রাশেদুল করীম সাহেব মোবাইল হাতে বারান্দা থেকে নিজের রুমে চলে এলেন। বিছানায় বসে আয়েশা বেগম কিছু একটা দেখছিলেন। তিনি ঢুকতেই জিনিসটা লুকানোর চেষ্টা করলেন। রাশেদুল করীম হাসিমুখে আয়েশা বেগমের পাশে এসে বসলেন। আয়েশা বেগম জিজ্ঞেস করলেন—
: কী ব্যাপার? এত খুশি লাগছে কেন তোমাকে?
তিনি বউয়ের দিকে তাকালেন। মোবাইল হাতে নিয়ে বললেন—
: শাহেদকে ফোন করেছিলাম।
আয়েশা আনন্দের কারণ জানলেন। তবে ছোট ছেলে শাহেদের সাথে কথা বলাটাই মুখ্য কারণ হতে পারে না। নিশ্চয়ই অন্য কিছু রয়েছে। কিন্তু কী হতে পারে সেটাই ভাবতে থাকেন। একটু আনমনা হয়ে পড়েন। আর সেই সুযোগে যে জিনিসটি স্বামীর কাছ থেকে লুকানোর চেষ্টা করছিলেন, সেটিই উন্মুক্ত হয়ে পড়ল।
একটা অ্যালবাম।
: আবারও তুমি ওকে দেখছিলে?
রাশেদ সাহেবের কথায় আয়েশা একটু চমকালেন। প্রথমটায় ঠিক বুঝে উঠতে পারলেন না। কিন্তু স্বামীর দৃষ্টিকে লক্ষ্য করে বিছানায় শাড়ির আঁচলের নিচ থেকে বের হওয়া বড় ছেলে রায়হানের হাসিমুখ নজরে পড়ে। দুজনে দুজনের দিকে তাকান। রাশেদ সাহেবের চেহারায় একটু আগের আনন্দের লেশমাত্রও নেই। কিন্তু তাঁর চোখ সে কথা বলছে না। আয়েশা বেগম বুঝে উঠতে পারলেন, স্বামী যা বলছেন সেটাই আসল কথা নয়। রাশেদ সাহেবের প্রশ্নকে উপেক্ষা করে জিজ্ঞেস করলেন—
: কী বলল শাহেদ? সবাই ঠিকমতো পৌঁছেছে?
: হ্যাঁ। অফিসে ছিল যখন কথা বলছিলাম। কিন্তু তুমি আমার প্রশ্নের জবাব দিলে না?
: যে প্রশ্নের কোনো জবাব হয় না, সেরকম প্রশ্ন কেন কর?
আয়েশা অ্যালবামটা হাতে তুলে নেন। পরম মমতায় ছেলের ছবির উপর দিয়ে মুখে হাত বুলান। হৃদয়ের মমতা হাতের স্পর্শের ভেতর দিয়ে ছেলের ছবিতে স্থানান্তর করার চেষ্টা করেন। চারশো কিলোমিটারেরও অধিক দূরত্ব পেরিয়ে ছেলে কি তা অনুভব করে?
হয়তো!
হয়তো করে না।
কিন্তু মায়ের সাথে যে নাড়ির সম্পর্ক!
আজ হয়তো পরিবারের সদস্যদের উপর রাগ করে মায়ের থেকে সে দূরে সরে আছে, কিন্তু এই টেলিপ্যাথিক সম্পর্ক—যাকে এখনো আধুনিক বিজ্ঞান পুরোপুরি ব্যাখ্যা করতে পারেনি—সেটা দূরত্বের বাধা অতিক্রম করে দু’টি হৃদয়কে সবসময়ই কাছে রাখে।
আজ দশটি বছর ছেলে কাছে নেই!
মোবাইলেও কথা হয় না। তবু কি দুজন দুজনের কাছে ‘আউটসাইডার’?
