বোকা সাথী

এক নাপিত । তার সঙ্গে এক জোলার খুব ভাব । নাপিত লোককে কামাইয়া বেশী পয়সা উপার্জন করিতে পারে না ।

জোলাও কাপড় বুনিয়া বেশী লাভ করিতে পারে না । দুই জনেরই খুব টানাটানি । আর টানাটানি বলিয়া কাহারও বউ কাহাকে দেখিতে পারে না ।

এটা কিনিয়া আন নাই, ওটা কিনিয়া আন নাই বলিয়া বউরা দিনরাতই কেবল মিটির মিটির করে ।

কাহাতক আর ইহা সহ্য করা যায় ।
একদিন জোলা যাইয়া নাপিতকে বলিল “বউ এর জ্বালায় আর তো বাড়িতে টিকিতে পারি না ।”
নাপিত জবাব দিল “ভাইরে! যাইয়া আমারও সেই কথা । দেখনা আজ পিছার বাড়ি দিয়া আমার পিঠের ছাল আর রাখে নাই।”
জোলা জিঙ্গাসা করে, “আচ্ছা ভাই,ইহার কোন বিহিত করা যায় না ?”
নাপিত বলে, “চল ভাই , আমরা দেশ ছাড়িয়া বিদেশে চলিয়া যাই । সেখানে বউরা আমাদের খুঁজিয়া পাইবে না;

আর জ্বালাতনও করিতে পারিবে না।”
সত্য সত্যই একদিন তাহারা দেশ ছাড়িয়া পালাইয়া চলিল ।
এদেশ ছাড়াইয়া ওদেশ ছাড়াইয়া যাইতে যাইতে তাহারা এক বিজন বন-জঙ্গলের মধ্যে আসিয়া পড়িল ।

এখন সময় হালুম হালুম করিয়া এক বাঘ আসিয়া তাদের সামনে খাড়া । ভয়ে জোলা তো ঠিক ঠিক করিয়া কাঁপিতেছে ।
নাপিত তারাতাড়ি তার ঝুলি হইতে একখানা আয়না বাহির করিয়া বাঘের মুখের সামনে ধরিয়া বলিল,

“এই বাঘটা তো আগেই ধরিয়াছি । জোলা! তুই দড়ি বাহির কর-সামনের বাঘটাকেও বাঁধিয়া ফেলি।”
বাঘ আয়নার মধ্যে তার নিজের ছবি দেখিয়া ভাবিল, এরা না জানি কত বড় পালয়ান । একটা বাঘকে ধরিয়া রাখিয়াছে ।

আবার আমাকেও বাঁধিয়া রাখিতে দড়ি বাহির করিতেছে ।এই না ভাবিয়া বাঘ লেজ উঠাইয়া দে চম্পট ।
জোলা তখনও ঠির ঠির করিয়া কাঁপিতেছে । বনের মধ্যে আধাঁর করিয়া রাত আসিল । ধারে-কাছে কোনো ঘর বাড়ি নাই ।

সেখানে দাঁড়িইয়া থাকিলে বাঘের পেটে যাইতে হইবে । সামনে ছিল একটা বড় গাছ ।

দুইজন যুক্তি করিয়া সেই গাছে উঠিয়া পড়িল ।
এদিকে হইয়াছে কি? সেই যে বাঘ ভয় পাইয়া পালাইয়া গিয়াছিল, সে যাইয়া আর সব বাঘদের বলিল,

“ওমুক গাছের তলায় দুইজন পালয়ান আসিয়াছে । তাহারা একটা বাঘকে ধরিয়া রাখিয়াছে আসিয়াছি ।

তোমার কেহ ওপথ দিয়া যাইও না।”
বাঘের মধ্যে যে মোড়ল- সেই জাঁদরেল বাঘ বলিল, “কিসের পালোয়ান? মানুষ কি বাঘের সাথে পারে?

