ভাঙ্গা ভাগ্য

বাইরে যখন গাভিটি তার পায়ে বাধা রশি ছিড়ে যে দিকে চোখ যায় সেদিকেই চলে যাচ্ছে , তখন বাড়ির ভেতরের কোন এক ঘরে জনী গলায় ফাঁস লাগিয়ে মরার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সে আজ মরবেই।দুনিয়ার কোন মায়া মমতা বাধন তাকে তার ইচ্ছা থেকে সরাতে পারবে না। কত মানুষই তো দুনিয়ায় এভাবে চলে যায় কে তাদের কতদিন মনে রাখে।জন্মের প্রস্তুতি বাড়ি ঘর সমাজে প্রায় বছর খানেক থাকলেও মৃত্যুর জ্বালার বিস্তৃতি কেবল মা ছাড়া আর কার কাছে দু এক মাসের চেয়ে বেশি দিন থাকে না।
আর তার যে মা সেতো তার জন্যে না থাকারই সমান। মরে গেলে বরং তা মায়ের জন্যে বেশ আনন্দের না হলেও বেশি কষ্টের হবে না বলে জনীর বিশ্বাস। জীবন টা তার এমন দুধের মাঝে তেতুল যে কোন সময় কি আলাদা হয়ে গেলেও তা জানলো না।জানলেও বুঝার কোন সূযোগ তার কপালে ঝুটে নি । যেদিন জনীর বাবা জনীর মুখ না দেখেই দুনিয়া ছেড়ে চলে গেল , সেদিন সকাল বেলার সূর্যের আলো ছিল না , সারা আকাশ কালো মেঘে মেঘে এমন অন্ধকারচ্ছন্ন হয়ে রয়েছিল যে মনে হচ্ছিল কে বুঝি উপর থেকে সারাটা আকাশ কালো কাপড়ে ঢেকে দিয়েছে।যা হোক বাবার মৃত্যুর কয়েক ঘন্টা পরই জনীর জন্ম হয়েছিল। একেতো মেয়ে শিশু তার উপরে পিতা খাওয়া অতএব পাঠক বুঝতেই পারতেছেন নবাগত জনীর ঊপর মানুষের নকল চোখদ্বয় কেমন ছিল। কেউ কেউ বললেন এমন অলক্ষনা মেয়ে তারা তাদের বাপের জন্মেও দেখে নি আবার কেউ কেউ বলল এমন রাক্ষসী শিশু কেবল রাক্ষসদের ঘরেই নাকি জন্মায়, দেশে নয় ।তাই যে যেভাবে পারে , বুঝিয়ে কিবা না বুঝিয়ে সদ্যজাত শিশুটির অমঙ্গল কামনা করেই গেল। এমনকি গ্রামের কয়েক জন সাধু সন্ন্যাসী নিজেদের স্ব স্ব আবিস্কৃত ঐশ্বরিক ক্ষমতায় গ্রামময় প্রচার করে দিলেন যে এবার এ গ্রামে তেমন ভাল শষ্য ফলবে না কারন এক অলক্ষ্মী শিশু গ্রামে জন্ম গ্রহন করেছে। জনী আজ যে কষ্ট করে গলায় ফাঁস লাগিয়ে মরতে যাচ্ছে তাকে এতটুকু কষ্ট করতে হত না , যদি না তার সদ্য বিধবা হওয়া মা গ্রামেরই স্কুল শিক্ষিকা না হতেন । তিনি ভাল করে জানতেন যে , শিশুর অপরাধ জন্মে নয় জন্মের মাটিতে।তাই তিনি তার শিশু কন্যাকে যথাসম্ভব বুকে আগলে রাখার চেষ্টাই করেছেন । বাকি আট দশটি শিশু যে রকম ভাবে বাচে তাকে সেরকম ভাবেই বাচিয়েছেন। কোথায় তেমন বেশি যেমন কিছু ছিল না আবার কমও না। নিজের বেতনের যা পেয়েছেন তাই তিনি ঊজার করে ঢেলেছেন এই কন্যা শিশিটির পেছনে। শিশুটি যখন ধীরে ধীরে বড় হতে হতে নিজের বাবার চেহারটা নিজের মধ্যে আর স্পষ্ট করে তুলছিল তখন তার মায়ের মনে একটা আকুলতা ব্যাপক লতা পাতা ছাড়তে লাগল ।কোথায় যেন এক সাগর শুন্যতা হোট করে মাথা তুলে চারদিক গ্রাস করে নিল। যেখানু হাবু ডুবু করে বাচা যায় , তবে হাবু ডুবু করা যায় কিনা তা বার বার মনকে জিজ্ঞাসা করতে হয় ।সে জিজ্ঞাসার উত্তরো যে সব সময় একই রকম হয় তা নয়, তাই মানুষ ইচ্ছে করে ভুল করে বা ভুল করতে হয় ।
