ভালবাসার সাতকাহন (ধারাবাহিক গল্পঃ পর্ব-২)

কিছু মানুষ রয়েছে, যারা মনে হয় জন্ম থেকেই ধুরন্ধর—অর্থাৎ শিয়ালের মত একধরনের ধূর্তামি তাদের ডিএনএ-তে বহন করে পৃথিবীতে আসে। প্রতিটি পদক্ষেপে তাদের এই পণ্ডিতমন্য গুণ চমকাতে থাকে। এরকম কয়েকজন মানুষের দেখা পেল রায়হান, শমশেরনগর আবাসিক এলাকায় যখন ওদের তিনজনের পরিবার শিফট হয়ে এলো।

এদেরই একজন জসীম নেতা। নিজেই চালাকি করে নামের শেষে ‘নেতা’ টাইটেল লাগিয়ে নিয়েছে। এখন নেতা হোক বা না হোক, নেতার গুণ থাকুক বা না থাকুক—মানুষ তো নেতাই ডেকে চলছে।

‘এই, কই যাও?’
– জসীম নেতার বাড়ি।

কিংবা—

‘ভীষণ সমস্যায় পড়লাম, কি করি ভাই বলতো?’
– এ্যাতো টেনশন করস ক্যারে? জসীম নেতার কাছে যাস না।

এভাবে মানুষ স্বাভাবিকভাবেই নিজের অজান্তে জসীম নামের একজনকে ‘নেতা’ নামে ডাকতে ডাকতে তাকে মনের অগোচরেই নেতার আসনে বসিয়ে দেয়। যেভাবে এই আবাসিক এলাকার এই কূটিল মানুষটিকে সবাই বানিয়ে দিয়েছে।

সে অনেক কাহিনী।
আপনারা ধীরে ধীরে সবই জানবেন। আজই তো রায়হান এসেছে এই এলাকায়।

নিজের এক চরম দুরাবস্থায় চাকরিহীন রায়হানকে ঢাকার বাসা ছেড়ে দিয়ে উপজেলার এই নির্জন গ্রাম্য পরিবেশে চলে আসতে হয়েছে। একজনের ফেলে রাখা প্রায় পরিত্যক্ত জায়গায় অনেকটা ‘কেয়ারটেকার’ হিসেবেই থাকবে সে। অন্তত বাসা ভাড়া দিতে হবে না। আর কয়েকটি রুম করে দেবেন বলেছেন ওই জায়গার মালিক। সেগুলো থেকে ভাড়া যা আসবে, তা দিয়ে এই জায়গাটির রক্ষণাবেক্ষণ করায় ব্যয় করতে পারবে সে। ভিতরে অনেক জায়গা রয়েছে। চাইলে শাকসবজির আবাদও করতে পারবে।

বাহ!
মাস্টার্স কমপ্লিট করে শেষে একজন চাষী হতে যাচ্ছে রায়হান।

একজন সাধক।
শুধুই কি সাধক? অনেক বড় সাধক। ঐ যে, একটা কবিতা আছে না—

‘সব সাধকের বড় সাধক
আমার দেশের চাষা
দেশ মাতারই মুক্তিকামী
দেশের সে যে আশা।’

তবে সে হতে যাচ্ছে একজন আধুনিক চাষী। এই শব্দটি থেকে ঈ-কারের জায়গায় আ-কার দিলেই কেমন অর্থটা বদলে যায়! রুমাকে একথা বলতেই কেমন যেন চোখ পাকিয়ে তাকিয়েছিল রায়হানের দিকে।

আর তাকাবেই বা না কেন?
রুমার বিদেশে অবস্থানরত মামার বদৌলতেই তো বিনা-পয়সায় এই থাকার জায়গাটুকু পেয়েছে ওরা। নাহলে কে আজকাল একেবারে মুফতে থাকার জায়গা দেয়? তাও আবার কয়েকটি এক্সট্রা রুম করে দেবেন ভাড়া দেবার জন্য। সেই টাকাগুলোও ওদের কাজে লাগাতে পারবে।

