ব্রীজ

মুখবন্ধঃ এই ভণিতাটুকুর প্রয়োজন ছিল। ধারাবাহিক লেখার ব্যাপারে আমার কিছু সুনাম ( প্রকারান্তরে দুর্নাম ) আছে। আমার ব্লগীয় বন্ধুদের অনেকেই মনে করেন যে আমি নাকি দিনের বেশিরভাগ সময় একটি বিশেষ জায়গা থেকে বেরোতেই পারিনা। যাক সেসব কথা, আপাতত এই লেখাটি পাঁচটি পর্বে শেষ করবার মানসিকতা নিয়ে মাঠে নেমেছি। আজ প্রথম কিস্তি। সমালোচনা কাম্য এবং প্রার্থনীয়।     -“ আজ তোদের একটা গল্প বলবো, একটা ব্রীজের গল্প।’’

-“ সে আবার কেমনধারা ব্যাপার? নায়ক নেই, নায়িকা নেই। খালি কিছু ঠুনকো লোহালক্কড় আর কংক্রিট ।”
-“ না না, উনি হয়ত তাস খেলার কথা বলছেন।”
-“ দূর, ওনার গল্পের নায়ক-নায়িকা শেষে ব্রীজের ওপরে দাঁড়িয়ে হাওয়া খাবে।”
-“ ধুর আঁতেলের দল, উনি…”
-“ তোরা সব থামবি? শোনাই যাক না উনি কি বলতে চান। আপনি শুরু করুন খুড়োমশাই ।”
এক ঃ
গোলবাড়ির সাদা পার্কের সামনে দিয়ে ধীরে হাঁটছিল অহনা। দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। ফাল্গুন মাস শুরু হতে আরও হপ্তা দুয়েক। পৌষমাসে বিয়ে খেতে না পারার অভিযোগ লুকিয়ে আছে আশেপাশের সমস্ত পথচলতি বাঙ্গালীর সাজসজ্জায়। মাঘের প্রথম বউভাতের দিনটা সপ্তাহান্তে পরায়, খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে করণিক থেকে বৈবাহিক সবাই। সামনের গলির ভেতরের বিয়েবাড়ির সানাই এর উদ্ভ্রান্ত সুর তার পাকা চুল নেড়ে সম্মতি দিচ্ছে অহনার কথাকে। ভাবতে ভাবতে একবার মণিবন্ধে বাঁধা ঘড়িটার দিকে অলস ভাবে চোখ বুলিয়ে নিলো সে। এখনো মিনিট কুড়ি দেরি আছে। মৈত্রেয়ী আসবে। কলেজে পড়ার সময় থেকে ওদের আলাপ। চাকরীসূত্রে দুজনেই এক শহরে থাকার সময় ঘনিষ্ঠতা। এবং অহনার বিদেশ নির্বাসনের সময় সেই ঘনিষ্ঠতা পরিণত হয় আমৃত্যু ভরসার বিশ্বাসে। সামনের সপ্তাহে অহনার বিয়ে। তাই হাজার কাজ ফেলে, মৈত্রেয়ী এসেছে কলকাতায়। গতকাল রাত্রে ফোনে কথা বলতে বলতে অনেক অনেক দিন পর নিঃসঙ্কোচে কেঁদে ফেলেছিল মৈত্রেয়ী। হকচকিয়ে গিয়েছিল অহনা। কাঁদবার কথা তো তার। যার সাথে বিয়ে হচ্ছে, সে থাকে পৃথিবীর অন্য গোলার্ধে। বাক্স প্যাঁটরা গুছিয়ে সেখানে চলে যাবে বলেই না এত দিন ধরে প্রেম করা, স্বপ্ন দেখা সবজে আলোর, নীলচে আকাশের তলায় বসে। সত্যি বলতে কি, অহনা নিজেও জানে না আর কখনও মৈত্রেয়ীর সাথে দেখা হবে কিনা। কাঁদতে কাঁদতেই ফোন রেখে দিয়েছিল মৈত্রেয়ী। তবে কি… কারণটা অনিমেষ? সেই ইসটুপিড গোবর গণেশ, তেল দিয়ে পেতে চুল আঁচড়ানো ক্যাবলা ছেলেটা? নাকি অন্য কিছু? ভেবে পায়নি সে। অবশ্য মৈত্রেয়ী চিরকাল বাঁধনহারা। কোন গল্পে না উপন্যাসে পড়েছিল প্রেমিক প্রেমিকাকে বেনারসে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল অ্যান্ড দে লিভড হ্যাপিলি এভার আফটার (!!!)। তাই শুভাশিসকে সেই সুযোগটা করে দিতে কাউকে কিছু না বলে শুভাশিসের সাথে হটাত করে বেনারস চলে গেলো। এই ঘটনা মৈত্রেয়ী অহনাকে জানিয়েছে গত বছর মে মাসে, শুভাশিসের সাথে বিয়ে হয়ে যাওয়ার মাসতিনেক পরে। অথবা বলা ভালো বিয়ে ভাঙ্গার উপক্রম হওয়াতে।
-“ আমি কিছুতেই ওকে ভুলতে পারছিনা রে। আমার শুধু মনে হচ্ছে আমি একসাথে তিনজনকে ঠকাচ্ছি।“
-“ তোমাকে কি অনি কিছু বলেছে এর মধ্যে?”
-“ বললে তো আমি বেঁচে যেতাম। ও তো আমার সাথে কোন কথা বলছে না। ফোন, মেসেজ বা ইমেইল তো ছেড়ে দে। বাড়িতে গেলেও দেখা করছে না।”
-“ তো তুমিই বা ওর জন্য এমন করছ কেন?”
-“ আমি জানি না। আমি শুধু চাই ও আমার সাথে আগের মত কথা বলুক।”
-“ ব্যাস!! আর কিছু না?”
-“ আমি জানি না। আমি সত্যিই জানি না।”
-“ তুমি কেন ওকে বিয়ে করলেনা মৈত্রেয়ীদি?”
-“ কারণ অনিকে আমার সবসময় একজন অভিভাবকের মত মনে হয়েছে। একজন খুব খুব ভালো সঙ্গী, আমার বাবা বা দাদার মত। কিন্তু ওকে কোন দিন চুমু খেতে ইচ্ছে করেনি আমার। এত গুলো ছেলে আমার জীবনে এসেছে কিন্তু আমি…আমি… ওর সাথে শুতে পারব না অহনা, বিশ্বাস কর। “
-“ তুমি কখনও ওর দিকটা একবার ভেবে দেখেছ মৈত্রেয়ীদি? প্রয়োজন মনে করেছ কখনও?”
-“ ঐ যে বললাম। ও আমার বাবা বা দাদা হলে ভালো হত।”
-“ মানে শুধু ওই তোমার কথা ভাববে, তোমার সব পাগলামি সহ্য করবে। আর তুমি…”
-“ এমন ভাবে বলিস না রে অহনা। আমি আর পারছিনা ।“
তিনটে বাজতে চলল প্রায়। যুগল ক্যাফের সামনে দাঁড়িয়ে ব্যাগ থেকে মোবাইলটা বের করে মৈত্রেয়ীর নম্বরটা ডায়াল করল অহনা। বার তিনেক রিং হবার পরে
-“ হ্যালো… “
ফোনটা অসঙ্কোচে কেটে দিয়ে মুখ তুলে তাকাল অহনা। সামনের ঝাঁকড়া অজানা গাছটা হলুদ ফুলে ভর্তি। তার ঠিক নিচেই বসেছিল একজন অন্ধ ভিখারি। সেই মুহূর্তে অহনার মনে হল এই পৃথিবীর অনেক মানুষের থেকে সে অনেক বেশী ভাগ্যবতী। কারণ লাল আকাশের পটভূমিকায় ওই হলুদ গাছটা সে দেখতে পাচ্ছে। ঠিক যেমন করে সে এখন চিনে নিতে পারল ওপাশের মানুষটার গলাটা। একবারও পেছনে না তাকিয়ে রাস্তায় নামল সে।
-“ ট্যাক্সি… বেহালা যাবেন ভাই?”
( চলবে…)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরো পড়তে পারেন...

আবিষ্কার

১ ‘ টুবলু, টুবলু, টুবলু উ উ উ ‘ মার গলা, অনেকক্ষন ধরেই শুনতে পাচ্ছি। …

সরল ও হাতি

সরল এখন খুব খুশি । কারণ সরল ইশকুলে ভর্তি হয়েছে । বাবু সরলকে ইশকুলে যেতে…

পুষুর দুঃস্বপ্ন

আলমারির তাকে থরে থরে সাজানো মধুভর্তি বয়ামগুলোর দিকে তাকিয়ে পুষুর দু চোখ চকচকিয়ে উঠলো। ‘কি…