জনীর মা ঠিক এই জায়গায় দাঁড়িয়ে যখন আবার বিয়ে করে জনীকে একটি নতুন তরতাজা পিতা উপহার দিল তখন জনী প্রাইমারী স্কুল ছেড়ে হাই স্কুলে বারান্দায় পা দিয়েছিল।সবাই তাকে জিজ্ঞাসা করত কিরে তোর নতুন পিতা কেমন? আদর টাদর করে তো? জনী মুচকি হেসে কেন যে লজ্জ্বায় লাল হয়ে যেত তা তার মন ভিন্ন অন্য কেউ জানার কথা নয় ।জানতো না। এমনকি নতুন পিতা আসলেই তার পিতা হয়ে তার মাকে বিয়ে করেছে না কেবল স্বামী হয়ে তা সে কোনদিন জানে নি , আজো যে সবাইকে জানাতে পেরেছে তা নয় । মায়ের নতুন বিয়ের পর নিজের বাবার ভিটা মাটি ছেড়ে মায়ের সাথে সাথে জনীকে মায়ের শ্বশুর বাড়িতে যেতে হয়েছিল। জনীর বাবার কোন ভাই বোন ছিল না বলে আশে পাশে তেমন কোন আত্মীয় স্বজন ছিল না যে সে মায়ের ইচ্ছার অবাধ্য হয়ে বলতে পারত ,মা আমি এখন ওদের সংগে থাকি তুমি বরং বাবার সাথে চলে যাও।নাকে রশি লাগিয়ে যেভাবে মহিষকে টেনে টেনে নেওয়া হয় ঠিক তেমন কোন রশি জনীর গায়ে দেখা যায় নি , তবে তার মা যে রশি তার মন ও জীবন গায়ে বেধে দিল তার টানের জ্বালা যে কি তা কেউ কি কোনদিন বুঝবে? নতুন বাবার বাড়িটাতে প্রথম কয়েকটা মাস বেশ ভালই কাটছিল। তারপর টুকটাক হাড়ি পাতিলের মত ধাক্কাধাক্কি হলেও দু তিনটা বছর একটা স্বপ্নের মোহে কেটে যাচ্ছিল। বাড়ির উঠানের কোনের পেপে গাছটা জনীর সাথে পাল্লা দিয়ে বেশ বড় হয়ে গেল ।গাছটাকে দেখে কে বলবে এই কয়দিন আগেই না গাছটা কত ছোট ছিল ?কেউ বলুক আর না বলুক গাছটি তার চিকচিকে সবুজ সতেজ পাতায় পাতায় সবার নজর নিজের দিকে টেনেছিল কিনা তা গাছটি জানবে। তবে সবার নজর যে তার উপর পড়েছে তা সবাই বেশ ভাল ভাবেই জানত । তখন ভাদ্র মাসের মাঝা মাঝি , বৃষ্টি আর মেঘের ডাকের মাঝে দূর কোথা থেকে একটা কুকুরীর মৃদু চিৎকার ভেসে আসছিল ।বৃষ্টির মাটি ছুয়া শব্দ এতই প্রবল ছিল যে , উপর থেকে কেউ পানিকে বৃষ্টি নাম দিয়ে এভাবে না ছুড়ে ফেললেও পারতো!কিন্তু বিধাতার কাজ ভাবি আর প্রকৃতির নিয়মই বলি সবকিছুই যেন কোথাও না কোথাও অসহায় । বেহেস্তে যে হাজার হাজার রমনী কেবল একটি হালাল পুরুষের জন্যে রাখা হয়েছে সে রমনী গুলোও দাসত্বের জীবন নিয়ে , অনুভুতি হীন ভাবে কত অসহায় !তাদের কে একজন পূন্য কাজের বিনিময়ে পতিতার মত ব্যবহার করবে আর তারা সেই সুখে তাদের বেহেস্তসুখ জলাঞ্জলী দিবে, তাহলে বেহেস্তে থেকে তাদের দোজক ভোগের দায়ভার কে নিবে?তাদের বেহেস্ত কোথায়? ভেজা শরীরে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরলে জনীর সৎ বাবা জনীকে ডেকে বলল, জনী আমার মাথাটা ব্যথা করছে একটু মালিশ করে দিবে? কাপড়টা বদল করে আসছি বাবা। বাড়িটি তখনো একা। চারদিকে এত আওয়াজ কোলাহল তারপরেও জনীর মনে হলো আজ দুনিয়া এত নিশ্চুপ কেন ?কি এক অজানা ভয় মনের কোনে নানা ভাবে জাগার চেষ্টা করছে। আর সে এই ভয়গুলো প্রাণপনে সরিয়েও নিঃশেষ করতে পারছে না। কে জানি কোথা থেকে বার বার বলছে , জনী বাড়িতে এখন কেউ নেই , তুই তোর মায়ের এই স্বামীটির কাছে বাবার দাবী নিয়ে যাস না।চামড়া টাই সবকিছুর আসল পরিচয় না । মাংস নামের দেয়ালের ভেতরে যে পশুটি সবার মনে বিরাজমান তা সবাই সব সময় দমিয়ে রাখতে পারে না ,তাই কোথাও মন্দির আবার কোথাও পানশালা বানিয়ে বেচে থাকার পথটা এখনো খুজছে।
