ব্যবসায়ী ও তার তিন ছেলের গল্প (পঞ্চম পর্ব)

জুযারকে আব্দুস সামাদ সবকিছু শিখিয়ে দিয়ে বললো: সপ্তম দরোজার বিপদ কেটে ওঠার পর সামনে পড়বে গুপ্ত ধন-ভাণ্ডারের দরোজা। ওই দরোজা তোমার সামনে খুলে যাবে। দেখবে একটা পর্দা একেবারে ছাদ থেকে মাটি পর্যন্ত ঝুলছে। পর্দাটা সরিয়ে ফেলবে। পর্দা গুটিয়ে নিলেই দেখতে পাবে গুপ্তধন-ভাণ্ডার শামারদাল সিন্দুক একটা চৌকির ওপর বসানো। শামারদালের ওপর গ্লোবের মতো জ্বলজ্বলে একটা বল দেখতে পাবে। গ্লোবের মাঝখানে একটা যাদুর তলোয়ার বাঁধা আছে। ঐ তলোয়ারের হাতলে মণিরত্নের একটা আংটি আছে।  আছে একটা চেইন। চেইনে বাঁধা আছে সুরমাদানি। এই চারটি জিনিস নিয়ে তুমি বেরিয়ে আসবে। আমি বাইরে অপেক্ষায় থাকবো।

 

জুযার উঠে দাঁড়িয়ে বললো: আল্লাহ ভরসা। আমি চললাম’। আব্দুস সামাদ আগুনে ধূপ জ্বালিয়ে দোয়া করতে শুরু করলো। জুযারের চোখ পড়লো নহরের দিকে। দেখলো সেখানে পানির প্রবাহ নেই, শুকিয়ে গেছে। শুকনো সেই নালায় বিরাট একটা সোনালি দরোজা। জুযার দরোজার দিকে এগিয়ে গেল। দরোজার সোনালি কড়াগুলো তিনবার নাড়লো। দরোজার ওপাশ থেকে কেউ একজন চীৎকার করে উঠলো: কে কড়া নাড়ছে?

জুযার বললো: আমি মাছ শিকারি জুযার।

 

দরোজা খুলে গেল। তারপর আব্দুস সামাদ যেভাবে যা যা করতে বলেছিল জুযার ঠিক তাই করলো। তাই একের পর এক দরোজা খুলতে লাগলো। মোট ছয়টি দরোজার যাদু নষ্ট হয়ে গেল। এরপর গেল সপ্তম দরোজায়। যথারীতি সেই দরোজাতেও কড়া নাড়লো। তারপর ঘটলো মজার ঘটনা।

 

 

দরোজা খুলে গেল ঠিকই। কিন্তু জুযার দেখতে পেল তার মায়ের মায়াময় চেহারা। মা দুহাত মেলে জুযারকে বুকে জড়িয়ে ধরতে চাইলো, চুমু খেতে চাইলো। ক্ষণিকের জন্য জুযারের মনটা নরম হয়ে গেল। পরক্ষণেই তার মনে পড়ে গেল আব্দুস সামাদের কথা। সে চীৎকার করে উঠলো: সরে যাও, তোমার মুখোশ থেকে বেরিয়ে আসো।

 

মা বললো: এ কী বলছো বাবা! তুমি আমাকে ভুলে গেছো! আমি তোমার মা!

জুযার তাড়াতাড়ি করে দেয়ালে রাখা তলোয়ার হাতে নিলো। মায়ের দিকে তলোয়ার নিয়ে এগিয়ে গিয়ে বললো: তুই আমার মা না! তুই তাড়াতাড়ি তোর মুখোশ খুলে ফেল। নৈলে আমি তোকে এই তলোয়ার দিয়ে আঘাত করবো।

 

মা কেঁদে ফেললো। বললো: আমি তোকে জন্ম দিয়েছি, দুধ খাইয়েছি, ছোটো থেকে লালন পালন করে বড়ো করেছি। কতো কষ্ট করেছি। আর তুই এখন আমার তার এই পুরস্কার দিতে চাচ্ছিস, মেরে ফেলতে চাস আমাকে? জুযার মায়ের কান্নাজড়িত কণ্ঠে কাকুতি মিনতি শুনে খানিকটা থমকে গেল। মনের ভেতরে তার মায়ের প্রতি দরদ তৈরি হলো। তলোয়ারটা মাটিতে ফেলে দিয়ে বললো: ‘মা! আমাকে মাফ করে দাও! আমার ওপর তোমার’…

জুযারের কথা শেষ না হতেই মায়ের চেহারা পাল্টে গেলো। এক মহিলা, দেখতে যেমন ভয়ংকর তেমনি জবুথবু এক বৃদ্ধা যাদুকর চীৎকার করে বলে উঠলো: জুযার ভুল করেছে। জুযার ভুল করেছে। ওকে মারো, আচ্ছা রকম মারো।

 

যাদুর বুড়ি একথা বলতে না বলতেই কুৎসিত চেহারার বহু পাহারাদার এসে জুযারকে মারতে শুরু করলো। মারতে মারতে গুপ্তধন ভাণ্ডারের বাইরে ফেলে দিলো। গুপ্তধন ভাণ্ডারের দুয়ার বন্ধ হয়ে গেল। ঝর্ণাধারার পানি আগের মতোই প্রবাহিত হতে লাগলো। জ্ঞান ফেরার পর জুযার তার মাথার কাছে আব্দুস সামাদকে দেখতে পেল। জুযার কাঁদতে কাঁদতে যা যা ঘটেছিল সব খুলে বললো। আব্দুস সামাদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো: আমি তোমাকে কতোবার বলেছি ও তোমার মা নয়, তুমি তার প্রতারণার ফাঁদে পা দেবে না। তার যাদুটা যদি নিষ্ক্রিয় করে দিতে পারতে তাহলে গুপ্তধনের কাছে পৌঁছে যেতে পারতে। এখন আর কিচ্ছু করার নেই। চলো ফিরে যাই। এক বছর অপেক্ষা করতে হবে। পরের বছর ঠিক এই দিনটা আসুক, তারপর দেখা যাক কী করা যায়। সেদিন পর্যন্ত তুমি আমার সাথেই থাকো।