রাশেদ সাহেব একটু অবাক হন। আজ কী হল তাঁর অর্ধাঙ্গিনীর? স্ত্রীর হাত দুটো আলগোছে নিজের হাতে তুলে নেন। এতগুলো বছর একসাথে পথ চলে… তিল তিল করে জমে ওঠা সমঝোতা এবং সীমানা পেরিয়ে একে অন্যের হয়ে যাবার গভীর ভালোবাসার অফুরন্ত যে খনির সন্ধান দুজনে পেয়েছেন—সেখান থেকে কিছু প্রগাঢ় ভালোবাসা তুলে আনেন। নিজের হৃদয়ের সর্পিল পথ ধরে সেই ভালোবাসা অর্ধাঙ্গিনীর হৃদয়ের চেনা পথটি দিয়ে স্ত্রীর মনের গহীনে ঢেলে দেবার চেষ্টা করেন।
স্বামীর স্পর্শে মুখ তুলে তাকান আয়েশা বেগম।
জীবনের এতোগুলো পথ পেরিয়ে আজ এই স্পর্শ যদিও তাঁকে শিহরিত করে তোলে না।
কিন্তু এক পরম নির্ভরতার অনুভূতি লাভ করেন।
কেউ আছে!
অতি কাছে!
যে ভালোবাসে!
এমন অপার্থিব অনুভূতি!!
কোনো ভাষা যাকে প্রকাশ করতে পারে না। এ কেবলই অনুভব করা যায়।
রাজধানী থেকে বহুদূরে এক মফস্বল শহরে এক মা এই মুহূর্তে ঠিক এমনই এক অনুভূতিতে প্রগল্ভ হয়ে পড়েন।
: তুমি রায়হানের নতুন বাসার কথা শাহেদকে বলেছ, না?
মুহূর্তে আয়েশা বেগমের হাত ছেড়ে দেন রাশেদ সাহেব।
একজন অভিমানী বাবা!
জীবনের শেষপ্রান্তে এসে রিক্ততার গোলকধাঁধায় কিছুটা বিপর্যস্ত এই ষাটোর্ধ্ব মানুষটি নিজের অর্ধাঙ্গিনীর কাছে ধরা পড়ে গিয়ে নিজের ভেতরের অদৃশ্য ছদ্মাবরণে নিজেকে ঢেকে নিতে আপ্রাণ চেষ্টা করেন।
কিন্তু পারেন কি?
ঘরের দক্ষিণের জানালার বাইরে তখন শেষ বিকেলের আলো অপূর্ব বর্ণচ্ছটায় চারপাশকে ধুয়ে দিতে চাইছে! সেদিকে তাকিয়ে রাশেদ সাহেব নিজের ভেতরটাও ধুয়ে ফেলতে চান।
কিন্তু কতটা পারেন?
পারেন না।
পারেন না বলেই দু’ফোঁটা অশ্রু চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে।
নিজেকে লুকাতে চেয়ে নীরবে রুম থেকে বেরিয়ে যান। আর ঠিক তখনই স্বামীর একটু আগের আনন্দের কারণটিও আয়েশা বেগমের জানা হয়ে যায়।
বড় ছেলেটি যে রাশেদ সাহেবের কত প্রিয় তা তাঁর বাহ্যিক কঠোর আচরণে অন্য কেউ না বুঝলেও তিনি তো জানেন। কিন্তু মানুষটা তাঁর কাছ থেকেও অনুভূতিগুলো কেন লুকাতে চান সেটা বুঝতে পারেন না।
মাগরিবের নামাজের প্রস্তুতি নিতে তিনিও বিছানা ত্যাগ করেন।
রায়হান নামের ছেলেটার হাসিমুখ ছবির অ্যালবামে রয়ে যায়… বিছানার উপর। এই একই ছবি ওর দুজন প্রিয় মানুষের হৃদয়েও যে একই রকম গাঁথা রয়েছে, শত শত মাইল দূরে থেকে রায়হান কি তা অনুভব করে?