চল সকলে মিলিয়া দেখিয়া আসি।”
জঙ্গী বাঘ-সিঙ্গি বাঘ-মামদু বাঘ-খুঁতখুঁতে বাঘ-কুতকুতে বাঘ- সকল বাঘ তর্জন-গর্জন করিয়া

সেই গাছের তলায় আসিয়া পৌছিল । একে তো রাত আন্ধারী, তার উপরে বাঘের হুঙ্কারী-অন্ধকারে জোড়া জোড়া বাঘের চোখ জ্বলিতেছে ।

তাই না দেখিয়ে জোলা তো ভয়ে ভয়ে কাঁপিয়া অস্থির । নাপিত যত বলে, “জোলা! একটু সাহসে ভর কর!” জোলা ততই কাঁপে ।

তখন নাপিত দড়ি দিয়া জোলাকে গাছের ডালের সাঙ্গে বাঁধিয়া রাখিল ।
কিন্তু তাহারা গাছের আগডালে আছে বলিয়া বাঘ তাহাদের নাগাল পাইতেছে না । তখন জাঁদরেল বাঘ আর সব বাঘদের বলিল,

“দেখ তোরা একজন আমার পিঠে ওঠ-তার পিঠে আর একজন ওঠ- তার পিঠে আর একজন ওঠ- এমনি করিয়া উপরে উঠিয়া হাতেরথাবা দিয়া এই লোক দুটিকে নামাইয়া লইয়া আয়।”এইভাবে একজনের পিঠে আর একজন- আর পিঠে আর একজন- তার পিঠে আর একজন করিয়া যেই উপরের বাঘটি জোলাকে ছুঁইতে যাইবে,অমনি ভয়ে ঠির ঠির করিয়া কাঁপিতে কাঁপিতে দড়িসমেত জোলা তো মাটিতে পড়িয়ে গিয়াছে ।

উপরের ডাল হইতে নাপিত বলিল, “জোলা ! তুই দড়ি দিয়া মাটির উপর হইতে জাঁদরেল বাঘটিকে আগে বাঁধ, আমি উপরের দিকে হইতে একটা একটা করিয়া সবগুলি বাঘকে বাঁধিতেছি।”
এই কথা শুনিয়া নিচের বাঘ ভাবিল আমকেই তো আগে বাঁধিতে আসিবে । তখন সে লেজ উঁচাইয়া দে দৌ-তখন এ বাঘের উপরে পড়ে ও বাঘ, সে বাঘের উপরে পড়ে আর এক বাঘ।
নাপিত উপর হইতে বলে, “জোলা মজবুত করিয়া বাঁধ-মজবুত করিয়া বাঁধ । একটা বাঘাও যেন পালাইতে না পারে ।

”সব বাঘই তখন পালাইয়া সাফ ।
বাকী রাতটুকু কোনোরকমে কাটাইয়ে পরদিন সকালে হইলে জোলা আর নাপিত বন ছাড়াইয়া আর এক রাজার রাজ্যে আসিয়া উপস্তিত হইল ।
রাজা রাজসভায় বসিয়া আছেন । এমন সময় নাপিত জোলাকে সঙ্গে লইয়া রাজার সামনে যাইয়া হাজির ।

“মহারাজ প্রণাম হি।”
রাজা বলিলেন, “কি চাও তোমরা?”
নাপিত বলিল। “আমার দুইজন বীর পালোয়ান । আপনার এখানে চাকরি চাই।”
রাজা বলিলেন, “তোমারা কেমন বীর তা পরখ না করিলে তো চাকরি দিতে পারি না? আমার রাজবাড়িতে আছে দশজন কুস্তিগীর,

তাহাদের যদি কুস্তিতে হারাইতে পার তবে চাকরি মিলিবে ।”
নাপিত বলিল, “মহারাজের আশীর্বাদে নিশ্চয়ই তাহাদের হারাইয়া দিব ।”
তখন রাজা কুস্তি পরখের একটি দিন স্তির করিয়ে দিলেন । নাপিত বলিল, “মহারাজ!কুস্তি দেখিবার জন্য তো কত লোক জমা হইবে ।

