমার সুখের ভেলায় ছারপোকার দল নিবাস গড়েছে এবং ভেলায়া আস্তে আস্তে ধ্বংস হচ্ছিল ঘুনে ধরার ফলে। বছর ফুরিয়ে নতুন বছর আসার আগে আমার ফুফুর বাডিতে হঠাৎ কোত্থেকে একদিন যেন মার্কিন ড্রোন বিমানের মত আমার মেজ মামা এসে হাজির! ফুফুকে মামা বললেন-আমি চাইছিলাম রিক্তকে আমার কাছে নিয়ে যেতে, বাপ হারা এতিম ছেলেটা; পড়া-লেখা কিছুই হচ্ছেনা। জীবনটার ষোলো আনা’ই বরবাদ হচ্ছে দিনে দিনে। রিক্তর দেখা-শোনার দায়িত্ব আমি নেওয়াটা অতীব জরুরী। ফুফু অমত করলেন না; মামার সাথে আমাকে যেতে দিলেন। বহুদিন পর মামা বাড়ী এসেছি, বেশ আনন্দ লাগছে। প্রথম কয়েকদিন খোশেই কাটল আমার। তারপর থেকে নিত্যদিন মামার দু’টো চা দোকানের যেকোন একটাতে সূর্য উঠার লগন হতে রাত নয়টা অবদি চা-রুটি, সিঙারা-ফুরি ইত্যাদি দোকানে বসা ভাল-খারাপ, খারাপ-ভাল, নানান রঙের, নানানঢ়ঙের মানুষ গুলোকে পরিবেশন করছি আর মাঝে মাঝে কাপ অথবা গ্লাশ হাত খশকে পড়ে ভেঙে ফেলার অপরাধে আমার সাবেক সুখের তরী মরহুম পিতাকে দু’চারটা গালি জুডিয়ে দিচ্ছি। মামা তার কথা অনুযায়ী আমাকে তাদের এলাকার নামকরা একটা মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিলেন। অংক ইংরেজীর আগা-মাথা কিছুই বুঝিনা। তবুও সু-সংবাদ। আমি আবার বিদ্যালয়ের আঙ্গিনায় পা রাখতে পেরেছি। খুব সৌভাগ্যের ব্যাপার। কিন্তু এরপর বড় সংবাদটা হল-দু’মাস মিলে একদিনও মনে হয়না আমি ক্লাশে যেতে পারি। যাবই’বা কেমন করে? আমি যে মামার চা দোকানের কর্মচারী। সারাদিন এবং রাতের এক তৃতীয়াংশ ওখানেই কাটাতে হয়। কোন বেতন নাই, শুধু থাকা খাওয়া!… তবে থাকা খাওয়াটা পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে হয় কারণ, আমি মালিকের আপন ভগ্নির ছেলে! ভাল লাগেনা। কিন্তু যাব কোথায়? সব আত্মীয়ের বাডীতে ঘুরেই এসেছি। বড় ফুফুকে ছাড়া আর আর কাউকে ভাল লাগেনি, ভালবাসতে শুধু তিনিই পেরেছিলেন আপন ভাইপোকে। ভাল না লাগলেও এখন আর কোথাও যাবার মন-মানসিকতা নেই। এখন শুধু মাঝে মাঝে দীর্ঘসশ্বাষের সাথে বলি-বাবা, তোমার রিক্তের শুন্যতা কি কখনো ঘুছবেনা? নাকি আজীবন রিক্তই থেকে যাবে ভালবাসার অভাবে?

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!