ভাবুক দরবেশ

বন্ধুরা, কেমন আছ তোমরা? তোমরা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছ যে, আমাদের সমাজে এমন অনেকেই আছে যারা সব সময় কল্পনার জগতে বাস করে। কল্পনার মাধ্যমে তারা ধনী, জ্ঞানী, নেতাসহ নানাকিছু হওয়ার স্বপ্ন দেখে। কিন্তু এসবের কোনটিই যে সঠিক পরিকল্পনা, চেষ্টা-সাধনা ও পরিশ্রম ছাড়া সম্ভব নয়- তা তারা বুঝতে চায় না। এর ফলে দেখা যায়- তাদের স্বপ্ন-স্বপ্নই থেকে যায়-বাস্তবের মুখ দেখে না।

আজ থেকে প্রায় দু’হাজার বছর আগে রচিত বিখ্যাত গল্পগ্রন্থ ‘কালিলা ও দিমনা’তে এক কল্পনা বিলাসী দরবেশের কাহিনী আছে। শুরুতেই আমরা ওই কাহিনীটি শোনাব।

এক শহরে ছিল এক তেল ব্যবসায়ী। তেল কেনা-বেচা করাই ছিল তার কাজ। ওই ব্যবসায়ীর এক প্রতিবেশি ছিল দরবেশ ধরনের। দরবেশরা সাধারণত দুনিয়াবি কাজকর্মের প্রতি তেমন লক্ষ্য রাখেন না। জীবিকার চিন্তা ভাবনাও তারা তেমন একটা করে না বললেই চলে। যার ফলে দেখা যায় দরবেশরা একটু অভাবী ও দরিদ্র শ্রেণীর পর্যায়েই পড়ে। এই দরবেশও সে রকমই ছিল। দরবেশের নির্দিষ্ট কোনো আয় রোজগার ছিল না। এক বেলা খাওয়া হলে পরের বেলার কথা চিন্তাও করতো না।

তবে একটা বৈশিষ্ট্য ছিল দরবেশের। ওই বৈশিষ্ট্যটাই তাকে এলাকার সবার মাঝে ব্যতিক্রমধর্মী করে তুলেছিল। বৈশিষ্ট্যটা হলো দরবেশ ছিল ভীষণ রকমের আমানতদার। তার মাঝে ছিল অসাধারণ সততা। মনটাও ছিল একদম কলুষমুক্ত নিষ্পাপ। এসব বৈশিষ্ট্যের কারণে জনগণের কাছে দরবেশ ছিল ভীষণরকম বিশ্বস্ত এবং সবার আস্থাভাজন। অভাবী হবার পরও সবাই তাকে সম্মান করতো। দরবেশের এই বিশ্বস্ততা এবং সততার কথা সবার মুখে মুখে ছিল।

তেল ব্যবসায়ী ছিল বেশ ধনী অর্থাৎ অনেক টাকা পয়সার অধিকারী। প্রতিবেশি দরবেশের সততা আর বিশ্বস্ততার কারণে সে দরবেশকে খুব ভালো জানতো এবং তার প্রতি সব ব্যাপারেই আস্থা রাখতো। সবসময়ই ব্যবসায়ী তাই দরবেশকে সাহায্য করতো। তেলের ব্যবসায় যখনই একটু ভালো লাভ হতো দরবেশের জন্যে কিছুটা তেল পাঠিয়ে দিতো।

দরবেশ তো বেশ সাদামাটা জীবন যাপন করতে অভ্যস্থ ছিল। সে কারণে ব্যবসায়ী যেটুকু তেল পাঠাতো তার সবটা ব্যবহার না করে খানিকটা রেখে দিতো একটা কলসির ভেতর। কলসিটা মোটামুটি বড়ই ছিল। এভাবে জমাতে জমাতে একদিন কলসিটা পূর্ণ হয়ে গেল।

যেদিন দরবেশ দেখল কলসি তেলে পূর্ণ হয়ে গেছে, মনে মনে বলল: অ্যাতো তেল দিয়ে আমি কী করব! আমার তো অ্যাতো তেল দরকার নাই। এক কাজ করা যাক। আমার চেয়ে যার বেশি দরকার সে রকম কাউকে দিয়ে দেব। কিন্তু প্রতিবেশিদের মধ্যে তেলের অভাব আছে- সে রকম কাউকেই পাওয়া গেল না। দরবেশ মনে মনে ভাবল: অ্যাতো তেল এখন আমি কী করব কোথায় নেব! কাকে দেব?