জুযার আর আব্দুস সামাদ ফিরে গেল শহরে। এরপর এক বছর পর্যন্ত জুযার আব্দুস সামাদের কাছেই থাকলো। এক বছর পর সেই দিনটি পুনরায় যখন এলো তারা তখন সেই ঝর্নাপ্রবাহের তীরে গেল। এবার জুযার বেশ সাহসিকতার সাথে ছয়টি দরোজাই খুলে ফেললো,কোনো যাদুতেই কাজ হয় নি। সব সে বাতিল করে দিয়েছে। সপ্তম দরোজায় আসার পর আগের মতোই তার মা এসে দরোজা খুলে দিল। জুযার এবার আর প্রতারিত হতে চায় না। দেয়াল থেকে তলোয়ার হাতে নিয়ে দৃঢ়তার সাথেই এগিয়ে গেল যাদুময়ী মায়ের দিকে। জুযারের মা আগের মতোই ব্যাপক কাকুতি মিনতি করল তাকে না মারার জন্য। কিন্তু সে এবার আর প্রতারিত হবে না বলেই দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিল। অবশেষে যাদুকর মহিলা তার আসল চেহারায় রূপান্তরিত হল। তার বিশ্রী চেহারা বেরিয়ে এলো। মাটিতে লুটিয়ে পড়তেই তার যাদুর সকল শক্তি হারিয়ে গেল।

 

 

যাদুকর মহিলাকে পরাস্ত করে জুযার চলে গেল গুপ্তধন ভাণ্ডারের আসল দরোজায়। দরোজা সহজেই খুলে গেল এবং ভেতরে ঢুকে পড়লো সে। তলোয়ার, আংটি, সুরমাদানি আর কথা বলতে জানা গ্লোবটি নিয়ে তাড়াতাড়ি বেরুবার দরোজার দিকে গেল। হঠাৎ শুরু হয়ে গেল তবলার বাজনা। চারদিকেই বাজছে তবলা। সে কি সাংঘাতিক ব্যাপার। গুপ্তধন ভাণ্ডারের প্রহরীরা বাজাচ্ছিল ওই তবলা। তারা সবাই জুযারকে অভিনন্দন জানাচ্ছিল। সমস্বরে সবাই বললো: হে জুযার! তোমার জন্য এই গুপ্তধন মোবারকবাদ। জুযার বেরিয়ে এলো ওই দরোজা দিয়ে। আব্দুস সামাদ তার দিকে দৌড়ে গেল। জুযারকে বুকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেল।

 

জুযার যে চারটি জিনিস গুপ্ত ধনভাণ্ডার থেকে এনেছিল আব্দুস সামাদের হাতে দিল, তারপর দুজনেই চলে গেল শহরে। বাড়িতে গিয়ে খাওয়া দাওয়া করে পথের ক্লান্তি দূর করলো। আব্দুস সামাদ জুযারকে বললো: ‘তুমি আমার জন্য অনেক কষ্ট করেছো! এখন বলো, তুমি আমার কাছে কী পুরস্কার চাও’!

 

জুযার বললো: আমি একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কারো কাছে কিছু চাই না।  তবে তুমি যদি দিতেই চাও, তাহলে তোমার ওই যাদুর জিনটা আমাকে দিতে পারো!

 

আব্দুস সামাদ বললো: আহ হা! তুমি যদি আরো মূল্যবান কিছু চাইতে আমার কাছে! এই জিন তো শুধু খাবারের জন্য। ঠিক আছে, আমি তোমাকে ওই জিনের সাথে আরেকটা স্বর্ণভর্তি জিন দিচ্ছি।

 

এই বলে সে একটা গোলামকে ডেকে বললো: স্বর্ণ রত্ন ভর্তি একটি জিন জুযারকে দাও! তাকে খচ্চরের পিঠে চড়িয়ে বাড়িতে পৌঁছিয়ে দিয়ে খচ্চর নিয়ে ফিরে আসবে। এরপর আব্দুস সামাদ জুযারকে জিনের ভেতর থেকে খাবার সংগ্রহের রহস্য শিখিয়ে দিলো। গোলাম জুযারকে নিয়ে পৌঁছিয়ে দিলো তার বাড়িতে। বাড়িতে যাবার পথে সে তার মাকে দেখলো ভিক্ষা করছে। চীৎকার করে উঠলো জুযার। দ্রুত মায়ের কাছে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করলো। মাকে খচ্চরের পিঠে চড়িয়ে নিয়ে গেল বাড়িতে। যাবার পথে মা জুযারকে বললো: যে স্বর্ণমুদ্রাগুলো তুমি দিয়ে গেছো বাবা! তোমার ভাইয়েরা প্রতারণা করে সেগুলো আমার কাছ থেকে নিয়ে গেছে’।

জুযার মাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললো: ভেবো না মা! আমি তো ফিরে এসেছি।

এই বলে রঙিন একটি দস্তরখান বিছালো জুযার।#

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!