মাঠের মধ্যে একখানা ঘর তৈরি করিয়ে দেন । যদি বৃষ্টি বাদল হয়, লোকজন সেখানে যাইয়া আশ্রয় লইবে। ”
রাজার আদেশে মাঠের মধ্যে প্রকান্ড খড়ের ঘর তৈরি হইল । রাত্রে নাপিত চুপি চুপি যাইয়া তাহার ক্ষুর দিয়া ঘরের সমস্ত বাঁধন কাটিয়া দিল ।

প্রকান্ড খরের ঘর কোনরকমে থামের উপরে খাড়া হইয়া রহিল ।
পরদিন কুস্তি দেখিতে হাজার হাজার লোক জমা হইয়াছে । রাজা আসিয়াছেন-রাণী আসিয়াছেন-মন্ত্রী,কোটাল,পাত্রমিত্র কেহ কোথাও বাদ নাই ।

মাটের মধ্যখানে রাজবাড়ির বড় বড় কুস্তিগীরেরা গায়ে মাটি মাখাইয়া লড়াইয়ের সমস্ত কায়দাগুলি ইস্তেমাল করিতেছে ।
এমন সময় কুস্তিগীরের পোশাক পরিয়া নাপিত আর জোলা মাঠের মধ্যখানে উপস্থিত । চারিদিকের লোকে তাহাদের দেখিয়া হাততালি দিয়া উঠিল ।
নাপিত তখন জোলাকে সঙ্গে করিয়া লাফাইয়া একবার এদিকে যায় আবার ওদিকে যায় । আর ঘরের এক একখানা চালা ধরিয়া টান দেয় ।

হুমড়ি খাইয়া ঘর পড়িয়া যায় । সভার সব লোক অবাক ।
রাজবাড়ির কুস্থিগীরেরা ভাবে, “হায় হায়, না জানি ইহারা কত বড় পালোয়ান । হাতের একটা ঝাঁকুনি দিয়া এত বড় আটচালা ঘরখানা ভাঙ্গিয়া ফেলিল । ইহারা কত বড় পালোয়ান । হাতের একটা ঝাঁকুনি দিয়া এত বড় আটচালা ঘরখানা ভাগ্ণজ্ঞিয়া ফেলিল ।

ইহাদের সঙ্গে লড়িতে গেলে ঘরেরই মতো উহারা আমাদের হাত –পাগুলোও ভাঙ্গিয়া ফেলিবে । চল আমরা পালাইয়া যাই । ”
তাহারা পালাইয়া গেলে নাপিত তখন মাঠের মধ্যখানে দাঁড়াইয়া বুক ফুলাইয়া রাজাকে বলিল, “মহারাজ !

জলদী করিয়া আপনার পালোয়ানদের ডাকুন । দেখি তাহাদের কার গায়ে কত জোর ।”
কিন্তু কে কার সঙ্গে কুস্তি করে? তাহারা তো আগেই পালাইয়াছে । রাজা তখন নাপিত আর জোলাকে তাঁর রাজ্যের সেনাপতির পদে নিযুক্ত করিলেন ।
সেনাপতির চাকরি পাইয়া জোলা আর নাপিত তো বেশ সুখেই আছে । এর মধ্যে কথা হইতে এক বাঘ আসিয়া রাজ্যে মহা উৎপাত লাগাইয়াছে ।