যদিও সময় সময় ধরে নানান বই কখনো আকাশ থেকে আবার কখনো জংগল থেকে বের হয়ে এসেছে কিন্তু তা যেহেতু মানুষের মাঝখান থেকে বের হয়ে আসে নি তাই সেখানে মানুষের কথা নেই , মানুষের বাচার পথ নেই আছে ভয় দেখিয়ে দাস বানিয়ে নিজের প্রভুত্ব সবার উপর চাপিয়ে দেওয়া। এই না করলে সেই হবে, এই করলে এই হবে বলে শুধু হুজুর হুজুর করার আবেদন ।নাম ভজিলে এই না ভজিলে ওই , তারে না দেখিয়াও তার নামে মাথা নত করলে বেহেস্তের চাবি হাতে চলে আসবে না করলে দোযকে। অর্থাৎ আমিই সেরা , তাই সেরা বলে আমাকে ভজন করো, আমি যা বলি তা শুন , আমার প্রভুত্ব মান। বই গুলো এগুলো মানুষকে শেখায় বলে মানুষ ভুল করে হোক কিবা সেরা ব্যক্তিকে অনুসরন করেই হোক কারো কারো জন্যে সেও প্রভু হয়ে উঠে, নিজের ঢোল নিজেই পেটাতে থাকে। নিজে যা বলে তা ই শেষ এবং চুড়ান্ত বলে একধরনের বিশ্বাস নিজের মনে পোষে রাখে।আবার এও ভাবে বাবা একবার একটা ভুল হয়ে গেলেও সমস্যা কি ।বিশেষ ঘর গুলোতে দান দক্ষিনা করলেই হলো, সব শেষ। তাছাড়া বিশেষ রাতে কাদলেই হয়, সব কিছু মাফ । এই ভাবনায় কি এক আশা জনীর দ্বিতীয় বাবা মনে লুকিয়ে রেখেছে তা জনি জানতো না ।পরে যখন বাবার কথা মত তার মাথা মালিশ করতে গেল তখন সে জানতে পারলো কোন শব্দের নাম বা ডাক মানুষের পশুত্বকে বদলায় না। যদি না সে নিজে না বদলায়। চিতকার করে বাবা নামের মায়ের স্বামিটিকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দৌড়ে কার ঘরে গিয়ে আশ্রয় নিল। তা বাতাসো জানলো না। যাদের ঘরে আশ্রয় নিয়েছে তারাও জানতে চাইল , কি হয়েছে রে জনী এভাবে দৌড়ে আসলে যে , তোর গা কাপছে কেন?কি হয়েছে বল ? কি আর বলার আছে তার, তাই সে চুপ। কান্নাটাই যেন তার কেবল মুখের ভাষা। কারন এমন এক কান্ড তার মায়ের স্বামিটি করেছে যে তা না যায় বলা , না যায় ভাবা।বরং তা বলতে গেলে কেউ বিশ্বাস করবে না। সমাজে এমন কোন কর্তা বসে আছেন যে নিজের গোত্র ভাইয়ের কথা না ভেবে জনী নামের এই সামান্য নারীটির কথা শুনবে। বরং সে মরে গেলেই সমাজ পবিত্র হলো বলে নিজেদের মনে শান্তি তারা খুজে নিবে এমনকি পেয়েও যাবে। পুরুষের অপরাধে নারী জীবন দেয় এমন আজব দেশ দুনিয়াতে আছে জানলে নারী দুনিয়াতে আসাই বন্ধ করে দিত। এমনকি দয়াল বন্ধু দুনিয়া বানাতেন কিনা তাও ভাবনার বিষয় হয়ে দাড়াত। নারীদের দেহ নাকি সমাজের সম্পত্তি যাতে একবার ময়লা কোনভাবে লেগে গেলেই সব শেষ হয়ে যায় , আর পুরুষের দেহ? তা না সম্পত্তি না আপত্তি। সেখানে ময়লা কেন দেহটা যদি ডাস্টবিন হয়েও বসে থাকে তবুও তাকে মরতে হয় না, বরং গর্ব করে বলে আমি অমুকের গায়ে ময়লা ফেলেছি তমুকের গায়ে ফেলেছি এবার আমাকে ফুলের মালা দিয়ে লালন পালন কর। আর যার ঊপর ফেলেছি তাকে কাষ্টে তুলে আমার অপরাধ মুছে ফেল ।