লোকটির চেহারা বেশ রুক্ষ। লম্বাটে মুখ। বসে যাওয়া দু’গালে বসন্তের দাগ। গায়ের রঙ কুটকুটে কালো। গড়ন লম্বা আর পাটকাঠির মতো চিকন।
লোকটি বোধহয় এ পাড়ায় নতুন। আর কখনো চোখে পড়েনি শিহাবের। দুদিন আগে যখন প্রথম ওর চোখে পড়লো, তখন অদ্ভুত এক কাণ্ড ঘটলো। লোকটি গলির পথ ধরে আসছিল, আর শিহাব গলিতে ঢুকছিল। দুজনের দূরত্ব না-হলেও বিশ-বাইশ কদম। এতোটা দূর থেকে শিহাবের দিকে তাকাতে তাকাতে হেঁটে আসছিল লোকটি।
বিশ-বাইশ কদম দূরত্বে দুটো রিকশায় সংঘর্ষ ঘটলো। রিকশাঅলা একজন আরেকজনকে দোষারোপ করতে করতে ঝগড়া বাধিয়ে বসলো, তারপর হাতাহাতি। রিকশায় যাত্রীরা এবং গলিতে হেঁটে চলা অন্যান্য লোকজন রিকশাওয়ালার ঝগড়া-হাতাহাতি থামাতে চেষ্টা করছে। এসব দেখতে দেখতে এগোচ্ছিল শিহাব। ঠিক তখনই ঝগড়া-হাতাহাতি বেধে যাওয়ায় ছোটখাটো হূলস্থূলের জায়গাটায় লোকটাকে দেখতে পেল শিহাব। অমন হূলস্থুলের মধ্যে দাঁড়িয়েও লোকটা তাকিয়ে আছে ওর দিকে। অন্যদের মতো রিকশাওয়ালাদের হাঙ্গামা থামাতে চেষ্টা করছে না সে। তাহলে ওই হাঙ্গামার মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা কেন? আর অমন হূলস্থূলের মধ্যে দাঁড়িয়েও লোকটি ওর দিকে তাকিয়ে আছে কেন? গলিটা পেরোতে পেরোতে শিহাব খেয়াল করলো লোকটি ওর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়েই আছে। একটুক্ষণ পরেই শিহাব যেদিক থেকে হেঁটে যাচ্ছিল সেদিকে হেঁটে আসতে শুরু করলো লোকটি। তবে রাস্তার একপাশে শিহাব আর অন্যপাশ ধরে ওই লোকটি।
শিহাব খেয়াল করলো ওর দিক থেকে লোকটির দৃষ্টি এক সেকেন্ডের জন্যও নড়চড় হলো না। আর রাস্তার দুপাশে দুজন যখন কাছাকাছি হলো তখন তার দৃষ্টি যেন আরো প্রখর হলো। শিহাবকে ক্রস করতে করতে লোকটির হাঁটার গতি কিছুটা মন্থর হলো!
এই দিনের পর প্রতিদিন লোকটির সঙ্গে দেখা হতে থাকলো শিহাবের।
গলির মুখে দেখা হয় প্রায়ই। লোকটি তখন অদ্ভুত চোখে শিহাবকে দেখে। এক-দুবার তাকিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয় শিহাব। তাতেই দেখে লোকটি প্রখর দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। লোকটির চোখ দুটো লাল টকটকে। দেখে ভয় লাগে।
একদিন স্কুল ছুটির পর গেট দিয়ে বেরোতেই লোকটিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো শিহাব। স্কুল থেকে ওর বাসা খুব বেশি দূরে নয়। মিনিট পঁচিশের পথ। এইটুকু পথ হেঁটেই যাতায়াত করে ও। স্কুল থেকে ফেরার পথে ওর সঙ্গে শুভ আর রিফাত থাকে। ওদের সঙ্গে যেতে যেতে শিহাব দেখলো লোকটি ওর পেছন পেছন আসছে।
খেলার মাঠে গিয়েও দাঁড়িয়ে থাকে লোকটি। মাঠের পাশে বসে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে শিহাবের দিকে। তার দৃষ্টিটা এমন যেন বহু বছর আগের চেনা মানুষকে নতুন করে চিনতে চেষ্টা করছে!