… … …
মিতুকে আজ নার্সারিতে ভর্তি করে দিয়ে আসা হয়েছে।
এইমাত্র ওরা তিনজন নতুন বাসায় ফিরল। মিতু খুবই উত্তেজিত! স্কুলটি ওর খুব পছন্দ হয়েছে। স্কুলের নামটাও খুব সুন্দর।
‘কলতান বিদ্যানিকেতন’।
শমশেরনগর আবাসিক এলাকাটি একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথেই। দেশের অন্যতম বিখ্যাত আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানকারই কয়েকজন শিক্ষকের স্ত্রী মিলে এই কেজি স্কুলটি চালাচ্ছেন। বেশ নামডাক রয়েছে।
রুমা খুব খুশি। ইতোমধ্যে সে তার নতুন সংসার বেশ গুছিয়ে নিয়েছে। ওদের প্লটটি এই আবাসিকের সবচেয়ে বড় প্লট। পনের শতাংশ জায়গা এখানে।
রুমার মামা পুরো জায়গাটিকে প্রথমে উঁচু বাউন্ডারি ওয়াল দিতে বললেন। প্রতিদিন রাত ন’টায় ওদের সাথে তিনি আমেরিকা থেকে মোবাইলে কথা বলেন। ঘড়ি ধরে বাংলাদেশ সময় ন’টায় তাঁর ফোন আসবেই। মা-বাবা হারা রুমার প্রতি তাঁর হৃদয়ে সীমাহীন ভালোবাসা। আজ প্রায় পাঁচ বছর ধরে স্টেটসে রয়েছেন। দেশে থাকতে তিনি-ই রুমার বিয়ে দিয়েছিলেন রায়হানের সাথে। আজ রুমার এই অবস্থার জন্য তিনি নিজেকেই দায়ী করেন। এজন্যই ওদের ছোট্ট এই পরিবারটিকে একই সাথে মা-বাবার ভালোবাসায় আঁকড়ে ধরে রাখার চেষ্টা করে চলেছেন। রায়হানকে রুমার জন্য নির্বাচন করা কি ভুল সিদ্ধান্ত ছিল? ওখানে বসে মাঝে মাঝে ভাবেন। তবে ভেবে ভেবে ক্লান্ত হওয়া ছাড়া আর কোনো লাভ হয় না। রায়হানের জন্য গত দশ বছরে তিনি তো কম চেষ্টা করেননি। কিন্তু রায়হান প্রকৃতিগতভাবে অস্থির, একগুঁয়ে এবং প্রচণ্ড রাগী স্বভাবের। তাই আজও সে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারেনি। মোবাইলে কথা বলার সময়ে কখনো কখনো এ কথা রায়হানকে তিনি বলেনও। তবে এতে করে তাঁর অজান্তে রুমারই কষ্ট বাড়ে।
প্রতিবার রুমার মামার কাছ থেকে এগুলো শুনে রায়হান রুমার সাথে চ্যাঁচামেচি করে। মিতুর সামনেই।
ছোট্ট শিশুটি তখন বাবার নতুন এই রূপ দেখে নিজের ভেতরে বিচিত্র বোধহীন নির্জীবতায় ভোগে। এভাবেই বেড়ে উঠছে সে।
কিন্তু ওর বিকাশ হচ্ছে কি?
রায়হান এটা বোঝে না। জগৎ সংসারের প্রতি ওর কেন জানি প্রচণ্ড এক বিদ্বেষ কাজ করে। সেও এক বিচিত্র মানুষ। কিন্তু প্রথমদিকে সে এমন ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকানো এক সম্ভাবনাময় যুবক সময়ের পরিক্রমায় কিভাবে যেন আজকের এই অস্বাভাবিক মানুষটিতে পরিণত হয়েছে।
ফ্রেশ হয়ে রায়হান ওদের রুমের বারান্দার সামনের খোলা জায়গাটিতে প্লাস্টিকের চেয়ার নিয়ে বসে। সুন্দর একটি বাগান করার চেষ্টা করেছে রুমা। ফুলবাগান। বেশ ছায়াঘেরা জায়গাটি। রুমার মামা জায়গাটি কেনার পরে পুরো বাউন্ডারি ঘিরে বেশ কয়েক জাতের ঔষধি গাছ লাগিয়েছিলেন। সেগুলো এত বছরে বড় হয়েছে। এগুলোর ভিড়ে দেশি গাছও রয়েছে।
চেয়ারে বসে বসে রায়হান মিস্ত্রীর কাজ দেখে। বাউন্ডারি ওয়ালের কাজ চলছে।
আজ পনের দিন হয়ে গেছে ওরা এখানে শিফট হয়েছে। দশ ফুট একটু বেশি উচ্চতা হয়ে গেল কি? তবে বাড়ির জন্য সুরক্ষা হলেও বাতাস প্রবাহের পথ কিছুটা রুদ্ধতাপূর্ণ হয়ে যাবে।
প্রতিটি এলাকাই প্রায় একই রকম।
