ব্যবসায়ী ও তার তিন ছেলের গল্প (ষষ্ঠ পর্ব)

সপ্তম দরোজার বিপদ কেটে না ওঠার কারণে জুযার এক বছর আব্দুস সামাদের কাছে ছিল পরবর্তী বছরের ঐদিনটির জন্য। এক বছর পর সেই দিনটিতে আবারো একই নিয়মে জুযার ঢুকলো গুপ্তধন ভাণ্ডারের ভেতর। ছয়টি দরোজা ঠিকঠাক পেরিয়ে যাবার পর সপ্তম দরোজায় এবার আর যাদুকর মা তাকে প্রতারিত করতে পারলো না। এবার ঠিকই সফল হলো এবং প্রয়োজনীয় চারটি জিনিস নিয়ে ফিরে এলো। আব্দুস সামাদ তাকে পুরস্কৃত করলো। ওই পুরস্কার নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে জুযার দেখলো তার মা পথে ভিক্ষা করছে। মা জানালো, ভাইয়েরা প্রতারণা করে মায়ের কাছ থেকে সবকটি স্বর্ণমুদ্রা নিয়ে গেছে। জুযার মাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলো: ভেবো না মা! আমি তো ফিরে এসেছি’। বাসায় ফিরে সে একটি দস্তরখান বিছালো, তাতে সাজালো বিচিত্র সব উন্নত খাবার।

 

জুযার যাদুময় জিনের রহস্যটা মাকে বলে দিয়ে বললো আর কাউকে যেন না বলে। এদিকে জুযারের ভাইয়েরা মায়ের কাছ থেকে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে স্বর্ণমুদ্রাগুলো জোর করে ছিনিয়ে নিয়ে খরচ করে ফেলে পুনরায় আগের অবস্থায় ফিরে গেছে। কিন্তু যাবে কোথায়! আবার ফিরে এসেছে জুযারের ঘরে। জুযার তার স্বাভাবিক উদারতাবশত ভাইয়ের দোষত্রুটি ক্ষমা করে দিয়ে সাদরে গ্রহণ করে নিলো তাদেরকে। জুযার প্রতিদিন মজার মজার সব খাবার দাবারের আয়োজন করতো আর সবাই মিলে সেগুলো খেত, যেগুলো বাকি থাকতো সেগুলো বিলিয়ে দিতো গরিবদের মাঝে।

 

এক রাতে জুযার ঘুমিয়ে পড়েছিল। সেই সুযোগে তার ভাইয়েরা মায়ের কাছে ওই খাবারের রহস্য সম্পর্কে জানতে চাইলো। মা তো! কোনোভাবেই লুকিয়ে রাখতে পারলো না। ছেলেদেরকে বলে দিলো সব। তবে তারা যেন আর কাউকে এ ব্যাপারে না বলে সে বিষয়ে সতর্ক করে দিলো। কিন্তু সেলিম এবং সালেম আবারও দুর্বুদ্ধি আঁটলো। কী করে ওই যাদুর জিনটাকে হাত করা যায় তার পেছনে লাগলো তারা। একজন নাবিকের কাছে গিয়ে নৌকা কেরায়া করলো। উদ্দেশ্য হলো জুযারকে ঘুমন্ত অবস্থায় তাদের সাথে নিয়ে যাওয়া।

 

মাঝরাতে জুযার যখন গভীর ঘুমে অচেতন সেলিম এবং সালেম তখন নাবিক এবং তার দুই বন্ধুসহ জুযারের ঘরে গিয়ে তার মুখ-হাত বেঁধে ফেললো। এরপর জুযারকে জোর করে ঘরের বাইরে নিয়ে গেল। নাবিক এবং তার সঙ্গীরা জুযারকে তুলে নিয়ে নৗকায় ওঠালো। নৌকা ছেড়ে দিলো। সমুদ্রের উদ্দেশ্যে নাবিক যাত্রা শুরু করলো।

 

সকালবেলা সেলিম আর সালেম এলো মায়ের কাছে। তারা মা’কে বললো: মা! জুযার তো তার অতিথি বন্ধুদের সাথে চলে গেছে।

 

মায়ের মন ভারি হয়ে গেল। দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন তিনি। জুযারের অনুপস্থিতির কারণে কাঁদতে শুরু করে দিলেন। সেলিম ও সালেম বললো: তুমি তো আমাদের চেয়ে জুযারকে বেশি ভালোবাসো!

 

মা বললেন: তোমরাও আমারই সন্তান। তোমাদেরকেও আমি ভালোবাসি। কিন্তু তোমাদের বাবা মারা যাবার পর তোমাদের কাছ থেকে দুর্ব্যবহার ছাড়া আর কিছুই পাই নি।অথচ আমার প্রতি জুযারের মেহেরবানি ছিল সবসময়। কখনোই সে আমার সাথে খারাপ আচরণ করে নি, সদয় ছিল সে।

 

সেলিম আর সালেম এসব কথা শুনে রেগে গেল। মায়ের সাথে ঝগড়া বাধিয়ে দিল তারা। ঝগড়া করতে করতে মায়ের গায়ে আঘাত করলো। এরপর জুযারের জিন দুটো কেড়ে নিয়ে গেল। একটা জিনে স্বর্ণরত্ন ভর্তি করা ছিল। সেগুলো তারা ভাগ করে নিলো। কিন্তু যাদুকরী জিনটা নিয়ে দু’জনের মধ্যে ঝগড়া লেগে গেল। ঝগড়ার মাঝে তারা সিদ্ধান্ত নিলো জিনটাকে কেটে দু’ভাগ করে দু’জনে ভাগ করে নেবে। কিন্তু মা চীৎকার করে উঠলেন। বললেন: ওই গাধারা! এই জিন ভাগ করা যাবে না, ভাগ করলে ওই জিন আর কাজ করবে না, বৈশিষ্ট্য হারিয়ে যাবে। জিনটাকে আমার কাছে রেখে দে! যখন তোদের খাবারের দরকার হবে আমার কাছে এসে নিয়ে যাবি।