কাল এর ছাগল লইয়া যায়, পরশু ওর গরু লইয়া যায়, তারপর মানুষ লইয়া যাইতে লাগিল ।
রাজা তখন নাপিত আর জেলেকে বলিলেন, “তোমরা যদি এই বাঘ মারিতে পার তবে আমার দুই মেয়ের সঙ্গে তোমাদের দুইজনের বিবাহ দিব ।”
নাপিত বলিল, এ আর এমন কঠিন কাজ কি ? তবে আমাকে পাঁচ মণ ওজনের একটি বড়শি আর গোটা কয়েক পাঁঠা দিতে হইবে ।
রাজার আদেশে পাঁচ মণ ওজনের একটি লোহার বড়শি তৈরি হইল । নাপিত তখন লোকজনের নিকট হইতে জানিয়া লইল, কথায় বাঘের উপদ্রব বেশি, আর কোন সময় বাঘ আসে।
তারপর নাপিত সেই বড়শির সঙ্গে সাত আঁটটা পাঁঠা গাঁথিয়া এক গাছি লোহার শিকলে সেই বড়শি আটকাইয়া একটা গাছের সঙ্গে বাঁধিয়া রাখিল । তারপর জোলাকে সঙ্গে লইয়া গাছের আগ ডালে উঠিয়া বসিয়া রহিল ।
অনেক রাতে বাঘ আসিয়া সেই বড়শিস্মেত পাঁঠা গিলিতে যাইয়া বড়শিতে আটকাইয়া গিয়া তজন গজন করিতে লাগিল । সকালে হইলে লোকজন ডাকিয়া নাপিত আর জোলা লাথির আঘাতে বাঘটিকে মারিয়া ফেলিল ।
রাজা ভারি খুশী । তারপর ঢোল-ডগর বাজাইয়া নাপিত আর জোলার সঙ্গে তাঁহার দুই মেয়ের বিবাহ দিয়া দিল ।জোলা বাসর ঘরে যাইতে ভয় পায় । নাপিতকে সঙ্গে যাইতে অনুরোধ করে ।
নাপিত বলে, “বেটা জোলা ! তোর বাসর ঘরে আমি যাইব কেমন করিয়া ? আমকেও তো আমার বউ-এর সঙ্গে বাসর ঘরে যাইতে হইবে । তুই কোন ভয় করিস না । খুব সাহসের সঙ্গে থাকিবি ।”এই বলিয়া জোলাকে বাসর ঘরের মধ্যে ঠেলিয়া দিল ।
বাসর ঘরে যাইয়া জোলা এদিকে চায়- ওদিকে চায় । আহা-হা কত ঝার-কত রঙের ফুল । জোলা কোথায় বসিবে তাহাই ঠিক করিতে পারে না । তখন অতি শরমে পাপোশখানার উপর কুচিমুচি হইয়া বসিয়া জোলা ঘামিতে লাগিল ।
কিছুক্ষণ বাদে হাতে পানের বাটা লইয়া, পায়ে সোনার নুপুর ঝুমুর ঝুমুর বাজাইয়া পঞ্চসখী সঙ্গে করিয়া রাজকন্যা আসিয়া উপস্থিত ।

জোলা তখন ভয়ে জড়সড় । সে মনে করিল,হিন্দুদের কোন দেবতা যেন তাহাকে কাটিয়া আসিয়াছে । সে তখন তাড়াতাড়ি উঠিয়া রাজকন্যার পায়ে পড়িয়া বলিল, “মা ঠাকরুন! আমার কোন অপরাধ নাই । স্ক্লি ঐ নপিত বেতার কারসাজি ।”রাজকন্যা সকলই বুজিয়া পারিল ।

কথা রাজার কানেও গেল । রাজা তখন জোলা আর নাপিতকে তাড়াইয়া দিলেন । নাপিত রাগিয়া বলে, “বোকা জোলা!

তোর বোকামির জন্য অমন চাকরিটা তো গেলই- সেই সঙ্গে রাজকন্যাও গেল।” জোলা নাপিতকে জড়াইয়া ধরিয়া বলিল, “তা গেল-গেল! চল ভাই, দেশে যাইয়া বউদের লাথিগুতা খাই । সে তো গাসওয়া হইয়া গিয়াছে । এমন সন্দেহ আর ভয়ের মধ্যে থাকার চাইতে সেই ভালো ।

দুঃখিত!