
পাবনা জেলার একটা প্রত্যন্ত গ্রামে আমার শৈশব আর কৈশোর কেটেছে।
এখানকার স্কুল থেকেই আমি এস, এস, সি পাশ করেছি। এরপর অবশ্য শহরে চলে আসি।
এতো কথা বলছি কারন আমার ঘটনাটা এই গ্রামেই ঘটেছে। আমার সাথে ঘটেছে বললে আসলে ভুল হবে।
কারন ঘটনাটি ঘটে আমার মায়ের সাথে। আমি একজন প্রত্যক্ষদর্শী। ১৯৯৪ সাল। আমি তখন বেশ ছোট। ক্লাস থ্রি তে পড়ি।
একে তো গ্রাম অঞ্চল তার উপর আমাদের বাড়ি ছাড়া আসে পাশের কোনও বাড়িতে ইলেক্ট্রিসিটি নেই।
বলা উচিত, আমাদের আসে পাশের বেশিরভাগ বাড়িঘরই কৃষকদের। তাই সন্ধ্যা হবার পরপরই চারদিকে সুনসান নিরবতা নেমে আসে।
ঝি ঝির শব্দ ছাড়া অন্য কোনও শব্দ পাওয়া যায় না। আমাদের বাড়িটা অনেক বড় জায়গা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত।
বাড়িতে একটা এক তলা বিল্ডিং, একটা টিনের ঘর, আর একটা রান্নাঘর।
গ্রাম বলে রুমের সাথে কোনও লাগানো টয়লেট নেই। বাড়ির পশ্চিম দিকে একটা বিশাল বাঁশ বাগান।
তার সামনে কিছুদূর এগুলেই ২ টা কবর। আমাদের পরিচিত কারো না।
আমার বাবা বাড়িটা বানানোর আগে থেকেই সে কবর ২ টা ছিল।
যেদিনকার ঘটনা সেদিন রাতে আম্মা আমাকে রাত ২ – ২.৩০ দিকে ঘুম থেকে জাগান টয়লেটে যাবার জন্য।
ছোট মানুষ তো, তাই প্রতিদিন ঐ সময়টাতে আমাকে ডেকে উঠানো হতো যাতে বিছানা না ভেজাই।
যাই হোক, ঘুম জড়ানো চোখে আমি উঠে টয়লেটে গেলাম। এসে আম্মাকে পেলাম না।
কি ভাবলাম মনে নেই, কিন্তু আমি ঘরে ঢুকে বিছানায় উঠে যাই এবং কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ি।
এভাবে কতক্ষণ ঘুমিয়েছিলাম মনে নেই, তবে কিছু সময় পর বিকট চিৎকারে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়।
প্রথমে ঘাবড়ে গেলেও পরে দৌড়ে রুম থেকে বের হই।
দেখি উঠানে আমার আম্মা সেন্সলেস হয়ে পরে আছেন। আমার দুই বড় ভাই জলদি জলদি আম্মাকে ধরে ঘরে নিয়ে আসে।
সে রাতে অনেক চেষ্টা করেও আম্মার জ্ঞান ফেরানো সম্ভব হয়নি। আমার বাবা সরকারী চাকরি করে।
সেই কারনে উনি প্রায়শই ঢাকা থাকতেন। বাড়িতে থাকতাম আমরা ৪ ভাই বোন।
সেই রাতে আমরা অনাথের মত কেঁদে রাত পার করলাম। আমার আম্মার জ্ঞান ফিরে সকালে ফজরের নামাজের পর।
জ্ঞান ফিরলেও তিনি আমাদের সাথে নরমাল কোনও কথা বার্তা বললেন না।
যা বললেন আবল তাবল এবং ছোট থাকার কারনে আমি প্রায় কিছুই বুঝতে পারলাম না।
এভাবে প্রায় বছর খানেক কেটে গেলো। আমার বাবা, আম্মাকে ডাক্তার কবিরাজ সব খানেই নিয়ে গেলো কিন্তু অবস্থার কোনও উন্নতি হচ্ছিল না।
আম্মা প্রায়ই ঘুমের মধ্যে চিৎকার করে উঠে বলতেন, “আমার হাতটা খেয়ে ফেলল। তোরা জলদি কিছু কর। আমাকে বাঁচা।” কিন্তু আমরা ছোট ছিলাম তাই কিছুই করতে পারতাম না।
শুধু কাঁদতাম পাশে বসে। এভাবে চলার পর হটাত একদিন এক কবিরাজের সন্ধান পাওয়া গেলো। তিনি আমাদের বাড়িতে আসলেন।
আমার আম্মাকে দেখলেন।
কবিরাজ এমনিতে খুবই কম কথা বলতেন, তাই আমার বাবা অনেক প্রশ্ন করলেও তিনি বেশিরভাগেরই কোনও উত্তর দিলেন না। শুধু বললেন, একটু পায়েশ রান্না করতে।
পায়েশ রান্না করা হলে তিনি তা একটা কলা পাতায় ঢেলে পশ্চিম দিকের কবর গুলোর পাশে রেখে আসলেন।
তারপর আমদের বাড়ির চতুর্দিকে ৪ কোণায় ৪ টা খুঁটি পুঁতে দিলেন এবং শেষে আমার আম্মাকে কয়েকটা তাবিজ দিয়ে চলে গেলেন। বলা বাহুল্য, সেদিনের পর থেকে আমরা আম্মার মধ্যে পরিবর্তন দেখতে পেলাম।
আম্মা সপ্তাহ ঘুরতেই প্রায় সুস্থ হয়ে গেলেন। তারপর আম্মার মুখেই আমরা শুনেছিলাম যে সেদিন কি হয়েছিলো, সেদিন আমি এক পাশের টয়লেটে ঢুকার পর আম্মা অন্য পাশের টয়লেটে ঢুকেন।
আমি টয়লেট করে চলে আসার কিছু সময় পর আম্মা টয়লেট থেকে বের হন।
হটাত একটা দমকা বাতাস বয়ে যায় এবং আম্মাকে অবাক করে দিয়ে বাঁশঝাড় থেকে একটা কুকুর বের হয়। উল্লেখ্য, আমাদের টয়লেটটা বাঁশঝাড়ের পাশেই ছিল।
কুকুরটার সাইজ একটা ৬ মাসের বাছুরের সমান ছিল। মাথায় ২ টা শিং এবং চোখ দুটো যেনও আগুনের গোলার মতন জ্বলজ্বল করছিলো।
জিহ্বাটা বেড়িয়ে আছে এবং তা থেকে অনবরত লালা গড়াচ্ছে।
কুকুরটা বাতাসের বেগে আম্মার সামনে আসে এবং ঠাণ্ডা চোখে আমার আম্মার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
তারপরের ঘটনা আর আমার আম্মার মনে ছিল না। এবার একটা রহস্য উদঘাটন করা যাক।
আম্মা যখন অসুস্থ ছিলেন তখন তিনি প্রায়ই ঘরের মধ্যে বলতেন, “আমার হাতটা খেয়ে ফেলল।” এটা যখন উনাকে জানানো হয় তখন তিনি বলেন, “তিনি দেখতেন সেই কুকুরটা এসে চিবিয়ে চিবিয়ে উনার হাতটা খাচ্ছে।” পাঠকদের উদ্দেশে কিছু কথাঃ আপনারা হয়তো বলবেন গল্পটা বানানো।
তাতে আমার কিছু যায় আসে না।
তবে যেই অবস্থা আমরা ৪ ভাই বোন পার করেছি, মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, এমন সময় যেনও কারো কাটাতে না হয়।
কারন আম্মা ঘরের মধ্যে তখন অনেকরকম কথা বলতেন যা শুনে প্রায়ই মনে হতো, আম্মা হয়তো আর বাঁচবেন না।
আম্মা কি কথা বলতো তা এখন আমার পুরোপুরি মনে নেই। তবে খাওয়া দাওয়ায় অনেক সমস্যা হতো।
কারন আমরা কেউই রান্না করতে পারতাম না। মহান আল্লাহর ইচ্ছায় আমার আম্মা এখন পরিপূর্ণ সুস্থ। আপনারা সবাই আমার আম্মার জন্য দোয়া করবেন।