 

 

কিন্তু কে শোনে কার কথা! মায়ের কথা কেউই কানে তুললো না। সকাল পর্যন্ত ওই যাদুকরী জিন নিয়ে সেলিম সালেম ঝগড়া করলো। ঘটনাক্রমে তাদের এক প্রতিবেশীর বাসায় বাদশার একজন সৈনিক আমন্ত্রিত অতিথি ছিলেন। সে সেলিম সালেমের ঝগড়াঝাঁটি এবং যাদুকরী জিনের বিষয়টি শুনে ফেলে। সকালবেলা ওই সৈনিক বাদশার দরবারে ফিরে গিয়ে ঘটনাটা বলে দিলো। শাহ তাড়াতাড়ি সেনাবাহিনী পাঠিয়ে সেলিম সালেমকে ধরিয়ে নিয়ে গেল। তাদের আচ্ছামতো পিটিয়ে যাদুকরী জিনের কথা স্বীকার করতে বাধ্য করলো। বাদশাহ শেষ পর্যন্ত যাদুকরী জিনটা তাদের কাছ থেকে নিয়ে গেল এবং তাদের দু’জনকেই পাঠিয়ে দিলো কারাগারে।

 

এরপর এক বছর কেটে গেল। সেলিম ও সালেম কারাগারে আর জুযার নৌকায় কাজ করছে। একদিন সমুদ্রে ভীষণ ঝড় উঠলো। তুফানে নৌকা ডুবে গেল সমুদ্রে। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো নৌকার সকল যাত্রীই ডুবে গিয়ে মারা গেল কেবল জুযার ছাড়া। জুযার সাঁতরে তীরে উঠে গেল। এরপর ধীরে ধীরে উঠে হাঁটতে শুরু করলো। হাঁটতে হাঁটতে এক কাফেলার সাথে ভীড়ে গেল। ওই কাফেলা সৌদিআরবের দিকে যাচ্ছিলো। কাফেলার নেতা ছিলেন ব্যবসায়ী তবে তার মনটা ছিল বেশ উদার। সে জুযারকে দেখে তার সব ঘটনা শুনলো। ব্যবসায়ী জুযারকে বললো: তুমি আমার সাথে চলো, আমার সাথে কাজ করো! জুযার ব্যবসায়ীর প্রস্তাব মেনে নিলো এবং কাফেলার সাথে রওনা হলো।

 

তারা একসময় জেদ্দায় গিয়ে পৌঁছলো। ঘটনাক্রমে সেই সময়টা ছিল হজ্বের মৌসুম। ব্যবসায়ী আল্লাহর ঘর কাবা যিয়ারত করার সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি জুযারকেও তাঁর সাথে মক্কায় নিয়ে গেলেন। কাবা শরিফ তওয়াফ করছিল জুযার। হঠাৎ তার দৃষ্টি পড়ে গেল একজন চেনা চেনা লোকের ওপর। সে আর কেউ নয় স্বয়ং আব্দুস সামাদ। জুযার দৌড়ে গিয়ে তাকে সালাম করলো। আব্দুস সামাদ জুযারকে দেখে খুশি হলো। একেবারে তাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেলো। তারপর জানতে চাইলো: কী করছো এখানে?

জুযার সব ঘটনা তাকে খুলে বললো। আব্দুস সামাদ সব শুনে তাকে তার ঘরে নিয়ে গেল। তাকে খুব আদর যত্ন করে বললো: ‘জুযার! আমার মনে হচ্ছে তোমার কষ্টের দিন শেষ হয়ে এসেছে। তুমি হজ্বের কাজ শেষ করে আমার সাথে চলো’।

জুযার ব্যবসায়ীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আব্দুস সামাদের সাথে চলে গেল।

 

আব্দুস সামাদ যে মণিরত্নের আংটিটা গুপ্তধন ভাণ্ডার থেকে জুযারকে দিয়ে এনেছিল ওই আংটিটা তাকে দান করে দিয়ে বললো: ‘যখনই তোমার কোনো কিছুর প্রয়োজন হবে এই আংটির পাথরের ওপর হাত রাখবে। রা’দ বা বজ্রপাত নামের এক খাদেম তখনই তোমার সবাই হাজির হয়ে যাবে। তাকে তুমি তোমার চাহিদাটা জানাবে। ব্যস’। কথা বলতে বলতে আব্দুস সামাদ নিজেই পাথরের ওপর হাত রাখলো। রাদ এসে হাজির হলো। জুযারকে দেখিয়ে বললো: হে রাদ! আজ থেকে এ হলো তোমার মালিক। রাদ জুযারের দিকে তাকিয়ে বললো: ‘আমি আপনার সেবায় হাজির’।

জুযার খানিক ভেবে বললো: ‘রাদ! আমি চাচ্ছি আমার নিজের শহরে নিজের ঘরে যেতে’।

 

তারপর আব্দুস সামাদের কাছ থেকে বিদায় নিলো। আংটিটা আঙুলে পরে রাদের ঘাড়ে চড়লো। রাদ তর্জন গর্জন করে শূন্যে উড়াল দিলো। ঘণ্টাখানেক শূন্যে উড়ে জুযারের বাড়ির আঙিনায় তাকে নামিয়ে দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল।#

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!