কেউ নতুন বাড়ি বা যে কোনো ধরণের নির্মাণ কাজ শুরু করলেই এলাকার ছেলেরা মূর্তিমান উপদ্রব হিসেবে আবির্ভূত হয়। শমশেরনগর আবাসিক এলাকাও তার ব্যতিক্রম নয়।
কাজ শুরুর প্রথম দিনেই কয়েকজন পরিচয়ের উসিলায় রায়হানের কাছে আসে। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে শেষ পর্যন্ত এলাকার ক্লাবের জন্য কিছু ‘ডোনেশন’ দাবি করে। সেদিনের মত ওদেরকে বিদায় করে দিয়ে রায়হান ভাবতে বসে কী করা যায়।
রাতে মামা ফোন করলে তাকেও সব কিছু জানায়।
‘আচ্ছা দেখছি’ বলে মামা ফোন রেখে দেন।
পরের দিন সকালে নেতা জসীম রায়হানের সাথে দেখা করে। রুমা তার আপ্যায়নে কোনো ত্রুটি রাখে না। কথা প্রসঙ্গে এলাকার ছেলেদের দাবির কথা রায়হান তাকে জানায়। তিনি হেসে বলেন—
: কোনো চিন্তা করবে না। আর তোমরা আমার ছেলেমেয়ের বয়সী। এজন্য তুমি করেই বলছি। তোমার মামার সাথে আমার কথা হয়েছে। দেশে থাকতে এই জায়গাটা আমি-ই তাকে কিনতে সাহায্য করেছিলাম। আমার সাথে ভালো সম্পর্ক হয়েছিল।
এভাবেই জসীম নেতা নামের শিয়ালের মত ধূর্ত গ্রাম্য রাজনীতির এক নষ্ট স্তম্ভ রায়হানের জীবনে স্থাপিত হয়। তার পরামর্শেই এলাকার ছেলেদেরকে বাউন্ডারি ওয়ালের জন্য ইট ও বালি সাপ্লাইয়ের কাজটি দিয়ে দেয়। সেই সুবাদে ওদের সাথেও রায়হানের প্রাথমিক সখ্যতা গড়ে উঠে।
মিস্ত্রিদের কাজ দেখতে থাকা রায়হান বসে বসে এসবই ভাবছে। কিন্তু ওর চিন্তায় এই কথাটি আসে না যে, জসীম নামের লোকটিই এলাকার ছেলেদের নিয়ন্ত্রণ করে। আর তার পরামর্শেই ছেলেরা প্রথমবার ওর কাছে এসেছিল চাঁদা চাইতে। যেখান থেকে লাভের কিছু কমিশন তার পকেটেও যাবে। এভাবেই তো চলে আসছে সবকিছু। একটা চক্র যা এদেশে এভাবেই পুনঃপুনিক চলে আসছে… হয়তো চলতেই থাকবে।
মিতু এসে বাবার পাশে দাঁড়ায়।
রায়হানের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। নিজের মেয়ের হাতের কোমল স্পর্শে কেন জানি রায়হানের ঘুম ঘুম আবেশ এসে যায়। সে ফিরে যায় বেশ আগে। নিজের মায়ের স্পর্শ মনে পড়ে।
‘ওহ মা!’
হৃদয়ের গভীর থেকে শব্দ দুটি নিঃশব্দে বের হয়ে আসে!
আজ এতোগুলো বছর মা থেকে দূরে রয়েছে। কিন্তু নিজের চেতনা থেকে কি তাঁকে দূরে সরাতে পেরেছে?
দু’চোখ বেয়ে মনের কষ্টগুলো পানি হয়ে বের হয়ে যেতে থাকে। কিন্তু তাতেও কি হৃদয়ের পাষাণভার একটুও কমে?
নিজের জনকের প্রতি জেদ একটুও হালকা হয়?
: তুমি কাঁদছ কেন, পাপা?
মেয়ের কথায় মেয়েকে কাছে টেনে নেয়। কোলে উঠিয়ে বুকের সাথে ধরে রাখে। মিতু অবাক হয়। বাবার বুকে চুপ করে থেকে আড়চোখে বাবাকে দেখতে চেষ্টা করে।
: কাঁদছি না, আম্মু। চোখে কি যেন একটা পোকা পড়ল। তাই পানি বের হচ্ছে।
নিজের মেয়ের কাছে মিথ্যে বলার জন্য খুব খারাপ লাগে রায়হানের। একটু গ্লানিবোধ করে।
মিতু ওর পাপার কথায় ওর মনে জমে থাকা এক প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পায়। ওর পাপা যখন আম্মুর সাথে রাগারাগি করে বাসার বাইরে চলে যায়, তখন আম্মুর চোখেও মনে হয় পোকাই পড়ে। তাইতো আম্মুর চোখ দিয়েও তখন এভাবে পানি পড়তে থাকে।
(ক্রমশ:)
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।