এসব ভাবতে ভাবতে নতুন এক কল্পনার রাজ্যে ডুবে গেল দরবেশ। তার দৃষ্টিভঙ্গি আস্তে আস্তে পাল্টে যেতে শুরু করল। আপন মনে বলতে লাগল: কাউকে যদি এক কলসি তেল হাদিয়া হিসেবে দিয়ে দেই, ফায়দা নাই।

তেল তো তাড়াতাড়িই শেষ হয়ে যায়। তাছাড়া উদার হৃদয় হওয়া তাকেই মানায় যার অন্তত একটা কাজ কারবার আছে, নির্দিষ্ট একটা আয়ের উৎস আছে। আমার এমন কি আছে যে, দানের চিন্তায় মেতে উঠেছি! তাছাড়া আমারইবা বউ, ছেলেমেয়ে এসব থাকতে অসুবিধা কি? আমিওতো আবার বিয়ে-শাদি করে সংসার গড়তে পারি। সুতরাং দান করার প্রয়োজন নেই। বরং এ তেল বিক্রি করে যে আয় হবে তা দিয়ে ছোটখাট ব্যবসা শুরু করে দেই। যখন ব্যবসার অর্থ দিয়ে অনেক টাকা আয় হবে তখন নিজেদের অভাব মিটিয়ে অন্যদের সাহায্য-সহযোগিতা করব।

আচ্ছা দেখি তো! কলসিতে কী পরিমাণ তেল আছে! বাহ্! কমপক্ষে পনের কিলো তো হবেই। কতো দাম হতে পারে এই পরিমাণ তেলের? আমার তো মনে হয় দুইশ’ তুমানের কম হবে না। দুইশ’ তুমান তো অনেক টাকা! অন্তত পাঁচটা মেষ তো কেনা যাবেই।

এখন তো গরমের সময়। তরমুজের খোসা আর লেটুস পাতা প্রচুর পাওয়া যাবে। তাতেই পাঁচটা মেষের খাবার হয়ে যাবে। অবশ্য এখন ক্ষেত খামারেও ঘাস ভর্তি। চারণভূমিতেও মেষগুলোকে চরানো যাবে, সমস্যা হবে না। প্রতিটা মেষ ছয় মাসের মাথায় অন্তত দুইটা করে বাচ্চা দেবে। তাহলে পাঁচ দ্বিগুণে দশ আর পাঁচ মিলে পনেরটা মেষ হবে। এখনই কিছু ঘাস শুকিয়ে রাখতে হবে তাদের জন্যে। শীতের সময় নৈলে খাওয়াব কী! পনেরটা মেষ, ঘাস তো আর কম হলে চলবে না। মেষগুলোকে বছর দুয়েক ভালো করে লালন পালন করলে ওরা বড়ো যাবে। পুরো একটা পাল হয়ে যাবে মেষের। মেষের দুধ দুইতে হবে, দুধ দিয়ে দধি, ঘোল, পণির, মাখন, ঘি ইত্যাদি বানাতে হবে। মেষের পশম কাটতে হবে। একপাল মেষের সারও তো কম হবে না। স…ব বিক্রি করতে হবে। কী দারুণ ব্যাপার, তাই না?

মেষ কিন্তু বেশ ভালো একটা প্রাণী। পয়সাপাতি জমে গেলে ভালো দেখে একটা বাড়ি কেনবো। কমপ্লিট বাড়ি। সবকিছু থাকবে বাড়িতে। বড়লোকদের বাড়িতে যা যা থাকে, কোনোকিছুই কম থাকবে না। আমিও তখন বড়লোকদের মতোই নাম করব। সবাই আমাকে চিনবে, সম্মান করবে। তখন ভালো এবং সম্ভ্রান্ত কোনো ফ্যামিলির একটা মেয়েকে বিয়ে করব। আর বিয়ে করার কয় মাসের মধ্যেই তো ইনশাআল্লাহ বাচ্চা কাচ্চার জন্ম হবে। ছেলে হোক কিংবা মেয়েই হোক আমার কাছে কোনো পার্থক্য নেই। আল্লাহ যা-ই দেবেন তাতেই আমি সন্তুষ্ট। সবচেয়ে বড়ো কথা হলো সন্তানদেরকে যথার্থ শিক্ষা দীক্ষায় বড় করে তোলা, মানুষের মতো মানুষ করে গড়ে তোলা। আমি অবশ্যই চেষ্টা করব আমার সন্তানদেরকে ভালো করে গড়ে তুলতে, চেষ্টার কোনো ত্রুটি করব না আমি।