ট্রাক থেকে সব মালামাল বুঝে নামিয়ে ট্রাক বিদায় করে দিতে দিতে সেই দুপুর পার হয়ে গেল। মালামাল নামাতে গিয়ে ড্রেসিং টেবিলের অনেক পুরনো বেলজিয়াম কাঁচের আয়নাটা চুরমার হয়ে গেল। আর রায়হানের একটি ব্লেজার নাই হয়ে গেল। কিভাবে হল, তা নিয়ে মাথা ঘামাবার সময় নেই এখন আর। ক্ষুধায় পেট চোঁ চোঁ করছে। আর এখানে গ্যাসের লাইন এখনো আসেনি। আপাতত স্টোভে রান্না করতে হবে কয়েক বেলা। গ্যাসের সিলিন্ডার কিনে তারপর স্থায়ী বন্দোবস্ত।

মিতু পুরো জায়গার ভিতর একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছে। সবে চার বছরে পড়েছে। রায়হান আর রুমার এই একটিই মেয়ে। ওদের দুজনের অস্তিত্ব। সকল কিছুর কেন্দ্র। মিতুকে ঘিরেই দুজনের সকল পথচলা। তাই তো সময়ের ফেরে রাজধানীর ফাস্ট লাইফে অভ্যস্ত একটি পরিবার আপাতদৃষ্টিতে নিরিবিলি এক গ্রাম্য পরিবেশে আসতে বাধ্য হয়েছে। চার বছরের মিতু খুব এক্সাইটেড। ওর কাছে নতুন এই জায়গাটি তার নবরূপের প্রথম দর্শনধারী গুণের মায়ার চমক দেখিয়ে ওকে ওর কচি মনে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করা শুরু করেছে ইতোমধ্যেই।

নতুন জায়গায় কেউ এলে নানান রঙের মানুষ দেখতে আসে—কারা এলো।
কেউ একটু বাজিয়ে দেখে। কেউবা মাপতে আসে। উদ্দেশ্য নিয়ে আসে অনেকে। কেউবা হুদাই কামে আসে।

এরকম একজনকে রায়হান দেখতে পেল মিতুর সাথে কথা বলছে। রায়হানের থেকে কয়েক বছরের ছোট হবে এমন একজন এবং মিতুর কিছু কথাবার্তা—

‘কি নাম তোমার বাবু?’
– মিতু।
‘বাহ! সুন্দর নাম।’
– থ্যাংক ইউ আংকেল।
‘তোমরা আগে কোথায় থাকতে?’
– রামপুরায়।
‘এখানে চলে আসলে কেন?’
– পাপার চাকরি নাই। টাকাও নাই।

আলোচনার এমন ক্লাইম্যাক্স অবস্থায় রুমার ডাকে মিতুকে চলে যেতে হয়। স্বল্পপরিচিত আংকেলকে বাই বলে মিতু মায়ের কাছে চলে যায়। মিতুর এই আংকেলটি এলাকায় নতুন আসা এই ছোট পরিবারটির ভিতরের আসল খবরটি জেনে ফিরে যায়। অনেক কাজ বাকি রয়ে গেছে তার। পেটটাও কিছুটা ফুলে গেছে। নতুন পরিবারটির সম্পর্কে পাওয়া খবরগুলো ‘যায়গামতো’ পৌঁছে দিতে না পারলে শান্তি হচ্ছে না।

এই ধরনের লোক হল ‘রয়টার’ টাইপ। এরা খবরাখবর দ্রুত পৌঁছাতে বেশ উস্তাদ।

ঘণ্টাখানেকের ভিতরেই শমশেরনগর আবাসিক এলাকার অধিকাংশ বাড়ির মালিকদের জানা হয়ে গেল যে, ঢাকার রামপুরায় থাকত এমন একটি পরিবার এই এলাকায় থাকতে এসেছে—যার কর্তা ব্যক্তিটি বেকার। সুন্দর একটি বউ রয়েছে। আর পুতুলের মত একটি মেয়ে। কিন্তু এরা সহায়-সম্বলহীন।

বিকেলের দিকেই সবাই রায়হানদের থেকে সকল আগ্রহ হারিয়ে ফেলল।

সমাজে অর্থ-বিত্ত এমনই একটি ফ্যাক্টর।
মানুষের আগ্রহকে ধরে রাখে এই জিনিসটি।
যেটি রায়হানের ঠিক এই মুহূর্তে নাই।

তাই সকলের চিন্তা-ভাবনায়ও রায়হান নামে কেউ ‘কিছুই’ দাগ কাটার মত রেখে যেতে পারল না।

সে প্রথম দর্শনে স্রেফ নাই হয়ে রয়ে গেল এই আবাসিক এলাকার বাসিন্দাদের কাছে।

(ক্রমশ:)

 

পরের পর্ব টি পড়তে ক্লিক করুন

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!