কিন্তু লোকটির অমন করে তাকানো একদম পছন্দ হচ্ছে না শিহাবের। কী অদ্ভুত দৃষ্টি! যেন আগুন ঝরে। চোখ দুটো লাল টকটকে। অমন টকটকে লাল চোখ আর কারো দেখেনি শিহাব।
গতকাল বিকেলে সালাম মিয়ার চায়ের দোকানে দেখা হয়ে গেল লোকটির সঙ্গে। বসে চা খাচ্ছিল। শিহাবকে দেখেই চা খাওয়া থেমে গেল তার। চোখ তুলে ওর দিকে তাকালো। শিহাবের চোখে পড়লো লোকটির চোখের রঙ বদলে গেল। হলদেটে চোখ দুটো মুহূর্তে লাল টকটকে হয়ে উঠলো।
সালাম মিয়ার দোকানে চা খেতে এসেছিল শিহাব। লোকটিকে দেখে আর দাঁড়ালো না। কিন্তু হুট করে চলেও আসতে পারছিল না। সালাম মিয়া কী ভাববে? আর লোকটিও তো ভাবতে পারে তাকে দেখে ভয় পেয়েছে ও। তাই দুটো চকলেট কিনে নিল।
তবে লোকটিকে আসলেই ভয় পায় শিহাব। তাকে নিয়ে নানা রকম সন্দেহ ঘুরপাক খায় ওর ভেতরে। লোকটি অমন করে তাকায় কেন ওর দিকে? ও যখন বন্ধুদের সঙ্গে থাকে, তখনো কেবল ওর দিকেই তাকিয়ে থাকে লোকটি।
শিহাব লোকটিকে নিয়ে খুব ভাবে। কেন অমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে শুধু ওর দিকে তাকাবে? ছেলেধরা নয় তো! নাকি ওদের গ্রামের কেউ! ঢাকায় এসে ওদের কোনো একটা ক্ষতি করতে চাইছে!
গ্রামে শিহাবের বাবার অনেক শত্রু! ওদের অনেক জমিজমা। কিন্তু ওরা গ্রামে থাকে না বলে ওসব দেখাশোনা করার মতো কেউ নেই। শিহাবের বাবার আর কোনো ভাই নেই। শিহাবের দাদা যেমন একাই ছিলেন, তার আর কোনো ভাই ছিল না। ওর বাবাও তেমনি একা। থাকার ভেতর শিহাবের এক ফুপু আছেন। তিনি স্বামী-সন্তান নিয়ে বিদেশে থাকেন। দুতিন বছরে একবার হয়তো দেশে আসেন! তাও ভাইয়ের বাসায় কদিন বেড়িয়ে আবার উড়াল দেন।
শিহাবদের গ্রামের জমিজমা দেখে রাখার মতো কেউ যখন নেই, তখন গ্রামের লোকের ইচ্ছে মতো বেদখল করে রেখেছে সেসব। গত বছর ওর বাবা গ্রামে গিয়ে নিজের জমিজমা পুলিশ-টুলিশ সঙ্গে নিয়ে দখলমুক্ত করেছেন বলে বেদখলকারীরা নাখোশ। তারা শত্রু হয়ে দাঁড়ালো। এই নিয়ে শিহাবের বাবা বেশ চিন্তিত থাকেন। গ্রামের লোকের সেই শত্রুতার রেশ শহর পর্যন্ত আসতে কতোক্ষণ? এই সন্দেহটা মনে ধরলো শিহাবের। কেননা ওই অদ্ভুত লোকটি দেখতে অনেকটা গাঁইয়া। কাপড়চোপড় খুবই নোংরা। কাছাকাছি এলে লোকটার শরীর থেকে বোটকা গন্ধ ভেসে আসে। শিহাবের শরীর গুলিয়ে ওঠে।
লোকটির কথা বাবা-মা’র কাছে বললো শিহাব।