বুড়ো টুড়ো হয়ে গেলে তো একা একা এতোসব কাজ সামলানো যাবে না। তখন একজন রাখাল রাখব। রাখালের কাজ হবে মেষ পালের দেখাশুনা করা, তাদের চরানো, দুধ দোহানো…ইত্যাদি। সেইসাথে বাড়ির কাজও কমবেশি করতে হবে তাকে।

এ সময় তো আমার বাচ্চারা কমপক্ষে ছয় সাত বছর বয়সে পৌঁছবে। ওহ্…এ সময়টা তাদের দুষ্টামির বয়স। ভীষণ দুষ্টামি করবে তারা। সারাক্ষণ খেলাধুলায় মেতে থাকবে। দুষ্টামি করতে করতে মেষকেও মেরে আহত করে ছাড়বে। মেষের পিঠে ওঠার বায়নাও করে বসতে পারে, কোনো কিছুরই ঠিক নাই। অবশ্য তারা তো তখনো বুঝবে না যে মেষের পিঠে চড়া যায় না। চড়তে হয় ঘোড়া কিংবা গাধার পিঠে। মেষ তো ঘোড়াও নয় গাধাও নয়।

রাখালের কাজ হবে বাচ্চারা যখন মেষের পিঠে ওঠার জন্যে পীড়াপীড়ি করবে তখন তাদের এগুলো নরম ভাষায়, আদর করে বোঝানো। কিন্তু রাখাল হয়তো উল্টোটাও করে বসতে পারে। রেগেমেগে যেতে পারে। বাচ্চারা কথা না শুনলে শেষ পর্যন্ত তাদেরকে মারও দিয়ে বসতে পারে। এটা ঠিক যে বাচ্চারা মেষের পিঠে চড়ুক সেটা আমিও চাই না, কিন্তু এটাও চাই না যে আমার বাচ্চারা মন খারাপ করে বসে থাকুক। খোদার কসম! রাখাল যদি আমার বাচ্চাদের গায়ে হাত তোলে তাহলে এই ভারি মুগুরটা দিয়ে তার মাথার ঠিক মাঝখানে এইভাবে কষে মারবো একটা।

বেচারা দরবেশ ডুবে ছিল তার স্বপ্নের ভবিষ্যতে। মনের অজান্তেই কল্পিত খাদেমকে মারতে গিয়ে হাতের মোটা এবং ভারি মুগুরটা আঘাত করল তেলের কলসির ওপর। কলসি তো ভেঙে খানখান আর কলসির পরের কিলো তেল সব দরবেশের গায়ে, হাতে, মুখে, জামায় লেগে ভিজে গড়িয়ে পড়তে লাগলো। সহসা দরবেশের চেতনা ফিরে পেলো। স্বপ্নের রাজ্য থেকে ফিরে এলো বাস্তব পৃথিবীতে। বুঝতে পারলো বাস্তবতা আর স্বপ্নের মাঝে আকাশ পাতাল পার্থক্য।

মজার ব্যাপার হলো- দরবেশ আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলো। মনে মনে বলল: মুগুর দিয়ে যেভাবে কলসিতে আঘাত হেনেছি, খোদা না করুক এই আঘাত যদি আমি রাখালের মাথায় হানতাম তাহলে তো সারাটা জীবন আদালতের কাঠগড়ায় দৌড়াদৌড়ি শেষে জেলেই কাটাতে হতো। বুড়াকালে যে আমাকে সেই জেলে যেত হলো না..সেটাই সৌভাগ্য.. এই বলে দরবেশ হাসতে হাসতে বলল: আলহামদুলিল্লাহ…।

কথা না রাখার পরিণতি

‘না উটের দুধ, না আরবের সাক্ষাত’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *