ব্যাখ্যাতীত — মোহাম্মদ মুহিবুল্লাহ

ছোট্ট একটি গ্রাম কুসুমপুর। শামত্মশিষ্ট ও সৌন্দর্যমন্ডিত গ্রাম। চারদিকে সবুজের সমারোহ। আধুনিক শহুরে যান্ত্রিকতার ছোঁয়া এখনও লাগেনি। অনেকটা অজ পাড়া গাঁ বলতে যা বুঝায় তাই। গ্রামের অধিকাংশ লোক অশিক্ষিত কৃষক। সকালের মোরগের ডাকে, পাখির কলতানে তাদের ঘুম ভাঙ্গে। তারপর সারাদিন কাঠফাটা রোদ মাথায় নিয়ে ক্ষেতে কাজ করে, ফসল ফলায়। সেই ফসল চলে যায় শহরে। কৃষকরা ন্যায্যামূল্য পায় না। মাঝখানে পকেট ভারী হয় মধ্যসত্তবভোগী দালালদের। আর সেই ফসল খেয়েই বিলাসবহুল জীবন যাপন করে শহুরে বাবুরা। বরাবর অবহেলিত থেকে যায় গ্রামগুলো। তারপরও গ্রামবাসীদের খুব একটা আক্ষেপ নেই। তাদের কোন মতে বৌ পোলাপান নিয়ে খেয়েদেয়ে বেঁচে থাকতে পারলেই চলে।
গ্রামের লোকজন খুব মিশুক। পুরো গ্রামবাসী একে অপরের খোঁজখবর নেয়, সুখ-দুঃখ শেয়ার করে, বিপদে আপদে একে অপরকে সাহায্য করে। শহুরে ব্যসত্মতা তাদের মধ্যে তাদের মধ্যে নেই, যে ব্যসত্মতার জন্য পাশের ফ্ল্যাটের লোকদের খবরও নেয়া যায় না।
প্রকৃতির মাঝে তারা জন্মগ্রহণ করে, প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্যে বড় হয় এবং এক সময় প্রকৃতির কোলে হারিয়ে যায়। তাই তাদের জীবন যাপনও প্রকৃতির মত কুটিলতাহীন তবে রহস্যময়।
সুখে-দু:খে ভালই কেটে যাচ্ছিল গ্রামবাসীর জীবন। কিন্তু তাদের সে জীবন যাপনের উপর এল রহস্যময় এক আঘাত। অন্যান্য দিনের মত সেদিনও ক্ষেতে গিয়েছিল গ্রামের কৃষকেরা। কিন্তু তাদের সেই যাওয়া আর ফিরে আসায় রূপামত্মরিত হয়নি। একদিনের মধ্যেই ভোজবাজির মত উধাও হয়ে গেল ২১ জন কৃষক। পুরো গ্রামে হৈ চৈ পড়ে গেল। স্থানীয় মিডিয়ার কল্যাণে এক সময় তা জাতীয় পর্যায়ে এবং শেষ পর্যমত্ম আমত্মর্জাতিক মিডিয়ার সংবাদে পরিণত হল।
বিশ্বের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত হল তদমত্ম কমিটি। পুরো গ্রাম ঘুরে গেল তদমত্ম কমিটি। পত্রিকায় ফলো আপ হল কয়েক সপ্তাহ ধরে। বিশেষজ্ঞদের বরাত দিয়ে কোন পত্রিকা বলল- এটা এলিয়েনদের কাজ। কেউ কেউ আরও নতুন নতুন তত্ত্ব দিল। একটি পত্রিকা রিপোর্ট করল- ‘‘…………….পৃথিবীর মত অসংখ্য সমামত্মরাল জগত রয়েছে। আর পৃথিবীর কিছু কিছু জায়গায় রয়েছে দুর্বল স্থান। আর এ দুর্বল স্থানে যখন কোন মানুষের পা পড়ে তখনই সে হাজির হয় অন্য একটি জগতে, অন্য একটি সময়ে। তবে এই দুর্বল স্থান গুলো সবসময় সক্রিয় থাকে না। ধারণা করা হচ্ছে, কুসুমপুর গ্রামে এই রকম দুর্বল স্থান রয়েছে। আর সেই দুর্বল স্থানে পড়ে হারিয়ে গেছে কৃষকেরা………।’’
গ্রামবাসীদের কেউ কেউ ছুটল হাজিরা দেখার জন্য। এসব বিষয়ে অশিক্ষিত গ্রামবাসীদের বিশ্বাস খুবই দৃঢ়। সেখানে বলা হল- ‘খুবই খারাপ জ্বীনের খপ্পরে পড়েছে কৃষকেরা। তারা আর কখনো ফিরে আসবে না।’
সময়ের সাথে আসেত্ম আসেত্ম উৎসাহে ভাটা পড়ল গ্রামবাসীর। যে যার কাজে ব্যসত্ম হয়ে পড়ল। রহস্যে মোড়ানো ঘটানাগুলোর মধ্যে একটা হয়ে থাকল একুশ কৃষকের হারিয়ে যাওয়ার ঘটনাটি।
দুই.
ঘরের উঠানে দাঁড়িয়ে অতীতের কথা ভেবে স্বসিত্মর নি:শ্বাস ফেললেন জামিলা খাতুন। আজ তাকে মোটামুটি স্বচছল বলা যায়। অথচ আঠারো বছর আগে কি অবস্থায় না ছিলেন তিনি। ভেবে বিস্মিত হন। ভাবেন, আল্লাহ সবাইকে সব সময় একই রকম রাখেন না। আজ থেকে আঠারো বছর আগে সবার মত তারও একটি সুখের সংসার ছিল। স্বামী ছিল, ছেলে মেয়ে ছিল। সুখে-দুঃখে ভালই কেটে যাচ্ছিল দিন। কিন্তু সে সুখ তার কপালে বেশিদিন সইল না। আঘাত হানল দুঃখ। অন্যান্য দিনের মত সেদিনও ক্ষেতে কাজ করতে গিয়েছিল তার স্বামী। কিন্তু আর ফিরে আসেনি। গ্রামের অন্য ২০ জন কৃষকের মত কোথায় যেন হারিয়ে গেল। ছোট ছোট তিন ছেলে মেয়ে নিয়ে অথৈ সাগরে পড়লেন জামিলা খাতুন। কিন্তু ধৈর্য্যহারা হলেন না। ছেলেমেয়েদের দিকে তাকিয়ে সংসারের হাল ধরলেন। সরকারের কাজ থেকে পাওয়া অনুদান দিয়ে বাড়ির চারপাশে শাক-সবজির ক্ষেত করলেন। রাত জেগে হাতপাখা, শীতলপাটি তৈরি করলেন, কখনো জাল বুনলেন। এভাবে সংসারের খরচ সামাল দিয়ে ছেলে মেয়েদের পড়ালেখা করালেন। বড় ছেলে এস.এস.সি পাশ করে হালচাষ করছে। ছোট ছেলে শহরে কলেজে পড়ালেখা করছে। মেয়েকে ভাল ঘর দেখে বিয়ে দিয়েছেন। আজ তার কুঁড়ে ঘরের জায়গায় মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে সেমি পাকা ঘর। জামিলা খাতুন আজ এত বছর পর ভেবে অবাক হন কোথায় ছিলেন, কোথায় এসেছেন? স্বামী হারিয়ে যাওয়ার আঠারো বছর পরও তিনি স্বামীর পথ চেয়ে বসে আছেন। তার বিশ্বাস-তার স্বামী একদিন ফিরে আসবেই (!)।
তিন.
কাঠফাটা রোদে অনেকক্ষণ কাজ করে ক্লামত্ম রফিক মিয়া। তিনি উঠে আসলেন ক্ষেত থেকে। আজ দু’দিন যাবত গায়ে জ্বর জ্বর ভাব। তাই আজ একটু তাড়াতাড়িই বাড়ি যাওয়ার মনস্থির করলেন। পাশের ক্ষেতে কাজ করতে থাকা রমজান আলীকে উদ্দেশ করে বললেন- ‘‘ও রমজান মিয়া, বাড়িত যাইবানি?’’
‘‘আপনে যান মিয়া ভাই, আমি কাজটা শেষ কইরা আইতেছি।’’ উত্তর দিল রমজান আলী।
রফিক মিয়া আসেত্ম আসেত্ম হেঁটে বাড়ির পথ ধরলেন। বড় সড়কের উপর উঠে অবাক হন। এ কোথায় এলেন তিনি? আজ সকালেই যে মেঠো পথ ধরে ক্ষেতে গেছেন তিনি, সে মাটির রাসত্মা কিনা দুপুরের মধ্যে শহরের মত পিচ করা হয়ে গেছে? আশে পাশে তাকান তিনি। সবকিছু তার কাছে নতুন মনে হয়। একটা ঘোরের মধ্যে হাঁটতে থাকেন রফিক মিয়া। মসজিদের সামনে এসে তার অজ্ঞান হওয়ার জোগাড়। যে মাটির মসজিদে আজ সকালেও তিনি নামাজ পড়েছেন সে মসজিদ দুপুরের মধ্যেই হয়ে গেছে পাকা। যে পুকুরে আজ সকালে মুখ ধুয়েছেন একটি খেজুর গাছের ঘাটে বসে, সেই পুকুরে এখন পাকা বাঁধানো ঘাট। হাত মুখ না ধুয়েই কাদামাটিসহ বাড়ির দিকে পা বাড়ালেন তিনি। পথে দুই তিনজন অপরিচিত লোককে দেখলেন। সবাই তাকে অবাক দৃষ্টিতে দেখছে। তিনি বাড়ির উঠানে এসে দেখলেন তার সে ছনের কুড়ে ঘর, সেমি পাকা ঘরে রূপ নিয়েছে। বিস্মিত হওয়ার শেষ পর্যায়ে উপনিত হলেন তিনি। যে কোন সময় মাথা ঘুরে পড়ে যাবেন অবস্থা। সর্ব শক্তি দিয়ে ডাক ছাড়লেন তিনি- ‘‘ও শফিউল্লাহ্র মা শুনছনি।’’
জামিলা খাতুন ঘরের ভেতর বসে ছিলেন। আঠারো বছর আগের সে ডাক শুনে অবাক হলেন, ছুটে এলেন উঠানে। রফিক মিয়াকে দেখে চমকে উঠে দাঁড়িয়ে রইলেন এক মিনিট। তারপর ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরলেন তাকে। ছুড়ে দিলেন একগাধা প্রশ্ন- ‘‘আপনে এতদিন কোথায় ছিলেন? কি রকম ছিলেন? আপনে দেখি একটু বদলান নাই?’’ রফিক মিয়া কোন প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ফ্যাল ফ্যাল চোখে তাকিয়ে থাকেন চারদিকে।
এ সময় আসেত্ম আসেত্ম লোকজনে ভিড় হয়ে যায় বাড়ির উঠানে।
চার.
কুসুমপুর গ্রামে হৈ চৈ পড়ে গেল। শুধু কুসুমপুর নয় স্যাটেলাইট মিডিয়ার কল্যাণে পুরো বিশেব খবরটি ছড়িয়ে পড়ল। আঠারো বছর আগে হারিয়ে যাওয়া সেই ২১ জন মানুষ আবার ফিরে এসেছে। তাদের কোন পরিবর্তন হয়নি। পৃথিবীর আঠারো বছর তাদের কাছে সকাল থেকে দুপুর মাত্র। পৃথিবী এগিয়ে গেছে আঠারো বছর। সে অনুযায়ী পৃথিবীর মানুষের বয়স বদলেছে। শিশুরা যুবক হয়েছে, যুবকরা বৃদ্ধ হয়েছে। কিন্তু ২১ জন মানুষ ঠিক আগের মতই রয়ে গেছে। কোনো পরিবর্তন হয়নি তাদের। পৃথিবী ও তাদের মধ্যে রহস্যময় সূক্ষ্ম পর্দা হয়ে বয়ে গেছে আঠারোটি বছর।

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!