বাবা বললেন, খুব সাবধানে থেকো। ক্লাস টেনের ছাত্র তুমি, একেবারে ছোট নও। বুঝে-শুনে চলবে।
বাবার সঙ্গে শিহাবের যেদিন কথা হলো, তার পরদিন থেকে লোকটির দেখা পাওয়া গেল না আর। তাকে আর না দেখতে পেয়ে খুশি হলেও মনে মনে লোকটিকে খোঁজে শিহাব। কিন্তু না, একটানা পাঁচ-সাতদিন তাকে আর দেখতে পেল না ও।
তারপর হঠাৎ একদিন। খেলা শেষ করে বাড়ি ফিরছিল শিহাব। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে ততক্ষণে। ওদের পাড়ার কবরস্থানের কাছাকাছি আসতে লোকটিকে দেখতে পেল শিহাব। দেখে ভীষণ চমকে উঠল। বুকের বাঁ পাশটা অনবরত লাফালাফি করতে থাকলো ওর। আশপাশে তাকিয়ে শিহাব দেখলো কবরস্থানের কাছে-ধারে কোনো লোকজনও দেখা যাচ্ছে না। সন্ধ্যা আর কবরস্থানের নীরবতা জায়গাটাকে আরো বেশি নিরিবিলি করে তুলেছে এই মুহূর্তে। সামান্য দূরে লোকটির ছায়া দেখা যাচ্ছে আবছা। এমন পরিস্থিতিতেও তার চোখের দিকে তাকাতে ভুললো না শিহাব। ও দেখলো লোকটির চোখ দুটো যেন বেড়ালের চোখের মতো জ্বলজ্বল করছে!
থমকে দাঁড়ালো শিহাব। মনে মনে কামনা করছে রাস্তা ধরে কোনো লোক কিংবা রিকশা-টিকশা যদি এসে পড়তো! তখনই ও দেখলো লোকটা কবরস্থানে ঢুকে পড়লো। এই দৃশ্য দেখে বুকের বাঁ পাশের লাফালাফি আরো বেড়ে গেল শিহাবের। ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে এলো ও। একটুক্ষণ এই অবস্থায়ই দাঁড়িয়ে থেকে গুটিগুটি পায়ে হাঁটতে শুরু করলো। হাঁটতে হাঁটতে কবরস্থানের দেয়ালের উপর দিয়ে একবার তাকালো, লোকটির ছায়াও দেখতে পেল না ও।
যেন রোবটের মতো বাসায় এসে ঢুকলো শিহাব। তারপর থেকেই শরীর কেমন অসাড় লাগতে শুরু করলো। রাতে শরীর কাঁপিয়ে জ্বর এলো। একসময় জ্ঞান হারিয়ে ফেললো।
তিনদিন পর নিজেকে হাসপাতালের বেডে আবিষ্কার করলো শিহাব। শরীর সেই আগের মতো অসাড়।
একটানা কয়েক মাস অসুস্থ থাকলো শিহাব। তারপর আবার ভালো হয়ে উঠল। শরীর শুকিয়ে কাঠ। ওকে দেখে আগের শিহাবের সঙ্গে মেলাতে পারে না কেউ।
কদিন পরপরই অসুস্থ হয়ে পড়ে শিহাব। ওর মা বলেন, ‘সেই লোকটার দৃষ্টি ভালো ছিল না। অশুভ দৃষ্টি পড়েছে শিহাবের ওপর।’
মায়ের কথা শিহাবেরও বিশ্বাস হয়। কিন্তু যে লোকটাকে যে সেদিন সন্ধ্যাবেলা কবরস্থানে দেখেছিল, একথা কখনোই কারো কাছে বললো না ও। বলতেও যেন ভীষণ ভয় ওর।