এক দেহ দেখলে বা দেখালে সব যায় আর আরেক দেহ দেখলে বা দেখালে কিছুই কারো হয় না । সন্ধায় মা বাড়িতে ফিরে আসলে জনী তার ঊপর তার বাবা নামের পশুটার আক্রমনের কথা বলার আগেই ঐ পাষন্ড নরপশু নিজের বঊকে বলল তোমার মেয়ে আমাকে বাবা হিসেবে মানতে পারে না ভাল কথা , তাই বলে এমন মহা মিথ্যা কথা রটাবে? বউ স্বামীকে বলল, ওগো বল কি হয়েছে? কি করেছে আমার জনী। ও ছোট মানুষ ভুল করে থাকলে মাফ করে দিও । তুমি আর কি বলবে নিজের মেয়ে বলেই তো মাফ করে দিয়েছি , তা না হলে কেটে নদীতে ভাসিয়ে দিতাম। কি করেছে সে?বলো না? ওকেই জিজ্ঞাসা কর। ঠিক এমন সময় জনী কিছু বলতে গেলে নরপশু জনীর মুখের উপর বলল, তুমি তোমার জায়গায় যাও আমি তোমার মাকে সব বলতেছি। জনী এবার রেগে গিয়ে চিৎকার করে কেদে ঊঠে বলল, ওই তুই কি আবার বলবি পশুর বাচ্চা পশু। আমি বলতেছি । যেই জনী এই বলল অমনি জনীর মায়ের নতুন স্বামী নরপশুটি জনীর মায়ের কাছে যা বলে ফেলল, তা জনী কানে শুনতে আর পারলো না। নিজের হাতের কাছে মাছ কাটার দা টি পেয়েই সোজা সে তা ঊড়িয়ে মারলো পশুটার দিকে। না তা পশুর গায়ে আঘাত করলো না ।
বরং সে নিজেই অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। কিছু মানুষের আওয়াজের মাঝে যখন তার জ্ঞান ফিরল তখন সে দেখল সেই পশুটি আর তার মা তার পাশে বসে আছে। মা বলল , এ কি করিস মা, লজ্জা হয় না তোর । এ তোর বাবা। বাবার চোখে দেখতে পারিস না বলে এভাবে আজে বাজে কথা তুলে দিবি। মায়ের কথা শুনে সে কেবল চোখের পানি মুছে গায়ের ওড়না ভিজিয়েছিল। আর কিছু কথা বলেনি। বলে লাভই বা কি? মা যে তার আজ আরেক জনের স্ত্রী । সে কি আর বুঝবে মেয়ের বুকে লুকানু কথাটি কত বেদনার কত অপমানের । সে সারা জীবনই ভাববে কেবল সৎ পিতা বলে সে মানতে পারে না।এমন জগন্য মিথ্যা কথাও নিজের মাঝে রাখে। তাই সে আজ এই আয়োজন করে বসেছে। যেখানে সবকিছু তার, কেবল তার কাঊকে বলে কয়ে বুঝিয়ে কোন সিদ্বান্ত নেওয়া লাগবে না। তবে ফাঁস লাগানুর আগে শুনা গেল কে জানি কাকে বলছে ,শুনেছে এক সন্ন্যাসিনী কোথা থেকে এ গ্রামে এসেছে । যে মানুষের ভবিষ্যত বলে দিতে পারে।

আরো পড়তে পারেন...

প্রতিজ্ঞা– শিশুতোষ গল্প

সেই ছোট বেলা থেকেই আমি খুব চঞ্চল স্বভাবের ছিলাম। সারাদিন বনে বাদাড়ে ঘুরে বেড়াতাম। লেখাপড়ার…

অহংকারের ফল

এক পালোয়ান মল্ল যুদ্ধে খুব পারদর্শিতা অর্জন করেছিলো। মল্ল বিদ্যায় সে তিনশত ষাটটি কৌশল আয়ত্ব…

ভিক্ষুক

সবুজ গ্রাম। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে মেঘনা। বাংলাদেশের অন্যতম নদীগুলোর মধ্যে মেঘনা একটি বৃহৎ…